১
পদ্মার দেশে জন্ম। জলের মতই
চঞ্চল ছিল ছোটবেলাটা। ঠাকুমা প্রবল ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক নিয়ে রাঁধছেন গোকুলপিঠে, একরত্তি মেয়েটা স্নান না করেই বাম হাতে পিঠে
তৈরির খানিকটা পুর তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিল। অতখানি পুর সম্পূর্ণ সকড়ি হয়ে যেতে
ঠাকুমা উনুনের আধনেভা একটা কাঠ ছুঁড়ে দিল যমুনার দিকে। দক্ষ ব্যাটসম্যানের মতো পাশ
কাটিয়ে সেটা আবার ঠাকুমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হাঁটুর ওপর শাড়ি তুলে চোঁ-চাঁ দৌড়।
বাবারে-মারে, মেরে ফেললো রে, দস্যি-অলক্ষ্মী- কোন গালই কানে নেওয়ার সময় নেই
তার। বাবা ফিরে এসেছে যে বন্দুক নিয়ে! জমির খালপারে বাঘ তাড়াতে গেছিল যে বাবা।
বাবা- কটা বাঘ ছিল? মারমুখী মা’র হাত থেকে যমুনাকে বাঁচিয়ে কাছারি বাড়িতে
তামাক খেতে যাওয়ার সময় মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে গেল বাবা। আলম, বাড়ির আধবয়সী চাকরের কোলে করে তেঁতুল চুষে চুষে
খেতে যাওয়ার সময় মেয়েটা জেনে নেয় আজ দুপুরে মোরলা মাছ ভেজেছে কিনা, বুড়ি রাক্ষসী (ঠাকুমা) জেগে আছে কিনা তখনও। বোন
হাসি তার গোয়ালে লুকিয়ে রাখা মাটির চৈতন্যদেব আর ছাগলের পুতুলে হাত দিয়েছে কিনা।
নিশ্চিন্ত হয় বাড়ি নিঝুম দেখে। খাওয়ার খাইয়ে দেয় আলম। ঠাকুমা আলমের হাতে কিছু খেতে
বারণ করেছে বহুবার। কই মা তো কিছু বলে না। আলমটা কত ভাল। বুড়িটার বেশি বেশি। বুড়ি
মরে না কেন!
বুড়ি মরলো।
চৈত্র মাসের গরমে তুলসী তলায় বুড়ির মোটাসোটা দেহটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। অমন শক্ত মানুষ বাবাটা এক-আধবার চোখ মুছছেন আর বিড়ি টানছেন। সবাই কাঁদছে কেন? বুড়ি মরেছে আপদ গেছে। এটা ছুঁবি না, সেটায় হাত দিবি না। ওতে লক্ষ্মী রাগ করবে- যমে টানবে- এসব আর শুনতে হবে না। সেদিনটা কেটে গেল। পরের একটা মাসও। তারপর একদিন লুকিয়ে বুড়ির পানের বাটায় সুপুরি চুরি করতে গিয়ে দেখে চুনটুকু শুকিয়ে কাঠ। কে-জানে কেন চোখে জল এল। হাসির পিঠে দু’কিল বসিয়ে গোয়ালে গিয়ে ফোঁপাল অনেকক্ষণ। তারপর ফিরে এল ঘরে। মায়ের পাশে আস্তে করে শুয়ে গেল। বুড়ি কোথাও থেকে চেঁচাল না- ওরে রাক্কুসি, হাত পা না ধুয়ে উঠুন পেরলি? গেরস্তঘরে একি অনাচিছটি!
চৈত্র মাসের গরমে তুলসী তলায় বুড়ির মোটাসোটা দেহটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। অমন শক্ত মানুষ বাবাটা এক-আধবার চোখ মুছছেন আর বিড়ি টানছেন। সবাই কাঁদছে কেন? বুড়ি মরেছে আপদ গেছে। এটা ছুঁবি না, সেটায় হাত দিবি না। ওতে লক্ষ্মী রাগ করবে- যমে টানবে- এসব আর শুনতে হবে না। সেদিনটা কেটে গেল। পরের একটা মাসও। তারপর একদিন লুকিয়ে বুড়ির পানের বাটায় সুপুরি চুরি করতে গিয়ে দেখে চুনটুকু শুকিয়ে কাঠ। কে-জানে কেন চোখে জল এল। হাসির পিঠে দু’কিল বসিয়ে গোয়ালে গিয়ে ফোঁপাল অনেকক্ষণ। তারপর ফিরে এল ঘরে। মায়ের পাশে আস্তে করে শুয়ে গেল। বুড়ি কোথাও থেকে চেঁচাল না- ওরে রাক্কুসি, হাত পা না ধুয়ে উঠুন পেরলি? গেরস্তঘরে একি অনাচিছটি!
আরও বছর দুই পর। বুড়ির রোগ
এখন মাকে ধরেছে। মাঝে মাঝেই মা আর রান্নাঘর-ঠাকুরঘরে ঢুকতে দেন না। হাসিকে কোলের
কাছে নিয়ে রান্না করেন। আলম বাটনা বাটে, কাপড় কাচে। গরুকে জাবনা দেয়।
যমুনা শান্ত হয়ে বসে থাকে বাড়ির পেছনের পুকুরের ঘাটে। ওপাড়ার সোনাজ্যাঠা বাবাকে কি
একটা লোকের ঠিকানা এনে দিয়েছে। সবাই বলছে তার নাকি বিয়ে। হুঁ, বললেই হল। আমাকে তেঁতুল আচার খেতে দেবে না বলে
এইসব বলছে। না, বোধহয় পুন্নিমে পুজোর ভোগ আগেভাগেই উঠিয়ে খেয়ে
নিয়েছিল বলে এই শাস্তি। মেয়েটা ভেবে কুল পায় না। তার ওপর গত একমাস ধরে বাড়ির পেছনে
জঙ্গলের ঘরটার চাদ্দিকে লোহার খাঁচা মত কি একটা করাচ্ছে বাবা। হাসির উৎপাতে কখনও
কখনও ওখানেও পুতুল রেখেছে সে এর আগে। সেদিন বাবা আর কোনও কথা শুনলেন না। মজুরও
ডাকেন নি। নিজের হাতে সব নোংরা পরিষ্কার করেছেন। আলম পাহারা দিয়েছে চাদ্দিক। তার
ভাঙা চৈতন্যদেব আর মাটির হাঁসের ঠাঁই হয়েছে পুকুরে। এখন থেকে যমুনা, মা আর হাসি নাকি ওঘরেই শোবে। ভাই হরি, কেষ্ট আর বাবা বড় শোবার ঘরে। সন্ধ্যার পরেই
যেটুকু হয় ভাত, ডাল, ছোট মাছের বড়ি দেওয়া ঝোল
খেয়ে ওখানে চলে যায় ওরা। বাবা গত দু’হপ্তা যশোরে যায়নি। মশলা দেওয়া ভাল ঝাল
পাঁপড় আনবে কথা দিয়েছিল। সব্বাই কি ঠাকুমার মতো হয়ে গেল? লোহার গ্রিলে তালা লাগিয়ে চলে গেল বাবা। সে
জানে এখন বাবা শোবে, আর আলম বড় ঘরের দাওয়ায় বসে বিড়ি টানবে। কেউ কি
আসার কথা আছে? নাহলে সারারাত আলম জেগে থাকে কেন? বাবা আর আলমের সাথে ধমকে কথা বলে না। সোনাজেঠু, উমাকাকুর সাথে যেভাবে কথা বলে, সেভাবেই কথা বলে আলমের সাথে। কই, যমুনা তো এসব ভাবে না, এই কালকেও সে আলমকে ঘুঁটে ছুঁড়ে মেরেছে। আলম তো
আগের মতোই হেসেছে। শান্তির কাছে তার বৈঁচি ফুলের দুটো মালা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু
আজ তিনদিন হল তাকে কেউ বাড়ির বাইরে যেতে দেয় নি। শান্তি আর জন্মেও তার সাথে কথা
বলবে না। আচ্ছা, আসছে শ্রাবণে শান্তির মেয়ের সাথে তার ভাঙা
চৈতন্যের বে! এমন ধারা করলে আর সে বে দেবে? বাবাটা আজকাল আর কিচ্ছু বোঝে
না! আচ্ছা, এখন একটু পুরনো কড়িগুলো নিয়ে খেললে হয় না? মা’কে ভয়ে ভয়ে বলে- মা, বড় ঘর থেকে আমার পুঁটলি’টা আনব। হাসি ঘরের কোনেই হিসি
করতে গিয়ে জল-জল করে চেঁচাচ্ছে। মা ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল গালে- “রাক্কুসি, জাতধম্মো সব খোয়াবি? মরিস না কেন তুই!”
থমথমে বিকেলে একগাদা
গাড়ি-ঘোড়া করে যে লোকটা তাকে নিয়ে চলে গেল তাকে সে আগে কখনও দেখে নি। খেমি পিসি
শাঁখ বাজাতেই সোনাজেঠু ধমকে উঠলেন। সিঁদুর পরা মাথা লম্বা ঘোমটায় ঢেকে তার ওপর
কালো চাদর পরে তাকে যেতে হল কোথায় একটা! শুনেছে তার শ্বশুরবাড়ি নাকি মালদায়।
মহদিপুর থেকে একটু দূরে। কাছেই বড় কাছারি বাড়ি- ইঞ্জিরিবাজার। লোকটা বয়সে একটু বড়।
কিন্তু দেখতে ভালো। ফরসা, লম্বা। কাপড়ের বড় দোকান আছে নাকি শহরে।
শান্তিকে এসব বলবে ভেবেছিল। কিন্তু এর আগে একমাস থেকে শান্তির কোন খবর পায়নি সে।
মাকে বলতেই আঁচলে চোখ ঢেকেছিল মা – তাই তো তোকে দূর করে দিচ্ছি
মা। শান্তি আর জন্মে সুখে থাকবে যুনি, এখন আর ওর কথা ভাবিস না।
স্বামীর ঘরে যাবি, কত বড় শহর, সবাই হিঁদু, সুখে থাকিস মা।
নাহ্, মাও ঠাকুমার মতো পাগল হয়ে গেল।
আজ তিনমাস ঐ বয়সে বড় বরের
দেখা পায়নি যমুনা। ঐ লোকটা কলকাতা যায়। কলকাতায় নাকি বড় বড় সব ব্যাপার। বড় বড় সব
বাড়িঘর। অনুমাস্টারের দোতলা বাড়ির চাইতেও অনেক বড়, অনেক তলা। লোকটা গল্প করে। ভালো একটা শাড়ি এনে
দিয়েছে। আর নাকের ফুল। সোনার। বাবা যেটা দিয়েছিল তার চাইতেও সুন্দর। ওখান থেকে তার
বর আর দেওর মালপত্র আনে। নিজেদের দোকানে বিক্কিরি করে, এখানে সব কিছু অনেক ভাল। শাশুড়ি তাকে কত
কাজকম্ম শেখান। মাঝে মাঝে দু’এক ঘা কিল মারেননি এমন নয়। কিন্তু শ্বশুর তার দেবতার মত মানুষ।
তাকে খুবই ভালোবাসেন। কত উপোসের দিন লুকিয়ে পরোটা খেতে দিয়েছেন। ছোট দুই দেওরের
সাথে মারামারি করে দুপুরের অনেকটা সময় কেটে যায় তার। এরা সবাই কৃষ্ণ কৃষ্ণ করে
অস্থির। ফি বেস্পতিবার কেত্তন বসায় তুলসীতলায়। লোকজন অবশ্য মন্দ লাগে না তার।
কিন্তু ঐ যে। কেত্তন হলেই ননদ আসে আর কথায় কথায় তার খুঁত ধরে। দেওর না থাকলে
শাশুড়িকে নালিশ করতেও ছাড়ে না। তার দেওরের সাথে কথা বলেছেন তার বাবা। শহরে তাদের
পাড়া থেকে একটু দূরেই একটা বাড়ি দেখেছেন বাবা। ওখানে নাকি আর থাকা যাবে না। হাসি, মা, বাবা আর ভাইয়েরা সবাই চলে
আসছে এখানে। কি মজা! কিন্তু বাবা যে দু’দিন এখানে এসেছিলেন, তাকে একটুও খুশি দেখেনি যমুনা। শ্বশুর মশাইয়ের
সাথে কি সব কথা বলেছেন গম্ভীর মুখে, কখনও চোখের জল ফেলেছেন। সান্ত্বনা
দিয়েছেন শ্বশুরমশাই। তার বর নিজেও বলেছে ওখানে আর থাকা যায় না। সবাইকে চলে আসতে
হবে এখানে। আচ্ছা, ওখানকার বাড়িঘর তাহলে কি হবে? কে থাকবে? গরুগুলোর কি হবে? – কেন? কেটে খাবে! হাসতে হাসতে
বলেছিল ননদ।
বাবা বললেন। আলমের খুব সুনাম
করলেন সেদিন। যুনি জানতে পারল আলমই এখন থেকে তাদের বাড়িতে থাকবে। ওদের গোয়াল, বড় শোবার ঘর, উঠোন সব কিছুতে থাকবে আলমের পরিবার। এই প্রথম
আলমের ওপর সত্যিকার রাগ হল যমুনার। ব্যাটা, তোর পেটে পেটে এই ছিল! আমার
বাবাকে কি এক মন্তর দিলি- বাবা সব তোকে দিয়ে এইখানে চলে এল? কেন? তোকে কি আমরা মাইনে দিতুম না? শ্বশুরের কাছে সেদিন আলমের নামে বেশ করে
গালাগাল দিতেই হঠাৎ ধমকে উঠলেন শ্বশুরমশাই। এই প্রথমবার। হাতের চা ঠকঠক করে কাঁপছে – “তুমি জানো বউমা, আলম না থাকলে কি হতো? তোমার বোন, হাসি, তাকে নিয়ে আর......যাক্গে, ছেলেমানুষ, ছেলেমানুষের মত থাক। আর নাহয়
তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস কোর গিয়ে, আলম না থাকলে কি হত...” কথা শেষ না হতেই দেওর দৌড়ে এল ছাদে- বাবা, হয়েছে। রেডিও তে বলছে মালদা এদিকে। চোখের জল
ফেললেন শ্বশুরমশাই।
আচ্ছা, এরা কি সবাই পাগল? এদিক- না ওদিক তাতে কি হল? কোনদিক? রাস্তায় কিসের চিৎকার? মিছিল নাকি?
২
সেই ছলছলে যমুনা আজ প্রায়
সাগরে এসে পড়ার মুখে। তার সেই গতিও নেই। স্বামী লোকটার সঙ্গে সংসার করতে অসুবিধে
হয়নি। বাড়ির বড় বউ হিসেবে যা-দেওররাও সম্মান করে এসেছে চিরকাল। দুই জামাইও খুব
ভাল। বড় ছেলের ফুটফুটে সন্তানের পেছনেই দিনের অনেকটা সময় কেটে যায় তার। ছোট্টবেলায়
বুড়ি ঠাকুমার যে ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে মজা করে এসেছে সে, আজ তার দুই বউমাই সেই রোগের শিকার। হাসি পায়
যমুনার। বাবা গেছেন অনেকদিন হল। শ্বশুর-শাশুড়ির যাওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই। একটু
দুরেই ভাইদের বাড়ি। তারাও খুব ভালবাসে। খুব আশ্চর্যের ব্যাপার, একরত্তি নাতিটাও ঠাকুরদেবতা নিয়ে বাতিকগ্রস্ত।
ওর তো কোন দুঃখকষ্ট নেই, তাহলে দিনরাত্তির কৃষ্ণ-কৃষ্ণ করা কেন? বরং তার নিজের ছেলেদুটো ভাল। নাস্তিক।
বেস্পতিবারের কেত্তনের পাট উঠেছে বহুদিন হল। ওদের বাবা যতদিন শক্ত-সমর্থ ছিলেন, একদিনও বাদ যায় নি। ছেলেদের সংসারে ঐ ঝামেলা
চুকেছে। ঠাকুরদেবতায় বিশ্বাস থাকলেও ঐ অকারণ আদিখ্যেতা যমুনা পছন্দ করে নি
কোনদিনই। এই বরং ভাল। এদিক-আর ওদিক বলতে কি বোঝায়, যমুনা বুঝে গেছে সে আজ প্রায় চুয়াল্লিশ বছর হল।
এখান থেকে বর্ডার খুব কাছে। অল্প কিছু টাকাপয়সা দিলেই ওপারে দিব্যি ঘুরে আসা যায়
নাকি। কোন কাগজপত্র বিশেষ লাগে না শুনেছে সে। একবার স্বামীকে বলেনি তা নয়, তার নিজের বাড়িতে যাওয়ার কথা। হাসির ছেলেকে, নিজের ছেলেদেরকে, সব্বাইকে বলেছে সেই কথা। কি হবে ওখানে গিয়ে? ‘এদিকের’ সাফ উত্তর।
আলমের বয়স অনেক হয়েছে।
যমুনাদের ওখানকার সব সম্পত্তি পাওয়ার পর তার অবস্থা ফিরেছিল। বাবা ওকে সব দিয়ে
এসেছিলেন। যমুনার আজও ধারণা, আলম এককণা কিছু না পেলেও
হাসি নিরাপদেই এদিকে আসতে পারত। আলম অনেকদিন অবধি এদিকে আসত। তার বাড়ি নয়, ভাইদের ওখানে। আম দিয়ে যেত ওদের নিজেদের
বাগানের। দু’একবার দেখাও হয়েছে যমুনার সাথে। আসলে রাষ্ট্রের চোখরাঙানিকে বুড়ো আঙ্গুল
দেখিয়ে আসতে হত তো আলমদের, তাই দিনক্ষণের ঠিক ছিল না কোন। আলমের দুই ছেলেও
এসেছে অনেকবার। তারা নাকি এদিকে কিসবের ব্যবসা করে। সীমান্তে অত টাকা ঘুস দিয়েও
কিভাবে লাভ করে কে জানে। যমুনার ছেলেরা মাঝে মাঝে হাসাহাসি করে, ক’টা নরম-গরম কথাও যে বলে না তা নয়। কিন্তু
এসব গায়ে লাগে না তার। তাদের ফেলে আসা কোন কিছু নিয়ে সুখী থাক আলমরা এতেই সে খুশি।
তার দিন কেটে যায় নাতিকে নিয়ে। যমুনার সাথে তার ঠাকুমার যেরকম ব্যাপারটা ছিল, এখানে ঠিক তার উলটো। নাতির ক্লাস টু হল। এই
বয়সেই খুব পাকা। আমের আঁটি, বাঘ-বকরির ঘুঁটি নিয়ে খেলা এদের পোষায় না।
