সুদীপ একটি ছেলের নাম। অক্লান্ত জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া কোন এক
বাবা-মায়ের হতাশা আর চাওয়া-পাওয়ার বেহিসেবের মাঝে হঠাৎ ভুল করেই
হয়তো বা জন্মে যাওয়া একটি ছেলে। দুম্ করে চমৎকার কিছু একটা করে ফেলার কথা তার ছিল না। সবাইকে চমকে দিয়ে খবরের শিরোনামে চলে আসার মত কোন ক্ষমতাও ছিল না। হয়ও নি সেরকম কিছু। আর পাঁচটা নিম্নমধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারে আগাছার মত নেহাতই অযত্নে বড় হয়ে উঠছিল সে। বাবা-মা'র ঘাড়ে কতকটা বোঝা আর তাঁদের ভেসে যেতে যেতে আঁকড়ে ধরে থাকা খড়কুটোর মত অনাগত ভবিষ্যতের কোন এক উজ্জ্বল স্বপ্ন হয়ে। পাড়ার ও স্কুলের সমবয়সীদের সাথে সমানভাবে মেশায় কোথাও যে একটা বাধা আছে, সেটা সে খুব কম বয়সেই টের পেয়েছিল। তারা ঠিক যে সমস্ত বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলত তার বেশীরভাগটাই তার অজানা আর অদেখা। প্রবল আগ্রহসহকারে সেসব নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হাসি-ঠাট্টার সম্মুখীন হওয়ার পর বন্ধুদের সাথে তার দূরত্বও বেড়ে গেছিল বেশ কিছুটা। স্কুলে বা বাড়িতে তাই বেশীরভাগ সময়টাই সে কাটাত নিজের সাথে আর তার ছেঁড়াখোঁড়া বইগুলোর সাথে। ছেলের সব বই কিনে দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলেও পরিচিত লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো, বাতিল পড়ার বইগুলো কি করে যেন খুঁজে খুঁজে ঠিক নিয়ে আসতেন সুদীপের বাবা। ক্লাস এইটের পর গ্রামের স্কুলে আর লেখাপড়া হত না তাঁর আমলে। তাই তাঁর প্রবল আগ্রহ সত্ত্বেও পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়েছিল তখনি। ছেলের লেখাপড়ার দিকে তাই সতর্ক নজর ছিল তাঁর ছোট থেকেই। সুদীপ মেধাবী ছাত্র ছিল। যা পড়ত চট করে শিখে ফেলত নিজে নিজেই। এই একটা কাজ যে সে ভালোই পারে, এমনকি তার নাকউঁচু বন্ধু-বান্ধবগুলোর থেকেও...... সেটা সুদীপ উপলব্ধি করে একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার পরই। তার পর থেকেই একটা জেদ ওকে পেয়ে বসে। তথাকথিত সমাজের সমস্ত অবজ্ঞা, অপমান আর তার হীনমন্যতার জবাব হিসাবে সে বেছে নেয় পরীক্ষার খাতাকে। পড়াশোনার প্রতি ওর আগ্রহ ছিল ছোট থেকেই। বা হয়তো তার পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার খবর শুনে বাবা-মায়ের বাঁধভাঙ্গা হাসি আর চোখের জল প্রতিজ্ঞার মশাল জ্বেলে দিয়েছিল ওর ছোট্ট বুকটায়। আমি জানি না। আমি যখন সুদীপকে দেখি তখন ও অনেকটা বড়। গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ চুকিয়ে উচ্চ-মাধ্যমিকে ভর্তি হতে এসেছিল আমাদের স্কুলে। ওই অঞ্চলে আশেপাশের সমস্ত গ্রামগুলোর মধ্যে আমাদের স্কুলটাই ছিল সবচেয়ে বড় আর নামী। আশেপাশের স্কুলগুলোতে আবার বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগও ছিল না। তাই ওই সমস্ত জায়গাগুলো থেকে ভালো ভালো ছাত্ররা আমাদের স্কুলেই চলে আসত মাধ্যমিকের পর। কিছুদিনের মধ্যেই সুদীপের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। খুব সরল সাদাসিধা, বুদ্ধিমান আর আমার মতই প্রচণ্ড কম কথা বলা এই ছেলেটিকে নতুন এক বন্ধু হিসাবে পেয়ে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। তো যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই সুদীপের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে স্কুলের স্যারেরাও মুগ্ধ আর সাথে কিছুটা বিষণ্ণও ওর বাড়ির অবস্থার কথা জেনে। একদিন তো এক শিক্ষক বেশ খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে আমাকে (পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম) দেখিয়ে ওকে বলেই ফেললেন, “পারবি না? পারবি না ওদের সাথে লড়াই করে ওদের হারিয়ে দিতে? ওদের সবাইকে পিছনে ফেলে দিতে”? আমি আবার স্কুলের অনেক পুরনো আর ভালো ছাত্র...... ঐ শিক্ষকও আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষকদের একজন। তাও বিশ্বাস করুন, একটুও খারাপ লাগেনি সেদিন। সুদীপের বাড়ির অবস্থা জানার পর ভেবেছিলাম বলি, “তুই আমার বাড়ি চলে আয়। আমার তো সবই অতিরিক্ত! সমস্ত বই, টিউশনের নোট.... তোর যা লাগে, নিয়ে যা। তোর থেকে কম নাম্বার পেতে আমার একটুও খারাপ লাগবে না।”...... বলতে পারি নি। অনেক ভয় ছিল, বাবা-মা কি বলবে, পাকামি হয়ে যাবে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য পরে আমাদের সমস্ত শিক্ষকরাই ওকে বিনা পয়সায় টিউশন পড়িয়েছিলেন দু'বছর, বইপত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন যথাসাধ্য। সুদীপের 'ভাগ্য ভালো' ছিল বলতে হয়।
হয়তো বা জন্মে যাওয়া একটি ছেলে। দুম্ করে চমৎকার কিছু একটা করে ফেলার কথা তার ছিল না। সবাইকে চমকে দিয়ে খবরের শিরোনামে চলে আসার মত কোন ক্ষমতাও ছিল না। হয়ও নি সেরকম কিছু। আর পাঁচটা নিম্নমধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারে আগাছার মত নেহাতই অযত্নে বড় হয়ে উঠছিল সে। বাবা-মা'র ঘাড়ে কতকটা বোঝা আর তাঁদের ভেসে যেতে যেতে আঁকড়ে ধরে থাকা খড়কুটোর মত অনাগত ভবিষ্যতের কোন এক উজ্জ্বল স্বপ্ন হয়ে। পাড়ার ও স্কুলের সমবয়সীদের সাথে সমানভাবে মেশায় কোথাও যে একটা বাধা আছে, সেটা সে খুব কম বয়সেই টের পেয়েছিল। তারা ঠিক যে সমস্ত বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলত তার বেশীরভাগটাই তার অজানা আর অদেখা। প্রবল আগ্রহসহকারে সেসব নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হাসি-ঠাট্টার সম্মুখীন হওয়ার পর বন্ধুদের সাথে তার দূরত্বও বেড়ে গেছিল বেশ কিছুটা। স্কুলে বা বাড়িতে তাই বেশীরভাগ সময়টাই সে কাটাত নিজের সাথে আর তার ছেঁড়াখোঁড়া বইগুলোর সাথে। ছেলের সব বই কিনে দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলেও পরিচিত লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো, বাতিল পড়ার বইগুলো কি করে যেন খুঁজে খুঁজে ঠিক নিয়ে আসতেন সুদীপের বাবা। ক্লাস এইটের পর গ্রামের স্কুলে আর লেখাপড়া হত না তাঁর আমলে। তাই তাঁর প্রবল আগ্রহ সত্ত্বেও পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়েছিল তখনি। ছেলের লেখাপড়ার দিকে তাই সতর্ক নজর ছিল তাঁর ছোট থেকেই। সুদীপ মেধাবী ছাত্র ছিল। যা পড়ত চট করে শিখে ফেলত নিজে নিজেই। এই একটা কাজ যে সে ভালোই পারে, এমনকি তার নাকউঁচু বন্ধু-বান্ধবগুলোর থেকেও...... সেটা সুদীপ উপলব্ধি করে একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার পরই। তার পর থেকেই একটা জেদ ওকে পেয়ে বসে। তথাকথিত সমাজের সমস্ত অবজ্ঞা, অপমান আর তার হীনমন্যতার জবাব হিসাবে সে বেছে নেয় পরীক্ষার খাতাকে। পড়াশোনার প্রতি ওর আগ্রহ ছিল ছোট থেকেই। বা হয়তো তার পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার খবর শুনে বাবা-মায়ের বাঁধভাঙ্গা হাসি আর চোখের জল প্রতিজ্ঞার মশাল জ্বেলে দিয়েছিল ওর ছোট্ট বুকটায়। আমি জানি না। আমি যখন সুদীপকে দেখি তখন ও অনেকটা বড়। গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ চুকিয়ে উচ্চ-মাধ্যমিকে ভর্তি হতে এসেছিল আমাদের স্কুলে। ওই অঞ্চলে আশেপাশের সমস্ত গ্রামগুলোর মধ্যে আমাদের স্কুলটাই ছিল সবচেয়ে বড় আর নামী। আশেপাশের স্কুলগুলোতে আবার বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগও ছিল না। তাই ওই সমস্ত জায়গাগুলো থেকে ভালো ভালো ছাত্ররা আমাদের স্কুলেই চলে আসত মাধ্যমিকের পর। কিছুদিনের মধ্যেই সুদীপের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। খুব সরল সাদাসিধা, বুদ্ধিমান আর আমার মতই প্রচণ্ড কম কথা বলা এই ছেলেটিকে নতুন এক বন্ধু হিসাবে পেয়ে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। তো যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই সুদীপের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে স্কুলের স্যারেরাও মুগ্ধ আর সাথে কিছুটা বিষণ্ণও ওর বাড়ির অবস্থার কথা জেনে। একদিন তো এক শিক্ষক বেশ খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে আমাকে (পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম) দেখিয়ে ওকে বলেই ফেললেন, “পারবি না? পারবি না ওদের সাথে লড়াই করে ওদের হারিয়ে দিতে? ওদের সবাইকে পিছনে ফেলে দিতে”? আমি আবার স্কুলের অনেক পুরনো আর ভালো ছাত্র...... ঐ শিক্ষকও আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষকদের একজন। তাও বিশ্বাস করুন, একটুও খারাপ লাগেনি সেদিন। সুদীপের বাড়ির অবস্থা জানার পর ভেবেছিলাম বলি, “তুই আমার বাড়ি চলে আয়। আমার তো সবই অতিরিক্ত! সমস্ত বই, টিউশনের নোট.... তোর যা লাগে, নিয়ে যা। তোর থেকে কম নাম্বার পেতে আমার একটুও খারাপ লাগবে না।”...... বলতে পারি নি। অনেক ভয় ছিল, বাবা-মা কি বলবে, পাকামি হয়ে যাবে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য পরে আমাদের সমস্ত শিক্ষকরাই ওকে বিনা পয়সায় টিউশন পড়িয়েছিলেন দু'বছর, বইপত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন যথাসাধ্য। সুদীপের 'ভাগ্য ভালো' ছিল বলতে হয়।
সে তো বটেই। নয়তো অ-আ-ক-খ আর যোগ-বিয়োগ শেখার পরই এইসব সুদীপ'দের
সাধারণত সংসারের খরচ টানতে উপার্জনের রাস্তায় নামতে হয়। বেশ
ভালো ফল করেছিল সুদীপ আমাদের স্কুল থেকে। যতটা আশা করা গেছিল
ততটা হয়তো নয়...... তবুও বেশ ভালোই। তারপর আমি কলকাতায় চলে আসি উচ্চশিক্ষার জন্য, সুদীপ বাড়ির কাছেই একটা ছোট
কলেজে ভর্তি হয় রসায়নে অনার্স নিয়ে। আবার হয়তো বা খরচের
কারণেই। তখনও মিডিয়া এতটা সোচ্চার ছিল না। আর কোন এঁদো
গ্রামে কোন সুদীপ ক'টা নাম্বার পেয়েছে সে নিয়ে বিশেষ কারও
মাথাব্যথাও ছিল না। তাই সুদীপের নাম ঐ গ্রামের বাইরে কোথাও
উচ্চারিত হয় নি। কোন সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে আসেন নি তার
পড়াশোনার ভার বহন করতে। গ্রামেরই কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে আর নিজের মনোবলকে সম্বল করে graduation শেষ করে সুদীপ। পরিবারের হাল ধরতে সেখানেই পড়াশোনার ইতি টেনে একটা স্কুলের চাকরিতে ঢুকে পড়ে ও।
কলেজে পড়াকালীন বেশ কয়েকবার বাড়ি ফিরে দেখা
হয়েছে ওর সাথে...... কেন জানি না, চোখে চোখ রাখতে পারি নি! আজ আর ওর সাথে কোনরকম যোগাযোগই নেই। দূরত্ব আর সময়
আমাদের অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে ধীরে ধীরে। জানি না
সুদীপ কোথায় আছে, তবে এটুকু জানি, যেখানে
আছে, ভালোই আছে। এই সুদীপ'রা
ভালো থাকার মন্ত্রটা খুব ছোট থেকেই কিভাবে যেন আয়ত্ত করে ফেলে! মনে পড়ে না, ঐ দু'বছরে
কোনদিনও ওকে বিষণ্ণ থাকতে দেখেছি বলে। আজও গবেষণার কাজে কোথাও
আটকে গিয়ে নিজেকে যখন অসহায় মনে হয়, মনে হয় ছোটবেলা থেকে যা যা
পেয়েছি তার সবকিছুটা পাওয়ার যোগ্যতা বুঝি আমার ছিল
না। এর সিকিভাগও পেলে আজ সুদীপ হয়তো আমাকে ছাড়িয়ে অনেক বড়
কিছু করতে পারত। এও একধরনের অপচয় নয় কি? আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, না, সুদীপের
দারিদ্রই ওর সবচেয়ে বড় অহঙ্কারের জায়গা। ওর ওই ছেঁড়া বই, মলিন
পোশাক, রংচটা ঘরদোর আর বাবা-মা'র গর্ব-ভরা চাউনিই বোধহয়
ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছিল। কোনটা ঠিক জানি
না। তবে কোথাও একটা কিছু না করতে পারার অপরাধ-বোধ মনের কোণে
এখনও থেকে গেছে। এবছর উচ্চ-মাধ্যমিকের ফল বের হওয়ার পরেরদিন সংবাদপত্রে চোখ রেখেই তাই চমকে উঠলাম। এবারও এক সুদীপ উঠে এসেছে অন্ধকারের
জগদ্দল ঠেলে। সেও কিনা পড়তে চায় রসায়ন নিয়ে!
স্বপ্ন গবেষণা করা। মনে মনে ভাবলাম, এর স্বপ্নটা সাকার করতেই হবে। সুদীপের জন্য কি? না, বোধহয়
আমারই জন্য!
নতুন সুদীপদের গল্প: আনন্দবাজারে
নতুন সুদীপদের গল্প: আনন্দবাজারে