Thursday, September 26, 2013

প্যাঁচাকাহিনী -- তপোব্রত

প্যাঁচা কয় প্যাঁচানী,
খাসা তোর চ্যাঁচানি
শুনে শুনে আন্‌মন
নাচে মোর প্রাণমন !
ছোটবেলাতে এই কবিতা পড়েননি এরকম বাঙালি বিরল না হলেও দুষ্প্রাপ্য তো বটেই। তার সঙ্গে আরো আছে গঙ্গারাম, যার মুখের গঠন “অনেকটা ঠিক প্যাঁচার মতন” কিম্বা সেই হ-য-ব-র-ল র জজসাহেব, কালো ঝোল্‌লা-পরা হুতুম প্যাঁচা যে এসেই একটা উঁচু পাথরের ওপর বসে ঢুলছিল এবং সেই মামলার শেষে যার রায়ে নেড়ার তিনমাসের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি হয়েছিল।

এগুলো ছাড়াও ছোটবেলা থেকেই প্যাঁচার ওই গোল মাথা, রাগী রাগী গোল চোখ, দিনে ঘুমিয়ে রাত্তিরে জেগে থাকার অভ্যেস, লক্ষ্মী ঠাকুরের বাহন এসব থেকে আমার বেশ একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল প্রাণীটার প্রতি। তবে হ্যাঁ প্যাঁচা যে মরা প্রাণী, ইঁদুর এইসব খায় তা জানতাম, তাই পোষার কথা কখনই মনে হয়নি। পরে হ্যারি পটার পড়ার সময় বুঝতে পারি যে, মাগল্‌ হয়ে জন্মানোর আরও একটি সমস্যা হল যে মাগল্‌রা কেউ প্যাঁচা পোষে না!

তবে প্যাঁচা না পুষলেও প্যাঁচা সংক্রান্ত দুটো গল্প নিয়েই এই লেখা।


প্রথম ঘটনার সময়কাল ১৯৯৩-৯৪ সাল। আমার বয়স ১০-এর আশেপাশে। একদিন বিকেলের দিকে, পাঁচটা নাগাদ, বাড়িতে একাই আছি, বাবার চাকরি ছিল বাইরে আর মা বোধহয় র‍্যাশান দোকান বা ওরকম কোথায় একটা গেছে। আমি বই পড়ছিলাম বা টিভি দেখছিলাম, হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা ঝট্‌পট্‌ আওয়াজ শুনে এসে দেখি আমাদের বসার ঘর আর রান্নাঘরের মধ্যিখানের পার্টিশনের ওপর কোত্থেকে একটা মস্ত বড় প্যাঁচা এসে বসেছে আর মুণ্ডুটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাগী রাগী চোখটা দিয়ে এদিক ওদিক দেখছে।

আমাকে দেখেই প্যাঁচাটা মুণ্ডু ঘোরানো থামিয়ে দিয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো। তার মধ্যে খেয়াল করলাম যে প্যাঁচাটার গায়ের রঙ ধপধপে সাদা। বাংলায় যে এদের লক্ষ্মীপ্যাঁচা বলে সেটা জানা ছিল। সঙ্গে এরাই যে লক্ষ্মী ঠাকুরের বাহন সেই সংক্রান্ত বেশ কিছু পৌরাণিক আর লোককথার গল্পও! কিন্তু একা বাড়ির মধ্যে ঐ মস্ত বড় গম্ভীর-দর্শন লক্ষ্মীপ্যাঁচার সামনে পড়ে ভয়ের চোটে কোন গল্পই মাথায় এলো না। সঙ্গে ঐ ধারালো ঠোঁটগুলো দেখেও খুব একটা ভরসা হল না। তার মধ্যে একবার একটা ডানাগুলো মেলে ধরতেই আমি ‘এই বুঝি তেড়ে এল’ ভেবে পড়িমরি করে ছুটে নিচে চলে গেলাম। চাবিটা সঙ্গে নিয়ে নিয়েছিলাম সুতরাং বাড়ির মেন গেট খুলে সামনের জমিটায় ঘোরাঘুরি করছি, মিনিট দশেক পর মা এসে হাজির। আমায় দেখে তো অবাক! সব কিছু খুলে বলে তারপর দুজনে মিলে আস্তে আস্তে ওপরে উঠে এলাম। অত বড় প্যাঁচা, কখন কী করে!
ওপরে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম যে, প্যাঁচাটা হয়তো উড়ে গেছে কিন্তু গিয়ে দেখলাম, সেটা তখনও ঐ পার্টিশনের ওপর এক জায়গাতেই বসে আছে। মা যথারীতি লক্ষ্মীপ্যাঁচা দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন এবং পুজো-টুজো করার প্ল্যান করছিলেন কিন্তু আমাদের দেখার কয়েক সেকেন্ড পরই প্যাঁচাটা রান্নাঘরের একটা জানালা দিয়ে উড়ে বেরিয়ে যায়।

