পটচিত্র ঐতিহ্যানুসারী
শিল্প। এই চিত্রধারা বংশপরম্পরায় একটা স্রোতের মতো এক শিল্পী থেকে অন্য শিল্পীর
কাছে যায়। তাই বলা হয় পটচিত্র অনভিজাত এবং শিক্ষা নিরপেক্ষ সংহত এক সমাজের ঐতিহ্যানুসারি
শিল্পী মনের প্রকাশ। চিত্র অঙ্কনের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, রঙের বিন্যাস, অঙ্কন শৈলী, অলংকরণ, প্রতীক ভাবনা সবই একটি সংহত
গোষ্ঠীর মধ্যে সংরক্ষিত থাকে। আবার পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা বিকশিত হয় গোষ্ঠীর
ফসল হিসেবে। পটচিত্রে কোনও কোনও লোকাচার ও লোকবিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। কিছু বিখ্যাত
পটের নাম করলে শুরুতেই আসে পুরুলিয়ার চক্ষু দান পট, কালীঘাটের ঘট পট, মনসার পট ইত্যাদি। পটচিত্রকে formalized folklore এর মধ্যে ফেলা যায়। বাকআশ্রয়ী এবং শিল্পাশ্রয়ী বিষয় নিয়েই formalized folklore। শিল্পাশ্রয়ীর মধ্যে
নকশিকাঁথা, নকশি পিঠা, নকশি বিছা, নকশি পুতুল, নকশি পাখা, আলপনা, দেওয়াল চিত্র, কুলোচিত্র, পাটা চিত্র, পটচিত্র, মুখোশ চিত্র, অঙ্গচিত্র, শোলার কাজ, কেশ বিন্যাস, শাঁখের অলংকার, দশাবতার তাস ইত্যাদি।
‘পট’ শব্দটি ব্যাঞ্জনাময়।
‘পট’ শব্দটির গঠনগত অর্থ পটি + অ (অচ)-ণ-বস্ত্র।
লেখা বা চিত্র আঁকার জন্য
বস্ত্র খণ্ডকেও পট বলা হয়। চিত্র আঁকার কাঠাদিকেও পট্ট বলা হত। চিত্রপট বা ছবিও পট
নামে চিহ্নিত হত। সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দের অর্থ কাপড়।
পরবর্তীকালে বস্ত্রখণ্ডের ওপর অঙ্কিত চিত্রই পট নামে চিহ্নিত হয়। কাপড়ের ওপর যাঁরা
ছবি আঁকতেন, অতীতে তাঁরাই পট্টিদার>পট্টিকার>পটকার>পটুয়া।
এরা কোথাও পোটো, চিত্রকর বা পাইক্কা নামেও
চিহ্নিত। পরবর্তীকালে কাগজ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে কাপড়ের ওপর চিত্র অঙ্কন ধারাই
কাগজের ওপর এসে পড়েছে। ভারতবর্ষের প্রাচীন পুঁথিগুলোতে পটের উল্লেখ দেখা যায়।
পাণিনির অস্থাধ্যায়ী বর্ণিত গ্রামশিল্পীকেই পটিদার বা পটুয়া বলা হত। গ্রন্থটির
সময়কাল গবেষকদের মতে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক। ‘পতঞ্জলির মহভাষ্য’, ‘অভিজ্ঞানম
শকুন্তলম’, কিংবা অষ্টম শতকে রচিত বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে পটুয়াগণ গুপ্তচর
বৃত্তিতে নিযুক্ত। এইসব গ্রন্থে পটুয়া প্রসঙ্গ থাকায় বোঝা যায় চিত্রকর বৃত্তি এক
প্রাচীন বৃত্তি। শাস্ত্রের বিধান মেনে কাপড়ের ওপর যাঁরা ছবি আঁকতেন তাঁরা অধিকাংশই
