সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি পথেরপাঁচালী মুক্তি পেয়েছিল১৯৫৫সালের ২৬শে আগস্ট। পথের পাঁচালী যে বাংলা সিনেমাকে
রাতারাতি নাবালক থেকে সাবালক বানিয়ে বাংলা ছবির নব মেঘদূত রচনা করেছিল একথা আর নতুন করে বলার কোন প্রয়োজন নেই। এর সাথে ছবিটি যে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে বিশ্বের দরবারেও হাজির করেছিল এ তথ্যও আমাদের সকলেরই জানা। এই ছবিটির নিরিখে ভারতীয় আধুনিকতাকে দেখার ও বোঝার চেষ্টায় রত হননি এরকম তাত্ত্বিক বা সিনেমা প্রেমীর সংখ্যা খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। মোটের ওপর ছবিটিকে নিয়ে যতটা লেবু কচলানোর ছিল তা আমরা স্থান, কাল, পাত্র বিশেষে পুরোপুরি কচলে নিয়েছি। তাই আজকের দিনে এসে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী বা
অন্যান্য ছবিগুলি নিয়ে প্রায় নতুন কিছুই বলার নেই। তাও ব্লগের সম্পাদক মণ্ডলীর অনুরোধ যে সত্যজিৎ রায় নিয়ে কিছু লিখতে হবে। কাজেই লিখতে বসা। তৎকালীন বাংলা ছবি তথা বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ও তার নিরিখে সত্যজিৎ রায়ের অবস্থান ও ছবির আঙ্গিক নিয়ে দু-চার কথা বলতে চাই।
রাতারাতি নাবালক থেকে সাবালক বানিয়ে বাংলা ছবির নব মেঘদূত রচনা করেছিল একথা আর নতুন করে বলার কোন প্রয়োজন নেই। এর সাথে ছবিটি যে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে বিশ্বের দরবারেও হাজির করেছিল এ তথ্যও আমাদের সকলেরই জানা। এই ছবিটির নিরিখে ভারতীয় আধুনিকতাকে দেখার ও বোঝার চেষ্টায় রত হননি এরকম তাত্ত্বিক বা সিনেমা প্রেমীর সংখ্যা খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। মোটের ওপর ছবিটিকে নিয়ে যতটা লেবু কচলানোর ছিল তা আমরা স্থান, কাল, পাত্র বিশেষে পুরোপুরি কচলে নিয়েছি। তাই আজকের দিনে এসে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী বা
অন্যান্য ছবিগুলি নিয়ে প্রায় নতুন কিছুই বলার নেই। তাও ব্লগের সম্পাদক মণ্ডলীর অনুরোধ যে সত্যজিৎ রায় নিয়ে কিছু লিখতে হবে। কাজেই লিখতে বসা। তৎকালীন বাংলা ছবি তথা বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ও তার নিরিখে সত্যজিৎ রায়ের অবস্থান ও ছবির আঙ্গিক নিয়ে দু-চার কথা বলতে চাই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন কারণে কলকাতার স্টুডিওগুলো তাদের প্রভাব ও প্রযুক্তিগত কর্মদক্ষতা হারিয়ে
ফেলতে থাকে। তার সাথে বাংলা ছবি যে নির্দিষ্ট ধরণ ও হলিউডি নির্মাণ পদ্ধতি ধীরে
ধীরে আয়ত্ত করছিল সেগুলিও বড়সড় সঙ্কটের মুখে পড়ে যায়। ছবির বাজারও তার আগের
স্থিতিশীল জায়গা থেকে অনেকটা অবিন্যস্ত হয়ে যায়। স্টুডিওর বিপন্নতার সুযোগ নিয়ে
একদল ফাটকা কারবারি লোক ছবির প্রযোজনায় আসতে শুরু করে। ছবির গুণমান নিয়ে তাদের
চিন্তাভাবনা যে বি.এন.সরকারের (নিউ থিয়েটার্সের কর্ণধার) মত নয় সেটা দেখা যাচ্ছিল।
আগে ছবির বাজেট যেখানে গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা ছিল তা এক ধাক্কায় এক-দেড়
লাখে নেমে আসে। এই সময় গুণমান বজায় রেখে ছবি করতে পারাটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। এবং
সেটা সম্ভবও হচ্ছিলনা। অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় তখনো উত্তম কুমার হয়ে ওঠেননি।
কাজেই গোটা ইন্ডাস্ট্রি-ই একটা দোলাচলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। এই মাহেন্দ্রক্ষণেই
সত্যজিৎ রায় ছবি তৈরিতে হাত দেন। পথের পাঁচালী (১৯৫৫) এই কারণেই সেই সময়কার সবথেকে
গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলির মধ্যে একটি। স্টুডিও তথা ইন্ডাস্ট্রি সিস্টেমের বাইরে থেকে
ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংলা ছবির নিরিখে এই ছবির আঙ্গিক সম্পূর্ণ নতুন। আর
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ছবির লোকেশন: গোটাটাই রিয়েল লোকেশন অর্থাৎ আউটডোরে
করা। আগেও বাংলা ছবি কমবেশি আউটডোরে শুট করা হয়েছিল। কিন্তু সেসব ছবির তুলনায় এই
ছবির বাস্তববাদী রূপ পুরোটাই আলাদা। এটা কিভাবে সম্ভব হল? ছবিতে বাংলার গ্রামের খুব বেশি মাত্রায় ডিটেলিং লক্ষ করা
যায়। ক্যামেরার অনেক বেশি গতিশীলতাও লক্ষণীয়। তার সাথে ছবিতে শটের দৈর্ঘ্য খুব কম
ছিল। অর্থাৎ বাংলা ছবিতে সেই সময় একটি দৃশ্যে প্রথাগতভাবে যত শট থাকত এখানে তার থেকে
বেশিই ছিল। অথচ সেই সময় ইন্ডাস্ট্রির নিয়ম ছিল একদিনে ২৫০০ ফিট বা তিন মিনিট এডিটেড
রাশ শুট করতেই হবে অর্থাৎ একদিনের শুট করা রাশের পরিমাণ সম্পাদনার পর ২৫০০ ফিট বা ৩ মিনিটের হতে হবে। নইলে বাজটের
মধ্যে ছবি কিছুতেই শেষ করা যাবেনা। সেক্ষেত্রে দৃশ্যে শট যত কম থাকবে ততই
লক্ষ্যমাত্রার কাছে পৌঁছানো সম্ভব, নচেৎ নয়। ইতিহাস বলে এই ছবির বাজেট খুব কমই ছিল। তর্কের খাতিরে একথা যদি ধরে
নেই যে চিন্তা-ভাবনা ও চলচ্চিত্র বোধে সত্যজিৎ রায় সমসাময়িক পরিচালকদের থেকে উন্নত
তাহলেও প্রয়োগগত কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। ক্যামেরার ব্যাটারির ওজন খুবি বেশি হওয়ার
ফলে ক্যামেরা নিয়ে বাইরে ছবি তুলতে যাওয়ায় সমস্যা ছিল। বিশেষ করে ছবির বাজেট যদি
কম হয়। তা সত্ত্বেও তিনি কিভাবে সেটা করতে সক্ষম হলেন? সেই সময়কার মিচেল ক্যামেরায় মোটরের একটা শব্দ হওয়ার ফলে
বাস্তব লোকেশনে শব্দগ্রহণ করায় সমস্যা ছিল। তিনি কিভাবে তা করলেন? এই ব্যাপারগুলো খুঁজে বের করা জরুরি। বাংলা ছবির ইতিহাস
লেখার জন্য এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়াও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দর্শন, সমাজ চিন্তা, শিল্পবোধের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায় কিন্তু এগুলো নিয়েও।
উত্তর পাওয়া গেল পূর্ণেন্দু বোসের
কাছে। তখনকার যুগের একজন সহকারী আলোকচিত্রী। উনি পথের পাঁচালীতে অবশ্য কাজ করেননি
কিন্তু পরবর্তীকালে ওঁর অনেক ছবিতে কাজ করেছেন। “বাংলা ছবি সেই সময় খুবই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছিল। মানিকবাবুই তাকে
নতুন পথ দেখালেন। সেই সময় স্টুডিওর বাইরে শুট করার রিস্ক কেউ নিতনা। তিনিই দেখালেন
যে স্টুডিওর বাইরে রিয়েল লোকেশনে শুট করেও সাফল্য পাওয়া যায়। দর্শক নেয়। কাজটা সহজ
ছিলনা। ক্যামেরার সাথে যে এ.সি মোডে চালানোর জন্য যে ব্যাটারিগুলো ছিল তার ওজন খুব
বেশি। তা নিয়ে বাইরে বাইরে শুট করা খুবি সময় ও খরচ সাপেক্ষ ছিল। মাণিকবাবু আর
সুব্রত মিত্র (আলোকচিত্রি) এর উপায় বের করলেন। ওঁরা দেওজি ভাই (আলোকচিত্রি)-এর
থেকে একটা ডি.সি মোটর ও তার ব্যাটারি ভাড়া করে শুটিং করলেন। ওগুলো খুবই হ্যান্ডি।
ক্যারি করা অনেক সুবিধাজনক। ক্যামেরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মুভ করাতে অনেক কম
সময় লাগে। অনেক বেশি শট নেওয়া যায়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কেউ ওগুলো ব্যবহার করতনা।” কারণটা
অজ্ঞাত নয় কারণটা হল ভয়। নতুন কিছুতে হাত না দিয়ে প্রথাগত ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়াই
ইন্ডাস্ট্রির প্রচলিত রীতি। আর এই রীতিকেই সত্যজিৎ রায় আঘাত করেছিলেন।
অপু-দুর্গার কাশ বনের মধ্যে দিয়ে
ট্রেন দেখতে যাওয়ার দৃশ্যটা বাংলা ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। সেটা কিভাবে সম্ভব
হয়েছিল? পূর্নেন্দুবাবু- “সুব্রতবাবু কাঁধে
ক্যামেরা নিয়ে ছুটেছিলেন। আর আরেকজনের কাঁধে ছিল ব্যাটারি। কারণ ট্রেন কখন আসবে
ঠিক জানা ছিলনা। আর একবার ট্রেন মিস করলে বেলা পরে যেতো। আলো পাওয়া যেতনা। তাই
ট্রেন আসছে দেখেই এইভাবে শটগুলি নেয়া হয়েছিল। এরকম তৎপরতা না দেখালে হয়তো দৃশ্যটা রাখাই
যেতনা”। বাকি রইল বাস্তব লোকেশনে
শব্দগ্রহণ। “এর জন্য এক্সট্রা যা লাগে তা হল
সাহস। বাইরের অনেক অযাচিত শব্দ আর ক্যামেরার মোটরের শব্দ চলে আসার ভয়ে কেউ এটা
করতনা। পথের পাঁচালী-ই দেখিয়েছিল ট্যাক্টিক্যালি হ্যান্ডল করলে এটা করায় বিশেষ কোন
সমস্যা নেই”।
পথের পাঁচালী সবদিক থেকেই খুব
উন্নতমানের ছবি। বিশেষ করে ছবির আঙ্গিক। তা না ছিল প্রথাগত হলিউড না ছিল ইটালিয়ান
নিও রিয়েলিস্ট ঘরানা। একেবারেই ইউনিক। প্রবলভাবে ভারতীয়। ছবির বিষয় নিয়ে লক্ষকোটি
লেখা আছে। নির্মাণকৌশল নিয়ে মানুষের ঔদাসীন্য দেখলে মনে হয় ছবিটা তৈরি করা হয়নি-
উনি ভেবেছেন আর আকাশ থেকে টুপ করে এক ফালি চাঁদের মত ছবিটি আমাদের মাঝে এসে পড়েছে।
এই লেখা জন্মদিনের সামান্য উপহার
মাত্র। পরবর্তীকালে আশা করব এই নিয়ে আরও অনেক গুরত্বপূর্ণ কাজ হবে। করতে হবে।