রূপকথার গল্পে লক্ষ্মীপ্যাঁচা রাজার বাড়ির ছাদে রোজ একটা করে সোনার টাকা ফেলে দিয়ে যেত। আমরা রাজা-রাজরা নই তাই আমাদের বাড়িতে তার ঐ একদিনই আগমন! এখন মনে হয় সেদিন যদি আরো কিছুক্ষণ থাকতো তাহলে পয়সা-কড়ির দিকটায় হয়তো একটু উন্নতি হত!


*****
দ্বিতীয় গল্পের সময়কাল ২০০৫-০৬, তবে স্থান কলকাতা নয়, কানপুর। ঠিকভাবে বলতে গেলে আইআইটি কানপুরের হোস্টেল।  ফার্স্ট ইয়ারের মাঝামাঝি সময় আমি আমার ডবল রুম বদলে একটা সিঙ্গল রুমে চলে গেছিলাম। সেই ঘরের জানালার পাশে ছিল একটা নিমগাছ।

একদিন রাতের বেলায় চ্যাট করতে করতে শুনলাম ঘরের বাইরে থেকে কেমন একটা আওয়াজ আসছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি একটা প্যাঁচা। এটা অবশ্য লক্ষ্মীপ্যাঁচা ছিল না। সাধারণ খয়েরি রঙের প্যাঁচা। যথারীতি ঐ গোল গোল চোখগুলো দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘরের বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। ওখান থেকে গাছটা আরও একটু ভালো করে দেখা যেত। সেখানে গিয়েও দেখি প্যাঁচাটা ঠিক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আমি বারান্দায় যতই সরে যাই প্যাঁচাটাও ততই ওর মুণ্ডুটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমার দিকেই দেখতে থাকে। তখনই মনে পড়ল যে প্যাঁচা তার মাথাটাকে ২৭০ ডিগ্রী অবধি ঘোরাতে পারে। এরপর প্যাঁচাটা নিয়মিতই আসত। রাতের দিকে পড়তে পড়তে বা চ্যাট করতে করতে বোর হয়ে গেলে মাঝে মাঝে বারান্দায় এসে প্যাঁচাটাকে দেখতাম। সেও আমার চোখের দিকে চোখ রেখে গম্ভীর হয়ে বসে থাকত। এক-এক দিন রাত্তিরে লাইব্রেরীতে পড়তে যাওয়ার সময় গাছের ওপরে বসে থাকা প্যাঁচাটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যেত। তারপর যতক্ষণ আমি তাকিয়ে আছি সেও তার মুন্ডু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখত আমাকে। বেশ নিজের লোক মনে হত প্যাঁচাটাকে।

সেকেন্ড ইয়ারে নতুন হোস্টেলে চলে যাওয়ার ফলে আমার ঐ ঘরটা আর প্যাঁচাটাকে একসঙ্গেই বিদায় জানাতে হয়। নতুন হোস্টেলে ঘরের পাশে কোন গাছই ছিল না।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই