অগণিত সংস্কারের সাথে আমাদের
নিত্য বসবাস। সে সব সংস্কারের বা প্রচলিত অভ্যাসের অনেকগুলিকে কুসংস্কার
বলে দাগিয়ে তার বিরুদ্ধে "লড়াই" আধুনিকতার একটা মার্কা বলে গণ্য হচ্ছে বহুকাল। হাস্যকর ভাবে সেই সংগ্রামের সৈন্যদের আবার গ্রহরত্নের আংটি সমেত বহু রকমের ব্যক্তিগত অভ্যাসের দাসত্ব করতে দেখা যায়। সংস্কারগুলি "কু" নাকি "সু", ভালো না মন্দ, সে বিতর্কে না ঢুকে এ'দেশে চালু তাদের কয়েকটার উৎসসন্ধান আর বিশ্লেষণের চেষ্টা করা যাক।
বলে দাগিয়ে তার বিরুদ্ধে "লড়াই" আধুনিকতার একটা মার্কা বলে গণ্য হচ্ছে বহুকাল। হাস্যকর ভাবে সেই সংগ্রামের সৈন্যদের আবার গ্রহরত্নের আংটি সমেত বহু রকমের ব্যক্তিগত অভ্যাসের দাসত্ব করতে দেখা যায়। সংস্কারগুলি "কু" নাকি "সু", ভালো না মন্দ, সে বিতর্কে না ঢুকে এ'দেশে চালু তাদের কয়েকটার উৎসসন্ধান আর বিশ্লেষণের চেষ্টা করা যাক।
সন্তানজন্মের পর নবজাতকসমেত প্রসূতিকে আঁতুড়ঘরে
থাকতে হয় কয়েকদিন। এই ক'দিন সেই ঘরে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। কিছুকাল আগেও
গ্রামের দিকে এই আঁতুড়ঘর বস্তুটি অবধারিতভাবে হত অন্ধকার আলোবাতাসহীন গোয়ালসদৃশ
একটা আস্তানা। প্রসূতি তাঁর নবজাতককে নিয়ে
সেখানে থাকতেন। তাঁদের ছোঁয়া লেগে বাড়ির অন্য সদস্যেরা অপবিত্র না হয়ে
পড়ে সে ব্যাপারে সবাই যারপরনাই শঙ্কিত থাকত। ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেলে সেই দুর্ঘটনার একমাত্র প্রতিবিধান ছিল স্নান করে পবিত্র হওয়া। আঁতুড়ঘরে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, বিশেষ করে কাপড়চোপড় যেহেতু অতঃপর পরিত্যাজ্য তাই যত নবজাতক আর মা'য়ের পরিচর্যার জন্য বাড়ির জমিয়ে রাখা পুরোনো এবং প্রায়শই নোংরা ন্যাকরা ইত্যাদি ব্যবহার করা হত ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সব বাড়িতেই। অবধার্য সংক্রমণে অসুস্থ হত মা। সংক্রমণে শিশুমৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
পড়ে সে ব্যাপারে সবাই যারপরনাই শঙ্কিত থাকত। ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেলে সেই দুর্ঘটনার একমাত্র প্রতিবিধান ছিল স্নান করে পবিত্র হওয়া। আঁতুড়ঘরে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, বিশেষ করে কাপড়চোপড় যেহেতু অতঃপর পরিত্যাজ্য তাই যত নবজাতক আর মা'য়ের পরিচর্যার জন্য বাড়ির জমিয়ে রাখা পুরোনো এবং প্রায়শই নোংরা ন্যাকরা ইত্যাদি ব্যবহার করা হত ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সব বাড়িতেই। অবধার্য সংক্রমণে অসুস্থ হত মা। সংক্রমণে শিশুমৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
এ'বার আমরা যদি এই সংস্কারের উৎসের
কথা ভাবি,
তাহলে বুঝতে
অসুবিধে হয় না,
সুপ্রাচীন
কালেও মা ও নবজাতকের প্রসবপরবর্তী সংক্রমণজনিত অসুস্থতার কথা মানুষ আন্দাজ করেছিল।
তার হাত থেকে মা আর নবজাতককে রক্ষা করতে তাদেরকে আলাদা রাখতেই এই আঁতুড়ঘরের
প্রস্তাবনা। অত্যন্ত ভালো আর কার্যকরী একটা ব্যবস্থা অজ্ঞানতার কবলে পড়ে উলটো পথে
প্রায় প্রাণঘাতী হয়ে উঠল।
