উৎস |
"...এটাকে আমি নিছকই 'হত্যা' মানতে পারি না, কারণ 'হত্যা' শব্দটার মধ্যে একটা ডেরোগেটরি সেন্স কাজ করে, প্রাথমিকভাবে। আমার ধারণা এটা ঠিক সেই অর্থে হত্যা নয়। হ্যাঁ, অনস্বীকার্য যে এটা হত্যা। কিন্তু একটা ব্যাপার আপনাকে বুঝতেই হবে যে এই হত্যার একটা লক্ষ্য আছে, একটা সিদ্ধান্তে সে উপনীত হতে চাইছে, দু'জনেই, অর্থাৎ হত্যা মানে দা এক্ট ইটসেল্ফ এবং হত্যাকারী অর্থাৎ আমি, আমরা দু'জনেই চাইছি একটা সার্বিক মুক্তি। কার? না শিল্পীর। আপনি বলবেন সাহিত্যিক, কিন্তু সেটাও তো একটা শিল্পই, নয় কি? মানে কিভাবে আপনি এই ডিমার্কেশন লাইনটা টানলেন? যার হাতে তুলি সে শিল্পী, যার হাতে কলম সে সাহিত্যিক, কে বলেছে আপনাকে? আপনি অমিয়ভূষণ পড়েছেন? পড়েননি সে আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়, নামই শোনেনি তো? আপনি পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ, আপনি শুনেছেনও তাই, আপনাকে সবাই বলেছে রবিঠাকুর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি - শুধু বলেইনি, আপনাকে ইস্কুলে, কলেজে, টিভিতে সর্বত্র ধরে ধরে ব্রেনওয়াশ করে বোঝানো হয়েছে রবিঠাকুরই শেষ কথা। গদ্য, পদ্য, গান, ছোটগপ্পো, ছবি, নাটক মানে ইউ জাস্ট নেম ইট! অদ্ভুত ব্যাপার, আপনার কখনো মনে হয়নি, ক্যানো? এর'ম ক্যানো? ক্যানো একজনই সব পারে আর যদি ধরেও নিই সে পারে, তাহলে আর কারুর পক্ষে কি এর'ম হওয়া সম্ভব না? পুরোপুরি না হলেও, এর শতকরা ষাট ভাগ? বা অন্তত চল্লিশ ভাগ? ভেবেছেন কখনো? ভাবেননি, আপনাকে ভাবতে দেওয়াই হয়নি, আর আপনিও স্বেচ্ছায় ভাবতে চাননি। একটু আগে অমিয়ভূষণের কথা বলছিলাম মনে আছে? উনি শব্দ দিয়ে ছবি আঁকতেন। আপনি হয়তো পড়ছেন অমিয়ভূষণ, পড়তে পড়তে ভাবছেন এনাকে কি বলবো, শিল্পী না সাহিত্যিক? অবশ্য আপনি পড়বেন ক্যানো? আপনি তো জানেনই রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ লিখতে পারেনা, পারেনি, পারবেও না। সুতরাং আপনি চাইবেন আমি ফার্স্ট বয়ের খাতাটাই দেখবো এবং মন দিয়ে দেখবো, আর বাকিরা লিখলেও সেটা ওপর ওপর পড়ে 'হ্যাঁ ভালোই কিন্তু ওর মতন তো না' বলে সব ভুলেটুলে যাবো। আমার দাদু একবার একটা গপ্পো বলেছিলো, দাদু ক্লাসে সেকেন্ড হতো আর ফার্স্টের সাথে তার ওই দু'এক নম্বরের ফারাক থাকতো। তো একবার কি হলো, কোনো একটা পরীক্ষায় আমার দাদু আর ওই জনৈক ফার্স্ট বয় একই ভুল করেছে, অথচ মাস্টার দাদুকে দিয়েছে গোল্লা আর ফার্স্ট বয়কে দুই না তিন নম্বর। তা দাদু উঠে গিয়ে বলেছে যে ওর আর আমার তো একই ভুল, ও নম্বর পেলো কিন্তু আমি পেলামনা ক্যানো? শুনে মাস্টার রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলেছিলো, 'ওরে তুই ভুল করেছিস না বুঝে আর ও করেছে বুঝে!' বলুন দেখি, এটা একটা যুক্তি হলো? ঠিক এই অন্ধযুক্তিটাই আমরা দিয়ে আসছি এখানেও। আমরা মানে আমরা মাইনাস আমি। আপনারা রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে ধেই ধেই করতে গিয়ে দুটো অকল্পনীয় অপরাধ করেছেন। কি কি? এক, আপনারা বহু লেখককে তাদের প্রাপ্য লাইমলাইট থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করেছেন এবং এখনো করছেন আর দুই, আপনারা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি চটকে একগাদা আবর্জনা পয়দা করেছেন যেটা কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। হেন্স আই চোজ্ টু কিল রবিঠাকুর অল বাই মাইসেল্ফ। আমি চাইনি ভদ্রলোক আমার হাতে খুন হোক, রাদার বেঁচে থাকলে উনি আরও দু'হাজার লেখা দিয়ে যেতে পারতেন কিন্তু একইসাথে ওনাকে নিজের সৃষ্টির নির্মম পতনও দেখতে হতো। সেদিক থেকে আমার এই হত্যা বা বারংবার হত্যার কাজ মার্সি কিলিং এর আওতায় পড়ে। কারণ এই হত্যার মধ্যে দিয়ে আমি শিল্পী ও শিল্প দু'জনকেই বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। শিল্পী তো তুচ্ছ! সে তো এক্সপ্লোরার! তার কাজ তো শিল্পসমুদ্রে ডুব মেরে গভীরে প্রোথিত মণিমাণিক্য কুড়িয়ে আনা! শিল্প তো বয়ে যাওয়া নদী, আর শিল্পী তাতে বিরামহীন অবগাহনে মত্ত! দেখলেন এখানে কিন্তু আমি 'স্নান' বললাম না। 'অবগাহন' বললাম। খেয়াল করলেন? স্নান একটি অতি ছেদো শব্দ। 'কোথায় চল্লি রে? এইত্তো চানে।' কিন্তু অবগাহন? শব্দটা উচ্চারণ করুন। আহা করুনই না একবার! অ ব গা হ ন। আত্মার শুদ্ধি হলো না কির'ম একটা? বাদ্দিন আপনি বুঝবেন না, আপনি ক্যানো আপনারা কেউ বুঝবেন না, যদি বুঝতেন তাহলে রবীন্দ্রনাথের 'নিভে' আর 'নিবে' ব্যবহারের ফারাক বুঝতেন আর দু'টোকেই ওইতো একই হলো বলে কামিনী প্রকাশনার 'সেরা পঞ্চাশটি রবীন্দ্রগান' বলে পেপারব্যাকে ছেপে বের করতেন না। বের করলে রেগে যেতেন, পুড়িয়ে ফেলতেন ওর'ম বই। যাগ্গে, যা বলছিলাম, আমার এই হত্যা বেসিকালি শিল্পের বাস্তিল দুর্গকে পতনের হাত থেকে বাঁচানোর একটা একক প্রচেষ্টা। এবং এতে আমার কোনো অহংবোধ নেই। আমার মনে হয়েছে একজন সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে হত্যা করা জরুরি, এবং আমি তা সফলভাবে করতে পেরে যারপরনাই উৎফুল্ল। আপনাদের ভার্ডিক্ট আমাকে কোনোভাবেই মর্মাহত করবে না কারণ আমি জানি আমি না থাকলে আপনারা সবাই মিলে প্রথমে রবিঠাকুরকে আর তারপর ধীরে ধীরে সাহিত্যকে সামগ্রিকভাবে কবর দিতেন। এবং সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো এই কাজটা আপনারা করতেন অজ্ঞানতার বশবর্তী হয়ে। অতএব, মহাশয়, এ বরমাল্য আমি সাদরে গ্রহণ করবো...
