বড়লোকের ‘বস্তি’র আস্তানা থেকে সকাল সাড়ে নটায়
অফিসের জন্য বেরোন সুজনবাবু। সরকারি
চাকরি। অফিসের হাজিরা খাতায় সকাল দশটায় attendance দিতে না পারলে লালকালি। তিনটে লালকালি মানে একটা C.L কাটা। বাড়ি থেকে, থুড়ি, ফ্ল্যাট থেকে অফিস পৌঁছতে তিনবার break journey করতে হয়- অটো, মেট্রো, অটো। প্রত্যেকটাতে কম বেশি পনেরো মিনিট করে সময় বরাদ্দ। কপাল ভালো থাকলে, রাস্তায় জ্যাম না থাকলে, কোনকিছুর জন্য লাইনে দাঁড়াতে না হলে বা পরপর পেয়ে গেলে বেলা দশটায় অফিস ঢোকা যায়। কিন্তু তেমনটা হয় খুব কমদিনই। তাই বেশিরভাগ দিনই সুজনবাবু দশটার পরই অফিস পৌঁছোন। দশটার পর পৌঁছেও কোন কোনদিন
বরাত জোরে সুজনবাবুর বস আরো পরে আসেন। হাজিরা দিতে অফিসারের ঘরে ঢুকে তাঁর চেয়ার ফাঁকা থাকলে তাই ঘড়িতে যতই বাজুক নির্দ্বিধায় 10 am লিখে arrival দেওয়া যায়। বস উপস্থিত থাকলেও পাঁচ-দশ মিনিটের দেরির জন্যে রাস্তার জ্যাম ও অন্যান্য আরো পাঁচটা বাজে বকে রেহাই পাওয়া যায়। সামান্য ভ্রুকুঞ্চনকে শুধু উপেক্ষা করলেই সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু তার বেশি দেরি হলে লালকালি। আর লালকালি না বসলে স্যারের বাঁকাকথা হজম করা ছাড়া উপায় থাকে না। ঘর থেকে বেরনো থেকে অফিস ঢোকা পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত কাটে ওয়ান-ডে ম্যাচের থেকেও বেশি টানটান উত্তেজনায়। ‘আজ নির্ঘাত লেট’, ‘আজ নির্ঘাত লালকালি’- কথাগুলো জপতে জপতে ছুটতে থাকেন সুজনবাবু। অটোওয়ালা লাইনে অটো আনতে দেরি করলে কাকুতি-মিনতি করতে শুরু করেন পরের অটো দেওয়ার জন্য। অটোতে চেপে মনে হয় চালককে বলেন, “দাদা যেভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন, আপনি বরং বসুন, আমি চালাই। বলেও ফেলেন, “দাদা একটু তাড়াতাড়ি চালান না!” অটোওয়ালারও উত্তর রেডি-“এরোপ্লেন নাকি যে ওড়াবো? এতো তাড়া থাকে তো পাঁচমিনিট আগে বেরোতে কি হয়?” ব্যস, সুজনবাবুর কাছে আর কোন উত্তর নেই। চেষ্টা কি করেন না তিনি পাঁচমিনিট আগে বেরোতে? কিন্তু পারেন কোথায়? বাজার, দুধ আনা, মেয়েকে কোচিং থেকে নিয়ে আসা- এসব সেরে তবে স্নানে ঢোকেন। কয়েকমিনিটের মধ্যে যন্ত্রের মত তৈরি হন। দু-চাট্টে নাকেমুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়েন। অফিসে যেতে যেতে হিসেব কষতে থাকেন ফেরার পথে কি কি কাজ তাঁকে করতে হবে। চিন্তার দড়িতে কখনো টান পড়ে আশপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকালে। তারাও একই গতিতে তাঁর মত ছুটে চলেছে। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা গন্তব্য, আলাদা রাস্তা, আলাদা উদ্দেশ্য কিন্তু সকলের মধ্যে অদ্ভুত মিল। সকলেরই বড্ড তাড়া। সুজনবাবু ভাবেন, আচ্ছা, এদের প্রত্যেকেরই কি নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে না পৌঁছলে C.L কাটা যাবে? কোথাও লালকালি পড়বে? রাস্তার গাড়িগুলোও তো একই ভাবে ছোটে মানুষগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
চাকরি। অফিসের হাজিরা খাতায় সকাল দশটায় attendance দিতে না পারলে লালকালি। তিনটে লালকালি মানে একটা C.L কাটা। বাড়ি থেকে, থুড়ি, ফ্ল্যাট থেকে অফিস পৌঁছতে তিনবার break journey করতে হয়- অটো, মেট্রো, অটো। প্রত্যেকটাতে কম বেশি পনেরো মিনিট করে সময় বরাদ্দ। কপাল ভালো থাকলে, রাস্তায় জ্যাম না থাকলে, কোনকিছুর জন্য লাইনে দাঁড়াতে না হলে বা পরপর পেয়ে গেলে বেলা দশটায় অফিস ঢোকা যায়। কিন্তু তেমনটা হয় খুব কমদিনই। তাই বেশিরভাগ দিনই সুজনবাবু দশটার পরই অফিস পৌঁছোন। দশটার পর পৌঁছেও কোন কোনদিন
বরাত জোরে সুজনবাবুর বস আরো পরে আসেন। হাজিরা দিতে অফিসারের ঘরে ঢুকে তাঁর চেয়ার ফাঁকা থাকলে তাই ঘড়িতে যতই বাজুক নির্দ্বিধায় 10 am লিখে arrival দেওয়া যায়। বস উপস্থিত থাকলেও পাঁচ-দশ মিনিটের দেরির জন্যে রাস্তার জ্যাম ও অন্যান্য আরো পাঁচটা বাজে বকে রেহাই পাওয়া যায়। সামান্য ভ্রুকুঞ্চনকে শুধু উপেক্ষা করলেই সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু তার বেশি দেরি হলে লালকালি। আর লালকালি না বসলে স্যারের বাঁকাকথা হজম করা ছাড়া উপায় থাকে না। ঘর থেকে বেরনো থেকে অফিস ঢোকা পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত কাটে ওয়ান-ডে ম্যাচের থেকেও বেশি টানটান উত্তেজনায়। ‘আজ নির্ঘাত লেট’, ‘আজ নির্ঘাত লালকালি’- কথাগুলো জপতে জপতে ছুটতে থাকেন সুজনবাবু। অটোওয়ালা লাইনে অটো আনতে দেরি করলে কাকুতি-মিনতি করতে শুরু করেন পরের অটো দেওয়ার জন্য। অটোতে চেপে মনে হয় চালককে বলেন, “দাদা যেভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন, আপনি বরং বসুন, আমি চালাই। বলেও ফেলেন, “দাদা একটু তাড়াতাড়ি চালান না!” অটোওয়ালারও উত্তর রেডি-“এরোপ্লেন নাকি যে ওড়াবো? এতো তাড়া থাকে তো পাঁচমিনিট আগে বেরোতে কি হয়?” ব্যস, সুজনবাবুর কাছে আর কোন উত্তর নেই। চেষ্টা কি করেন না তিনি পাঁচমিনিট আগে বেরোতে? কিন্তু পারেন কোথায়? বাজার, দুধ আনা, মেয়েকে কোচিং থেকে নিয়ে আসা- এসব সেরে তবে স্নানে ঢোকেন। কয়েকমিনিটের মধ্যে যন্ত্রের মত তৈরি হন। দু-চাট্টে নাকেমুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়েন। অফিসে যেতে যেতে হিসেব কষতে থাকেন ফেরার পথে কি কি কাজ তাঁকে করতে হবে। চিন্তার দড়িতে কখনো টান পড়ে আশপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকালে। তারাও একই গতিতে তাঁর মত ছুটে চলেছে। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা গন্তব্য, আলাদা রাস্তা, আলাদা উদ্দেশ্য কিন্তু সকলের মধ্যে অদ্ভুত মিল। সকলেরই বড্ড তাড়া। সুজনবাবু ভাবেন, আচ্ছা, এদের প্রত্যেকেরই কি নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে না পৌঁছলে C.L কাটা যাবে? কোথাও লালকালি পড়বে? রাস্তার গাড়িগুলোও তো একই ভাবে ছোটে মানুষগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
অনেকদিন
ধরে একটা অন্যরকম কিছু করার কথা ভাবছেন সুজনবাবু। কিন্তু কিছুতেই সাহস করে উঠতে
পারছেন না। হাজারবার নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, কাজটা করা কি ঠিক হবে? বাড়িতে
স্ত্রীকেও সাহস করে কথাটা বলতে পারেননি। বললেই হাজার কৈফিয়ত দিতে হবে। তখন আর
কাজটা করার ইচ্ছে বাকি থাকবে না। বন্ধুরা কেউ কাছাকাছি নেই। থাকলে তাদের বলা যেত।
এখন Lunch Break এ যে সহকর্মীদের সাথে তিনি আড্ডা দেন তাদের বলতে
গেলে তো তারা পাগল বলবে। মাস দুয়েক হল সুজনবাবু তাই কথাটা শুধু ভাবছেন-এরকম করলে
কেমন হয়? রবিবার ঘুরে সোমবার এলেই তাঁর ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু কাজটা
করার মত মনের জোর সঞ্চয় করতে পারছেন না।
আজ বাড়ি
থেকে বেরোলেন একই ভাবে। যেভাবে প্রতিদিন বেরোন। বাড়িতে বুঝতে দিলে হবেনা যে তাঁর
প্ল্যানটা কি। প্ল্যানটা তাঁর নিজস্ব। তাই সাকসেসফুল হোক না হোক তাঁর আনন্দ অথবা
দুঃখ তিনি একাই পেতে চান আর এটাই তাঁর প্ল্যান। একটা দিন স্বাধীন ভাবে বাঁচা।
কোনো তাড়াহীন গোটা একটা দিন। নিজের মত করে কাটানো। তিনি দেখতে চান একটা দিন কোন
তাড়া না নিয়ে একই চেনা পথে যেতে কেমন লাগে। রাস্তার লোকজনকে ছুটতে দেখতে কেমন
লাগে। ঘর থেকে বাসরাস্তা অবধি প্রতিদিনের মত গতিতে হেঁটে এসে থামলেন। তারপর অটো
স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে চা খেলেন। চারটে অটো ছেড়ে পাঁচ নম্বর অটোটায় উঠে মেট্রোস্টেশনে
পৌঁছলেন। সেখানে অনেকক্ষণ বসে অন্যদের হুড়োহুড়ি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন। দুটো মেট্রো
ছেড়ে তিন নম্বর মেট্রোটায় উঠলেন। সুজনবাবুর এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা যে আজ তাঁর তাড়া
নেই। সেই কবে কলেজ বাঙ্ক করে সিনেমা দেখতেন। আজ এতদিন পর অফিস বাঙ্ক করছেন একই
স্পিরিটে। বছরে যতগুলো C.L নেন সবগুলোই অন্যদের জন্য- স্ত্রী, কন্যা, ব্যাঙ্ক,
পোস্ট অফিস, ডাক্তার, গ্যাস। কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের জন্য অফিস কামাই লাইফে এই
প্রথম। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা হচ্ছে ভেতর ভেতর। মনে হচ্ছে কেউ জেনে যাবে, দেখে
ফেলবে, পাগল ভাববে তাঁকে। জনতার ভিড়ে মিশে থাকলে তাঁকে কেউ চিনবেনা নিশ্চয়ই। আজ তাঁর
অনেক কিছু করার আছে। মাল্টিপ্লেক্সে কোনোদিন সিনেমা দেখেননি। সামান্য সরকারি
কেরানির চাকরিতে তিনজনে মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখা যায় না। কলেজ লাইফে এমন অনেক
জায়গা ছিল যেখানকার খাবার মাঝেমধ্যে না খেলে ভাল লাগতো না। দুপুরে এরকম একটি
জায়গায় খেয়ে মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখলেন। তারপর হেঁটেহেঁটে ঘুরলেন আর মানুষ
দেখলেন। অবশেষে বিকেলের পড়ন্ত রোদ বাড়ি ফেরার কথা জানান দিল।
সুজনবাবু বাড়ি ফিরছেন একবুক বাতাস নিয়ে। আজকের দিনটার কথা উনি কাউকে জানাবেন না। এই দিনটা তাঁর একান্ত নিজের। এর ভাগ উনি কাউকে দিতে রাজি নন।
সুজনবাবু বাড়ি ফিরছেন একবুক বাতাস নিয়ে। আজকের দিনটার কথা উনি কাউকে জানাবেন না। এই দিনটা তাঁর একান্ত নিজের। এর ভাগ উনি কাউকে দিতে রাজি নন।