Monday, January 14, 2013

মেয়ে-জ্বালানো -- দিদিমণি


আমাদের দেশের হিন্দি ছবির অসংখ্য গানের মুখ্য উপজীব্য হচ্ছে ইভ-টিজিং। নায়ক ও তার সঙ্গীরা হেঁটে, সাইকেলে, বাইকে, চার-চাকায় এমনকি হেলিকপ্টারে করেও নায়িকাকে তাড়া করে যতক্ষণ না সে প্রেম-প্রস্তাবে সম্মতি জানাচ্ছে। তাতে নায়িকা বিরক্ত, ক্রুদ্ধ, ভীত, যাইহোক না কেন নায়ক ও তার সাগরেদরা দমছে না। সিনেমায় এসব দেখতে মানুষের বোধহয় ভালই লাগে। জীবন, কেরিয়ার, চাকরি- এ সবের পিছনে না দৌড়ে একটা বা একাধিক মেয়ের পিছনে ধাওয়া করা, বিয়ে না করে একসাথে থাকার থেকেও বেশি সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে। দেশের রাস্তাঘাটেও দৃশ্যটা প্রায়ই নজরে আসে। হেঁটে, রিক্সায় বা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে- আর তার পেছনে পেছনে follow করে চলেছে কয়েকটি ছেলে। তারা নিজেদের মধ্যে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন কথা বলছে, গান গাইছে ও অঙ্গভঙ্গি  করছে। যদি মেয়েটি একা থাকে বা দু-একজন সঙ্গীর সাথে থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই।

একটি মেয়ে হাইস্কুলে সিক্স থেকে সেভেনে উঠতে উঠতেই তার স্কুল, কোচিং, নাচ বা গানের ক্লাসের যাওয়া আসার পথে কিছু রোড-সাইড রোমিওর পাল্লায় পড়ে। খু-উ-ব কম মেয়ে আছে যাদের এই অভিজ্ঞতা নেই। গ্রাম, ছোটো শহর, বড় শহর- সম্ভবত এমন কোনও জায়গা নেই যেখানকার মেয়েরা এই ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিফ-হাল নয়। আমার আবছা আবছা মনে আছে প্রথম কবে ছেলেরা আমার পিছু নিয়েছিলো। সত্যি বলছি, একদম প্রথম অভিজ্ঞতার কথা ভালো মনে নেই। তবে যতদূর মনে পড়ে, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয় ক্লাস সেভেনে পড়তাম। যারা ফলো করেছিলো তারা সংখ্যায় প্রায় তিন-চার জন ছিল।
প্রত্যেকেই আমার থেকে অনেকটা বড়। ভাল করে বুঝতে পারতাম না এরা সকলেই আমাকে প্রেম নিবেদন করবে বলে পিছু ধাওয়া করছে, নাকি একজন, নাকি অন্যকিছু। মা শিখিয়ে দিয়েছিলো এরকম কোনও অভিজ্ঞতা হলেই বাড়িতে জানাতে। তাই জানিয়ে ছিলাম। মা এ-ও শিখিয়ে দিয়েছিলো, প্রতিদিন এক রাস্তা দিয়ে স্কুলে না গিয়ে রাস্তা বদল করে করে যেতে। এতে দু’একদিন কাজ হল। তারপর আবার যে-কে-সেই। ওরা বাড়ির এতটা কাছে সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করতো যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোড়ের মাথায় এলেই দেখতে পেতো, তারপর স্কুল অবধি যেত। দিনের পর দিন, আবার তার পরের দিন- ওদের কথার কোনও উত্তর দিতাম না- প্রচণ্ড গম্ভীর মুখে স্কুলে যেতাম, বাড়ি ফিরতাম। ভয় পেতাম, যদি রাস্তায় আটকায়? রাস্তার দোকানপাট বন্ধ থাকলে বেশি ভয় লাগতো। না, এই দলটি ফলো করা ছাড়া বেশি কিছু  করেনি। অনেকদিন নিজেদের সময় নষ্ট করার পর যখন বুঝলো কিছু হওয়ার নয়, তখন আসা বন্ধ করলো। ওদের মধ্যে একজন ছিলো আমাদের বাড়ির কাজের দিদির ভাই। ওকে এখনো মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখতে পাই। এখন আর চোখের দিকে তাকায় না। সে এখন এক ছেলের বাপ।

এর পরের স্মৃতি ক্লাস নাইনের। এটাতে একটু বাড়াবাড়ি করেছিলেন আমার মাতৃদেবী। অনেকদিন ধরে দু’টি ছেলে ফলো করতো। একদিন বৃষ্টি পড়ছে- সাইকেল নিয়ে বেরোতেই মোড়ের মাথায় ছেলেদু’টিকে দেখতে পেলাম। আমি আর না এগিয়ে বাড়ি ঢুকে মাকে জানালাম। মা আমাকে এগিয়ে যেতে বলে নিজে পিছনে রিক্সা নিয়ে এগোলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর যখন একটি ছেলে আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে গেছে, হঠাৎ আমি দেখলাম মা রিক্সা থেকে নেমে একহাতে ছেলেটির সাইকেলের হ্যান্ডল, আর একহাতে ওর জামার কলার ধরে’। লোক জমা হয়ে গেছে। ছেলেদু’টি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে... ইত্যাদি। না, মা ছেলেদু’টিকে পুলিশে দেননি, এমন শাসিয়েছিলেন, যে সেইদিনই সন্ধেবেলা ওর আত্মীয়-বন্ধুরা ক্ষমা চাইতে আমাদের বাড়িতে আসে। এর পর সেই ছেলেদু’টিকেও আর দেখিনি।

ক্লাস টেন-ইলেভেনের পর রাস্তায় এরকম ইভ-টিজিং এর পাল্লা আর পড়িনি। এর পর থেকে ভদ্র ছেলেরা ভদ্র-বেশে বিয়ের প্রস্তাব দিতো এবং আমি এনগেজড জেনে চুপসে যেতো। অনেকদিন পর, যখন আমি রাস্তাঘাটে একা একা চলতে শিখে গেছি, যখন আর আমি ছেলেদের ভয় পাইনা, তখনও উৎপাত কমলো না। পরকীয়া করতে চাইলেন একজন পশু-চিকিৎসক। তাঁর বক্তব্য, তিনি আমার বন্ধু হতে চান। বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখী নন বলে নিজের একটা জগত বানাতে চান। আমি বুঝলাম না, আমাকে দেখে কেন তাঁর মনে হলো, আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হবো।

এখনো পর্যন্ত ঘটা শেষ ঘটনাটা ঠিক আজ থেকে দু’সপ্তাহ আগের। আমার বাবার বয়সী (চুল ও ত্বক দেখে মনে হলো) একদম অপরিচিত একজন (অ)ভদ্রলোক আমাকে চিরকুটে লিখে জানালেন, ‘Elder Brother’ এর মতো তিনি আমাকে ভালবাসেন ও আমার সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ করতে চান। অনাগ্রহী, এ কথাটা কঠোরভাবে জানানোর পরও টানা দু’সপ্তাহ ফলো করলেন ও তিনদিন আগে আমার কাজের জায়গায় পৌঁছে গেলেন। আচ্ছা করে কথা শোনানোর পর দু’দিন হলো উৎপাত বন্ধ আছে।

যে কোন কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব হলে জানতে ইচ্ছে করে আমার কৈশোরের মত অভিজ্ঞতা তারও হয়েছে কিনা, আর হয়ে থাকলে সেটা কেমন। অনেকেই দেখি এ’রকম ঘটনায় ভয়-টয় তো পায়ই না, উলটে আনন্দ পায়। আবার কেউ কেউ আছে যারা এমন প্রতিক্রিয়া দেয় যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি এমন একটি মেয়েকে চিনতাম, যে, কোনও ছেলে ওকে দেখে শিস দিলে ও ফিরে পালটা শিস দিতো। আবার এমনও অনেক মেয়ে ছিল যারা মায়ের হাত না ধরে বেরোত না। একমাত্র ইভ-টিজিং এর ভয়ে।

মেয়েরা ছেলেদের প্রশংসাসূচক মন্তব্য শুনে ও তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলে খুশিই হয়। আবার, এর উল্টোটাও সত্যি। কিন্তু ইভ-টিজিং শব্দটার পুরুষ-সংস্করণ নেই। এ বড় আশ্চর্য। কয়েকটি মেয়ে একটি ছেলেকে রাস্তায় tease করছে ভাবলে হাসিই পাবে। টিভির বিজ্ঞাপনে দেখা গেলেও বাস্তব জীবনে এরকম ঘটনা ক’টা ঘটে? একটি ছেলেকে কোন মেয়ে বা মেয়েদের দল ফলো করছে, taunt করছে, রাস্তা ঘিরে দাঁড়াচ্ছে- এসব কষ্টকল্পনা। আর উলটোটা? অত্যন্ত স্বাভাবিক আমাদের দেশে।

আধুনিকারা কিন্তু এখন বেশ সাহসী। ঘাবড়ে না গিয়ে এ’রকম উটকো ঝামেলা তারা নিজেরাই সামলাতে পারে। তার জন্য বাপ-মা বা পাড়া-পড়শিকে হাঁকডাক শুরু করেনা। তবে মফস্বলে এখনো মেয়েরা রাস্তাঘাটে একা একা চলাচল করতে ভয় পায়, রাতে তো বটেই, এমনকি দিনে-দুপুরেও। এই ভয়ের আবার একটা খুব সহজ হাস্যকর সমাধান আছে আমাদের ঘরোয়া মা-মাসিদের কাছে। তাঁদের বক্তব্য মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তাকে আর এরকম সমস্যার সম্মুখীন আর হতে হবেনা। এই ভুল ধারণার জন্য অবশ্য তাঁদের দোষ দেওয়া যায়না, কারণ জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁরা এমন বলছেন। কিন্তু বাস্তবে এর ব্যতিক্রমের অসংখ্য উদাহরণ সবসময় তৈরি হচ্ছে এখানে-ওখানে।

একটা সীমা পর্যন্ত সাধারণ মানুষ সব মেনে নিতে পারে। কিন্তু কে বলে দেবে সেই সীমাটা ঠিক কোথায়? সমস্ত সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে কিছু বেহায়া ছেলের দল আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে একটি মেয়ের ওপর - এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটতে শুরু করেছে আমাদের দেশে। প্রতিদিন।

কাজ করতে বেরিয়ে দেখতে পাই, রাস্তায় অসংখ্য মেয়ে-পুরুষ, কম-বেশি বয়সের, নিরাসক্ত মুখে চলেছে নিজের কাজে। আগে মনে হতো, বড় শহরের desensitized নারী-পুরুষ সব- ‘কিস্যু হবে না’ গোত্রের। সে ভুল ভেঙে গেছে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, ওই তিন-পাত্তি-খেলোয়াড় সুলভ মুখগুলোর পিছনে গনগনে আগুনের আঁচ। এককালে ওদের অনুভূতি আহত হতো হয়তো, এখন ক্রোধ ছাড়া আর কিছুই কাজ করে না। মা এখন নেই, তবু এদের দেখে মনে এখনো বল আসে। অন্তত আরও কিছুদিন।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই