Monday, January 16, 2017

যে ছিলো আমার... -- ঊর্মি

উৎস
     একটা চারকোনা উঠোন, তার দু’টো দিক জুড়ে বাথরুম, কলের পাড়সহ চারটে ঘর। উঠোনের আরেক কোণে একটা ঝাঁকড়া মাথা শিউলি ফুলের গাছ। কলের পাড় ঘেঁষে একটা খুব সরু রাস্তা ঢুকে গেছে পাশের বাড়িতে, কোনো দেওয়ালের বালাই নেই। সেই বাড়ি টপকে আরেকটা বাড়ি পেরোলেই অন্য একটা গলি, ধরে ডানদিকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই বড় রাস্তা, বড় রাস্তা ধরে দুটো বাড়ির সামনে দিয়ে ফিরলেই মিঠির বাড়ির দোরগোড়া হয়ে সেই চারকোনা উঠোন। 


এই পুরো ম্যাপটা মিঠির ১০ এর ঘরের নামতার থেকেও ঝরঝরে মুখস্থ। খেলা আর পাশের গুহকাকিমার রান্না চাখতে যাওয়া ছাড়াও প্রতিদিন রামায়ণের ছবিওয়ালা বইও পড়াতে যায় মিঠি দু’বছরের ছোট রিন্টুকে। কিন্তু তাই বলে এই মাঝরাতে লোকের বাড়ি যাওয়া যায় নাকি! মা যে কেন ঘরের দরজাটা খুলছে না! মিঠি মায়ের কথা না শুনে একা একা টয়লেটে গেছিলো বলে রাগ করেছে? ও তো মাকে বুঝিয়ে বলেছিলো, যে ভয় ওর করে না - সন্ধেবেলা লোডশেডিং হলে দাদাকে টয়লেট অবধি কে এগিয়ে দেয় শুনি? যাকগে, করুক রাগ, মিঠি আজ জেঠিমনির সাথে ঘুমোবে তবে।

দশ মিনিট হয়ে গেলো প্রায়, মিঠি জেঠুর ঘর, ঠাম্মার ঘর, মা-বাবার ঘরের দরজা ধাক্কিয়েই চলেছে - কেউ খুলছে না! কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিঠি ভাবলো - ঘুম তো গেলোই, যাই পাড়াতেই বেড়িয়ে আসি, দেখি যদি কাউকে পাওয়া যায়। সেই ম্যাপ ধরে দুই বাড়ি পেরিয়ে বড় রাস্তা আসতে আসতে অবাক হলো- কোনো বাড়িতেই কোনও সাড়াশব্দ নেই - যেন সবাই নিঃশ্বাস নিতে অবধি ভুলে গেছে! নিঝুম পাড়াটা পূর্ণিমার নীল আলোয় তকতক করছে। হঠাৎ মিঠির মনে পড়লো, পরশু দিদা একটা গল্প বলছিলো - দিদার কাকুকে নাকি এইরকম একটা রাত্তিরে নিশিতে ডেকে নিয়ে ডোবায় নিয়ে ফেলেছিলো! গা ছমছম করে উঠতেই নজর পড়লো উপস্থিত দ্বিতীয় প্রাণীটির দিকে - পিছনে কিছদূরে একটা শেয়াল। মিঠি দুই পা এগোলেই সেও এক পা এগোয়। এইবারে সাহসী মিঠিরও বুক কেঁপে যায়, একছুটে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির উঠোনে ফেরত পা ফেলে সে একটু নিশ্চিন্ত হয়। তবু এই ভূতুড়ে রাতে শিউলিফুলের গন্ধে যেন ওর দম চেপে আসে। ও কেঁদে উঠে বলে – “ও মা, মাগো, আমি কথা শুনবো, আমি ঠিক ভয় পাবো, দরজা খোলো মা!”
ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হয়। না, মা নয়, শিউলিগাছসংলগ্ন যে স্টোররুমটা আছে সেটার দরজা ফাঁক হওয়ার শব্দ। আর সাথে সাথে ওর পিছু নেওয়া শেয়ালটাও লেজ গুটিয়ে দুদ্দাড় পালায়। মিঠি বুকে বল নিয়ে ঘরে পা রাখে - অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ছে না, কিন্তু ওর হিসেবমতো জল গরম করার মাটির উনুনটা সামনেই থাকার কথা। ভাবতে ভাবতেই উনুনে পা, সঙ্গে সঙ্গে কে যেন ভিতর থেকে টান দিলো আর ও তলিয়ে যেতে থাকলো একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে।
উৎস
ধড়ফড় করে ঘুম ভাঙলো মিঠির, মনে হলো যেন অনেক উপর থেকে ধুপ করে পড়লো! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝলো, যে ও স্বপ্ন দেখছিল - যে স্বপ্নটা ও ছোটবেলায় ঘুরেফিরেই দেখতো - তাই এত স্পষ্ট মনে আছে। এখন সবে সন্ধে হচ্ছে, কোথা থেকে শাঁখের শব্দ ভেসে আসছে - মা বাবা এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। ওরা এখন আর সেই বাড়িতে থাকেনা, অন্য শহরে একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকে। স্বপ্নটার কথা ভাবতেই খুব বিরক্ত হলো মিঠি, কোথায় মন ভালো করা স্বপ্ন দেখবে তা না, কি সব! রোজ তো ঘুমোনোর সময় সামনের ফ্ল্যাটের কিউট ছেলেটার কথা ভাবে, যদি স্বপ্নে আসে - দূর দূর! ছেলেটা, মানে দীপ, দুর্দান্ত আঁকে, গিটার বাজায়, আবার ক্যারাটেও শেখে। মিঠির বন্ধুরা অবধি ওদের বাড়ি আসে ওকে ঝাড়ি মারতে আর মিঠি আসা-যাওয়ার পথে দীপের হাসির পরিবর্তে আড়ষ্ট ভাবে দু’ঠোঁট সামান্য ফাঁক করা ছাড়া কিছুই করে উঠতে পারেনি। এসব ভেবে ভরসন্ধেয় মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপ হলেই মিঠি ছাদে চলে যায় - ওর ফেভারিট স্পট - আকাশ আর তারা দেখে মন ভালো হয়ে যায়।

ওদের দুই ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদও লাগোয়া। মিঠি ভাবতেই পারেনি দীপও এইসময় ছাদে থাকবে। ভালোই হয়েছে, আজ ও কথা বলেই ছাড়বে। ওদিকে দীপ একটা হেডফোন কানে দিয়ে মোবাইলের মত কিছু একটা জিনিস নিয়ে খুটখুট করছে। মিঠি এক-পা দু’-পা করে কার্নিশের দিকে এগোতেই হঠাৎ আলোর সজোর ঝলকানি! চোখ সামলাতেই ও দেখলো তেলের পিপের মতো অথচ বিশাল বড় একটা জিনিস ভাসন্ত অবস্থায় দীপের সামনে আর তার থেকে ক্রমাগত বিপবিপ আওয়াজ বেরোচ্ছে। ওকে অবাক করে দিয়ে দীপ বলে উঠলো – “মৈথিলী, তোমাকে অনেকদিন ধরে একটা কথা বলবো ভাবছি, সুযোগ হয়নি। আমি চলে যাচ্ছি সুদূর এক গ্রহে, তুমি কি যাবে আমার সাথে?” আনন্দে, উত্তেজনায় মিঠি যত বলতে যায় – “হ্যাঁ, আমাকেও সাথে নাও প্লীজ”, বিপবিপ শব্দটা পাল্টে “ক্ষ...ক্ষ... ফস...” হতে থাকে আর ওর কথা চাপা পড়ে যায়। “আমাকে... নিয়ে... প্লীজ... ক্ষ...ক্ষ...ভোঁস” - এই শেষ শব্দটা এত জোরে হলো, যে মিঠি চমকে উঠলো - আ মোলো যা! এ তো ওর সোনারপুরের ফ্ল্যাট - আর পাশে শুয়ে ওর বর, জয়, সজোরে নাক ডাকাচ্ছে। ওর এই বিদঘুটে স্বপ্ন দেখার অভ্যেস হয়তো মরার আগে অবধি চলবে আর এরকম বেরসিক ভাবেই শেষ হবে! জয় তো ওর নামই দিয়েছে স্বপ্নচারিণী। যাকগে, এখনও রাত বাকি, আরেকবার মনোযোগ দিয়ে ভাবলে হয়তো ওর কাশ্মীরে না-হওয়া হনিমুনটা স্বপ্নেই সেরে আসতে পারে।

আরতি আজ আই.সি.ইউ-এর নাইট ডিউটিতে রয়েছে। কাল থেকে চাপ খুব বেশি পড়েছে - গড়িয়ার কাছে মেট্রো-ব্রিজ ভেঙে পড়ায় প্রচুর মানুষ সিরিয়াস অবস্থায় এই নার্সিংহোমে ভর্তি। আই.সি.ইউ-তে তো কয়েকজনের অবস্থা খুবই খারাপ। যেমন, এই ভদ্রমহিলার সারাশরীর, গলার নীচ থেকে প্যারালাইজড - হার্টবিটও খুব ইররেগুলার, কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক, ব্রেনটা অ্যাক্টিভ আছে। অনেকক্ষণ থেকে আরতি লক্ষ্য করছে ওনার মুখে বিভিন্ন ভাব খেলে যাচ্ছে যেন - কখনও সামান্য ভ্রূ ভাঁজ হচ্ছে, কখনও ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটছে। কে জানে, কি চলছে মাথার ভিতরে, আরতি কেস রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে দেখার আগে আরেকবার নামটা চেক করে নিলো - মৈথিলী বসু।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই