Monday, June 4, 2012

ঠাণ্ডা লাভা(Lava)- ১ -- সুনন্দ

Link


স্ট্রবেরী ওয়াইল্ড অর্থাৎ বুনো হলে তার স্বাদ বেড়ে যায় কে জানতো? বিশেষ করে তা যখন পাওয়া যায় এমন এক রাস্তার ধারে, যা বরাবর চলতে চলতে
মাঝে মধ্যেই মনে নিকো পার্কের বাচ্চা রোলার-কোস্টারের কথা উঁকি দিয়ে যায়? হলুদ রঙের এবড়ো খেবড়ো ওই ফলগুলোকে স্ট্রবেরী বলে মানতে বেজায় আপত্তি থাকলেও মুশকো জোয়ান ড্রাইভার (যার হাতে প্রাণের জিম্মা দিয়ে চলেছি পাঁচ ভেতো বাঙালি) জোর দিয়ে বললো যখন- আপত্তি করে কার বাপের সাধ্যি? পরে দেশে ফিরে দেখি ওগুলোকে সত্যিই ভারতীয় স্ট্রবেরী (Mock Strawberry) বলে- এই দেখুনতবে গল্পটায় অনেক এগিয়ে গেছি, তার আগের কিছু ঘটনা না বলে নিলে আপনারা থই পাবেন না।
মাত্র দুদিনের তোড়জোড়ে হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চাট্টি অরুণ এবং একজন কিরণমালা। লক্ষ্য- কলকাতার প্লাস্টিক ব্যাগটা থেকে বেরিয়ে একটু দম নিয়ে আসা- সম্ভব হলে ঠাণ্ডা কোথাও। কিভাবে কি করেছি, তার বিবরণ পরেই দেবোখন (আপনাদের সুবিধের জন্যেই), আপাতত ধরে নিন, দুম করে আমরা এসে পড়লাম সেবক ব্রিজের ধারের এক সরাইখানায় (সেখানে অবশ্যি থাকতে দেয়না, কিন্তু সরাইখানা বললে বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ আসেনা?)- দুপ্লেট লাল রঙের অতি সুস্বাদু ছোলা বাটোরা আর দুপ্লেট তড়কা-রুটি গোগ্রাসে গিলতে। সঙ্গের ড্রাইভার সেয়ানা লোক, মাঝেমধ্যেই বুzলেন তো, বুzলেন তোবলে অনেক কিছু জপানোর চেষ্টা করছে আর আমি সামনে বসে থাকায় সে সবের উত্তরও দিতে হচ্ছে আমাকেই। শেষ অবধি আর উপায় না দেখে ওর কোন কথায় কান না দিয়েই আমি হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক কথাবলতে শুরু করেছিলাম।
গাড়ি চললো সেবক ছাড়িয়ে বহুদূর- মাঝে পড়লো অনেক চা-বাগান, যার একটারই নাম আমার পরিচিত- Goodricke- সে যাকগে, গরুবাথান পেরোলাম যখন, (আগেও ওই রাস্তায় একবার গেছি, আর তখন ওখানে জায়গায় জায়গায় টাঙানো ‘Welcome to Gorkhaland’ পোস্টার দেখে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ গুরুগম্ভীর আলোচনা হয়েছিল, নইলে কোন একটা জায়গার নাম আমি মনে রেখেছি- এ আমার শত্তুরেও বিশ্বাস করবে না) মনে আশা জাগলো, এইবার হয়তো গরমটা একটু হলেও কম লাগবে। হলোও তাই- সর্পিল রাস্তা দিয়ে গাড়ি যতই ওঠে, দূরে পাহাড়ের গায়ের মেঘগুলো ততই আরো কাছে আসতে শুরু করলো। একসময় দেখা গেলো আমাদের চারদিকে মেঘ আর মুখভরা হাসি। সেই যে তখন শুরু হলো শালা এখানেই থেকে যাবোবলা, সেটা একেবারে ফিরে আসার সময়েও থামেনি। লাভায় আমাদের বুকিং ছিলো Orchid হোটেলে। টাউনের মাঝখানে, একটা ভীষণরকম চড়াইয়ের শেষে, ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের একদম গায়ে। দুনিয়ায় চিরকাল যা হয়ে এসেছে, তাই হলো। কমদামী ঘরটায় পাওয়া গেলো বিশাল ব্যাল্কনি, যা দিয়ে মেঘের রাজ্য দেখা যায়(পরে আমাদের ঘরেও মেঘ ঢুকে পড়েছিলো) আর বেশি দামের ঘরটার বেশি দামের কারণ হলো একখান বস্তাপচা টিভি, যেটা একবারও অন করা হয়নি। তবে সবাই ঘুমোতে যাওয়ার সময়টুকু ছাড়া নিচের তলার ব্যাল্কনিতেই কাটিয়েছিলাম বলে আলাদা কিছু বোঝা যায়নি। বিকেল করে পৌঁছেছিলাম বলে কোথাও না গিয়ে লাভা পায়ে হেঁটে ঘোরা মনস্থ করলাম। সে কি জায়গা, কি বলবো মশাই, বাচ্চাগুলো থেকে শুরু করে কুকুরগুলোর পর্যন্ত বেজায় দেমাক, কিন্তু বড্ড শান্ত। আমরা সক্কলে জানি পাহাড়ের মানুষ খুব পরিশ্রমী হয়- কিন্তু ঠিক কতটা, নিজের চোখে না দেখলে মোটেই মনে থাকেনা- যতবার দেখি, তত ভুলে যাই।
আমরা ঘুরে বেড়ালাম অন্ধকার নামা অবধি- চড়াই-উতরাই বেয়ে, জোঁকের ভয় এড়িয়ে, বিজাতীয় গরু আর ফুলো ফুলো কুকুরের পালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। খাওয়ার পরের সিগারেটের মতো করে টান দিলাম অক্সিজেনের ভাগ কম পড়া বাতাসে, ন্যাড়া টিলায় দাঁড়িয়ে গলা খুলে চিৎকার করলাম পাহাড়ি টারজানের মতো, ঝাউবনের canopy দেখে আহ্লাদ করলাম আর মনকে বারে বারে ধমকে ভুলিয়ে রাখলাম যে দুদিন পরেই এখান থেকে চলে যেতে হবে।
রমেশ
পরদিন সকালে আমার মতো লেট-লতিফও উঠে পড়লাম সকাল সাড়ে পাঁচটায়, ভাবা যায়! ঘুম থেকে উঠে স্নান করে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে, ক্যামেরা বগলদাবা করে আমরা, পাঁড় কলকাত্তাইয়ারা সকাল সাতটায় বেরিয়ে পড়েছি হাঁটতে, ভাবতে পারেন? আমরা যাবো লাভা থেকে রিশপ, পায়ে হেঁটে- ফিরবোও সেভাবেই। দলের কিরণমালা আগের দিন থেকেই গাঁইগুঁই শুরু করেছিলো হেঁটে যেতে পারবে না, জোঁক ধরবে- এইসব নানা বাহানা করে। তাকে ফেলে চলে আসার হুমকি দেওয়ায় গোমড়া মুখেও সে যেতে রাজি হয়েছে। আমাদের গাইডের নাম রমেশ। কতক্ষণের রাস্তা জিজ্ঞেস করায় সে অবজ্ঞার হাসি হেসে বললো- আমাদের জন্যে কম সে কম একঘণ্টা, যদিও তারা ওই রাস্তা আধঘণ্টায় পৌঁছে যায়। বীরদর্পে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা কজন।
মাত্র মিনিটখানেকের মধ্যে আমাদের জিভ বেরিয়ে বুকে। কি রাস্তা! খাড়া উঠে গেছে শোঁ শোঁ করে। তার ওপরে আমাদের জানা নেই আর ঠিক কতক্ষণ চলবে এই চড়াই, তাই মুখে কিছু না বললেও আমি তো বেশ ঘাবড়েই গেলাম- এই ঘটোৎকচের মতো চেহারায় চলতে চলতে ফুসফুস আবার হাপর না হয়ে যায়। কখনো জঙ্গুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে, কখনো ছাগল-চরা পথে হাঁটতে গিয়ে একবারও যে উল্টোদিকে যাওয়ার কথা ভাবিনি তার কারণ- অসাধারণ সৌন্দর্য! দুপাশে নেমে গেছে খাদ, একদিকে অনেক নিচে পিচের রাস্তা, অন্যদিকে অতল বুনো গহ্বর। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য রমেশের অভয়বাণী সত্য প্রমাণ করে আমরা বেশ কিছুটা ভালো রাস্তায় উঠে এলাম। সে রাস্তার সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতো শব্দ বা বাক্য আমার শহুরে কি-বোর্ডে নেই। অরুণ নম্বর ১ এর কথা ধার করে বলতে হয়- বিভূতি পাতার পর পাতা কেন যে লিখেছিল বুঝতে পারছি মাইরি...। দুজন পাতলা সদস্য আর দলের মেয়েটি জোর কদমে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এগিয়ে চলে গেছে- পিছনে পড়ে আছি দুই ক্যামেরা-বাহক অপোগণ্ড। এদিক ওদিক তাক করে করা shutterbug এর খচর খচর মিশে যাচ্ছে অজস্র পোকা আর পাখির ডাকের সাথে।
কখনো ওই রাস্তা দিয়ে উঠে আসছে একপাল গরু নিয়ে সুন্দরী দুটি মেয়ে (যাই বলুন, অমন জায়গায় সক্কলকে সুন্দর দেখায়), কখনো রিশপে বেড়াতে আসা, গামবুট পরিহিত স্বামী-স্ত্রী, যাদের দেখে মনে আশা জাগে, এরা যখন পারছে, আমিও পারবো পুরো রাস্তা যেতে-আসতে।
রিশপে পৌঁছে আমরা গিয়ে বসলাম নেওড়া ভ্যালী রিসোর্টের ক্যাম্পাসে। ঢালু পাহাড়ের গায়ে ফুটে আছে যত্নে সাজানো ফুল আর ততোধিক যত্নে সাজানো ছোট্ট ছোট্ট কটেজ। চারপাশে নানা বয়সের
, নানা চেহারার কুকুর- কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ পাশে এসে বসে আছে- ভাবটি যেন মোটেই পাত্তা দেয়না আমাদের, কিন্তু বিস্কিটের প্যাকেট বের করতেই ঘাড় ঘুরিয়ে চলে আসবে কাছে। একটা কালো আর দুটো তামাটে কুকুর এর পর সারা রাস্তা (রিশপ থেকে লাভা) এসেছিলো আমাদের সাথে।


ফিরতি পথে এক মজার কাণ্ড। যখন প্রায় লাভা পৌঁছে গেছি, বেশ কয়েকবার জিরিয়ে নেওয়ার পরে- মানে সেই সরু ছাগল-চরা বুনো রাস্তাটা বেয়ে এখন নামার পালা, তখন আমাদের পায়ে পায়ে চলা কুকুরগুলো হঠাৎ করে বেদম ডাকতে শুরু করলো। তখন আমরা নামছি এমন একটা সিঁড়ি বেয়ে, যার ধাপগুলো তৈরি হয়েছে কোন এক গাছের শিকড় মাটি ঘিরে ধরার ফলে। দুপাশে একটুও জায়গা নেই সরে যাওয়ার। এমতাবস্থায় পিছন থেকে ধুপধুপ শব্দ আর টুং টুং ঘণ্টির আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একপাল ছাগল সেই ঢাল বেয়ে বিপজ্জনক গতিতে নেমে আসছে আমাদের দিকে। আমরা যখন প্রমাদ গোনায় ব্যস্ত, তখন আমাদের পিছন থেকে কালো রঙের দলের পাণ্ডা কুকুরটা, যেটা প্রচুর ভাব দেখিয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলো, ডাকতে ডাকতে চলে এলো আমাদের সামনে। এমন ভাবে ঘিরে ধরলো রাস্তাটা, যে ছাগলগুলোর আর এগনোর পথ রইলো না সামনে। ওরা কতকটা বাধ্য হয়েই নেমে গেলো পাশের ঢাল বেয়ে, যেখান দিয়ে মানুষের পক্ষে নামা অসম্ভব না হলেও বেদম কঠিন কাজ। এরপর সেই সারমেয়-প্রধান আবার একই র‍্যালা নিয়ে এগোতে শুরু করলেন আমাদের সামনে সামনে। লাভা পৌঁছে আমরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছি, তখন ও আমাদের পাশেই বসে ঝিমোচ্ছিলো। বিস্কিট খেতে দিলাম, একবার শুঁকেই মাথা ঘুরিয়ে নিলো। আমার ব্যাখ্যা ছিলো, ও বলতে চাইছে, ‘এসেছি লোক পছন্দ হয়েছে বলে, এর মধ্যে আবার দেনা-পাওনা কিসের বাপু?’ আমার গিন্নির বক্তব্য, ‘বিস্কিটে ক্রিম ছিলো, তাই খায়নি, জানে লোম পড়ে যাবে। কে জানে, আমার কিন্তু নিজের ধারণাটাই ঠিক মনে হচ্ছে।
চলবে...

ছবি: সুনন্দ

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই