Tuesday, January 8, 2013

শিরে-সংক্রান্তি -- নির্মাল্য

পৌষ মোদের ডাক দিয়েছে। ছুটে আসার কারণ আছে বৈকি। শীতের মাঝখান বরাবর এই মাস শেষ হলেই বাংলার হেঁশেল সরগরম। আজ্ঞে হ্যাঁ পিঠে খেলে পেটে সয়- প্রবাদটি আর সর্বতোভাবে সত্যি না হলেও “চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনীর মতো বাঙালি না শুনে স্বাস্থ্যের কাহিনী। কাজেই ময়দা, আটা, চালের গুঁড়ো, খেজুর গুড়, ক্ষীর, দুধ, ঘি এবং হাল্কা ডালডা সহ বাঙালি নেমে পড়বে রসনাতৃপ্তিতে। বিশেষ একটা দিনও ঠিক করা আছে। ঘটা করে নাম দেওয়া হয়েছে পৌষ সংক্রান্তি। ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর আরাধনা করে ঠাকুরের জন্য সামান্য ঘুসের ব্যবস্থা- তিলুয়া ভোগ। বস্তুটি আর কিছুই নয়। কদমা জাতীয় চিনির ড্যালা ও তার মধ্যে গুটিকতক সাদা তিল। ঈশ্বর বোধহয় সত্যিই সর্বংসহ। তা নইলে ভগার ভাগে এতটুকু দিয়ে ভক্তের নিজের জন্য এই রাজকীয় আয়োজন বরদাস্ত করতেন না কখনই। যাহোক, ওনাকে ওনার বাঁশি এবং প্রেমিকা সহ ঠাকুরঘরে ‘বিশ্রাম’ দিয়ে চলুন হেঁশেলের দরজা খুলি।

বড়দিনের কেককে দুশো শতাংশ চ্যালেঞ্জ জানানো এই অমৃত পদটির নাম পিঠে। বাঙালির একান্ত নিজস্ব সৃষ্টি। মূলত দুরকম ভাবে এটি খাইয়ে আসছেন মা-ঠাকুমারা। দুধে সেদ্ধ করে বা সেরায় ডুবিয়ে। আর এই পিঠে তৈরির হরেক প্রণালীর পেছনে সমান্তরালে রান্না হয়ে চলে হাজারো রীতিনীতি ও সংস্কার। প্রথম বিজয়ী ও জনপ্রিয়তম প্রতিনিধি হলো পুলিপিঠে। চালের গুঁড়ো, ময়দা একটু সুজি দিয়ে বস্তুটির খোলস তৈরি হয়। এই চালের গুঁড়ো নির্বাচনেও বঙ্গগিন্নি careful. সিদ্ধ চালের গুঁড়ো ব্যবহারে নরম পিঠে ও আতপ গুঁড়ো থেকে একটু শক্ত পিঠে- প্রয়োজন ও রুচি অনুযায়ী বেছে নেওয়া হয়। পুর তৈরি হয় দুভাবে- নারকোল কোরা ও আঁখি গুড় পাক দিয়ে বা নারকোল কোরা ও ক্ষীর জ্বাল দিয়ে। খোলসের ভেতরে ঐ উপাদেয় পুরটি পুরে দিয়ে পটলের মত আকারের পিঠে রান্নার জন্য প্রস্তুত- প্রেমিকার পটলচেরা চোখের চাইতে বহুগুণে বেশি আকর্ষণীয় (আসলে প্রথম ক্ষেত্রে ঐ চোখের চোখরাঙানীও সহ্য করতে হয় কিনা!)।
 খোলসের ধারটি মুড়িয়ে নিতেও মুনশিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। নিখুঁত শিল্পকর্মের নমুনা রাখেন অনেক গৃহবধূই। এসব সাজিয়ে
ঠাকুমারা বসে পড়েন উনুনের কাছে। সামনে লোকাচার হিসেবে আড়াআড়ি ভাবে সাজিয়ে নেন পাঁচখানি মোটাসোটা পাটকাঠি। দুধ জ্বাল দিতে দিতে গুণগুণ করতে থাকেন বহুদিনের অভ্যস্ত একটা ছড়া আর গানের combo। মাঝখানের কটি লাইন বেশ মজার। “মেজরানী দুষ্টমতি না শোনে বারণ/ অসিদ্ধ চালের গোলা করিল ভক্ষণ/ দেখিয়া পিঠার বিবি হইলা কোপন/ সন্ধ্যাকালে যমে টানে ব্যথার কারণ- সামান্য অপক্ক পিঠে খাওয়ার কারণে মৃত্যুদণ্ড বাড়াবাড়ি বৈকি, কিন্তু, দুধে সিদ্ধ হওয়ার আগেই পুর খেয়ে নেওয়া থেকে বাড়ির ছেলেপুলেদের আটকাতেই বোধহয় এই ছড়া আর লাঠি/পাটকাঠির ব্যবস্থা। যাই হোক, গল্পে গল্পে হাল্কা পায়েসের সাথে সেদ্ধ হয়ে আপনার দুধপুলি তৈরি। উঁহু, চামচে হাত দেবেন না। হাত দিয়ে আস্ত এক একখান মুখে পুরে দিন। ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ুক আনন্দধারা।

যাদের এই প্রায় কাঁচা চালের গুঁড়োয় অসূয়া আছে, তাদের জন্য আছে দুধপুলির এক দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী- মুগপুলি। দেখতে প্রায় দুধপুলির মতই। শুধু দুধের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ। চালের গুঁড়োর বদলে এখানে মুগডাল বাটা খোলস নির্মাণের উপকরণ। পুরের ক্ষেত্রেও রকমফের। মুগডালের সুন্দর গন্ধ বজায় রাখতে সাধারণতঃ শুধু ক্ষীরের পুরই ব্যবহৃত। নারকোল নৈব নৈব চ। পিঠের গঠন একইরকম, শুধু কাঁচা পিঠেগুলিকে গাওয়া ঘি তে ভেজে শুধু শুধু বা চিনির রসে ডুবিয়ে উদরসাৎ করা। তবে হাই প্রেসার এবং ফ্যাটি লিভারের যুগে আজকাল পৌষ-পার্বণে ঘি কে বিদেয় করে ঢুকে পড়েছে রকমারি সাদা তেল।

এরপর আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে চষিপিঠে। হালের সিমাই এর পায়েসের পূর্বপুরুষ। দুধপুলির খোলসের উপকরণেই তৈরি এই মজার বস্তুটি। কোনো পুরের বালাই নেই। শুধু ঐ জিনিসটিকে সরু করে ইঞ্চিটাক পাকিয়ে হাল্কা ঘি-এ ভেজে দুধে ফেলে দিলেই আন্দাজমত মিষ্টি সহযোগে আপনার চষিপিঠে তৈরি। রাতে রুটির পর সাধারণ পায়েসের মতোই চট করে মেরে দেন দিকি। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সিধে কম্বলের তলায়।
এবারে গোকুলপিঠে, বৃন্দাবনের সন্নিহিত এই গ্রামটির সাথে পিঠের দূরদূরান্তে কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। তবে স্বাদে গোকুলের অন্যান্য বিভিন্ন মহার্ঘ্য পদের সাথে তুলনীয়। বিশেষ কিছু না, সেদ্ধচালের গুঁড়ো আর ময়দা দিয়ে নরম করে খোলস বানিয়ে তার ভেতর দুধপুলির মতন পুর দিয়ে হাল্কা ভেজে নেওয়া আর পাতলা চিনির রসে ডুবসাঁতার। ব্যস্‌, শীতের বিকেল ফুরফুরে। বস্তুটি দেখতে অনেকটা তালের বড়ার মত। আর স্বাদে? নাই বা বললাম।

আসুন এসব সরিয়ে রেখে এবারে চেখে নিই অন্যরকম একটা পদ - সরা পিঠে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এর গঠন প্রণালীতে বেশ অভিনবত্ব। মাটির রেকাবীতে গোল গোল গর্ত করে তৈরি বিশেষ ধরণের সরায় মা-ঠাকুমারা বানান এই পিঠে। এর প্রস্তুতিতে প্রাচীন আমলের প্রেসার কুকারের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাবেন। সরার ঢাকনিটি অর্ধবৃত্তাকার। তার ওপরের দিকের হাতলটি আসলে একটি খুব ছোট্টমতন একটা বাটি। পুরো ঢাকনা এবং সরা, দুটিই জলে ডোবানো থাকে অনেকক্ষণ। চালের গুঁড়োর গোলা যাতে আটকে না যায় মাটির গায়ে। এরপর সিদ্ধ চাল আর আতপ চালের balanced মিশ্রণের গোলা তৈরি করে তাকে গর্তগুলিতে ঢেলে নিয়ে আপনার preparation complete। জলে ডোবা ঢাকনি অনবরত সরবরাহ করবে জলীয় বাষ্প। ‘প্রেসার’ এর যোগান দেবে। আর হাতলের ওপরের বাটি আপনাকে জানিয়ে দেবে সেদ্ধ হওয়ার শুভক্ষণ। কতক্ষণে সেই পিঠে তৈরি হবে? কেন? যখন হাতলের ওপরের cute বাটিটিতে জল সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাবে। ব্যস্‌, এবারে এক একটি পিঠে নামিয়ে নিন, আর ঝোলাগুড়ে ডুবিয়ে ছেড়ে দিন জিভের পরীক্ষায়। গ্যারান্টি দিচ্ছি, স্টার মার্কস্‌ পেয়ে পাস করবে সরা পিঠে। এরই একটা অন্য রূপান্তর আছে বাঙালির ঘরে। নাম- চিতই পিঠে। প্রস্তুতির প্রণালী একই। শুধু ঝোলাগুড়ে না ডুবিয়ে সেটিকে জ্বাল দিয়ে নিন দুধে। তবে হ্যাঁ, দুটি ক্ষেত্রেই গনগনে আঁচে নয়, একেবারে হাল্কা কাঠের উনুনের আঁচে তৈরি হয় এই দুইরকমের পিঠে। আচ্ছা, গোটা ব্যাপারটাতে ‘ইডলি’ মার্কা গন্ধ পেলেন নাকি? ভেবে বলবেন তো! সরা পিঠে অবশ্য মূলতঃ ওপার বাঙলার সৃজন। তবে স্বাদের ক্ষেত্রে বিলিতি কাঁটাতারের ব্যবধান মানার মত আহাম্মক বাঙালি নয়।

আচ্ছা, এবারে আপনাকে নিয়ে আসি পাটিসাপটার পাতে। পাটিসাপটা- সোজাসাপটা এই মেনুটিও নিতান্তই শীতের নিজস্ব। চালের গুঁড়ো, ময়দা আর সুজি মেখে নিয়ে গোলা করে তাওয়াতে গোলা রুটির মতো হালকা ভাজা ভাজা হয়ে গেলে প্রচলিত পুর দিয়ে অমলেটের মতো করে মুড়িয়ে নিয়ে বসে পড়ুন পাতে। তোফা আরাম মশাই। জিভের এবং পেটেরও। এই প্রসঙ্গে মধ্যবঙ্গের এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের পৌষ পার্বণের ছবিটা মনে পড়ে গেল। নিখরচায় share করার লোভ সামলাতে পারছি না। সেখানে পৌষ সংক্রান্তির দিনে দুপুর বেলা গ্রামের সব মেয়ে বউ এক হন হরিসভার মাঠে। সবারই হাতে সারা সকাল ধরে বহু যত্নে তৈরি করা দুধপুলি, পাটিসাপটা –এসব। এরপর নিকোনো উঠোনে চালের গুঁড়োর আলপনা দেওয়া হয় নিখুঁতভাবে (যদিও এমন potential উপকরণের এই অপচয় মেনে নেওয়া যায় না) সবার বাড়িতে তৈরি একইরকম পদগুলিকে একত্র করা হয় এক একটি বড় বাটি বা সরায়। সেগুলিকে ঢাকা দিয়ে একের পর এক থাকে থাকে সাজিয়ে নেওয়া হয়। সবার ওপরে কলাপাতায় থাকে গোবিন্দের ভোগ সেই তিলুয়া ও শীতের নতুন ফলমূল। এরপর নতুন মাটির প্রদীপ জ্বেলে  দুর্ব্বা ঘাস দিয়ে বরণ করা হয় সেই অমৃতস্তূপকে। অতঃপর ওপরের কলাপাতা থেকে তিলুয়া আর কিছু ফলমূল উপস্থিত বাচ্চাকাচ্চাদের মধ্যে একটু করে দিয়ে বাকিটা ধরে দেওয়া হয় গরুর সামনে। ভেবে দেখুন দিকি, গোটা যজ্ঞিতে সবটুকু দুধ সরবরাহ করে বেচারার প্রাপ্তি এটুকুই। তাতেই সে ন্যাজ নাড়িয়ে, আরামে চোখ বন্ধ করে, কান নেড়ে চিবোতে থাকে বিনা প্রতিবাদে। গোবুদ্ধি আর কাকে বলে! এরপর একে একে বাটি নামানো হতে থাকে আর সেই বাটির বিশেষ পদটি বিলি করে দেওয়া হয় উপস্থিত সবার মধ্যে। সাথে সাথে চলতে থাকে এক-একটি বিশেষ মন্ত্র (ছড়া)। যেমন, পাটিসাপটার সরা নামানোর আগে একটা বাক্য- “আছে তার কন্যা এক বিন্ধ্যাচলে বাস......”। সত্যি, পাটিসাপটা তৈরির মূল প্রণালী ধোসা তৈরির সাথে খুব সামান্যই পৃথক।

