Monday, June 11, 2012

আমসংকীর্তন- নির্মাল্য


ভ্যাপসা গরমের কোন লাভজনক দিক চট করে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমি অন্তত পাই না। ঘামাচি, ডিহাইড্রেশন, সর্দিগর্মি ইত্যাদি হরেক উপসর্গে ঋতুটি
সর’গরম’। যাই হোক নিন্দে করা আমার স্বভাব নয় মোটেই, তা সে গরমকালই হোক বা গরম মাথা- নৈব নৈব চ। কাজেই আসুন পাখার বাতাসে চুপটি করে খেতে বসি। উঁহু, বিরিয়ানি, কালিয়া পোলাও নয়। গরমকালে ওসব থেকে দূরেই থাকা ভালো। বরং খেতে যাই উত্তরবঙ্গে। মানে উত্তরবঙ্গের মালদায়। আর মালদা নেহাতই আম আদমির জায়গা। ওখানকার আদম এবং ইভেরা আম নিয়ে বিশেষ অহংকারী। তাদের নাকি সব আমই খাস। ফলের রাজা বলে কথা, কাজেই ব্যাপারটা একটু নুন মশলা মাখিয়ে পরিবেশন না করলে রাজরোষে পড়ার আশঙ্কা।
ঘটনার সূত্রপাত এক্স শতকে (এক্স খুঁজতে গেলেই কিন্তু খাওয়াদাওয়া মাটি- এই বলে রাখলুম)। শ্রী রামচন্দ্র লঙ্কাজয়ে যাব যাব করছেন। হনুমান জোড়হস্তে get set go শোনার অপেক্ষায়। ব্যাটা বড্ড দেরী করছে তো! শালা তোর বউকে নিয়ে ভেগেছে আর তুই বসে বসে confusion এ ভুগছিস? রাগের চোটে খিদে পেয়ে গেল পবনপুত্রের। প্রভুর জন্য দেবতাদের পাঠানো খাবারদাবার থেকে অদ্ভুতদর্শন একটি নাকওয়ালা ফল তুলে নিয়ে চম্পট দিলেন। গঙ্গার দক্ষিণ প্রবাহের কাছাকাছি একজায়গায় বসে নিশ্চিন্তে এক কামড় বসিয়েছেন, খোসা সুদ্ধুই, হঠাৎ ডাক দিলেন বেআক্কেলে প্রভু। আধখাওয়া অমৃত ফলটি গঙ্গার ঘাটে ছুঁড়ে ফেলে ল্যাজ তুলে দৌড় দিলেন ভক্ত। স্বর্গের অমৃত ফল তো, চট করে আঁতে লেগে গেল। একদিন এই উপেক্ষার বদলা নেওয়ার আশায় বংশবিস্তার করল সেই নাকউঁচু ফলটি- জন্ম হল পৃথিবীর প্রথম আমবাগানের, মালদার বুকে। হনুমানের অর্ধভুক্ত আমের আঁটিতে জন্ম- তাই নাকি মালদায় আমের এই বাড়বাড়ন্ত!
নিঃসন্দেহে আষাঢ়ে(বোশেখী) গল্প। আচ্ছা, চলুন খাওয়ার পাতে। মালদায়। বিজাতীয় আলফানসো, বোম্মাই ল্যাংড়া এসবের কথা তো অনেক শুনেছেন, স্বাদে-গন্ধে কেউই মালদার নিজস্ব আমের কাছাকাছি নয়। এখানে আমের উদ্বোধন হয় ‘ভূমিপুত্তুর’ কাঁচামিঠে আম দিয়ে। এ জিনিস কাঁচাতেই মিঠে (বেঁড়ে পাকা আর কি!)। কয়েক টুকরো কাঁচা আমে যেমন সুগন্ধ, তেমন মনকাড়া স্বাদ। বিক্রি হয় ১০-১২ টাকা কিলো দরে। এবছর আর আপনাদের খাওয়াতে পারলাম না, এপ্রিলের প্রথম ২-৩ সপ্তাহে এই আম পেকে যায়, আর পাকলেই বিস্বাদ।
এরপর আছে ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, রাখালভোগ। এসব বহু প্রজাতির নানা স্বাদের আমে মালদার বাজার সুপারহিট।কলকাতার ফুটপাথ থেকে ৩০-৪০ টাকা কিলো দরে যেসব কিনে খান, সেসব বেশীরভাগই কার্বাইডে পাকানো হিমসাগর, ভিন্ন নামে। পুষ্টিগুণ এবং স্বাদ- দুয়েই ফেল্টুস। আসল স্বাদের জন্য আসুন মালদার আমবাগানে।মালদার আরেক বিখ্যাত প্রতিনিধি ফজলি- রাজা বাদশার ইতিহাস জড়ানো। যাক, বাদশাহী আমকথা শুনে যদি জিভে জল আসে, তবে জানিয়ে রাখি, সম্রাটদের নৈশভোজের এই পদটি এখনও আপনার নাগালের মধ্যেই- মালদার আম বাজারে। বছরের শেষ আমটির নাম ‘আশ্বিনা’ – সত্যিই আশ্বিনেই তার যৌবন। অল্প মিষ্টি, ওজনেও হালকা, আর দামেও কম। দুটি অন্য খাস আমের নাম না করলেই নয়। আম্রপালি আর মল্লিকা। স্বর্গের অভিশপ্তা অপ্সরা আম্রপালি নশ্বর মানুষের প্রেমে দেবরোষ ভোগ করেছিলেন জানি। মালদার এই আম্রপালি শুধুমাত্র দেবভোগ্যা হলে এতদিনে হয়তো নাস্তিক হয়ে উঠতুম। যেমন তার স্বাদ, তেমন রঙ। আকারে অবজ্ঞা করার মত ছোট, কিন্তু ওজনে প্রতিটি প্রায় ২০০ গ্রাম। আর স্বাদ? ডায়াবেটিক রুগীরা সাবধান! মল্লিকাও এর কঠিন প্রতিযোগী। এর বৈশিষ্ট্য সোনালী রঙ আর মনমাতানো গন্ধ।
গরমের দুপুরে তাই আজও প্রতিদিন পাতে আমের সমারোহ চোখে পড়ার মতই। সকালে উঠে হালকা জলখাবারের পর, ফ্রিজ থেকে বার করা ঠাণ্ডা আমের কুচি, সাথে দু-এক চামচ ঘরে তৈরি ক্ষীর। ভেবে দেখুন। দুপুরে আম-ডাল, অল্প চিনি দিয়ে আমের পাতলা করে চাটনী (যাকে আঞ্চলিক ভাষায় টক জল বলে), বা আত্মীয়-স্বজন এলে আমের প্লাস্টিক চাটনী। তারপর ভাত খেয়ে উঠে গোটা গোটা আম। না,না, বিদেশী কেতায় ছোট ছোট ভদ্দরলোকের টুকরো নয়, একেবারে খোসা ছাড়িয়ে সটান মুখে, ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে, দু’এক ফোঁটা জামায় মাখামাখি, এ না হলে আপনি আর কি এমন আমবিলাসী! বরং ইন্টারনেটে আমের ছবি দেখে দুধের স্বাদ জলে মেটান। বিকেলেও সেই আম-আদমী। কম মিষ্টি ফজলী আমের টুকরো অল্প নুন আর চিনি দিয়ে মেখে সেরে নিন জলখাবার। মালদা একে বলে ‘ঝামনি’। তেলেভাজা দিয়ে জলখাবার খেলে সাথে রাখুন সাদা রঙের কাঁচা আম-লঙ্কা দিয়ে তৈরি ‘আমবাটা’। আর রাতে, বেশী খাওয়া নয়, গরম কাল তো। এসময় রবিদাদুই ভরসা। আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলী- দু’খান রুটি দিয়ে...পাকা আমের অ্যালকোহল সত্ত্বা সাংঘাতিক (বিজ্ঞান বলছে ৩০ শতাংশ!), তাতে কী!! তোফা ঘুম অপেক্ষা করে আছে, আপনার জন্য। গরমের রাতে, এসি ছাড়াই!! আমসত্ত্বের গল্পে পরে আসছি।
আম কিভাবে ওই এলাকার জীবনযাত্রা আর্থিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এই নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা সরকারেরও নেই, আপনারও নেই, এমনকি মালদাবাসী হওয়া সত্ত্বেও আমারও নেই। সেই কাঁচামিঠে আমের সময় থেকেই একাধিক ভাগচাষী, গ্রামের বেকার প্রৌঢ়, এমনকি ষাট ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধও পৌর বাজারের পাশে বসে পড়েন নিজের বাগানের, মালিকানাহীন গাছের, এমনকি চুরি করা আম নিয়েও। সবই বিকিয়ে যায় মোটামুটি- সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে, দিনাজপুরের ব্যবসায়ীদের কাছে, নইলে তিনগুণ দামে রাজধানী কলকাতার বাজারে। এই বৃত্তান্ত চলতে থাকে জুন মাস অবধি। মে-জুন মাসে আমের দাম কমে যায় একেবারেই। সব ধরণের আম মোটামুটি ১০ টাকা কিলো- মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্নবিত্তেরও পকেটের নাগালে। এসময় মালদার গ্রামে গ্রামে গৃহবধূরা তৈরি করেন আমসি। খারাপ জাতের কিছু ফজলি আর পাখীতে খাওয়া বা অন্য কোনভাবে আংশিক নষ্ট হয়ে যাওয়া আম পাতলা লম্বা লম্বা টুকরোয় কেটে তাকে শুকিয়ে নিয়ে তৈরি হয় টক আমসি। এছাড়া আরো এক ধরণের আমসি হয়, মিষ্টি। কাঁচামিঠে আমের আগে থেকে শুকিয়ে নেওয়া টুকরো আর সদ্যজাত আশ্বিণা আমের টুকরো শুকনো করে খুব অল্প চিনিতে ভেজে নিয়ে তাকে চড়া রোদে শুকোনো হয় দিন পনেরো। সেটি মিষ্টি আমসি। বিক্রি হয় বেশ চড়া দামে। বিদেশেও এর চাহিদা প্রচুর। এই আয় গ্রামের মহিলাদের একান্ত নিজস্ব। গাজোল, বামনগোলা, কালিয়াচক এই গ্রামগুলির মহিলারা সারা বছরের তাদের হাতখরচ্‌ বাবদ এ থেকে জমা করেন হাজার তিনেক টাকা। এছাড়া আছে ‘আমচুনা’, খুব বেশি শুকিয়ে যাওয়া আমসি শিল নোড়ায় মিহি করে গুঁড়ো করে তৈরি হয় আম্রজাত এই বিশেষ মশলাটি। তেলেভাজার সাথে, ছোলাভিজে দিয়ে, মুড়িতে, এমনকি মুরগীর মাংসের কিছু বিশেষ পদে এই আমচুনার বহুল ব্যবহার
এছাড়াও আছে বিভিন্ন ধরণের আমের আচার। শুকনো আম দিয়ে বড় বড় টুকরো ডুবো তেলে সবুজ রঙ্গা আচার, অল্প পাকা আম গুড় দিয়ে ভিজিয়ে লাল রঙের 'আমসুক্ত', উঁচু জাতের কাঁচা রাখালভোগ আম বড় লাল লঙ্কা, মশলা মাখিয়ে 'আম-ঝাল', মিষ্টি আমের চিনি আর গুড় দিয়ে আচার, পাকা আর কাঁচা আম একসাথে বেটে নিয়ে তৈরি 'আম-কাসুন্দি'। আমসত্ত্বেরও অনেক আকার ও প্রকার। আমসত্ত্ব আসলে বেশ শক্ত। আজ্ঞে হ্যাঁ, কলকাতার ফুটপাতে যেটিকে আমসত্ত্বের নামে কিনে খান, সেটি আসলে কুমড়োসত্ত্ব, বড়জোর বলা চলে mango flavored কুমড়োসত্ত্ব।মালদার দিদিমা-ঠাকুমারা খুব বেশি পেকে যাওয়া এমনকি আংশিক পচে যাওয়া হিমসাগর, গোপালভোগের ঘন রসের প্রলেপ দিয়ে তৈরি করেন আমসত্ত্ব। পরতের পর পরত ঠিকঠাক শুকিয়ে গেলে ঘন বাদামী রঙের আমসত্ত্ব তৈরি। এইটে অবশ্য বেশ মহার্ঘ্য- ২০০-৬০০ টাকা কিলো। সাবধানে রাখলে বছরের পর বছর পোকা ধরে না। যে কোন সময় দুধ-রুটি দিয়ে বা শুধু শুধুই আস্বাদ করুন মালদার এই আন্তরিক পরিবেশন।
মালদার আদি বাসিন্দাদের ৮০ শতাংশ মানুষ কোন না কোন ভাবে আমের সাথে যুক্ত। এদের মধ্যে যারা অন্ততঃ একশো বছর ধরে মালদায় আছেন, প্রায় প্রত্যেকেই কোন না কোন আমবাগানের মালিক। বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকার আমের ব্যবসা হয় এই জেলায়। আমবাগান লিজ দিয়ে, বা মুকুল থাকা অবস্থায় শেয়ারে অস্থায়ী ভাবে বাগান কেনেন অনেকে। একে ‘ফলকর’ বলে। পুরোপুরি ফাটকা। কোন কারণে ফলনের ক্ষতি হলে পুরোটাই লোকসান। আর লাভ হলে ‘আম’ থেকে ‘খাস’। অন্ততঃ ৪০-৫০ হাজার টাকা আপনার ঘরে। কয়েক দশক আগেও সেখানে বিয়েতে আমবাগান উপহার দেওয়ার রীতি ছিল। কয়েক বছর ফল ভোগ করার পর আবার দাতার বংশের কোন বিয়েতে প্রাপক উপহার দিয়ে ফিরিয়ে দিতেন সেই বাগান। মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ার পর থেকে আর জমি সংক্রান্ত আইনের জটিলতার কারণে উঠে গেছে এই প্রথা।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, ফিরে আসা যাক সেখানেই। পবনপুত্রের হাতে অপমানিত হয়ে স্বর্গীয় ফলটির গোসা হয়েছিল বটে, তবে আজ তাঁরই বংশধরদের হাতে আমের লাঞ্ছনা দেখার মতো। বিশেষতঃ বিগত ১০-১২ বছর ধরে বিহার থেকে আগত বহু হনুমানের উৎপাতে মালদার আম সাম্রাজ্য বিপর্যস্ত। আধখানা করে খেয়ে, নষ্ট করে আমবাগানে ‘বাঁদরামি’। যাহোক, তাতে লাভ বই ক্ষতি হয়নি। পরিসংখ্যান বলছে, মালদার আমের বাগান শহর ঘেঁষা এলাকায় কমে এলেও গ্রামের দিকে বেড়েছে ৭ শতাংশ। অতএব এই গরমে চলে আসুন মালদায়। ‘আম’ আদমি হয়ে।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই