মলের দরজা দিয়ে নাচতে নাচতে বেরোচ্ছি, এমন সময়
শুনি- “এই, শোনো, এরা বলছে, ‘লাইফ অব পি’ বইটা নাকি ভাল হয়েছে। টিকিট কেটে নিই?”
কুল্যে দেড়খানা বাক্য, তাতেই আমায় কুপোকাত করে
দেওয়ার মতো যথেষ্ট আগুন ভরা। প্রথম কথা, সিনেমাটা সবে আমি দেখে বেরোলাম- ওর সাথে প্রস্রাবের
সম্পর্ক দূর-দূরান্তে নেই। ওটা পি (Pee) নয়, পাই
(Pi)। তা ভদ্রলোককে না হয় ক্ষমাঘেন্না
করে দেওয়া গেলো, হতে পারে অঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, বা ওই নম্বরটির ‘জীবন’ নিয়ে
সিনেমা হতে পারে, সেটা কল্পনাতেও আনতে পারেননি। আমি চাইলেই, “সেকি, পাই শোনেননি?”
বলে নাক উঁচু করতেই পারি, কিন্তু তাতে নাকের ডগা চিলে খেয়ে যাবে।
কিন্তু ওই যে, ‘বই’! ওটিতো
অত সহজে হজম হওয়ার নয় চাঁদ! যে কোন সিনেমাই বঙ্গ-লেহনে ‘বই’ হয়ে গেলে তা আমার পেটে
তোতার পেটের মতোই গজগজ করে, হজম হয়না। তার জন্যে সত্যবাবু দায়ী। ‘বিষয় চলচ্চিত্র’
বইটিতে পোস্কার করে কয়েচেন, বাঙালি সিনেমা বলতে বুঝতো শরৎবাবুর গপ্পো- তাই সিনেমা
আর বই চিরকালের মতো গুলিয়ে চুরমুর হয়ে গেছে। কিন্তু সত্যি বলতে, এই ওব্যেসটা যে
কতটা ক্ষতিকর, তা ভদ্রলোকের কথা শুনে বুঝলাম। ‘Life of Pi’ সত্যিই ভাল বই হয়েছে। বছর দশেক আগেই সেটা গোটা দুনিয়ার
লোকে জানতে পেরেছে, বুকার পুরস্কারটি বগলদাবা করার সঙ্গে সঙ্গে। তাই, “বইটা
দেখলাম, বেশ হয়েছে...” বললে, ঘরপোড়া, থুড়ি, বিদগ্ধ পাঠক ভাববেন, অ, বুজি থান-ইট বইডার
কতা কয়েসে। ভাবুন তো, কি বিচ্ছিরি ভুল বোঝাবুঝি!
সে যাকগে। অনেকক্ষণ তবলা
বাঁধলাম, এবার বোল তোলা যাক। প্রথমে ছোট করে বলি। বইটা, থুড়ি, থুত্থুড়ি, সিনেমাটা (কি ছোঁয়াচে রোগ বলুন তো!) দেখে বহু, বহুদিন পরে আবার সিনেমাহলের মজা বুঝলাম।
ভাল স্পেশাল এফেক্ট বিশেষ দেখিনা ভেবে নাক সিটকোবেন না। আমি ঘাগু
মাল।
‘Avatar’, ‘Transformers’ এবং এই জাতীয়
যাবতীয় হলিউডি ‘বই’ 3D তে হলে দেখেছি। খারাপ লাগেনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, একবারও মনে হয়নি, ওই 3D ব্যাপারটা সিনেমাটা দেখানোর জন্যে অপরিহার্য ছিল। ওটা ওই
হাতে আঁকা বিউটি স্পট হয়েই থেকে গেছিলো। এই সিনেমাটা দেখে মনে হলো, এদ্দিনে
টেকনোলজিটা সার্থক গালের টোল হয়ে উঠতে পেরেছে। যার আছে, তাকে মানায়।
যে 3D তে, ভাল হলে দেখেছে, তাকে জিজ্ঞেস করুন- রিচার্ড পার্কার প্রথম বেরিয়ে আসার সময় চমকেছিলো কি না। আলবাত হ্যাঁ বলবে। এই যে আপনাকে বলে দিলাম, এটা জেনেও আপনি চমকাবেন। আর এটাই সিনেমাটার তুরুপ। যা দেখছেন, সেটা সত্য নয় জেনে দেখতে বসেও ভুলে যাবেন। পাইয়ের সঙ্গে নৌকাবিহার (এটাকে ঠিক নৌকাবিহার বলে না বোধহয়। আচ্ছা, তবে ‘নৌকা-বাংলা’ বলি?) সেরে আসবেন। ঠিক যেরকম ছোটবেলায় মনে হতো। যেমনটা আপনার বাবা-কাকার উত্তমের সিনেমা দেখতে গিয়ে মনে হতো। চলচ্চিত্র জগতের প্রায় সব পথিকৃৎ যে কাজটা করার স্বপ্ন দেখে প্রতিদিন সকালে বিছানা ছাড়েন। যেমন অনুভূতি পাড়ার কম-বয়স্ক শখের জাদুকরটি তার সেরা দিনে মুহূর্তের জন্যে হলেও আপনার মনে তৈরি করে। বিরিয়ানি আর কলিগ প্যাঁদানোয় সিদ্ধহস্ত, নিখাদ ধান্দাবাজ এই আপনাকে একেবারে সেই ছোট্টটি বানিয়ে দেবে, যে প্রথমবার বাবার কোলে চেপে সিনেমাহলে ঢুকে হাঁ হয়ে, চোখ বড় বড় করে বলেছিলো, “বাবা! এত বড় টিভি!”
Ang Lee ম্যাজিক
দেখিয়েছেন। কি অমানুষিক আর দীর্ঘদিনের চিন্তা, পরিশ্রম আর বুদ্ধি আছে এটার পিছনে,
সেটা এই পোড়া দেশে বসে আন্দাজ করাও কঠিন। আপনি সিনেমা দেখতে গিয়ে, কি দেখে মোহিত হন? নিশ্চিত থাকুন, সেটা যা-ই হোক, সেই
বিভাগেও এই সিনেমা Distinction নিয়ে পাশ
করেছে। জাহাজডুবির দৃশ্য দেখে মনে মনে উরিব্বাস বলেছেন কি বলেন নি, তার পরের দিন
সকালের গল্প আপনাকে চমকে খাপছাড়া করে দেবে। পাইয়ের মতোই আপনি রিচার্ডকে ভয় পাবেন,
কিন্তু পাত্তা না দিয়ে থাকতে পারবেন না। CliftonFadiman, Catcher in the Rye এর নায়ক Holden এর
সম্পর্কে বলেছিলেন, “...That rare miracle of fiction has
again come to pass: a human being has been created out of ink, paper, and the
imagination.” (ভয় পাবেন না, RubySparks সিনেমার শেষে গল্পের নায়ক কোট করেছিলো, আমি গুগ্ল করে
সূত্রটা বের করলাম মাত্র) ঠিক একই কথা বলা যায় রিচার্ড সম্পর্কে। আবারও, Gollum, King Kong, TinTin, Aslan- আরও অনেক নামজাদা পূর্বসূরীর
সঙ্গে এক তালিকায় চলে এল রিচার্ড। তার ক্ষেত্রে কল্পনার মাধ্যম ছিল C.G.I- তবু একবারও, একটিবারও ওর দিকে তাকিয়ে ওকে সত্যি না ভেবে
পারবেন না। বাজি।
অপেক্ষায় থাকবো সিনেমার
হেঁশেলের গল্প জানার। ক্যামেরার পিছনের গল্পটাও বেশ ভালই লাগবে আশা করি।
লাইফ অব পাই কোন মহাকাব্য
টহাকাব্য নয়। দর্শনের মেড-ইজিও নয়। নিখাদ জমাটি গল্প। জাস্ট দেখে আসুন। 3D তে।
******
এখানেই থেমে যাওয়া যেত। এত
খেটেখুটে তৈরি ভাল একটা সিনেমা- সেটার নিন্দে না করলেই কি নয়? তাই থেমে গেছিলাম।
কিন্তু সত্য হলো জামাইয়ের মতো। কোন কাজে আসেনা। নেহাত বিরক্তি ছাড়া কোন অনুভূতিও
আসেনা। কিন্তু খাতির করতে এমন সব কাজ করে বসতে হয়, যা করার জন্যে মোটেই তৈরি ছিলেন
না। জামাই, থুড়ি, সত্যের খাতিরে কিছু সাবধান-বাণী দিয়ে রাখি। প্রধানত বুদ্ধিমান,
থুড়ি, নাস্তিকদের উদ্দেশ্যে।
১) এই সিনেমা ‘মুক্তমন’
নিয়ে দেখতে যাবেন। ভাল গল্প, ভাল সিনেমা, কিন্তু বাজে দর্শন ভাববেন।
২) হলে সিনেমা শুরুর প্রথম
কুড়ি মিনিটে মাঝে মাঝে দমক মেরে ওঠা হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করবেন। নইলে পিছন থেকে
চাঁটি আসতে পারে। ইয়ার্কি মেরেও “ওরে, রামকৃষ্ণের ডাকনাম ‘পাই’ ছিলো রে...” বলেছেন
কি মরেছেন। পুরো একঘরে হয়ে যাবেন বলে দিচ্ছি।
৩) ইরফান খান ভাল অভিনেতা।
তাঁর অতীত, ভবিষ্যৎ ও এই সিনেমার শেষের কিছু মুহূর্তের ভাল অভিনয়ের কথা ভেবে,
সম্মান জানাবেন। তিনি যখন গম্ভীর মুখে অর্ধপাচিত দার্শনিক ফান্ডা ‘কেমন দিলুম’ মুখ
করে আওড়াবেন, তখন আপনি পপকর্নে মন দেবেন। হাসবেন না।
৪) আসল বইটা পড়ে বিমুগ্ধ
আপনার গার্ল-ফ্রেন্ড যদি আপনার সঙ্গে দেখতে গিয়ে থাকেন, ভুলেও তাঁকে সিনেমা
চলাকালীন বোঝাতে বসবেন না, যে কেন ছেলেটার মাথায় গোবর আছে আর গোটা পরিবারে ওর বাবা
আর দাদাটিই যা একটু পদের। এ সব যদি এদ্দিনেও এত চাপ নিয়ে বোঝাতে হয়, তবে কিছু মনে
করবেন না, এই শীতে ওঁর মাথাতেও একটা চন্দ্রমল্লিকার চারা লাগিয়ে দেখতে পারেন। ভাল
ফুল হবে।
৫) সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ-
সিনেমার শেষে লেখক ভদ্রলোক যখন ইরফানের শেষ, শুনতে ভাল, অথচ অর্থহীন দার্শনিক মন্তব্যটা
শুনে ‘বুঝেছি, কিন্তু বলবো না’ গোছের হাসি দেবেন, তখন খবরদার- “ওরে মাথামোটা, Meerkat মরুভূমিতে পাওয়া যায়- দু’টো গল্প সমান নয়” বলে চেঁচাবেন
না। আপনাকে বের করে দেবে। তখন ভাল লাগবে কি?
মোদ্দা কথা, এখনও অবধি
দেখা সেরা 3D সিনেমাটা দেখে বুঝেছি, ‘গল্প ভাল, তাই সত্যি
হলো।’ এর
পর যদি কোন ভবিষ্যৎ বিবেকানন্দ এসে আমায় জিজ্ঞেস করেন, “ভগবানকে
দেখেছেন? কেমন তিনি?” তবে বলবো…
“ওই, Life of Pi তে যেমন দেখিয়েছিলো”