Wednesday, February 20, 2013

থাবা -- কৌস্তুভ


আমরা নিরামিষ ব্লগার। গোল্ডেন গেট ঘুরে এসে ট্রাভেল ব্লগ লিখি, চীজকেক রাঁধতে শিখলে রেসিপি পোস্ট দিই। এর মাঝেই মমতার কার্টুন শেয়ার করে প্রফেসরের হেনস্থার প্রতিবাদে স্যাটায়ার লিখি, বইমেলায় রুশদিকে ঢুকতে না দেওয়ার লজ্জায় ধিক্কার জানাই। কিন্তু ব্লগিং যে এক লহমায় আমাদের ভূতপূর্ব ব্লগার করে দিতে পারে, এমনটা কল্পনা করি না।

রাস্তাঘাটে পথদুর্ঘটনায় রোজই অনেক লোকের মৃত্য হচ্ছে, সে খবরগুলো পড়তে খারাপ লাগলেও রোজকার ডালভাত হজমে সেগুলো কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু যদি বাসের ধাক্কায় মৃত পথচারীটি হয় আমারই বন্ধু, তাহলে সেই ড্রাইভারের প্রতি আক্রোশটা অসহনীয় রকমের তীব্র হয়ে ওঠে। যার ফান-পোস্টারে লক্ষ্মীর পরনের স্কটিশ কিল্ট নিয়ে এই সেদিনও হাসাহাসি করেছি, যার স্যাটায়ারের মান আরো ধারালো করার জন্য সমালোচনা-ভরা উৎসাহ দিয়েছি, যখন খবর পেলাম যে আমার সেই সহব্লগারকে গলা কেটে খুন করে তারই বাড়ির সামনে ফেলে গেছে কিছু লোক, তখন আর সারাদিন কাজ করতে পারিনি ।

থাবা বাবা

সুনন্দদার সূত্রে নাস্তিকীয় বিনোদনের ব্লগ ধর্মকারী সম্পর্কে অনেকেই হয়ত পরিচিত। এই ব্লগেই ‘থাবা বাবা’ নিক নিয়ে ব্লগিং করতেন বাংলাদেশী স্থপতি আহমেদ রাজীব হায়দার। বাংলাদেশের ইসলামিক পরিবেশ ও মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসায় ইনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করাতেই ছিলেন সবচেয়ে আগ্রহী, নবী মোহাম্মদের জীবনী নিয়ে টুকরো-টুকরো স্যাটায়ার পোস্ট করতেন নিয়মিত। কমেন্টেও আমাদের সঙ্গে অল্পবিস্তর আড্ডা হত। অন্যান্য ধর্মের অপকর্ম নিয়েও বেশ আগ্রহ থাকায় আমার হিন্দুধর্ম বিষয়ের পোস্টগুলোতে প্রায়ই মন্তব্য করে যেতেন। এছাড়াও আরো দুয়েকটা বাংলাদেশী ব্লগে দেখা যেত ওঁকে। কিন্তু ঠিক কী পরিস্থিতিতে মৌলবাদীরা টার্গেট করে তুলল ওঁকে, তা বুঝতে হলে আমাদের- পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের- সংক্ষেপে একটু বুঝে নিতে হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু বাংলাদেশী অতিধার্মিক মানুষজন মনে করত, এই পবিত্র ইসলামি দেশ পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা তাদের পবিত্র কর্তব্য। এরা সেদেশে উপস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় স্থানীয় মানুষের বাহিনী গড়ে তোলে যারা সেনাদের সঙ্গে মিলে স্থানীয় জনতার উপর খুন-জখন-ধর্ষণ ইত্যাদি চালিয়ে যেত। বরিশাল-আগত আমার ঠাকুর্দার মখে শুনেছি কীভাবে এরা পাকি বাহিনীর অগ্রদূত হয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে চিনিয়ে দিত হিন্দুদের বাড়িগুলো, ধরিয়ে দিত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারদের। এদেরকে বলা হত রাজাকার।

কিন্তু স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ এদের ঘৃণ্য কাজকর্মের বিচার করার সুযোগ পায় নি। সেনাবাহিনীর ক্যু ও বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসেন মেজর জিয়া, যিনি শক্তি বাড়ানোর জন্য কট্টর ইসলামিস্টদের সাথে হাত মেলানোই শ্রেয় মনে করেন। তিনি এদের ক্ষমা করে দেন ও পাকিস্তান ইত্যাদি জায়গা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন বড় বড় চাঁইদের। তারা তাদের পুরোনো রাজনৈতিক দল, জামাত-এ-ইসলামী'তে আবার ভিড়ে যায় সক্রিয়ভাবে। এরপর আরেক ক্যু’য়ে জিয়াও নিহত হন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক গণ্ডগোল চলতেই থাকে। জিয়া’র বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়া (বিএনপি’র নেত্রী) আর মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা (আওয়ামী লীগের নেত্রী) পরষ্পরের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ান। ২০০১-এ বিএনপি’র সঙ্গে জোট করে জামাত ক্ষমতায় এলে এই এককালের বাংলাদেশ-বিরোধী রাজাকাররাই দেশের মন্ত্রী হয়ে দাঁড়ায়, আর ফের দেশজুড়ে লীগকর্মী-মুক্তিযোদ্ধা-হিন্দু পরিবারদের টার্গেট করে।

কয়েক বছর আগে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার শীর্ষ রাজাকারদের বিচার শুরু করে। বলাই বাহুল্য, জামাত এই ট্রাইবুন্যালকে বলে ক্যাঙারু কোর্ট, বিএনপি এই বিচার বন্ধ করে ‘আন্তর্জাতিক মানের আইনি প্রক্রিয়া’র দাবী জানায়, আর সাধারণ মানুষ যাদের অনেকের পরিবার দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে নিহতদের ক্ষত বয়েছে তারা অবশেষে বিচার পাওয়ার আশায় উল্লসিত হয়। ফেব্রুয়ারির শুরুতে গ্রেপ্তারকৃত কয়েকজনের মধ্যে প্রথম রায় হয় ‘মিরপুরের কসাই’ নামে কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, বহু খুনের মামলায় তার সরাসরি জড়িত থাকা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হলেও আদালত তাকে খুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে স্রেফ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
এতে সবাই বাক্যহারা হয়ে পড়ে। বিশেষত ইন্টারনেটে দ্রুত ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একদল ব্লগার ওই দিনই ঢাকার শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। জলদিই দেখা যায়, সেখানে জড়ো হয়ে গেছেন হাজার হাজার মানুষ, বাচ্চা কোলে মা থেকে বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা। এঁদের দাবী, শীর্ষ রাজাকারদের ফাঁসি চাই, আর তাদের দল জামাতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। শাহবাগ গেলে রিকশাওয়ালা ভাড়া নিচ্ছেন না, এমন ঘটনার খবরও নেটে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আরো লোক ডেকে আনে। এ-পার বাংলাতেও কবীর সুমন থেকে দোহার শাহবাগের সমর্থনে গান বাঁধেন। অবশ্য অনুমান করাই যায় যে সরকারের এর পেছনে পরোক্ষ সমর্থন আছে, তবুও এটা একটা রাজনীতি-নিরপেক্ষ সমাবেশ ছিল। যে-কোনো দলের নেতানেত্রীই বক্তৃতা দেবার বাসনায় মঞ্চে উঠতে গেলে জনতার ধমক খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

এতদিন অবধি জামাতের অভ্যাস ছিল অবাধ শক্তিপ্রদর্শনের। অকুতোভয় লেখক হুমায়ূন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছিল তারা, কলেজে তাদের শক্তিবিস্তারে বাধা দেওয়ায় প্রতিপক্ষ ছাত্রদলের সভাপতির হাত কেটে বর্শার ফলায় টাঙিয়ে বিজয় মিছিল করেছিল তারা। মানুষের এহেন কাজকর্ম দেখে হকচকিয়ে গেলেও ঢাকা সহ দেশের নানাদিকে বোমা ফাটানো থেকে খুনজখম চালানোর পাশাপাশি দ্রুত একাধিক স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নেয় তারা। ‘শাহবাগ আন্দোলন নাস্তিক ও বেলেল্লাদের আখড়া, কোনো ভদ্র মুসল্লি ওখানে যাবেন না’ বলে প্রচার করতে থাকে দেশের নানাস্থানে, এবং বিশেষ করে ইন্টারনেটে। বাংলা ব্লগজগত, যেটা মূলত বাংলাদেশী-অধ্যুষিত, তাতে সৌদি-তুর্কীর টাকায় জামাতের আস্তানায় প্রতিপালিত বহু মর্কট ঘুরে বেড়ায় যাদের কাজ হল যথাসম্ভব নিজেদের দলের কোলে ঝোল টানা, ইসলামী নয়ত যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে। এদের বলা হয়ে থাকে ‘ছাগু’। এরা নানা ফটোশপ করা ছবির মাধ্যমে ব্লগে-ফেসবুকে ওই কথাগুলোই ছড়িয়ে দিতে থাকে। আরো একধাপ এগিয়ে এরা শাহবাগের সমর্থনে পেজ খুলে মূল ব্লগারদের সঙ্গে ভাব করে নেয়, এবং শাহবাগের ভিড়ে মিশে যেতে থাকে, উদ্যোক্তাদের থেকে খবরাখবর বার করে নিতে থাকে।

