আমার
বাড়ির চতুর্দিকে গিজগিজে বাড়ি আর ফ্ল্যাট। আগে অবশ্য বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি এত ছিল না,
গত চার-পাঁচ বছরে এগুলো সব তৈরি হয়েছে। আমার বাড়ি বলতে যেখানে
জন্মের পর থেকে আমি
বড় হয়েছি, এখন অবশ্য কর্মসূত্রে অন্যত্র থাকি। বাবার কাছে শুনেছি আমাদের বাড়ির চারপাশটা নাকি আগে, মানে প্রায় চল্লিশ বছর আগে, একেবারে ফাঁকা ছিল। পরে ধীরে ধীরে এই জায়গাটা এত জনবহুল হয়েছে। ছোটবেলায় এটা জানার পর
,খুব অবাক হয়ে সেই চল্লিশ বছর আগের দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করতাম। একটা
ঝাপসা ছবি আন্দাজ করতে পারলেও সেটা স্পষ্ট হয়নি কোনদিন। বিশেষ মাথাও ঘামাইনি তা
নিয়ে। শুধু খেলার সময় যখন পাশের পাড়ার প্রাইমারি স্কুলের মাঠে যেতে হত আর ও পাড়ার
ছেলেমেয়েগুলো ভিক্ষে দেওয়ার মত বলে দিত ঠিক কতটুকু জায়গায় আমাদের খেলতে হবে, তখন
মনে হত, আমার বাড়ির চারপাশটাই তো একসময় মাঠ ছিল! তখন জন্মালে তো এত অপমান সইতে হত
না! ,, বড় হয়েছি, এখন অবশ্য কর্মসূত্রে অন্যত্র থাকি। বাবার কাছে শুনেছি আমাদের বাড়ির চারপাশটা নাকি আগে, মানে প্রায় চল্লিশ বছর আগে, একেবারে ফাঁকা ছিল। পরে ধীরে ধীরে এই জায়গাটা এত জনবহুল হয়েছে। ছোটবেলায় এটা জানার পর
ধীরে
ধীরে আমার খেলার জায়গা হল আমার বাড়ির ছাদ আর বারান্দা। ছাদ বা বারান্দায়
খেললে মায়েরও দুশ্চিন্তা কম হত, তাই খিটখিট কম করত। নিচের বারান্দায় সকলের
প্রবেশাধিকার ছিল কিন্তু ছাদে শুধু পাড়ার বন্ধুদেরই ওঠার অনুমতি ছিল। আর ছাদে
দাপাদাপি করে খেলা নিষেধ ছিল বলে আমরা শুধুমাত্র মেয়েদের লেবেল দেওয়া খেলাগুলো, যেমন পুতুলের বিয়ে, রান্নাবাটি, কিত্কিত্, এসব খেলতাম। খেলা
হয়ে গেলে বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ছাদে বসে থাকাটা ছিল আমার অভ্যেস।
আশপাশটা দেখতাম, কোন গাছে নতুন পাখি এসেছে, কোন বেড়ালটাকে পাড়ায় আর দেখা যাচ্ছে
না, ছাদের সিঁড়িঘরে ঠিক ক’টা টিকটিকির ফ্যামিলি বাস করে, এসব নিয়ে সময় কাটাতাম।
বাড়ির ত্রিসীমানায় ক’টা নারকেলগাছ, সুপুরিগাছ, আমগাছ আছে, ক’টা একতলা,ক’টা দোতলা আর ক’টা তিনতলা বাড়ি, সব মুখস্থ ছিল। মনে আছে তিনতলা বাড়ি মানে
তখন আমার কাছে বিশাল একটা ব্যাপার ছিল আর তার সংখ্যা ছিল মাত্র দু’টো।
দেখতে
দেখতে সব পালটাতে শুরু করল। কোন কোন বাড়ির লাগোয়া যে অল্পস্বল্প বাগান বা ফাঁকা
জায়গা, সেগুলোতে দালান উঠতে শুরু করল। আমার মাথায় গাছের যে হিসেবগুলো ছিল, সব
গুলিয়ে গেল। পড়াশুনোর চাপের ঠেলায় আগের মত অত সময়ও থাকলো না, যে বাড়ির
চারপাশটা observe করব।
এবার
পুজোর ছুটিতে অনেকদিন পর আবার ছাদে উঠে চারপাশটায় তাকানোর চেষ্টা করলাম। চোখের
দৃষ্টিটা বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি দিয়ে ঘেরা একটা সীমায় আটকে গেল।
আমাদের বাড়ির উত্তর-পূর্ব দিকে একটা আমগাছ ছিল। সেটা চোখের সামনেই ধীরে ধীরে বড় হয়েছিল। দেখলাম সেটা নেই আর তার লাগোয়া রংচটা যে একতলা
বাড়িটা ছিল, যে বাড়িটার ছাদের একটা পোষা স্পিচ কুকুরের গতিবিধি আমার মুখস্থ ছিল,
সেটাও নেই। বুঝলাম, পরের বার বাড়ি এসে ছাদে উঠলে ওখানেও বহুতল দেখতে পাব।
এইভাবে
এক একটা বছর পেরিয়ে আজ থেকে চল্লিশ বছর পর কি হবে চারপাশটার চেহারা,
তা আন্দাজ করতে পারি না। কুড়ি বছর পর হয়তো আমার বাড়ির ছাদটার বদলে একই জায়গায় কোন
বহুতলের ছাদে দাঁড়িয়ে দূরে এয়ারড্রোমের মাঠটা দেখতে পাব মনে হয়। আমাদের
উত্তরসূরিরা কি আমার মতই শুনে অবাক হবে, যে আমরা ছাদ-বারান্দায় খেলতাম, ঝড়ের সময়
নারকেল গাছগুলোর দোলা দেখে ভয় পেতাম, ছাদে বসে পাখির ফল খাওয়া দেখতাম! ওরা অবাক
হতে জানবে তো?