ছিলেন বৈশ্য বা শূদ্র সমাজের অন্তর্ভুক্ত। ক্ষত্রিয়দের চিত্র অঙ্কন নিষিদ্ধ না
হলেও পেশা হিসেবে ক্ষত্রিয়রা একাজ করতেন না। ব্রাহ্মণের পক্ষে চিত্র অঙ্কন নিষিদ্ধ।
এমনকি নট নর্তক এবং শিল্পীদের ঘরে অন্ন গ্রহণ ব্রাহ্মণদের পক্ষে অমার্জনীয় অপরাধ
হিসেবে ছিল। তৎকালীন সমাজকে পরিচালনা করত শাস্ত্র। চিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রেও
শাস্ত্রের নির্দেশ ছিল। পট বিশ্বকোষ বলছে
“যাহারা দেবীর পট প্রস্তুত করে তাহারা সিদ্ধিলাভ করিয়া থাকে। নতুন বস্ত্রে পট প্রস্তুত করতে হয়। এই পট সর্বাঙ্গ সুন্দর সমান ও তন্তু বিশিষ্ট গ্রন্থি এবং কেশ বিহীন হওয়া আবশ্যক। পট ছিদ্র যুক্ত বা পটিত হইলে পট নির্মাতার অশুভ হইয়া থাকে। নবধা বিভক্ত বস্ত্রের সকালে দেবগণ, দশান্ত, পাশান্ত’র মধ্যে নরগণ এবং অবশিষ্ট তিন অংশে রাক্ষসদিগের আবাসস্থল”।
শাস্ত্র নির্দেশিত পট
অঙ্কনের এই রীতি ভাস্কর্য খণ্ডে ও প্রাচীন দেওয়াল চিত্র মেনেই করার চেষ্টা করা
হয়েছে। দীর্ঘ কাপড়ে পট আঁকার সময় পটুয়াগণ শাস্ত্র নির্দেশ পালন করেছেন। কিংবা
পরবর্তীকালে যখন পটের আকার ছোট হল কাপড়ের পরিধি কমে গেল এবং যখন তা আরও শীর্ণ হতে
হতে কাগজের ওপর উঠে এল তখন শাস্ত্রের ঐ নিয়মনীতির হ্রাস ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে গেল।
কাপড়ের আঁকা পট ও কাগজে আঁকা পটের মাঝামাঝি সময়ে পটচিত্রের জন্য জমি তৈরি হত চটের
ওপরে গোবরের প্রলেপ দিয়ে। শুকনো হয়ে গেলে প্রথমে সাদা রঙ মাখিয়ে ভূমি প্রস্তুত হত
তারপর শুরু হত চিত্র আঁকা। এই পদ্ধতির কথা জানালেন বীরভূমের বাহু পটুয়ার ছেলে
শান্তনু পটুয়া। তাদের বাড়িতে এ জাতীয় পট ও তালপাতার প্রাচীন পটও আছে। বর্তমানে
কাগজ কেটে আঠা দিয়ে জুড়ে লম্বা করা হয় তারপর পেন্সিল দিয়ে স্কেচ টানা হয়। এক একটি
ফলকের চারপাশে যে নকশা থাকে তাকে বলে বাব। দীর্ঘ কয়েকটি কাগজকে বাব দিয়ে বিভক্ত
করে স্কেচ দিয়ে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকে প্রয়োজনীয় রঙ দিয়ে সুচিত্রিত করতে হয়। রঙ
ব্যবহারের সময় বেল বা নিম আঠা মিশিয়ে দেওয়া হয় স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য। দীর্ঘ পটের
দুই প্রান্তে দুটি মোটা কাঠি জুড়ে দেওয়া হয় গোটানোর সুবিধার জন্য। কেউ কেউ পটের
পেছনে পুরানো কাপড় আঠা দিয়ে জুড়ে দেন। যাতে পট দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়।
কলকাতার কালীঘাট মন্দির
প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৯৮ সালে। মন্দিরের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ার পর ভক্ত সমাগম বাড়তে থাকে। জীবন
ও জীবিকার টানে বহু মানুষ মন্দিরের দুপাশে দোকান তৈরি করেন। গ্রামের পটুয়াগণও ঐ
এলাকায় বসবাস শুরু করেন। উদ্দেশ্য তীর্থযাত্রীদের দেব-দেবীর মুখের মূর্তি, পুতুল, সরাচিত্রে বিক্রয় করা। তীর্থ
ভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে তীর্থযাত্রীরা এইসব কিনে নিতেন। দরিদ্র পটুয়াগণের জীবিকার
একটা দিক এইভাবে খুলে গেল। কালীঘাটে প্রথমদিকে যে সমস্ত পটুয়ারা এসেছিলেন তাঁরা
নিম্নবর্গের হিন্দু। হিন্দু তীর্থের পাশে তৎকালীন সামাজিক পরিবেশে মুসলমান
শিল্পীদের স্থান পাওয়া বেশ জটিল ছিল। পটুয়াগণ চিরিদিনই মিশ্র জীবিকার মানুষ। পুতুল
তৈরি, পট আঁকা, কৃষিকাজ, সাপ খেলা দেখান, রাজমিস্ত্রির কাজ – এইসব কাজেই ছিল তাদের
দক্ষতা। বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন
ধরণের পটুয়াগণ উক্ত অঞ্চলে বসবাস করার ফলে তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও টেকনিকের একটা আদান-প্রদান ঘটতে থাকল। কালীঘাটের পটুয়াগণ প্রথমে দেব-দেবীর মুখোশ বা মুখের মূর্তি মাটি দিয়ে তৈরি করতেন। তাকে রং ও তুলির টানে জীবন্ত করার চেষ্টা করতেন। সঙ্গে থাকত দেব-দেবীর পুতুল ও অন্যান্য পুতুল। ক্রমে মাটি সরায় দেব-দেবীর মূর্তি আঁকা হত। ঐ সরা পূজায় ব্যবহৃত হত। তারপর শুরু হল চৌকো পটে দেবতার মূর্তি আঁকা। ঐ পট সামনে রেখে নিরাকার ঈশ্বরকে সাকারে চিহ্নিত করে পূজা নিবেদন করতেন ভক্ত সমাজ। এইভাবে গ্রামের ছিন্নমূল কিছু পটুয়া নতুনভাবে জীবিকার সন্ধান পেলেন। শুরু হল কালীঘাটে পটের যুগ। মুসলিম ও ইংরেজ শাসনের যুগস্বন্ধিক্ষণে কালীঘাটের পটের জন্ম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের রণদামামা বেজে ওঠার পূর্বেই আবার বিলুপ্তি। কালীঘাটের পট আশ্চর্য সৃষ্টি। এটা একটা বাস্তব ঘটনা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন। প্রথানুসৃত ও প্রগতির দ্বন্দ্ব। চিন্তা-ভাবনার বহু অবাস্তবতা পরিণামে নেমে এসেছে অপমৃত্যু। এই শোচনীয় মৃত্যু লোকশিল্পের ক্ষেত্রে চরম দুঃখের। কালীঘাটের পট চৌকো পট। একটা চৌকো আকৃতির খোপের মধ্যে সংকেতময় ব্যঞ্জনা। যেন একটা নিটোল ছোটগল্প। এই চৌকো পটের উৎস কি? পাল ও সেন যুগের বিভিন্ন মন্দির গাত্রে পোড়া মাটির চৌকো টেরাকোটা লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ এগুলিকে কালীঘাটের পূর্বসূরি বলে মনে করেন। মহেঞ্জদরোতে প্রাপ্ত শিলমোহরই কালীঘাটের পটের উৎস বা আদিরূপ। পণ্ডিত হরিদাস মিত্র বলেন, “একসময় পটুয়াগণ ভারা বেঁধে চালচিত্র আঁকতেন। কোনও দিনই স্বতন্ত্রভাবে কাপড়ে বা কাগজে এঁকে চালচিত্রের ওপর জুড়ে দেওয়ার রীতি দেখা যায়নি। এইভাবেই চালচিত্রের পরম্পরা কালীঘাটের পটকে হয়ত প্রভাবিত করেছে”। বাংলার লোকায়ত ধারায় চৌকো পটের প্রচলন ছিলই। আমাদের মনে হয় কালীঘাটের পটুয়াগণ সরাচিত্র আঁকতে আঁকতে কাগজে চৌকো পটে দেব-দেবীর মূর্তি আঁকা শুরু করেন। কালীঘাটের পটুয়াদের পটচিত্রের ক্রমবিকাশের ধারাটা এইরকম। দেব-দেবীর মুখের অবয়ব বা পুতুল, সরায় আঁকা দেব-দেবীর ছবি, ধর্মীয় পট, পৌরাণিক পট, দৈনন্দিন জীবনের ছবি ও ব্যঙ্গ চিত্র। কালীঘাটের বিষয়বস্তু গুলি ছিল দাঁড়ে বাঁধা কাকাতুয়া, পাকানো চাদর গলায় বিলাসী বাবু, পটের বিবি, গড়গড়ার নল মুখে সাহেব, মাছ কুটুনি বাঙালি গিন্নি, বীণা বাদনরত যুবতী, সালংকারা গৃহবধূ সম্মুখে হুঁকো হাতে চেয়ারে বসা গৃহকর্তা, মোহন তৈল কেশী মহাদেবের কোলে ঘুমন্ত পার্বতী, বৃক্ষ শাখায় শুকপাখি, যুবতীকে কোলে বসিয়ে সুরা পাত্র হাতে বাঙালি বাবু। অল্প কয়েকটি রেখায় পটুয়াগণ এইসব চিত্র চৌকো পটে এঁকেছেন। চিত্র গুলো বৃত্তের ব্যাসের আদলে। রঙের ব্যবহারও কম। এক একটি চৌকো পটে চরিত্র সংখ্যা দুই বা তিন।
ধরণের পটুয়াগণ উক্ত অঞ্চলে বসবাস করার ফলে তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতা ও টেকনিকের একটা আদান-প্রদান ঘটতে থাকল। কালীঘাটের পটুয়াগণ প্রথমে দেব-দেবীর মুখোশ বা মুখের মূর্তি মাটি দিয়ে তৈরি করতেন। তাকে রং ও তুলির টানে জীবন্ত করার চেষ্টা করতেন। সঙ্গে থাকত দেব-দেবীর পুতুল ও অন্যান্য পুতুল। ক্রমে মাটি সরায় দেব-দেবীর মূর্তি আঁকা হত। ঐ সরা পূজায় ব্যবহৃত হত। তারপর শুরু হল চৌকো পটে দেবতার মূর্তি আঁকা। ঐ পট সামনে রেখে নিরাকার ঈশ্বরকে সাকারে চিহ্নিত করে পূজা নিবেদন করতেন ভক্ত সমাজ। এইভাবে গ্রামের ছিন্নমূল কিছু পটুয়া নতুনভাবে জীবিকার সন্ধান পেলেন। শুরু হল কালীঘাটে পটের যুগ। মুসলিম ও ইংরেজ শাসনের যুগস্বন্ধিক্ষণে কালীঘাটের পটের জন্ম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের রণদামামা বেজে ওঠার পূর্বেই আবার বিলুপ্তি। কালীঘাটের পট আশ্চর্য সৃষ্টি। এটা একটা বাস্তব ঘটনা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন। প্রথানুসৃত ও প্রগতির দ্বন্দ্ব। চিন্তা-ভাবনার বহু অবাস্তবতা পরিণামে নেমে এসেছে অপমৃত্যু। এই শোচনীয় মৃত্যু লোকশিল্পের ক্ষেত্রে চরম দুঃখের। কালীঘাটের পট চৌকো পট। একটা চৌকো আকৃতির খোপের মধ্যে সংকেতময় ব্যঞ্জনা। যেন একটা নিটোল ছোটগল্প। এই চৌকো পটের উৎস কি? পাল ও সেন যুগের বিভিন্ন মন্দির গাত্রে পোড়া মাটির চৌকো টেরাকোটা লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ এগুলিকে কালীঘাটের পূর্বসূরি বলে মনে করেন। মহেঞ্জদরোতে প্রাপ্ত শিলমোহরই কালীঘাটের পটের উৎস বা আদিরূপ। পণ্ডিত হরিদাস মিত্র বলেন, “একসময় পটুয়াগণ ভারা বেঁধে চালচিত্র আঁকতেন। কোনও দিনই স্বতন্ত্রভাবে কাপড়ে বা কাগজে এঁকে চালচিত্রের ওপর জুড়ে দেওয়ার রীতি দেখা যায়নি। এইভাবেই চালচিত্রের পরম্পরা কালীঘাটের পটকে হয়ত প্রভাবিত করেছে”। বাংলার লোকায়ত ধারায় চৌকো পটের প্রচলন ছিলই। আমাদের মনে হয় কালীঘাটের পটুয়াগণ সরাচিত্র আঁকতে আঁকতে কাগজে চৌকো পটে দেব-দেবীর মূর্তি আঁকা শুরু করেন। কালীঘাটের পটুয়াদের পটচিত্রের ক্রমবিকাশের ধারাটা এইরকম। দেব-দেবীর মুখের অবয়ব বা পুতুল, সরায় আঁকা দেব-দেবীর ছবি, ধর্মীয় পট, পৌরাণিক পট, দৈনন্দিন জীবনের ছবি ও ব্যঙ্গ চিত্র। কালীঘাটের বিষয়বস্তু গুলি ছিল দাঁড়ে বাঁধা কাকাতুয়া, পাকানো চাদর গলায় বিলাসী বাবু, পটের বিবি, গড়গড়ার নল মুখে সাহেব, মাছ কুটুনি বাঙালি গিন্নি, বীণা বাদনরত যুবতী, সালংকারা গৃহবধূ সম্মুখে হুঁকো হাতে চেয়ারে বসা গৃহকর্তা, মোহন তৈল কেশী মহাদেবের কোলে ঘুমন্ত পার্বতী, বৃক্ষ শাখায় শুকপাখি, যুবতীকে কোলে বসিয়ে সুরা পাত্র হাতে বাঙালি বাবু। অল্প কয়েকটি রেখায় পটুয়াগণ এইসব চিত্র চৌকো পটে এঁকেছেন। চিত্র গুলো বৃত্তের ব্যাসের আদলে। রঙের ব্যবহারও কম। এক একটি চৌকো পটে চরিত্র সংখ্যা দুই বা তিন।
১৮০০ সাল থেকে ১৮৫০। বাবু
কালচারের এক ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা লক্ষ করা যায় কলকাতার সমাজে। কেউ কেউ নববৃন্দাবন
হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এটাকে। এই সময় সমাজচিত্র ধরা পড়েছে ভবানীচরণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবু
বিলাস’, ‘নববিবিবিলাস’, কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম
প্যাঁচার নকশা’, দীনবন্ধু মিত্রের রচনা, মধুসূদন দত্তের প্রহসন, শিবনাথ শাস্ত্রীর সাহিত্য
প্রায় ধ্বসে যাওয়া বাবু পরিবারের অশিক্ষিত নিষ্কর্মার ধারী বংশধররা তাদের
বাপ-ঠাকুরদা’র রোজগারের টাকা তার বেশিরভাগটাই উড়িয়ে দিয়েছেন
মদ, মেয়েমানুষ, ইয়ারবকশি, মোসাহেব নিয়ে বেলেল্লাগিরি করে। সমাজে তখন
যৌনতা চরম আকার ধারণ করেছে। পটুয়াগণ সমাজের এই ব্যভিচারকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে
চিত্র আঁকতে শুরু করেন। অনেকটা কার্টুনের মতো। কার্টুন কিন্তু শুরুর দিন থেকেই establishment বিরোধী। এবং সহজ জিনিসকে
ব্যঙ্গের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করে। পটুয়াগণ যেহেতু মাটির পুতুল তৈরি করতেন তাই
মূর্তির গোলাকার ভাবটি চিত্রের হাতে পেয়ে থেকে গেল। পটচিত্রের এই বর্তুল প্রবণতাকে
লক্ষ করে সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন,
“তৎকালীন চরিত্রের ব্যঙ্গ
চিত্র রচনায় এই শৈলী খুব কাজে লেগেছিল। বাবু, বেশ্যা, ভণ্ড পুরোহিতের ফাঁপা ফোলা হাত পা মুখ সমাজের
অন্তঃসারশূন্য তাড়িত পট”। কালীঘাটের পটুয়াগণ এঁকেছেন অ্যালবারট কেতায় চুল আঁচড়ানো, উদ্ধত কাঁধে দামী শাল, শাঁটা জুতো। ভিক্টোরীয়
ফ্যাশানে শৌখিন চেয়ারে বসে আছেন সামাজিক দায়িত্বহীন বাবু। হুঁকো পান তার একমাত্র
কাজ। শিবও যেন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। ছাপোষাহীন পৃথিবীতে সংসার পেতেছেন। অবশ্য
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল থেকেই শিবের এই রূপ শুরু হয়ে গিয়েছিল। কার্ত্তিকও পটুয়াদের
তুলির টানে লাপেটা চালের কলকাতার ফুলবাবু। পটুয়াগণ সমাজের পরিবর্তনের ধারাতে
শিল্পের মাধ্যমের প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। কালীঘাটের পট সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে
পটুয়াগণ তাদের চিত্রে ব্যঙ্গের কষাঘাত এনেছেন। একই সঙ্গে চেষ্টা করেছেন প্রতিরোধের
দেওয়াল তৈরি করতে। সময়সীমা ১৮৫৪ থেকে ১৮৭১ এর মাঝামাঝি।
দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা
পটুয়াগণ ঝলসে উঠেছেন শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। এবং তথাকথিত পয়সাওয়ালা বাবুদের কদর্য
নোংরামির বিরুদ্ধে। আসলে দীঘল পট আঁকাই পটুয়াগণের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল সমাজ
সংশোধনের জন্য পট আঁকা। জীবিকার প্রয়োজনে দ্রুত সম্পন্ন করার পট হল এই চৌকো পট। এই
পটের মাধ্যমে পটুয়াগণ তাদের সমাজ সংশোধনের প্রথা অনুসৃত করেছেন। দীঘল পটের মধ্যে
বিবর্তনকে স্বীকার করে নেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। সেখানে ব্যঙ্গের ঝাঁঝ কম। বেশি
থাকে হিউমার। তাই পরিবর্তনের হাওয়া মেখে দীঘল পট দীর্ঘজীবী। অপমৃত্যু হয়েছে
কালীঘাটের পটের।
কালীঘাটের পটুয়াগণ নগরজীবনে
প্রবেশ করেছিলেন জীবন ও জীবিকার টানে। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে দীঘল পট ছেড়ে চৌকো পট
আঁকাও শুরু করলেন। তাঁরা নগর রুচি লক্ষ করলেন। ঘট পট, ধর্ম পট, পৌরাণিক পটে অন্যান্য জীবনের
রূপভেদ আঁকলেন তাঁরা। অবশ্য পৌরাণিক পট অপেক্ষা সামাজিক পটে তাঁদের দক্ষতা চূড়ান্ত
রূপে দেখা গেল। তবু কালীঘাটের পটে রং প্রয়োগের চটকদারি ঘটেনি। ওড়িশি চিত্র, গুজরাতি চিত্রে রঙের প্রয়োগ
ছিল হালকা ধরণের। অবশ্য শেষ দিকে গুজরাতি চিত্রে রঙের ব্যবহার বেশ তীব্র হয়ে ওঠে।
এইসব পটে পটুয়ারা প্রাচীন ধারা বর্জন করেছেন। কালীঘাটের পটুয়াগণ মিশ্র পেশার মানুষ
ছিলেন। কাঠের কাজ, মন্দির তৈরি, পুতুল তৈরি, প্রতিমা তৈরির অভ্যাসের
অভিজ্ঞতা উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের মধ্যে ছিল। তাই কালীঘাটের পটচিত্রে সেই
অভিজ্ঞতা স্পষ্ট। কালীঘাটের পটচিত্রে সেই মূর্তিত্বসুলভ ঘনত্ব রয়েছে।
খুব দ্রুত বেগে নগরের রুচি
বদলে যায়। কালীঘাটের পট এক যুগসন্ধিক্ষণের ফসল ও শিকার। ১৭ শতকের কালীঘাট
কেন্দ্রিক পটশিল্প আঘাত পেলেও ১৯ শতকের ইংরাজি শিক্ষিত নব্যবঙ্গের শিক্ষিত সমাজের
কাছে। মেয়েলি ব্রত আচার পুষ্ট কালীঘাটের পট ধর্মীয় ঠাট নিয়ে নব্য শিক্ষিতের
ড্রইংরুম থেকে নির্বাসিত হল অন্দরমহলে। পটুয়াগণ তখন প্রমাদ গুনলেন। বাঁচার
সংগ্রামে তাঁরা নতুন করে তুলিতে আঁচড় কাটলেন। ব্যঙ্গ করলেন নতুন সমাজের ব্যভিচারকে।
যাঁরা মেয়েলি আচার পুষ্ট পটকে অন্দরমহলে ঢুকিয়েছিলেন তাঁরাই ব্যঙ্গ রসাত্মক নব
বৃন্দাবনের পটকে আবার ড্রইংরুমে নিয়ে এলেন। ততদিনে এ দেশে এসে গেছে বিদেশী
চিত্রশিল্পী। তার রং তুলির নতুন নৈপুণ্য। কালীঘাটের পটুয়াগণ ঐসব শিল্পকে সুনজরে
দেখেনি। দেখেছিলেন বৈরিতার নজরে। বিদেশী শিক্ষার সঙ্গে বিদেশী চিত্রশিল্পের
জোয়ারের তীব্রতায় ধীরে ধীরে পরাজিত হতে শুরু করল কালীঘাটের পটশিল্প। যদিও কালীঘাটের
কিছু কিছু পটুয়া বিদেশে অয়েল পেইন্টিং, এনগ্রেভিং অনুশীলন শুরু করেছিলেন, তবু তার মধ্যে যেটা ছিল তা হল
তাঁদের ছিল গ্রামীণ রুচির প্রতি শ্রদ্ধা। আর বিদেশী শিল্পকলার সঙ্গে আন্তরিক
শত্রুতা। চিত্রশিল্পের বাজারে শুরু হল এক অসম প্রতিযোগিতা। কালীঘাটের পটুয়াগণ
দ্বিমুখী দ্বন্দ্বে বিক্ষত হলেন। একদিকে পুতুলের মায়াময় জগত, প্রতিমা নির্মাণের রূপকথা, নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি তুলি
রং তার ব্যবহারের প্রথানুসৃত ও উত্তরাধিকার। অন্যদিকে নব্য পদ্ধতির প্রতি অজ্ঞতা ও
ক্ষীণ আকর্ষণ। চিত্রশিল্পের নতুন বিদেশী জোয়ারকে বরণ করার শিক্ষা দীক্ষা ও
মানসিকতা তাঁদের মধ্যে ছিলনা। আর ছিলনা জোয়ারে ভেসে যাওয়ার উদ্দাম মানসিকতা।
শিক্ষা ও চেতনার উর্বর ভূমিতে তাই রুদ্ধ হল কালীঘাটের পটের জয়যাত্রা।