রবীন্দ্রনাথকে আমি প্রথমবার দেখি স্কুল স্টাফেদের নিউ ইয়ারের পিকনিকে। মিসেস ঘোষাল, মানে জিওগ্রাফির রত্না ঘোষাল চোখ বুজে 'আকাশ ভরা সূর্য তারা' গাইছিলো। কোমল গান্ধার দেখেছেন আপনি? ঋত্বিকের কোমল গান্ধার? দেবব্রত বিশ্বাসের দৈববাণীর মতন কণ্ঠস্বর। রত্না ঘোষাল চোখ বুজে সম্পূর্ণ ভুল উচ্চারণে, মানে 'নাড়ি'কে 'নারি' গোছের বিকট উচ্চারণে গেয়েই চলেছে আর সামনে রবীন্দ্রপ্রেমী তাঁবেদাররা আহা উহু করছে তো করছেই। আমি পেছনের পুকুরধারে সিগারেট খাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম এর একটা বিহিত হওয়া উচিত। ঠিক তখনই দেখি রবীন্দ্রনাথ, পুকুরের ওপারের পাঁচিলের গায়ে প্রস্রাব করছেন । আমি প্রথমে ভাবলাম চোখের ভুল। তারপর দেখি মোটেই না, সেই দাড়ি, সেই আলখাল্লা, ডিটো। বুকটা ধড়াস করে উঠলো। এ তো অসম্ভব! তারপর মনে হলো এও নেতাজি কেস নয়তো? মানে সন্তানদল যের'ম লেখে এ দেয়াল সে দেয়ালে 'নেতাজি ফিরে আসবেই' কিংবা 'একটা ঝড় আসছে', হয়তো সেরকমই। ঠাকুর ফিরে এয়েচেন। আর এসেই শুনছেন রত্না ঘোষাল ভুল উচ্চারণে গান গাইছে। তাঁর নিজের লেখা গান। আমার মনে হলো এই অত্যাচার থেকে ওনাকে মুক্তি দেওয়াটা জরুরি। এবং একজন একনিষ্ঠ শিল্পপ্রেমী হিসেবে এ দায়িত্ব আমারই নেওয়া উচিত। অতএব, আমি পা টিপে টিপে প্রথমে ওনার কিছুটা কাছে যাই। তখনও উনি প্রস্রাবরত। খুব আস্তে, প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে, আমি একটা থানইট কুড়িয়ে নিই। আরও কিছুটা এগিয়ে যাই। জাস্ট ভাবুন একবার! আমার সামনে রবিঠাকুর! ঐর'ম ভগবানের মতন ভাস্বর একটা চেহারা নিয়ে প্রস্রাব করছেন! আমি পেছনে দাঁড়াতেই উনি অল্প ঘুরে বললেন 'ওদিকে রান্নাবান্না হলো?' আমি উত্তর দেবো কি! প্রথমেই ইটটা যতটা জোরে পারা যায় মাথায় মারলাম। মনে মনে ক্রমাগত বলে চলেছি, যা করছি প্রভু তা আপনার হিতার্থে, সামগ্রিকভাবে শিল্পের হিতার্থে, দোষ নেবেন না। রত্না ঘোষালের উচ্চারণ শুনলে আপনি আত্মহত্যার পথই বেছে নিতেন, আমি স্রেফ সাহায্য করছি আপনাকে। প্রথম আঘাতটা যথেষ্ট জোরে হওয়ার জন্যে, রবীন্দ্রনাথ 'ওঁক' করে একটা আওয়াজ করে নিজের পেচ্ছাপের ওপরেই পড়ে গেলেন উপুড় হয়ে। তারপর উনি চেষ্টা করছিলেন উঠবার। আমি আর রিস্ক নিলাম না। বার দশেক এক নিঃশ্বাসে মাথায় মারলাম, মেরেই চললাম। বেশ কিছু ঘিলুটিলু আর রক্ত জামায় এসে লাগলো। আমি থামিনি তাও। ততক্ষণ মারলাম, যতক্ষণ না মাথাটা মাটির সাথে মিশে যায়। শেষ আঘাতটার পর দেখলাম বিয়ন্ড রিকগনিশন। মাথা-মাটি-পেচ্ছাপ-ঘিলু-রক্ত সব একসাথে মিশে একটা সমসত্ব মিশ্রণ তৈরি হয়েছে। আমি চেয়েছিলাম কবরটা দিয়ে আসি, কিন্তু ওদিক থেকে 'কোথায় সব খেতে আসুন এবার' ডাকাডাকি শুরু হওয়াতে আমি পা-দু'টো ধরে একটু টেনে পাশের কলাবাগানে ফেলে হালকা শুকনো পাতা চাপা দিয়ে চলে এলাম। আসার সময় জামাটা কয়েকটা ইট সমেত পুকুরে ফেলে দিলাম। ফেরার পরে সবাই জিজ্ঞেস করলো, 'একি জামা কই!' আমি শান্তভাবে উত্তর দিলাম, 'আর বোলো না, পা'টা পিছলে কাদায় পড়েছিলাম, ওই জামা আবার কে আনবে!' তাই ওদিকেই ফেলে দিয়েছি। সবাই অবাক হয়েছিলো, কিন্তু আমাকে যেহেতু প্রথম থেকেই সবাই ছিটিয়াল হিসেবে জানে, তাই আর কেউ কথা বাড়ায়নি। ফেরার সময় খালি রত্না ঘোষাল একবার জিজ্ঞেস করেছিলো 'আপনার প্যান্টে কিন্তু একটুও কাদা লাগেনি, বেশ শৈল্পিক পতন হয়েছিলো তো আপনার!' আমি উত্তর দিইনি...
আচ্ছা, 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি হয়' কথাটা শুনেছেন? কে বলেছিলো জানেন? আপনি কনফিডেন্টলি বলবেন এইর'ম উইজডম রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কার'ই বা হতে পারে? ভেবে আপনি পরিতৃপ্ত হবেন, তারপর এই কথাটা আরও চার-পাঁচজনকে বলবেন। বলবেন, 'দেখেছ? এইরম কবি বাংলাদেশে জন্মেছিলো ভেবে বুকটা গর্বে ফুলে যায়না?'...কোনোদিন জানবার চেষ্টাও করবেন না এই কথা আদৌ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলো কিনা। কারণ জেনে কি লাভ? আস্তিকদের নিরীশ্বরবাদ বোঝানো, আর আপনাদের রবীন্দ্রনাথের আওতার বাইরে সাহিত্য বোঝানো একইভাবে পণ্ডশ্রম। এই আমি নামলাম রবীন্দ্রকুয়োতে, চারিদিকে টলটলে জল, এই আমি অল্প একটু নিয়ে মাথায় ঢাললাম, তারপর আমি আমার ইয়ারদোস্তদের ডেকে ওই কুয়োতেই নামালাম। অতঃপর? জল ঘোলা করলাম সব্বাই মিলে! কি আনন্দ! জানতেই পারলাম না ওর বাইরে একটা পৃথিবী অযুত সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জানবার কথাই ভাবলাম না কোনোদিন। কারণ তাতে তো পরিশ্রম হবে! আমাদের শেখানো হ'লো আলোচ্য অংশে রবীন্দ্রনাথ কি বলতে চেয়েছিলেন, আমাদের শেখানো হ'লো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে হলে দাঁত চেপে চোখ বুজে এদিক ওদিক দুলতে হয় পেন্ডুলামের মতন, আমাদের শেখানো হলো রবীন্দ্রনাথকে যুগোপযোগী করে তুলতে হলে রবীন্দ্রনাট্যের সাবভার্সান বের করতে হয়, রবীন্দ্রগানে ঝিনচ্যাক ঢোকাতে হয়, আর কোথাকার কে বাবুল সুপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম বের করে ফ্যালে এভাবেই! আমরা কিস্যু শিখতে পারলাম না। রবীন্দ্রনাথ তো দূরস্থান,আমরা জানতেও পারলাম না 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি হয়' কথাটা জীবনানন্দ বলেছিলেন, তাঁর 'কবিতার কথা' বইয়ের ওপেনিং লাইন। অতএব, হে বন্ধু আমার, এ হত্যাসমূহ পাঠক বা দর্শক বা শ্রোতার চিন্তার বিস্তারের দিকনির্দেশিকা, তাদের কুয়ো থেকে সমুদ্রে উত্তরণের একটা রোপওয়ে...
রবীন্দ্রনাথকে আমি শেষবার দেখি আমার নিজের বাড়িতেই। ততদিনে আমি রবীন্দ্রনাথকে বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন উপায় হত্যা করেছি এবং প্রত্যেকবারই এনশিওর করেছি পরেরবার যেন আর ফিরে না আসেন । কিন্তু কোন এক দৈবশক্তির অধিকারী হওয়ার দরুণ, আবার ফিরে এসে আমার সাথে বহুবছরের পুরোনো আত্মীয়ের মতো, স্কুলের বন্ধুর মতো, সহজেই হেসে কথা বলেছেন, টুকরো আড্ডাও মেরেছেন এবং একবারও বলেননি দ্যাট হি কনডেমস মাই এক্ট। মহাপুরুষরা সম্ভবত এর'মই হন। যাইহোক, শেষবার রবীন্দ্রনাথকে আমি দেখি আমার বাড়ির বৈঠকখানায়। আমি বাগানের দিকে যাচ্ছিলাম সার দেবো বলে। যাওয়ার সময়ই দেখি কি একটা পড়ছেন উনি। আমি ডিস্টার্ব না করে বাগানে যাই এবং সার দিয়ে ফেরবার পথে বেলচা হাতে নিয়ে আসি। সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর পরও দেখি উনি নিজেরই কোনো একটি লেখা পড়ছেন অখণ্ড মনোযোগ সহকারে। আমি একটুও না রেগে ওনাকে স্মিতমুখে বলি, 'আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, আপনার এই কথোপকথন ও বিস্তৃত বিবরণসমৃদ্ধ লেখার এই সময়ে কেউ মূল্য দিতে পারবে? পারবে কেউ না হাঁপিয়ে পড়তে?' উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ঘাবড়ে গিয়েই বললেন, 'বাবা তুমি কাল ওষুধ খাওনি না?' এবার আপনিই বলুন, এর'ম একটা সিরিয়াস প্রশ্নের উত্তরে বাবা সম্বোধন করে ফাজলামো মারলে কার না মাথা গরম হয়? আমি সপাটে বেলচাটা চালালাম মাথা লক্ষ্য করে। 'বং' করে একটা আওয়াজ হলো আর সাথে সাথেই রবীন্দ্রনাথ লুটিয়ে পড়লেন। আমি আর কালক্ষেপ না করে বার কুড়ি চালালাম বেলচাটা। লাল একটা মাংসপিণ্ড তৈরি হলো বেশ। শেষ মারটা মেরে যখন বেশ আত্মতৃপ্তি বোধ করছি তখন ঘুরেই দেখি আমার স্ত্রী, আমি সবে বলতে যাচ্ছি, 'আর ফিরবে না গো, যা দিয়েছি না!' উনি চৌকাঠে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন..."
ইন্টারোগেশন রুমের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন লালবাজারের গোয়েন্দাপ্রধান রণজিৎ সোম। ঘামছেন। এর'ম কেস আগে দেখেননি কখনো। লোকটা কি সত্যি উন্মাদ? নাকি খুনগুলোর সত্যিই কোনো মোটিভ ছিলো? কি করে এরকম ঠাণ্ডা মাথায় একরাশ বাজে যুক্তি দিতে পারে কেউ? কোনো আলিবাইও তো দিচ্ছেন না ভদ্রলোক। পোকার ফেস করে বলে যাচ্ছেন কথাগুলো। মোট চারটে খুন করেছেন নবজীবন তরফদার, চাঁপাডাঙা উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার মাস্টারমশাই। অসম্ভব নামডাক এলাকাতে। প্রত্যেক ভিকটিমের নামই রবীন্দ্রনাথ। প্রথমজন নিজের কলিগ রবীন্দ্রনাথ সাঁপুই,পরেরজন রবীন্দ্রনাথ হাজরা, যাঁর ছেলে পড়তে আসত নবজীবন বাবুর কাছে, নেক্সট রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, নবজীবনবাবুর এলআইসি এজেন্ট এবং লাস্ট রবীন্দ্রনাথ তরফদার, নবজীবন বাবুর বাইশ বছরের ছেলে। লাস্ট খুনের পরই ভদ্রলোককে থানায় নিয়ে আসে পাড়ার ছেলেরা। মাথা নিচু করে বসে বিড়বিড় করছিলেন একটানা। লাস্ট ছ'মাস ধরে ভদ্রলোক নাকি সারাদিন 'ওরা সবাই মিলে ওঁকে মেরে ফেলছে, আমাকে কিছু একটা করতে হবে' বলতেন আর মাঝে মাঝেই উন্মত্ত হয়ে গিয়ে জিনিসপত্র ভাংচুর করতেন। মানসিক স্থিতি সম্পূর্ণ বিগড়ে গিয়েছিলো। মেডিকেশনের ওপর ছিলেন। স্কুলে যাওয়া, বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন সমস্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে যে জল এতদূর গড়িয়েছে কেউ বোঝেনি। লাশগুলো পাওয়া গেছিলো এদিক সেদিক থেকে, কিন্তু একজন পঞ্চান্ন বছরের বাংলার শিক্ষক যে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে এটা কেউ ভাবতেও পারেনি। ধরে নেওয়া হয়েছিলো লোকাল হুলিগানস। শেষ খুনের সময় স্ত্রী দেখতে পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যান এবং সেখানেই হার্টফেল করেন। শব্দ পেয়ে বাড়ির চাকর ছুটে আসে এবং দৃশ্যের ভয়াবহতা দেখে পাড়ার ছেলেদের ডেকে আনে। তারাই থানায় পৌঁছে দেয় ভদ্রলোককে।
রণজিৎ ঘাম মোছেন। ফ্যানটা বাড়িয়ে দ্যান। কার মনের কোন গভীরে কতটা ক্ষত তৈরি হয়েছে সেটা কোনোদিন বোঝা যাবে না, প্রিকগনিশান অফ ক্রাইম হিউমান সাইকোলজির কাছে কমপ্লিট ফেলিওর। তবে আপাতত ক'দিন নিজের নেশা থেকে দূরে থাকতে হবে। নেশা বলতে সিনেমা আরকি। তবে সব সিনেমা না, রাদার সবার সিনেমা না। আলফ্রেড হিচকক রণজিতের বড়ো প্রিয়। হিচককের রিমেক হোক রণজিৎ চান না। একদম না। কোনোদিনও না।