ঠাকুরদা অনেক রকম খেলনা এনে দেন। ছোট্ট ছেলের ভক্তি দেখে পেতলের কৃষ্ণও এনে
দিয়েছেন। খুব চকচকে। ভাঙা চৈতন্যের পুতুলের কাছে কিছুই না। সন্ধ্যাবেলা মা জোর করে
পড়তে বসালে তার আশ্রয় ঠাম্মা। টিভিতে চিত্রহার চালিয়ে নাতিকে প্রায় ঢেকেঢুকে নিয়ে
সংসারের সুখ অনুভব করেন বৃদ্ধা। মাঝে মাঝে ঠাকুরদা বাদ সাধেন- কি গো ছেলেটাকে মাটি
করবে দেখছি! যখন তখন ওকে নিয়ে টিভির সামনে বসে পড় কেন? এসব দেখে কি শিখবে? পড়তে বসতে দাও ওকে।
তারপর কোথা থেকে কি যে হল, হঠাৎ সবাই খুব গম্ভীর। সীমান্ত শহরে মাঝে মাঝেই
শুনতে পাচ্ছেন অশান্তির খবর। ছেলেরা প্রতিদিনই বাইরে থেকে মানুষ খুনের খবর নিয়ে
আসে। রামের যুদ্ধ নাকি আবার শুরু হয়েছে। যুদ্ধ কি? নির্বিবাদে খুন নয় তো? অযোধ্যার খবরে এখানে অশান্তি কেন? উত্তর দেয়নি ছোটছেলে। শুধু গম্ভীর মুখে জানিয়ে
দিয়েছিল যে এখন কারোর সঙ্গে ছাড়া
হঠাৎ করে বাইরে বেরোনো বারণ। ‘ওরা’ নাকি গ্রাম থেকে শহরে এসে ‘প্রতিশোধ’ নিতে পারে।
এইরকম হুকুম যমুনার কাছে নতুন নয়। কিন্তু এখন সে গোটা ব্যাপারটা জানে। শহরে কিছু
হয়নি এখনও। নিয়মিত পুলিশি টহল চলছে, কিন্তু বর্ডারের কাছাকাছি গ্রামগুলো থেকে
মারামারির খবর আসছে প্রতিদিনই। দু’একটা খুন-জখমের খবরও। কি আশ্চর্য! তার
কিন্তু এতটুকুও রাগ হয় না বিশেষ কোন পক্ষের প্রতি। স্বামী ভিন্নমত, যমুনারা নিজেও ভুক্তভোগী, কিন্তু তার এখনও মনে হয়, আচ্ছা, ওখানেও সব ঠিকঠাক আছে তো? শান্তি’র মত আবার কেউ নিখোঁজ হয়ে যায় নি তো এপারে?
উত্তর এল অল্পদিনেই। অবৈধ
অনুপ্রবেশে ভিনজাতের রামবিরোধী লোক হিসেবে বড় ছেলে সহ সীমান্তে কুপিয়ে মেরেছে
আলমকে। তার অপরাধ, এদেশে সে নাকি চিকিৎসা করাতে এসেছিল। মসজিদ
ভাঙ্গল এপারে। ওপারের বহু মন্দির তার মাসুল গুনল, আর পুরনো চাকর মালিকের নিজের দেশে এসে ফিরতে
পারল না আর। বড় ছেলে খোঁজ খবর নিয়ে জানাল মাকে। না, যমুনা কান্নায় ভেঙে পড়ে নি। আশ্চর্যের ব্যাপার, তখন তার মনে পড়ছিল না আলমের মুখ। মনে পড়ছিল
শ্বশুরের সেই ক্রুদ্ধ চাহনি- “...জানো, আলম না থাকলে কি হত?” ঠাম্মা, ও ঠাম্মা, কি হয়েছে? কাঁদছ কেন? নাতির ডাকে সম্বিৎ ফেরে যমুনার। কোলে টেনে নেন
নাতিকে। নাতি প্রায় নিষ্পাপ স্বরে বলে- “ওরাও তো আমাদেরকে কত মেরেছে, তাই তো ওদেরকে মারছে, তাই না?”
নাতির মুখের দিকে একবার
তাকায় যমুনা, তার হাত ধরে সোজা প্রশ্ন করেন স্বামীকে- “এইটুকু ছেলের সামনে সারাদিন ওসব
ছাইপাঁশ খবর না শুনলেই কি নয়? কি শিখবে এসব দেখে?” এবং এই প্রথমবার বউমাকে ডাক পাড়েন-“বউমা ওকে পড়তে বসাও......”