প্রতিমার
যাত্রার দিন সেবার ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। ঠাকুরঘর এর সামনে কাঁসি, করতাল
নিয়ে তবু আমরা সোৎসাহে কারিগরকাকার ছোট্ট পুতুল দুর্গা বানানো দেখতে ব্যস্ত। প্রতিমা তৈরি শুরুর আগে যাত্রা করার রীতি অনেক বাড়ির পুজোতেই প্রচলিত।
নিয়ে তবু আমরা সোৎসাহে কারিগরকাকার ছোট্ট পুতুল দুর্গা বানানো দেখতে ব্যস্ত। প্রতিমা তৈরি শুরুর আগে যাত্রা করার রীতি অনেক বাড়ির পুজোতেই প্রচলিত।
প্রতিমা তৈরি শুরু করার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হত
সেদিন। পুজোর যদিও তখনো মাস আড়াই
বাকি কিন্তু সেদিন থেকেই আমার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল। ঠাকুরদার কাছে শুনেছিলাম যে ওই ছোট পুতুলটা বড় দুর্গার পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হত, ওটা যেন মা দুর্গার হৃৎপিণ্ড! এরপর নিয়মমাফিক স্কুল যাওয়ার সময় রোজই একবার চোখ রাখা ঠাকুরঘরের বারান্দায় একচালাতে খড়ের প্রতিমা এলো কিনা। তখনো আকাশে অল্প ধূসর বর্ণের মেঘ দেখা যাচ্ছে। বিকেলে গুটিকয়েক ঘুড়ি তখন সবে মহড়া দিচ্ছে মাসখানেক পরে ফাইনাল শো-র জন্য কিন্তু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি মাঝে মাঝেই ট্রায়ালে বিঘ্ন ঘটিয়ে ফেলত। এরকম চলতে চলতে হঠাৎ-ই একদিন ঠাকুরঘরে মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তিতে দেখি কারিগরকাকা মাটি দিচ্ছে। সেসময় ঋতুপরিবর্তন মোটামুটি নিয়ম মেনেই হত তাই প্রতিমাতে মাটি দেবার পর বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবার ভয় ততটা ছিলনা। শরৎ তখন অরুণ আলোর অঞ্জলি নিয়ে উপস্থিত। আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘের প্রেক্ষাপটে লাল, নীল নানা রঙের ঘুড়ির মেলা। ইতিমধ্যে ঠাকুরের দোমেটে পড়ে যাবার পর দেবীদের ও তাঁদের বাহনদের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাগড়া অসুর আর সিংহ হচ্ছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু আমার কাছে। কারিগরকাকার কাছে শুধু ঘ্যানঘ্যান করতাম অসুরটা যেন একটু রোগা রোগা হয়েছে, আরেকটু মোটাসোটা না হলে ঠিক মানাচ্ছে না। এরপর হাতের আঙুল লাগানো হলে প্রথমেই ঠাকুরদার কাছে আমার রিপোর্ট করার দায়িত্ব ছিল দুর্গাঠাকুরের যে হাতে যে অস্ত্র সেই অনুযায়ী আঙুলের বিন্যাস হয়েছে কিনা। না হলে কারিগরকাকাকে আবার ঠিক করতে হতো। এরপর মুখ বসানোর দিন তো আমাকে কারিগরকাকুর অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে হত। মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও অসুর এর মুখ সোজাসুজি বসানো হল কিনা দূর থেকে দেখে বলতে হত। পুজোর আর হাতে গোনা কয়েক দিন বাকি। রোদে ফেটে যাওয়া প্রতিমার গায়ে ফাটা অংশগুলো মাটি দিয়ে মেরামত করে এবার কাদামাটির প্রলেপ দেবার পালা। আকাশে এখন আর ঘুড়ি উড়তে দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে প্যান্ডেলের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ভোরের শিশির, শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ পুজোর আগমন বার্তা বয়ে নিয়ে হাজির - লেখাপড়ায় মন বসতেই চাইত না। খড়িমাটি পড়ার পরই প্রতিমার দিকে তাকালে মনে হত মৃন্ময়ী মূর্তি চিন্ময়ী রূপ লাভ করেছে। দুদিন বাদেই মহালয়া। প্রতিমাতে এখন রঙ পড়ে গেছে। চক্ষুদান হবে মহালয়ার দিন। সন্ধ্যেবেলা অন্ধকারে প্রদীপের আলোয় কারিগরকাকা চোখ আঁকতেন আর আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতাম! এরপর শুধু বাকি রইলো শাড়ি আর গয়না পরানোর পালা। চতুর্থীর দিন সন্ধ্যে থেকে শুরু হত আর চলত গভীর রাত পর্যন্ত। আমি রাত বারোটা পর্যন্ত ঠাকুরঘরে ঠায় বসে অপেক্ষা করতাম কখন সম্পূর্ণ হবে প্রতিমার সজ্জা। কিন্তু চোখে ঘুম জড়িয়ে আসত এবং শেষে বাবার গম্ভীর ডাকে সাঙ্গ হত আমার শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের সজ্জা দেখার আশা। পঞ্চমীর সকালে উঠোনে রোদের বদলে ত্রিপলের ছায়া। ঠাকুরঘরের চাতাল ধুইয়ে দেওয়া হয়েছে আর পিছনে একচালাতে দশভুজা সুশোভিতা। ষষ্ঠীর সকালে ঢাকবাদ্য দিয়ে পাড়ায় জানান দিয়ে দেওয়া হল যে পুজো শুরু হল। মা, কাকিমা, পিসিরা মিলে ঘট ভরতে পাশের পাড়ার চক্রবর্তীদের পুকুরে যাবার জন্য প্রস্তুত। পুরোহিত ঠাকুর পুজোর উপকরণ নিয়ে ততক্ষণে কাজে লেগে পড়েছেন। ঠাকুরদা সবই অত্যন্ত যত্ন সহকারে গুছিয়ে রাখতেন তাই পুরোহিত মশাই হাতের কাছেই সব পেয়ে যেতেন। অন্যদিকে আমরা ছোটরা মেজপিসি, সেজপিসি, ছোটপিসির তত্ত্বাবধানে পুজোমন্ডপ সাজাতে শুরু করেছি। একটা করে পরিকল্পনা করা হচ্ছে আর কোনও না কোনও ছুতোয় সেটা বাতিল হচ্ছে। শেষে ঠিক হল যে শোলার কাজ হবে। ঠাকুরঘরকে একটা শ্বেত পাথরের মন্দিরের চেহারা দেবার চেষ্টা করা শুরু হল। সকালে ষষ্ঠীপুজো শেষ, সন্ধ্যেবেলা বেলতলায় পুজো। ঠাকুরঘরের সামনেই ডানদিকে বেলমঞ্চ করা ছিল। তাতে সন্ধ্যেবেলা পুজো হল। অন্যদিকে চলছে থার্মোকল কেটে গজ আর নৌকো বানানোর কাজ। দেবী এবার নৌকায় এসেছেন আর গজে চড়ে বিদায় নেবেন। প্রতিমার দুপাশে তাই ওই দুই বাহন কে আটকে দেওয়া হবে। আমার অবশ্য খুব একটা হাত লাগাতেই হত না। দাদা, দিদি, পিসিদের তৈরি করা সেট গুলোকে চেয়ারের উপর উঠে তার বা দড়ি দিয়ে বাঁধার সময় আমার ডাক পড়ত। সকালে ফুল তুলতে শিউলি গাছের তলায় সাজি নিয়ে বসে পড়া একটা দারুণ আকর্ষণীয় কাজ ছিল। গাছ ঝাঁকিয়ে শিউলি ফুল পাড়ার আনন্দই আলাদা। আমরা বাড়ি এবং পাড়ার কোনো গাছই বাদ রাখতাম না। সপ্তমী থেকেই অঞ্জলি দিতে এপাড়া ওপাড়া থেকে লোক ভিড় করত। আর আমাদের পুজো শেষ হতো প্রায় বেলা ১ টা নাগাদ। ঠাকুরদা আমাকে ডেকে পুজোর নির্ঘণ্ট লিখিয়ে ঠাকুরঘরের সামনে টাঙিয়ে দিতে বলে দিলেন। এমনি ভাবে সপ্তমী কেটে অষ্টমী পড়ল। বাড়িতে সেদিন সবথেকে বেশি লোকের ভিড়। অনেকেই যারা দূরে থাকেন তারা শুধু অষ্টমীতে পুজো দিতে আসতেন। অষ্টমীর রাতে নিশিপুজো হবে। বারোয়ারি পুজোকে 'সন্ধিপুজো' বলা হয়। অহোরাত্র পুজো। এমনিতে আমরা রোজই প্রায় ভোররাত অবধি মণ্ডপেই কাটাতাম আড্ডা মেরে। নিশিপুজোর দিন তো কথাই নেই। গান, আড্ডা, চোরপুলিশ খেলা ইত্যাদি মিলে হইহই করে কেটে যেতো সারারাত। সেজপিসির পেট থেকে দমফাটানো হাসির গল্প আর ফুলকাকার গলায় লোকগান ছিল বিশেষ আকর্ষণ। নিশিপুজোতে রাত জেগে আমরা নবমীর সকালটা প্রায় ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিতাম বেলা দশটা এগারোটা অবধি। কিন্তু বড়দের সে উপায় থাকতো না। নবমীর নৈবেদ্য আর পুজোর জোগাড় করতে আবার সকাল থেকেই লেগে পড়তে হত। কিছু কাজের জন্য সিফটিং ডিউটি ছিল, যেমন যে নিশিপুজোর নৈবেদ্য ইত্যাদি করতো তার পরের দিনের সকালটা ছুটি থাকতো। এমনি ভাবে পুজোর দিনগুলো কেটে যেত মনে হত যেন ষষ্ঠীতে যে দিনের সূচনা হয়েছিল বুঝি নবমীতেও অন্ত হয়নি। কিন্তু দশমীর সকালটা এলেই মনের মধ্যে কেমন একটা মোচড় দিয়ে উঠত। কোথা থেকে যেন একরাশ বিষাদ এসে গলার কাছে এসে জড়ো হত। বিসর্জনের আগে অভিষেক পর্বে গানের লড়াই হতো। যতক্ষণ অভিষেক চলত গানের লড়াই খেলা হত ছেলে বনাম মেয়েদের মধ্যে। আর পিসিদের অফুরন্ত গানের ভাণ্ডারের কাছে আমরা হার
মানতাম। তারপর ঠাকুর বরণ এর পালা। মা পিসি দিদিমাদের সিঁদুর খেলা। আমাদেরও মাখিয়ে দিত ওরা! ঠাকুর ধরাধরি করে মণ্ডপ থেকে এবার উঠনে নামাতে হবে। তার সাথে চলছে ধুনুচি নাচ, বিসর্জনের ঢাকের তালে। সবাই যেন আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে চায় আজকের দিনটাতে। আবার তো একবছরের অপেক্ষা! এমনি করেই মহামায়া আমাদের সকলকে পুজোর কয়েকদিন এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে রাখেন আর তারপর কেমন যেন হৃদয়ে এক অনির্বচনীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে বিদায় নেন। "ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন" এর তালে তালে আমরা প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনের ঘাটে উপস্থিত হতাম। বিদায় দিতে হবে মাকে। বাবা বিসর্জন মন্ত্র পড়া শুরু করলেন। সবাই হাতের কোষে জল নিয়ে প্রস্তুত। কাকু, সোনাকাকু, ফুলকাকু একহাতে ঠাকুরের কাঠামো ধরে আর অন্যহাতে জল নিয়ে পুকুরে একহাঁটু জলে দাড়িয়ে ভাসানের জন্য প্রস্তুত। মা কে আবার পরের বছর আসার জন্য আবাহন- “ওং দুর্গেদেবী জগন্মাতঃ সস্থানং গচ্ছপূজিতে সম্বৎসর ব্যতিতেতু পুনরাগমনায়....”।
বাকি কিন্তু সেদিন থেকেই আমার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল। ঠাকুরদার কাছে শুনেছিলাম যে ওই ছোট পুতুলটা বড় দুর্গার পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হত, ওটা যেন মা দুর্গার হৃৎপিণ্ড! এরপর নিয়মমাফিক স্কুল যাওয়ার সময় রোজই একবার চোখ রাখা ঠাকুরঘরের বারান্দায় একচালাতে খড়ের প্রতিমা এলো কিনা। তখনো আকাশে অল্প ধূসর বর্ণের মেঘ দেখা যাচ্ছে। বিকেলে গুটিকয়েক ঘুড়ি তখন সবে মহড়া দিচ্ছে মাসখানেক পরে ফাইনাল শো-র জন্য কিন্তু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি মাঝে মাঝেই ট্রায়ালে বিঘ্ন ঘটিয়ে ফেলত। এরকম চলতে চলতে হঠাৎ-ই একদিন ঠাকুরঘরে মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তিতে দেখি কারিগরকাকা মাটি দিচ্ছে। সেসময় ঋতুপরিবর্তন মোটামুটি নিয়ম মেনেই হত তাই প্রতিমাতে মাটি দেবার পর বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবার ভয় ততটা ছিলনা। শরৎ তখন অরুণ আলোর অঞ্জলি নিয়ে উপস্থিত। আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘের প্রেক্ষাপটে লাল, নীল নানা রঙের ঘুড়ির মেলা। ইতিমধ্যে ঠাকুরের দোমেটে পড়ে যাবার পর দেবীদের ও তাঁদের বাহনদের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাগড়া অসুর আর সিংহ হচ্ছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু আমার কাছে। কারিগরকাকার কাছে শুধু ঘ্যানঘ্যান করতাম অসুরটা যেন একটু রোগা রোগা হয়েছে, আরেকটু মোটাসোটা না হলে ঠিক মানাচ্ছে না। এরপর হাতের আঙুল লাগানো হলে প্রথমেই ঠাকুরদার কাছে আমার রিপোর্ট করার দায়িত্ব ছিল দুর্গাঠাকুরের যে হাতে যে অস্ত্র সেই অনুযায়ী আঙুলের বিন্যাস হয়েছে কিনা। না হলে কারিগরকাকাকে আবার ঠিক করতে হতো। এরপর মুখ বসানোর দিন তো আমাকে কারিগরকাকুর অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে হত। মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও অসুর এর মুখ সোজাসুজি বসানো হল কিনা দূর থেকে দেখে বলতে হত। পুজোর আর হাতে গোনা কয়েক দিন বাকি। রোদে ফেটে যাওয়া প্রতিমার গায়ে ফাটা অংশগুলো মাটি দিয়ে মেরামত করে এবার কাদামাটির প্রলেপ দেবার পালা। আকাশে এখন আর ঘুড়ি উড়তে দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে প্যান্ডেলের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ভোরের শিশির, শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ পুজোর আগমন বার্তা বয়ে নিয়ে হাজির - লেখাপড়ায় মন বসতেই চাইত না। খড়িমাটি পড়ার পরই প্রতিমার দিকে তাকালে মনে হত মৃন্ময়ী মূর্তি চিন্ময়ী রূপ লাভ করেছে। দুদিন বাদেই মহালয়া। প্রতিমাতে এখন রঙ পড়ে গেছে। চক্ষুদান হবে মহালয়ার দিন। সন্ধ্যেবেলা অন্ধকারে প্রদীপের আলোয় কারিগরকাকা চোখ আঁকতেন আর আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতাম! এরপর শুধু বাকি রইলো শাড়ি আর গয়না পরানোর পালা। চতুর্থীর দিন সন্ধ্যে থেকে শুরু হত আর চলত গভীর রাত পর্যন্ত। আমি রাত বারোটা পর্যন্ত ঠাকুরঘরে ঠায় বসে অপেক্ষা করতাম কখন সম্পূর্ণ হবে প্রতিমার সজ্জা। কিন্তু চোখে ঘুম জড়িয়ে আসত এবং শেষে বাবার গম্ভীর ডাকে সাঙ্গ হত আমার শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের সজ্জা দেখার আশা। পঞ্চমীর সকালে উঠোনে রোদের বদলে ত্রিপলের ছায়া। ঠাকুরঘরের চাতাল ধুইয়ে দেওয়া হয়েছে আর পিছনে একচালাতে দশভুজা সুশোভিতা। ষষ্ঠীর সকালে ঢাকবাদ্য দিয়ে পাড়ায় জানান দিয়ে দেওয়া হল যে পুজো শুরু হল। মা, কাকিমা, পিসিরা মিলে ঘট ভরতে পাশের পাড়ার চক্রবর্তীদের পুকুরে যাবার জন্য প্রস্তুত। পুরোহিত ঠাকুর পুজোর উপকরণ নিয়ে ততক্ষণে কাজে লেগে পড়েছেন। ঠাকুরদা সবই অত্যন্ত যত্ন সহকারে গুছিয়ে রাখতেন তাই পুরোহিত মশাই হাতের কাছেই সব পেয়ে যেতেন। অন্যদিকে আমরা ছোটরা মেজপিসি, সেজপিসি, ছোটপিসির তত্ত্বাবধানে পুজোমন্ডপ সাজাতে শুরু করেছি। একটা করে পরিকল্পনা করা হচ্ছে আর কোনও না কোনও ছুতোয় সেটা বাতিল হচ্ছে। শেষে ঠিক হল যে শোলার কাজ হবে। ঠাকুরঘরকে একটা শ্বেত পাথরের মন্দিরের চেহারা দেবার চেষ্টা করা শুরু হল। সকালে ষষ্ঠীপুজো শেষ, সন্ধ্যেবেলা বেলতলায় পুজো। ঠাকুরঘরের সামনেই ডানদিকে বেলমঞ্চ করা ছিল। তাতে সন্ধ্যেবেলা পুজো হল। অন্যদিকে চলছে থার্মোকল কেটে গজ আর নৌকো বানানোর কাজ। দেবী এবার নৌকায় এসেছেন আর গজে চড়ে বিদায় নেবেন। প্রতিমার দুপাশে তাই ওই দুই বাহন কে আটকে দেওয়া হবে। আমার অবশ্য খুব একটা হাত লাগাতেই হত না। দাদা, দিদি, পিসিদের তৈরি করা সেট গুলোকে চেয়ারের উপর উঠে তার বা দড়ি দিয়ে বাঁধার সময় আমার ডাক পড়ত। সকালে ফুল তুলতে শিউলি গাছের তলায় সাজি নিয়ে বসে পড়া একটা দারুণ আকর্ষণীয় কাজ ছিল। গাছ ঝাঁকিয়ে শিউলি ফুল পাড়ার আনন্দই আলাদা। আমরা বাড়ি এবং পাড়ার কোনো গাছই বাদ রাখতাম না। সপ্তমী থেকেই অঞ্জলি দিতে এপাড়া ওপাড়া থেকে লোক ভিড় করত। আর আমাদের পুজো শেষ হতো প্রায় বেলা ১ টা নাগাদ। ঠাকুরদা আমাকে ডেকে পুজোর নির্ঘণ্ট লিখিয়ে ঠাকুরঘরের সামনে টাঙিয়ে দিতে বলে দিলেন। এমনি ভাবে সপ্তমী কেটে অষ্টমী পড়ল। বাড়িতে সেদিন সবথেকে বেশি লোকের ভিড়। অনেকেই যারা দূরে থাকেন তারা শুধু অষ্টমীতে পুজো দিতে আসতেন। অষ্টমীর রাতে নিশিপুজো হবে। বারোয়ারি পুজোকে 'সন্ধিপুজো' বলা হয়। অহোরাত্র পুজো। এমনিতে আমরা রোজই প্রায় ভোররাত অবধি মণ্ডপেই কাটাতাম আড্ডা মেরে। নিশিপুজোর দিন তো কথাই নেই। গান, আড্ডা, চোরপুলিশ খেলা ইত্যাদি মিলে হইহই করে কেটে যেতো সারারাত। সেজপিসির পেট থেকে দমফাটানো হাসির গল্প আর ফুলকাকার গলায় লোকগান ছিল বিশেষ আকর্ষণ। নিশিপুজোতে রাত জেগে আমরা নবমীর সকালটা প্রায় ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিতাম বেলা দশটা এগারোটা অবধি। কিন্তু বড়দের সে উপায় থাকতো না। নবমীর নৈবেদ্য আর পুজোর জোগাড় করতে আবার সকাল থেকেই লেগে পড়তে হত। কিছু কাজের জন্য সিফটিং ডিউটি ছিল, যেমন যে নিশিপুজোর নৈবেদ্য ইত্যাদি করতো তার পরের দিনের সকালটা ছুটি থাকতো। এমনি ভাবে পুজোর দিনগুলো কেটে যেত মনে হত যেন ষষ্ঠীতে যে দিনের সূচনা হয়েছিল বুঝি নবমীতেও অন্ত হয়নি। কিন্তু দশমীর সকালটা এলেই মনের মধ্যে কেমন একটা মোচড় দিয়ে উঠত। কোথা থেকে যেন একরাশ বিষাদ এসে গলার কাছে এসে জড়ো হত। বিসর্জনের আগে অভিষেক পর্বে গানের লড়াই হতো। যতক্ষণ অভিষেক চলত গানের লড়াই খেলা হত ছেলে বনাম মেয়েদের মধ্যে। আর পিসিদের অফুরন্ত গানের ভাণ্ডারের কাছে আমরা হার
মানতাম। তারপর ঠাকুর বরণ এর পালা। মা পিসি দিদিমাদের সিঁদুর খেলা। আমাদেরও মাখিয়ে দিত ওরা! ঠাকুর ধরাধরি করে মণ্ডপ থেকে এবার উঠনে নামাতে হবে। তার সাথে চলছে ধুনুচি নাচ, বিসর্জনের ঢাকের তালে। সবাই যেন আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে চায় আজকের দিনটাতে। আবার তো একবছরের অপেক্ষা! এমনি করেই মহামায়া আমাদের সকলকে পুজোর কয়েকদিন এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে রাখেন আর তারপর কেমন যেন হৃদয়ে এক অনির্বচনীয় শূন্যতা সৃষ্টি করে বিদায় নেন। "ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন" এর তালে তালে আমরা প্রতিমা নিয়ে বিসর্জনের ঘাটে উপস্থিত হতাম। বিদায় দিতে হবে মাকে। বাবা বিসর্জন মন্ত্র পড়া শুরু করলেন। সবাই হাতের কোষে জল নিয়ে প্রস্তুত। কাকু, সোনাকাকু, ফুলকাকু একহাতে ঠাকুরের কাঠামো ধরে আর অন্যহাতে জল নিয়ে পুকুরে একহাঁটু জলে দাড়িয়ে ভাসানের জন্য প্রস্তুত। মা কে আবার পরের বছর আসার জন্য আবাহন- “ওং দুর্গেদেবী জগন্মাতঃ সস্থানং গচ্ছপূজিতে সম্বৎসর ব্যতিতেতু পুনরাগমনায়....”।