বেড়াল চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে পার
হলে, দুর্ঘটনার ভয়ে শঙ্কিত হয়
না উপমহাদেশে এমন গাড়িচালক বিরল। কেউ কেউ গাড়ি থামিয়ে রাখেন দু'দণ্ড। কেউ আশ্রয় নেন অন্য
কোনও তুকতাকের। নিছকই অর্থহীন কাজকারবার। কিন্তু সুদূর অতীতে যখন শুরু হয়েছিল এই
সংস্কার তখন হয়তো এত অর্থহীন ছিল না ব্যাপারটা। লোকবসতি এত ঘন ছিলনা তখন। নগর তথা
লোকালয়গুলি থাকত অনেক দূরে দূরে। রাজপথগুলি ঘন অরণ্য বা তেপান্তরের মাঠের মধ্য
দিয়ে চলে যেত দূরে। জনবিরল অঞ্চলে হিংস্র পশু বা দস্যুর ভয়ে একাকী যান নিয়ে যেতে
সাহস পেতনা মানুষজন। তাই এক নগর থেকে অন্য নগরে যেত যানবাহনের বহর বা ক্যারাভ্যান।
যা কী না সে'যুগের নিরিখে যথেষ্ট
পরিমাণে আলোকোদ্ভাসিত কলকোলাহল। বন্য বিশেষত ছোট পশু স্বভাবতই এই রকম
ক্যারাভ্যানকে ভয় পেত, তার
মুখোমুখি হতে চাইত না। তা সত্ত্বেও যদি কোনও পশু চলন্ত বহরের সামনে দিয়ে ত্রস্ত
পেরিয়ে যায় রাস্তার এ'দিক
থেকে ও'দিকে তবে নিশ্চয়ই বুঝে
নিতে হবে ভীত সেই প্রাণীটি আরও বড় কোনও বিপদ এড়াতে বিপজ্জনক ক্যারাভ্যানের সামনে
দিয়েও রাস্তা পেরোনোর ঝুঁকি নিতে বাধ্য
হয়েছে। অতএব গাড়িচালক দাঁড়িয়ে যাবে। অপেক্ষা করে দেখবে, বুঝতে চাইবে কী সেই বিপদ। তা কি হঠাৎ ধেয়ে আসা বন্যা, না কি দাবানল অথবা ভয়ঙ্কর
কোনও প্রাণী। যদি বিপদ না খুঁজে পাওয়া যায় তবেই আবার এগোনো। হয়তো এই ইতিহাসই
কালক্রমে বেড়াল পেরোলে দাঁড়িয়ে যাওয়ার প্রতীকী সংস্কারে পালটে গেছে।
নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে অশৌচ এখনও
নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে অবশ্য পালনীয় প্রথা। কী কী করা হয় এই অশৌচ চলাকালীন? এগারো দিন বা ক্ষেত্র
বিশেষে তেরোদিন যাঁদের অশৌচ চলছে তাঁরা চুল দাড়ি কাটবেন না। একবস্ত্রে থাকবেন।
বসার জন্য নিজস্ব আসন(কম্বল
বা কুশাসন)
বহন করবেন।
স্বামীস্ত্রী সহবাস করবেন না। হবিষ্যান্ন(যা কি না অবশ্যই নিরামিষ) খাবেন। নির্ধারিত দিনের
পর চুল দাড়ি কামিয়ে তাঁরা আবার অন্যান্য সহনাগরিকদের সাথে একাসনে বসে একই অন্ন(আমিষান্নও!) গ্রহণের অধিকারী হবেন।
ফিরে পাবেন অন্যান্য অধিকারও। এ'বার বিশ্লেষণ করা যাক সংস্কারটিকে। আগেকার দিনে গড় আয়ু
ছিল কম। অকাল মৃত্যুর হার বেশি। অধিকাংশ
মৃত্যুই হত সংক্রামক ব্যাধিতে(যুদ্ধ বা খুনোখুনি বাদ দিলে)। সংক্রামক ব্যাধির সংক্রমণ রুখতে
এখনকার দিনে যাকে বলা হয় কোয়ার্যানটাইন বা আলাদা করে রাখা সেই ব্যবস্থা নিয়েছিল
তৎকালীন সমাজ,
মানে যতটা
পারা যায় আর কি। সেই জন্যই মৃতের আত্মজনদের জন্য আলাদা বসার আসন, যা সে নিজের সাথে বহন
করবে। হবিষ্যান্ন মানে যতদূর সম্ভব নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাবারও সেই জন্যই। আর চুল
দাড়ি? অবশ্যই কাটবে না। নাপিতের
সর্বজন ব্যবহার্য ক্ষৌরকার্যের যন্ত্রপাতি নিরাপদে রাখতেই ওই সময় তার ধারেকাছে
যেতে দেওয়া হবে না সন্দেহভাজনদের। তেরোদিন পার হয়ে গেছে মানেই তুমি বাছাধন টিকে
গেলে এ যাত্রা। এসো, ফিরে
এসো মূল স্রোতে।
এ'দেশে শববাহকেরা খই ছড়াতে ছড়াতে যায় কেন? এই অভ্যাসের কারণটি কি
হতে পারে?
একটা
সম্ভাব্য সহজ ব্যাখ্যা পাখপাখালির খুঁটে খাবার জন্য সামান্য খাবার ছড়ানো হচ্ছে
পরলোকগত আত্মার শান্তি কামনায়। প্যাঁচালো বুদ্ধিতে ব্যাপারটা হয়তো অন্য রকম। সেই
প্রাচীন কালের শ্মশানগুলি সবই হত লোকালয় থেকে দূরে যেখানে পৌঁছনোর পথ ততটা সুগম
নয়। শক্ত সবল দ্রুতগামী শববাহকদের সঙ্গী যারা তারা কেউ কেউ তত সবল নয়। তারা ধীরে
ধীরে যাবে। কিছুক্ষণ বাদেই শববাহকদের সমস্বর স্লোগান যা প্রায় রণহুঙ্কারের মত
সেটাও অশ্রুতপ্রায়। কীভাবে তবে অনুসরণ করা যাবে তাদের? ছায়াচ্ছন্ন পথে ছড়ানো জাজ্বল্যমান
ধবধবে সাদা খই, আর তার আকর্ষণে আসা কাকপাখিদের
লক্ষ্য করে এগোলেই অগ্রগামীদের খুঁজে পাওয়া যাবে। এই ব্যাখ্যাটা ফেলনা নয় কিন্তু।
বন্যা ভূমিকম্পে শঙ্খ বাজানোর প্রথা সহজবোধ্য।
প্রতিকারের আশায় ঈশ্বরের করুণাঘন দৃষ্টি আকর্ষণের চাইতে এই প্রথায় প্রতিবেশীদের
সাবধান করাই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য। গঙ্গাজলের সুপ্রাচীন পবিত্রতা নিয়েও সন্দেহের
অবকাশ নেই। এখনকার তুলনায় প্রাচীনকালে জনবিরল ভারতে গঙ্গা তখনও এত দূষণের শিকার
নয়। বরং উত্তর আর পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে প্রাণদায়িনী এই জলধারায় হিমালয়ের
পাথরগলানো নানা জীবানুনাশক খনিজ উপস্থিত যাদের তখনও মনুষ্যসৃষ্ট দূষণ দমিয়ে দিতে
পারে নি। তা'ছাড়া বৈজ্ঞানিকভাবেই
প্রমাণিত একথা সত্যি যে গঙ্গাজলে পাওয়া যায় ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী ব্যাকটেরিওফাজ
নামের অণুজীব। সারাদিন ধরে হাজার কিলোমিটারব্যাপী গঙ্গাকে স্নান করায় বিষুবসংলগ্ন
আকাশের সুতীব্র আলট্রাভায়োলেট রশ্মি যা সেই জলকে শুদ্ধ করে। তাই তখনকার অন্যান্য জলউৎসের তুলনায় তখনকার গঙ্গার জল শতগুণে
শুদ্ধ পানযোগ্য তথা পবিত্র ছিল এই আন্দাজে কোনও ভুল নেই। তার সঙ্গে আজকের শত সহস্র
আবর্জনাসমৃদ্ধ গঙ্গাজলের কোনও তুলনাই চলেনা। তবু সেই পুরোনো সংস্কারবশে আজও
মহাপবিত্র এই জল।
হাঁচি পড়ল যাত্রার সময়ে। দু'দণ্ড বসে যাও। আজও অনেকের
কাছে এই নির্দেশ অবশ্য পালনীয়। এ'টিও কিন্তু প্রণিধানযোগ্য। আগেকার দিনে কোথাও যাওয়া মানে
পদব্রজে বা পালকি গরুর গাড়ি চড়ে যাওয়া। খুব কম ক্ষেত্রে বাহন অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতি
ঘোড়া। যাই হোক না কেন এখনকার পক্ষে সহজগম্য জায়গাতেও গিয়ে ফিরে আসা মানে
নিদেনপক্ষে কয়েকদিনের ধাক্কা। যেমন ধরা যাক কলকাতা থেকে রাণাঘাট নৈহাটি এমনকি
হাতের কাছের শহরতলি ব্যারাকপুর। নিছক অভিজ্ঞতা থেকে তখনকার দিনেও মানুষ জানত হাঁচি
হচ্ছে একগুচ্ছ রোগের পূর্বলক্ষণ। এখন আমরা জানি সেই অসুখগুলি ভাইরাস ঘটিত।
মানে তথাকথিত ঠাণ্ডাসর্দি লাগা থেকে শুরু
করে ইনফ্লুয়েঞ্জা হাম এমনও কী প্রাণঘাতী বসন্তরোগ অবধি। কাজেই যাত্রার সময়
যাত্রাকারী হোক বা বাড়ির কেউ যদি হেঁচে ফেলে, দু'দণ্ড অপেক্ষা করে দেখ, আরও হাঁচি পড়ে কি না, অথবা পরবর্তী রোগলক্ষণ
জ্বর বা অন্য কিছু প্রকাশ পাচ্ছে কি না। যদি তেমন হয়, যাত্রা বাতিল, কেননা স্বস্থানে ফিরতে
লেগে যাবে কয়েকদিন। খারাপ খবর পাওয়ার বা দেবার জন্য নেই ডাক তার, এমনকি নতুন জায়গায় হাতের
কাছে হয়তো নেই ডাক্তারও!
টিকটিকি ডাকলে যাত্রা স্থগিত রাখার মূলেও সম্ভবতঃ
রয়েছে সেই পর্যবেক্ষণ যে ছোট প্রাণীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে ডাকাডাকি করে, চঞ্চল হয়ে ওঠে। পিছুডাক
অর্থাৎ কোথাও রওনা হবার সময় পেছন থেকে ডাকা, এটাকেও যাত্রায় বাধা বলে ধরে
নেওয়া হয়। এটার মানে ওই একই। যাত্রারম্ভের সময় যাদের ছেড়ে যাচ্ছ তাদের কেউ অসুস্থ
হল বা কোনও কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেল না তো? একটু থমকে সেই সম্ভাবনাগুলো যাচাই করে নাও।
এক শালিক দেখা দুর্ভাগ্যসূচক। এমন
কী সাগর পেরিয়েও সেই সংস্কার। ওয়ান ফর সরো, ট্যু ফর জয়! কেন? শালিক বা অন্য ছোট পাখি
যারা সাধারণভাবে সবসময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে সে হঠাৎ একা কেন? তবে হয়তো আশেপাশেই আছে কোনও ঘাতক, দু'পেয়ে বা চারপেয়ে বা
সরীসৃপ ... কিম্বা দাবানল ... কিম্বা ঝড়বৃষ্টির মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিম্বা বার্ড ফ্লু'র মত অন্য কোনও দুর্যোগ, যা সেই একলা পাখিকে
সঙ্গীহীন করে দিয়েছে। নিকটেই থাকা সেই ঘাতক দুর্ভাগ্য নেমে আসতে পারে দর্শকের
জীবনেও। তাই এক শালিক দেখা অশুভ। এর সাথে বিরহ কাতর প্রেমিকপ্রেমিকাদের একাকীত্বের
দুঃখ যোগ হয়ে ব্যাপারটাকে পুরো কাব্যিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
অশুভ সংখ্যা তেরো এত অশুভ কেন? একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা
হল এই সংখ্যাটি দুই তিন চার ছয় আর বারো দিয়ে অবিভাজ্য। এই রকম ছোট সদস্যসংখ্যার গোষ্ঠীতে
কাজেই বারোটা শিকার অথবা ফল অথবা অন্য কিছু
এলে ঝগড়ার অবকাশ নেই। কিন্তু এক বেড়ে সংখ্যাটা তেরো হলেই অবধারিত বিবাদ
মনোমালিন্য এবং সে যুগের নিরিখে হয়তো বা
প্রাণহানিও। কাজেই তেরো অশুভ, হ্যাঁ আজও!
প্রথমেই যা বলছিলাম। কুসংস্কারের
বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের অনেকের হাতে গলায় কোমরে গ্রহরত্নের আংটি তাবিজের রমরমা
এখন। এই গ্রহ রত্নের ধারণার উদ্ভব কী ভাবে? কল্পনা করা যাক সে যুগের কথা। ছোট
বড় গোষ্ঠীতে মানুষেরা বাস করছে। গোষ্ঠীপতি সবার চাইতে শক্তিশালী একটা মানুষ, যার বুদ্ধিও হয়তো
অন্যান্যদের গড়বুদ্ধির চাইতে একটু বেশি। সেই গোষ্ঠীর একজন হঠাৎ করে কুড়িয়ে পেল
একটা দর্শনদারী পাথর বা ঝিনুক ভেঙ্গে পেল একটা চকচকে মুক্তো। সবার কাছে নেই। বিরল, তাই সেটি লোভনীয়। তাই
সেটি রত্ন। পাঁচকান হতে হতে সেই রত্নের খবর পাবে এবং অবধারিত ভাবে সে'টি জোর করে গ্রাস করবে
ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীপতি। অথবা রত্নসংগ্রহকারী নিজেই সেটি উপঢৌকন দিল নেতাকে। হয়তো
তার পক্ষে অপ্রাপণীয় কোনও সুবিধা বা গোষ্ঠীপতির
উচ্ছিষ্ট কোনও নারীর বিনিময়ে। যাই হোক না কেন সেই রত্ন এখন ক্ষমতাবানের দখলে। সেই
ক্ষমতাবান পরবর্তী অনেক লড়াই জিতবে (জেতার সম্ভাবনা বেশি, কারণ সে তো আসলেই শক্তিশালী!)। সে নিজে তো বটেই আর তার
আশেপাশের মানুষজনেরাও বিশ্বাস করতে শুরু করবে ওই দেহলগ্ন রত্নই তার এই সাফল্যের
মূলে। পুরোহিত তথা জ্যোতিষিদের খেলা শুরু হবে এর পর। তারা নানান আঁক কষে প্রমাণসিদ্ধ
করবে অনুরূপ সাফল্য পেতে গেলে অনুরূপ রত্নধারণের প্রেসক্রিপশন। অর্থাৎ
প্রাথমিকভাবে রত্ন যা কিনা দখলে এসেছিল ক্ষমতার জোরে, সে'টি নিজেই এখন ক্ষমতাদায়ক বলে
মর্যাদা পেয়ে গেল। তুমি গরিব, তত ক্ষমতাবান নও? কুছ পরোয়া নেই। তোমার জন্যও রয়েছে হিরের বদলে অমুক গাছের
ডাল, গোমেদের বদলে তমুক গাছের
শেকড়। নিদেন পক্ষে মন্ত্রপূত পুজোর ফুল বেলপাতা সমৃদ্ধ তাবিজ, বাঘের নখ বা সাপের হাড়।
হাতে গলায় কোমরে বেঁধে ঘুরে বেড়াও সাফল্য সমৃদ্ধির অনন্ত সন্ধানে।
মেয়েদের সাজসজ্জার কথা আলোচনা করা
যাক। মেয়েদের সুন্দরী দেখাতে গেলে সাজতে হয় এতো প্রায় একটা সংস্কারই। সালঙ্কারা
কন্যার কথা কাব্যে সাহিত্যে বহুল আলোচিত। গয়নাগাটি(নারীপুরুষ নির্বিশেষে) যা কিছু দেখি সবই কিন্তু
সভ্যতার আদিকালের দাসপ্রথার স্মৃতিবহনকারী। যুদ্ধে জয় করা বা ক্রীত দাসদাসীদের
স্বভাবতই বেঁধে রাখা হত বেড়ি শেকল প্রয়োজনে নাকে দড়ি পড়িয়ে। এর মধ্যে কোনও দাস বা
দাসী অধিকতর প্রিয় বা কালক্রমে ভালবাসার জন হয়ে পড়লে তাকে লোহার বেড়ি বা শেকলের
বদলে গড়িয়ে দেওয়া হত সোনার রূপোর বেড়িশেকল। দাসপ্রথা চলে গেল কিন্তু সেই অপমানের
বন্ধনের স্মৃতি রয়ে গেল সোনার কাঁকন সাতনরি হার আর হিরের নাকছাবি হয়ে। না কি সেই
পুরোনো দাসত্বই চলছে আজও! যাঁরা সাজেন আর যাঁরা সাজ যোগান তাঁরা কি এতসব ভাবেন?
অলঙ্কার বাদ দিয়ে মেয়েদের অন্য
রূপসজ্জার সাথে তো রীতিমত কান্নার ইতিহাস জড়িয়ে। সভ্যতা যখন পুরুষতান্ত্রিক হল, মেয়েরা আবদ্ধ হল ঘরে, তখন তাদের ঘরকন্নার
হাড়ভাঙা খাটুনির সাথে অবশ্য করনীয় দায়িত্ব ছিল বছর বছর গর্ভবতী হয়ে গোষ্ঠীকে
জনসমৃদ্ধ করা। তাই তখন প্রচলিত ছিল শতপুত্রের জননী হবার আশীর্বচন। পুরুষদের ক্ষুন্নিবৃত্তির পর মেয়েগুলি আহার্যও
পেতনা ঠিকঠাক। অবধারিত ভাবে দেখা দিত রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া।
সেই অ্যানিমিক মেয়ে না পারত ঘরের কাজ, না পারত সুস্থ সন্তানের
জন্ম দিতে। এক কথায় সে তখন গোষ্ঠীর বোঝা। তাই তাকে অবহেলায় ত্যাগ করা বা বনবাসে
বিসর্জন দেওয়াই ছিল সঙ্গত। ডাক্তারবাবুরা অ্যানিমিয়া ক্লিনিক্যালি দেখেন শরীরের
কোথায় কোথায়?
জিভে,চোখের পাতায়, হাতের নখে,হাত পায়ের তালুতে, গালের চামড়ায়। সেখানে
রক্তাভা দেখে তাঁরা বোঝেন শরীরে রক্ত আছে কেমন। সেই আদি কালেও এই সব দেখেই আন্দাজ
করা হত মেয়ে বিসর্জনের যোগ্য হল কি না। মেয়ে তখন বাঁচার জন্য শরীরের এই সমস্ত
জায়গাগুলিকে লালরঙ করে ফেলল। হাতপায়ের নখে লাগালো
নেলপালিশ, পায়ের
তালুতে আলতা,
হাতে
মেহেন্দি,
ঠোঁটে
লিপস্টিক,
জিভে আর
ঠোঁটে পানের লাল রঙ, চোখে
কাজল আর সুর্মা যার মূল কাজ হবে কেমিক্যাল ইরিটেশনে, অ্যানিমিয়ায় ম্লান কনজাইটাইভাকে
রক্তিম করা। এখন আমরা যতই অন্য অন্য রঙের লিপস্টিক বা নেলপালিশ দেখিনা কেন এগুলো
কিন্তু আদিতে ছিল, আদিতেই
বা বলছি কেন,
এই সেদিনও
ছিল টকটকে লাল। সেই লাল ... কোনও সন্দেহ নেই ... অ্যানিমিয়া ঢাকার সেই আদিম
কান্নাভরা প্রয়াসেরই সংস্কার।
সঠিক জানিনা অন্য দেশের বা অন্য
মহাদেশের সংস্কারগুলো। তবে এ'টুকু জানি তার অনেকগুলোর সাথেও জড়িয়ে থাকবে বহু বছরের
অভিজ্ঞতা ব্যথা আর বাঁচবার লড়াইএর কাহিনি যা কী না উলটে পালটে এখন অর্থহীন তথাকথিত
কুসংস্কার!