- সর্বক্ষণ অন্যের কথা
ভাবতে, শুনতে, বলতে আর ভাল লাগেনা। কে কোথায় কার স্বাধীনতা কেড়ে নিলো, কে কবে কার
ওপর অত্যাচার করলো, কোথায় কোন নক্ষত্রে ক’টা টিকটিকি দেখা গেছে, সেই নিয়ে আলাপ,
প্রলাপ, বিলাপ, আলোচনা, প্রস্তাবনা, সমালোচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, দুর্গন্ধ – আর ভাল
লাগেনা। আর ভাল লাগেনা এত শব্দ। শব্দ-কল্পদ্রুম মানে অনেক পরে বুঝেছি। ওর মানে কেউ
বাজে শব্দ করলে কল্পনা করা যে তার মাথায় দুড়ুম করে হাতুড়ি বসিয়ে দিলাম। Anger Management এর দরকার হবে না, ওই দুড়ুম শব্দেই
বেজায় হাসি পাবে। আমারও এখন তেমন ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে, কেউ একটু আমার কথা বলুক।
কেউ না বললে অন্তত আমিই একটু নিজের কথা বলি। একটু নিজের পিঠ চাপড়ে দিই, নিজের
কাঁধে মাথা রেখে একটু ঘুমোই। অন্য সক্কলের মতো আমিও নিজেকে ভালবাসি, কথাটা একবার
অন্তত বলার মতো করে বলি। “প্রতিটি বলের সমান ও বিপরীতধর্মী বল দোকানে পাওয়া যায়”
এর মতো করে নয়। কিছু নিখাদ সত্যি কথা আছে, যা জনসমক্ষে বলতে গেলেই আর মেরুদণ্ডে
জোর পাওয়া যায় না।
- যাহা শিরশির করে, তারে শিরদাঁড়া কয়।
- নিজের কথাও ঠিক তাই। একদম বাচ্চারা ছাড়া সবাই বোঝে ‘আমি, আমি’ করা মানে কি। ‘আত্মসর্বস্ব’ হয়ে যাওয়া। ‘স্বার্থপর’ হওয়া। ‘খারাপ’ হয়ে যাওয়া। কেন?
- কেননা
ওসব হওয়া খুব খারাপ।
- কেন?
- কেন
আবার, ওরকম যারা করে, তারা অন্যের কথা ভাবে না।
- তার
মানে, এই যে সবাই চুপ করে আছে, নিজের কথা মোটেই বলছে না,- এরা সব চুপটি করে অন্যের
ভালর কথা ভাবছে? রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, ট্রেন, বাস, মেট্রোয় ঝুলতে ঝুলতে, শপিং
মলের কাচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, খানের সিনেমা দেখতে বসে, পার্কের নিঃসঙ্গ বেঞ্চে,
টয়লেটে, বিছানায়, প্রেমে বিরহে, বিয়েশ্রাদ্ধভোটপৈতেমাসতুতোমামাতো –সব উৎসবে এরা
সবাই নিজেকে বাদ দিয়ে অন্যের কথা ভাবছে?
- আহ্! তা কেন? নিজের কথা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া, সমাজ- সব কিছু নিয়েই ভাবে মানুষ। ভাবনার কি আর শেষ আছে?
- ভাবনার
শেষ না থাকুক, কথার তো আছে- লোকে সব
কিছু বলে, শুধু
নিজের কথাটি সযত্নে এড়িয়ে যায়। নিজের কথা মানে দাবীদাওয়ার কথা নয়। এ হল অনুযোগের কথা, ঘ্যান ঘ্যান করার কথা, সারাক্ষণ ‘দেখো, আমার না কিচ্ছু ভাল লাগছে না। আমি না, একদম ভাল নেই’ বলার কথা। সে সব কথা যদি, ‘ভাই, খুব ডিপ্রেসিং, সমাজে চলবে না’ বলে দাবড়েও দাও, আরও আছে। আছে নিজের স্বপ্নের কথা, জয়ের- পরাজয়ের, অতীত-চারণের কথা। অবশ্য শেষেরটা তাঁরাই বেশি করেন, যাদের অতীতের খেরো খুব মোটা।
নিজের কথাটি সযত্নে এড়িয়ে যায়। নিজের কথা মানে দাবীদাওয়ার কথা নয়। এ হল অনুযোগের কথা, ঘ্যান ঘ্যান করার কথা, সারাক্ষণ ‘দেখো, আমার না কিচ্ছু ভাল লাগছে না। আমি না, একদম ভাল নেই’ বলার কথা। সে সব কথা যদি, ‘ভাই, খুব ডিপ্রেসিং, সমাজে চলবে না’ বলে দাবড়েও দাও, আরও আছে। আছে নিজের স্বপ্নের কথা, জয়ের- পরাজয়ের, অতীত-চারণের কথা। অবশ্য শেষেরটা তাঁরাই বেশি করেন, যাদের অতীতের খেরো খুব মোটা।
- জিয়ন-শক্তি নষ্ট হলেই মানুষ নস্টালজিয়ায় ভোগে।
- তা---ই! সারা জীবন ভোগে না বুঝি? ‘ইশ্শ্, স্কুল-লাইফটাই সবচেয়ে ভাল ছিল জানিস’, ‘মা, সেই যে আমার ছোট টেবিলটার ওপর রাখা থাকতো ফুল ফুল মলাট দেওয়া খাতাটা, ওটার কথা তোমার মনে আছে?’, ‘তোমার মনে আছে, সেই যে তুমি অ্যাকাডেমির সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছিলে, তোমায় দেখে আমি ফিক করে হাসলাম?’, ‘বুঝলি ভজা, তোর মায়ের তখন কিইই লজ্জা, আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই পারছে না, হাজার হোক বর তো!’... এসব বুড়ো বয়সে বলে বুঝি মানুষ? ও সব বাজে কথা। আসল কথা হলো, আমি যে আমি, সে আমি তো আর আজ সকালেরটা নই- আমার গোটা বিগত জীবনটা এঁকে-বেঁকে অসংখ্য বগি-ওয়ালা ট্রেনের মতো আমারই পিছু ধাওয়া করছে, তার কিছু আমার চোখে ধরা পড়ছে, কিছু পড়ছে না। আবার কোন এক বাঁকে কোন একটা বগি চোখে পড়বে। কিন্তু, শেষ অবধি, আমি সামনের দিকেই এগোচ্ছি, আর বার বার পিছনে উঁকি মেরে দেখছি- আমার ট্রেনটাকে দূর থেকে কি সুন্দরই না দেখায়! আহা!
- ‘মেরি সপ্নো কি রাণী কব্ আয়েগি তু, আয়ি রুত মস্তানি কব আয়েগি তু...’
- মেলা
বাজে বোকো না... মাঝে মাঝে মনে হয় দিই এই গোটা অতীত ব্যাপারটাকে টিকটিকির লেজের
মতো খসিয়ে। লেজও নেই, লেজ-ব্যথাও নেই। কিন্তু সে কি সম্ভব?
- আলবাত!
প্রচুর মদ খাও। অল্প-স্বল্প খেলে হবে না। তেমন তেমন খেতে পারলে তোমার সমস্ত বেয়াড়া
স্মৃতিকে কাগজ-কুড়ুনির যত্নে গুটিয়ে-গুছিয়ে সঙ্গে নিয়ে তোমার লিভার-বাবাজী
মহা-প্রস্থানে যাবেন। সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন অর্থ-প্রতিপত্তি আর তেমন ভাগ্য করে এলে
মগজটাও। লেজের কথা বলতে পারিনা, তবে মাথা না থাকলে মাথা-ব্যথা থাকবেনা, সে বিষয়ে
নিশ্চিত।
- সবকিছু অত হালকা করে দেখাটা তোমার একটা বদ-অভ্যেস। আমি মরছি নিজের জ্বালায়- মনে হচ্ছে ওই সামনের কমোডে ঝাঁপ দিই, আর আমায় মদ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছো? লজ্জা করে না?
- না করে না, আর তোমারও করা উচিত নয়। বসের কাছে অমন একটুআধটু ঝাড় সকলেই খেয়ে থাকে- এ তোমার প্রথমবার বলে ওইসব মনে হচ্ছে। এখন তাড়াতাড়ি চলো- দশ মিনিটের ওপর বাথরুমে আছো শুনলে খুব একটা খুশি হবেন না তিনি। তখন নিজের অতীত ছেড়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা শুরু করতে হবে।
- (হুম্... গরগর আর ঘড়ঘড়-এর মাঝামাঝি একটা শব্দ)