ঘুম থেকে দেরি হয়, টেনে নিই পুরনো চাদর।
ক্রমাচ্ছন্ন। বুঁদ হই।
বই পড়া
হয় না। চোখে লাগে। আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
পাহাড়, ঝর্ণা, রেন্ট হাউস, পাথুরে সিঁড়ি। বারান্দার সোজাসুজি লম্বা প্যাসেজ।
সার দেওয়া তিনটে ঘর। প্রথম ঘরটায় সবাই বসে আছে। গল্প, হাসি, অন্তাক্ষরী, ফল-ফুল-দেশ-পাখি।
ফ্রাইং প্যানে টগবগিয়ে ফুটছে জল। পাহাড়ে বন্ধ আজ। লাঞ্চে ডিমসেদ্ধ পাউরুটি, মাখন;
চাইলে জেলি। বড়মার ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে গোলমরিচের কৌটো। দিদা বিট-নুনের শিশি সামলায়,
একটু সুযোগ পেলেই ঢেলে নিয়ে দৌড় দেব, তক্কে তক্কে আছি। বারান্দায় মা, ছোটমাসি দাঁড়িয়ে
আছে। সামনে তাকালে নিচে যাওয়ার সিঁড়ি।
এক-পা নামতেই বকুনি। দু’পা নামলে বিচ্ছু বদনাম। তিন পা এগোলে কানমলার হুমকি।
চার ধাপ পেরোলে থাপ্পড়ের প্রতিশ্রুতি। পাঁচ পা নামলে ছেলেধরা...
এরপরও সাহস করে আর এক ধাপ এগোলে খুন খারাপি কিছু একটা হয়ে যাবে, মার গলার
আওয়াজ জানিয়ে দিচ্ছে।
আর ভরসা হয় না।
‘উঠে আয়, উঠে আয়, এক্ষুনি উঠে আয়।’
ফিরতি পায়ে এক দুই...সিঁড়ি গুলো খুব খাড়াই। হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হয়। উপর
দিকে মুখ তুললেই মার কড়া দৃষ্টি। সেদিকে চোখ রেখে নামতে গিয়েই হঠাৎ ‘পপাত চ’। কপালে একটু লাগলো।
দৌড়ে আসছে মা। একগাল হেসে নাগাল এড়াতে এলোমেলো পায়ে ঘরের দিকে যাচ্ছি। কপাল
বেয়ে ঘাম পড়ছে। ঢুকতে না ঢুকতেই ঘরের মেজাজ বদলে গেল। সবাই অবাক। বাবার মুখ ফ্যাকাশে।
সঙ্গে সঙ্গে দিদা উঠে এসে হাত চেপে ধরেছে। আহ! জ্বালা! ডেটলের গন্ধ! ভুরুতে
তুলো চেপে বসে আছি। কিছুক্ষণ বাদে বাদেই লাল হয়ে উঠছে! শীত বাড়ছে। ঘুমোতে চাইছি। কেউ
ঘুমোতে দিচ্ছে না। খালি শুনছি ইনজেকশন, হাসপাতাল, ওষুধ, বনধ। চারখানা লাল তুলোর ছোট্ট
ঢিপি। পাঁচ নম্বরটা রাখলাম। এক-জায়গায় ঠায় বসে থাকতে ভালো লাগছে না। দাদা কে বলছি,
খেলতে চলো। সেও এক পাশে দাঁড়িয়ে ‘নট নড়ন’। বিটনুনের শিশিটা নেবো কিনা ভাবছি!
শীত নামছে চোখে। ঢলে পড়ছি বাবার কোলে। ছোটমেসোমশাই ব্যস্ত সমস্ত হয়ে কথাবার্তা
বলছে।
মেসোমশাই-এর কাঁধে চেপে সিঁড়ি বেয়ে শীতের আরও কাছে পৌঁছতে যাচ্ছি।
একটাও গাড়ি নেই। কোনোমতে একটা জিপ জোগাড় হলো। মাঝে মাঝে সাড়া দিই। ঠেলা,
চিমটি, চুল ধরে টানা।
ঘুমোইনি। জেগে আছি।
ম্যাল ধরে দ্রুত হাঁটছে সবাই। দৌড়লে রক্ত পড়া বাড়বে ক্রমশ। তাই সতর্ক পা
ফেলা। আশপাশ আবছা। বন্ধ চোখ খুললেই ছোট মাসির মুখ। নইলে আধ-ঘুমের পাড়া।
ডাক্তার নেই। হাসপাতাল। নামমাত্র এমার্জেন্সি। ওয়ার্ড-বয়, নার্সের ব্যস্ততা।
সুতো কাঁচির ওঠানামা। সেলাই পড়ছে! থেকে থেকেই আমি ছটফটিয়ে উঠছি। মেসোমশাই
শক্ত করে দু’পা ধরে আছে। এর আগে লাথির চোটে ওষুধের শিশি ভেঙেছি খান দু’য়েক। একটা মাত্র
ওষুধের দোকান খুলেছে, নষ্ট হলে বেশি ওষুধ কিনে আনার উপায় নেই। মাঝে মাঝে ছোটমাসি এসে
দু’পা আগলায়। আরাম লাগে। মেসোমশাইয়ের শক্ত হাত। নড়তেই পারি না। খুব রাগ হয়।
আধ ঘণ্টা আগে দেওয়া ওষুধটা এবার বোধহয় কাজ করছে। ঘুম পাচ্ছে আমার। সবার
কথা যেন অনেক দূর ছুঁয়ে ফিরে ফিরে আসছে। আরও একবার ছুঁচ ফুটলো হাতে। ঘোর এসে জাঁকিয়ে
জমালো মৌরসী।
ঘুম! ঘুম! ঘুম!
কাল সকালে জেগে উঠে মা কে দেখতে পাবো। রাত জাগা। পাশ ফিরলে বাবা। এক হাত
মুঠোয় নিয়ে বসে আছে। বাবা কখনো বলেনি, আমায় কতটা ভালোবাসে, শুধু বুঝিয়ে দিয়েছে। এভাবেই।
ভাগ্যিস স্মৃতির বয়স বাড়ে না, জ্বর পেলে অক্টোবরের হালকা শীতের গ্যাংটক আমায় ঘুমিয়ে
পড়তে বলে।
তাই, মাঝে মাঝে ধুম জ্বর করি। বেশি নয়। যেসব দিন কোনো না কোনো ভাবে দাগ
রেখে গেছে তাদের ফিরে পেতে যেটুকু ওষুধ না খেয়ে থাকতে হয়। অল্প অনিয়ম মেনে নিতে হয়।
ডান ভুরুর উপরে থাকা দাগটা এখনও যেমন জ্বলজ্বল করছে।
আজকের মতো জ্বর নেমে গেছে।