রাজীব ছিলেন এই শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা। জামাত দেখে যে একে টার্গেট করলে বিশেষ লাভ, কারণ ওঁর ইসলামবিরোধী পোস্টগুলো দেখিয়ে লোকেদের দেখানো যাবে যে শাহবাগ আসলেই কিছু নাস্তিক-বেয়াদপদের আখড়া, এদের থেকে দূরে থাকুন। ওঁর ন্যক্কারজনক নাস্তিকতাকে হাইলাইট করে তাদের ব্লগে একটা পোস্ট আসে। এবং সেটাই ছিল এই মুরতাদ(ধর্মত্যাগী)কে তার প্রাপ্য দোজখে পৌঁছে দেওয়ার ব্লুপ্রিন্টের প্রথম ধাপ। তার কিছুদিনের মধ্যেই, দেশের হিসাবে গত শুক্রবার রাত্রে, শাহবাগ থেকে বাড়ি ফেরার পর রাজীবের মোবাইলে আবার ফোন আসে, তিনি বাড়ি থেকে বলে বেরোন যে আবার একটু ওখানে যেতে হবে। তার কয়েক ঘন্টা পরেই পাড়ার লোক বাড়ির সামনে তাঁর চাপাতি দিয়ে কোপানো লাশ দেখতে পায় অন্ধকারে পড়ে থাকতে। পকেটে মোবাইল অক্ষত ছিল, লাশের পাশে রাখা তাঁর ল্যাপটপ আর তার উপরে সযত্নে রক্ষিত একটি চাপাতি।

এই কাজটার মাধ্যমে জামাত এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারে। যারা শাহবাগে জড়ো হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, তাঁদের মনে অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। এতদিন আন্দোলন করে কী পেলাম, না ফাঁসির রায় না জামাত নিষিদ্ধ হওয়া, বরং তারা এক সহযোদ্ধাকেই খুন করে গেল, এই মনোভাবটাও জেগে উঠতে থাকে। আর এর মধ্যেই দেখা যায়, নেটে বহু মানুষ যারা এমনিতে শাহবাগের প্রতি সহানুভূতিশীল তাঁরাও থাবা বাবার ব্লগগুলি শেয়ার দিয়ে বলছেন, এমন একটি মানুষকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে আমরা মোটেই অখুশি নই। অর্থাৎ বিরুদ্ধ জনমতের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করে দেওয়া এবং বড় একটা ধর্ম-সহানুভূতিশীল অংশকে নিজেদের পক্ষেই নিয়ে আসা, এটাতেও জামাত সফল।


তবে ভাল ব্যাপার এইটুকু, যে শাহবাগে উপস্থিত জনতার এক বড় অংশ এই প্রচারে বিচলিত হয়ে আন্দোলন ছেড়ে যায় নি, বরং রাজীবের হত্যা তাদের ক্ষোভ আরো তীব্র করেছে। পরের দিন রাজীবের মরদেহ নিয়ে শোকযাত্রা আসে শাহবাগে, উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে গার্ড অফ অনার দেন। রাজীবের বাবা নিজেও প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিসৌধ রাজীবেরই নকশায় করা হবে বলে স্থির হয়েছে জানা যায়


লন্ডনের সময়ে শুক্রবার দুপুরে ডিপার্টমেন্টে বসে ফেসবুকে যখন দেখি এক বন্ধু স্ট্যাটাস দিয়েছে ‘থাবা বাবা নাকি খুন হয়েছে?’, তখন সেটা নেহাতই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কিন্তু খোঁজ নিতে গিয়ে দ্রুতই জানতে পারি যে খবরটা সত্যি, টিভিতে দেখাতে আরম্ভ করেছে। ব্লগগুলোয় পোস্ট আসতে থাকে, এমনকি রিচার্ড ডকিন্স ফাউন্ডেশনও এটাকে নিউজ করে। অন্যদিকে পাকি ফোরামে শুরু হয়ে যায় জশনে-জলুশ। ওই দিনই একটা প্রোজেক্ট শেষ করে কলাম্বিয়ায় পাঠানোর কথা থাকলেও কাজ করার বৃথা চেষ্টা শেষে সন্ধ্যাবেলা হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, অপেক্ষাকৃত হেভিওয়েট ব্লগাররা থাকতেও কেন আমাদের বন্ধুকেই প্রথম টার্গেট করা হল? উত্তরটা সম্ভবত তাঁর অদম্য উদ্যম। ভালো হোক, মন্দ হোক, ধর্মকারী ও অন্যান্য ব্লগে ইনি যেমন প্রবল উদ্যমে লেখা-গদ্য-কবিতা পোস্ট করে যেতেন, তেমনই উদ্যমে শাহবাগে সারাদিন স্লোগান দিয়ে যেতেন। ওঁর এক শিক্ষক সাক্ষাৎকারে একই কথা বললেন, ‘রাজীব প্রবল উৎসাহে নানারকম আর্কিটেকচারের নকশা করে নিয়ে আসত, সেগুলো সবসময় ভালো হত না, কিন্তু ওর উদ্যমী মুখটার দিকে তাকিয়ে সে কথা আর বলতে পারতাম না।’ নাস্তিকতা বিষয়ে এই উদ্যমই তরুণ থাবা বাবাকে থিও ভ্যান গখের পরিণতিতে ঠেলে দিল। এবং দুনিয়া থেকে যতদিন না ধর্মীয় মৌলবাদ বিলুপ্ত হবে, ততদিন এর থাবা আরো কতজনকে গ্রাস করবে তা কে জানে?

********************************************************************************
থাবা বাবার কিছু লেখা:

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই