উৎস |
যারা জানে না, তারা খুব ভয় পেতে
পারে, গ্রামের ছেলেরা কিন্তু একটুও ভয় পায় না ধীরুকে। প্রতিদিন কোন না কোন বাড়ি থেকে ধীরু পাগলের
খাবার যায়। কোনদিন ভুলে গেলেও ধীরু কিছু বলে না, আওয়াজও করে না। তবু সবাই মনে
রাখার চেষ্টা করে।
আজ আমার পালা। দশ কিলোমিটার দূরের
দোকান থেকে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতে এসেও শান্তি নেই। বেরনোর সময় বউ হাতে ভাতের
টিফিন বাক্স ধরিয়ে দিলো। ফেরার পথে দিয়ে যেতে হবে পাগলের সামনে। গজগজ করতে করতে এই এখন ওই দিকেই হাঁটছি।
ক্ষেত ছিল, ঘর ছিল, ঘরে ভালবাসার বউ ছিল। শোনা যায় একখান পুকুরেও নাকি অংশীদারি ছিল ধীরুর। ধীরুর বাবার কোর্টে
কিসের একটা চাকরি ছিল। চাষ আর চাকরির পয়সায় বেশ সচ্ছলই ছিল ওরা। লেখাপড়ায় ধীরু খুব একটা খারাপ ছিল না বলে চোদ্দ বছর বয়সে ওকে শহরের স্কুলে পড়তে
পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তিরিশ বছর বয়সের আগে আর ও বাড়ি ফেরেনি। একেবারে
ফিরেছিলো বাপের শ্রাদ্ধ করতে। ভাই-বোন কেউ নেই, মা-ও গেলেন তার এক বছর পর। ধীরু থিতু
হলো, একা হলো।
গ্রামের জীবনে আবার মানিয়ে নিতে ধীরুকে
বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। পুরুষমানুষ, গোটা বাড়িতে একা থাকে, তাই গোটা গ্রামের যেন
নতুন দায়িত্ব এসেছিল ওর বিয়ে দেওয়ার। বড়দের কথায় আর নিজেরও জমে ওঠা ইচ্ছেয় ভর করে
তাই মেয়ে দেখাও শুরু হল। ধীরুর কোন দাবি-দাওয়া নেই, আছে বলতে একটাই শর্ত।
মেয়েটি যেন অনাথ হয়। ওরই মত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন সকলেরই উৎসাহ
থিতিয়ে এসেছে, আর লোকে আড়ালে বলাবলিও শুরু করেছে যে ধীরুর আসলে বিয়ের ইচ্ছেই নেই,
তাই অমন উদ্ভট শর্ত - সেই রকম সময়েই কিছু দূরের গ্রামে খোঁজ পাওয়া গেছিলো বন্যার।
বন্যা
মাহাতো। জাতে মেলেনি, ধাতে মেলেনি, শুধু শর্ত পূরণ হয়েছিল। মেয়ে বড় হয়েছে মামার
বাড়িতে, বয়স তিরিশ ছুঁই ছুঁই, মেজাজ তীক্ষ্ণ আর কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা। মেয়ে নয়,
মহিলা। আর বেশ কঠিন মহিলা। এ যে বিয়েতে রাজি হবে, কেউ ভাবেনি। মাস দুই পর বিয়ের
দিনেও লোকে বলাবলি করছিলো, এদের ঝগড়ায় এরপর গ্রামে আর কাক-চিল বসবেনা। এমন দজ্জাল
মেয়ে কি ধীরুর মত একা মানুষের পোষায়?
বিয়ের পরের প্রথম আড়ষ্টতা কেটে
যাওয়ার পর এক অন্য ধীরুকে দেখলো গ্রামের লোক। একটা গোটা মানুষ ওর ঘরে ঘুরে-ফিরে
বেড়াচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, ওর খবর নিচ্ছে, গল্প করছে, ভালবাসছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে
ভাল সম্পর্ক বজায় রাখছে - এটা পুরো হজম করতে ধীরু কখনোই পারেনি। মাঝে মাঝে বন্যা
কাজে ব্যস্ত থাকলে ধীরু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো। কি ভাবতো কে জানে?
বন্যার পরিবর্তনটা একটু অন্যরকম ছিল।
নতুন গ্রাম, নতুন জীবন – কেউ যে আর ওকে আগের মাপকাঠিতে মাপবে না, সেটা বুঝতে পেরেই
বোধহয় ওর আসল শান্ত স্বভাবটা বেরিয়ে এসেছিল। ধীরুর দিকে বন্যাও তাকিয়ে থাকতো, অবাক
হয়ে – ও ঘুমিয়ে পড়ার পর।
অত প্রেম বিশেষ কেউ এর আগে দেখেনি।
কম বয়সে, একরাশ লজ্জা-টজ্জা নিয়ে বিয়ে হয় অধিকাংশের, উঁকি-মারা, অত্যুৎসাহী
আত্মীয়েরা আবেগের ভাগ খেয়ে যায় আর প্রেম-ট্রেম ভাল করে বোঝার আগেই বয়সের সাথে রেস
লাগিয়ে হাজির হয় সন্তান। গড়পড়তা সকলেই প্রেম ব্যাপারটা বায়োস্কোপেই দেখেছে। ধীরু
আর বন্যা যে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক মন আর নির্জন বাসার সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়ে এমন
আগল-খোলা প্রেম করবে, এ কেউ আগে ভেবে দেখেনি।
ওদের হিংসে করতে ইচ্ছে হতো সকলের। কিন্তু
দু’টো একা-বোকা লোক, যাদের তিনকুলে কেউ নেই, তাদের প্রেমে হিংসে করা খুব কঠিন।
দু’বছর পর,
যে রাতে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বন্যা মারা গেলো, তখন ধীরু বাড়ি ছিলো না। শহরে
গেছিলো ডাক্তারের খোঁজে। শোনা যায়, ফিরে আসার পর ও একবারও সন্তানের মুখ দেখেনি।
খবর শুনে দাওয়ায় বসেছিলো কিছুক্ষণ, তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। পরদিন সকালে ধীরুকে
পাওয়া গেছিলো ওদের জমির ঠিক মাঝখানে পোঁতা বটগাছটার সামনে। হাত দিয়ে মাটি খুঁড়ে
গর্ত করে তার ভেতরে শুয়েছিলো ধীরু। রাত হওয়ার আগে গর্ত ছেড়ে বেরোয়নি। খাবার, জল,
কিছুই খায়নি। কেউ একজন খুব উত্যক্ত
করায় বলেছিলো,
“শেকড়টা কোথায় গেলো জানিস? শেকড়টা?”
এ ছাড়া অন্য কোন শব্দ ওর মুখ থেকে আর
কেউ কখনো শোনেনি।
বন্যার সৎকারটুকুও করেনি ধীরু, পাড়ার লোকে করেছিলো। তারাই ঘরের কিছু আসবাব
বেচে বন্যার শ্রাদ্ধ করেছিলো। খুব চেষ্টার পরেও যখন ধীরুকে আনা যায়নি সেখানে, তখন
নাকি কোন এক শুভানুধ্যায়ী সেই শ্রাদ্ধের খাবারই বেড়ে দিয়েছিলো সেই গাছতলায়। ধীরু
না করেনি।
ধানজমি ছেড়ে
আলপথ দিয়ে বটগাছটার দিকে যেতে যেতে এসব কথাই ভাবছিলাম। বাঁক ঘুরতেই চেনা গর্ত আর
চেনা হাড্ডিসার লোকটার দেখা পাওয়া গেল। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। গর্তটা আগের থেকে বড়
হয়েছে অনেক। ধীরু পাগলা তবু সেই এক কোনেই শুয়ে থাকে। ঘড়ি দেখলাম, দুপুর একটা। বউ
এক টিফিন-বাক্স খাবার দিয়েছে এই পাগলের জন্য। পাগলেরও যে এত খিদে থাকে, না দেখলে
বোঝা যায়না। কাছে গিয়ে উঁকি মেরে বুড়োটাকে টোকা মেরে বললাম,
“বাবা, ভাতটা খেয়ে নাও। বেলা হয়ে
গেছে।”