শিয়ালদহ থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। স্টেশনের নাম মথুরাপুর। সেখান থেকে অটো ধরে খটিরবাজার। তারপর ভ্যান-রিকশোতে সাতঘড়া গ্রামের তালপুকুর। আমার ছোট পিসির বাড়ি। গত পুজোয় একাদশীর দিন গিয়েছিলাম, প্রায় অনেক বছর পরে। না, আমাকে শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরতে হয় না। আমার বাড়ি মথুরাপুরের তিনটি স্টেশন আগে। দক্ষিণ বারাশত। কিন্তু এই তালপুকুর গ্রামের অনেকে সেটাকেই শহর ভাবে।
দুপুর নাগাদ খটিরবাজারে পৌঁছে ভ্যানে চেপেছি। ইট বিছানো রাস্তা। রাস্তার পাশে ঘন বাঁশবন, ‘সবুজ হলুদ সর পড়া পুকুর’ ঝিম মেরে আছে। ছোটবেলায় মা-বাবার সাথে বেশ ঘটা করে আসতাম, রাস্তাগুলো সব আবছা মনে পড়ছে। অনেকদিন পর নিজের বাড়িতে ফেরার মতো লাগছে। যেতে যেতে একটা কুমোর-পাড়া পড়ে, রোদে দেওয়া মাটির কলসি, মিষ্টির ভাঁড়। খুব মনোযোগ দিয়ে ছোটবেলায় এগুলো বানানো দেখতাম - বন বন করে চাকা ঘুরছে আর এক বুড়ো নিপুণ হাতে একটা কলসি বানিয়ে ফেলছে। একটা বড় মুসলিম-পাড়ার পরেই রাস্তার বাঁক, বাঁক পেরিয়ে ভ্যানটাকে দাঁড়াতে বললাম। পিসি দাঁড়িয়ে, পিসির ছেলেরা দাঁড়িয়ে, প্রতিবেশী আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে। ভ্যান থেকে নামতেই অর্ধেক-চেনা মুখে হাসি এক মহিলার- “কতো বড়ো হয়ে গেছিস বাবা... আমায় চিনতে পারিস?” কিছু বলার আগেই পিসির ছেলেরা এসে পড়লো। ওরাও বড়ো হয়ে গেছে। প্রায় হাত ধরে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলো। আগে মাটির বাড়ি ছিলো। দাদা চাকরি পেয়ে পাকা বানিয়ে নিয়েছে, ইলেক্ট্রিসিটিও এসেছে। প্লেট-ভর্তি খাবার সাজিয়ে নিয়ে এলো বৌদি, পিসি মাটির উনুনে রান্নায় ব্যস্ত, দেশি মোরগের ঝোল খাব আগেই বলে রেখেছিলাম।
কোনওমতে লুচিগুলো খেয়ে হাঁটতে বেরলাম সেজো ছেলেটির সাথে। অদ্ভুত ভাবে এই ভেতরের রাস্তাগুলোও মনে আছে আমার। মাটির রাস্তা, চারদিকে ঘন সবুজ গাছপালা, নিশ্চিন্দিপুরের থেকে একেবারেই আলাদা করা যায়না। হঠাৎ রাস্তা শেষ, বিশাল ধান-জমি। দাঁড়িয়ে পড়লাম ওখানেই। এটা-ওটা গল্পের মধ্যেই পাশের মুসলিম-পাড়ার কথা উঠলো, কারণ বাইরে তখন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। মুসলিম-পাড়ার সবাই নাকি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সমর্থক।