এরপর আসি রাঙ্গা আলুর পানতুয়াতে। হাল্কা পশ্চিমি গন্ধ থাকলেও এটিও কিন্তু সুপারহিট। রাঙ্গা আলু আর ছানা, ক্ষীর, হাল্কা ময়দা বেশ ভালো করে ঠেসে নিয়ে তাতে বাঙ্গাল কায়দায় পুর না দিয়েই বা ঘটি রীতিতে হাল্কা নারকোল-ক্ষীরের পুর দিয়ে ব্যাপারটাকে লাল করে ভেজে নিয়ে চিনির রসে ডুবিয়ে নিন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। অসাধারণ মিষ্টান্ন তৈরি। এর ওপর অল্প এলাচের গুঁড়ো- সোনায় সোহাগা আর কাকে বলে! বহু ব্রাণ্ডেড মিষ্টির দোকানি আপনার খুন্তির আঘাতে কুপোকাত।

প্রস্তুতির অভিনবত্বে এবং অবশ্যই মিষ্টত্বে এই সব রকমের পিঠে মরসুমি মেনু হিসেবে বোধহয় ভূভারতে ফার্স্ট। সমস্ত পদকে মধুরেণ সমাপয়েৎ অবধি টেনে নিয়ে যেতে বাঙালির জুড়ি নেই, একথা কে না জানে। কিছুদিন আগেই এ নিয়ে একটা বিজ্ঞাপন দেখছিলাম পথে ঘাটে। নামকরা এক চকোলেট প্রস্তুতকারী সংস্থা এক অভিনব প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে, বাঙালির সেরা মিষ্টি নিয়ে। caption দিয়েছে “love your misti? Then fight for it”। সাধু আয়োজন। সেখানে পিঠের কোন স্থান ছিল না। হবেই বা কি করে। বিশুদ্ধ পিঠে তৈরিতে যেটুকু ভালোবাসা আর পরিশ্রম থাকে, শুধুমাত্র পেশাদারিত্ব দিয়ে বোধহয় তার পাদপূরণ করা সম্ভব নয়। কাজেই আজকের প্রবল ইঁদুর দৌড়ের যুগে যখন আপনার বা আপনার গিন্নির কারুরই সময় নেই কোলে-‘পিঠে’ মানুষ করার, তখন নিতান্ত নিরুপায় হয়েই আপনি মানিব্যাগ হাতে বড় মিষ্টির দোকানে। তাতে কোনরকমে জিভের দাবী হয়ত মেটে। মনেরটা মেটে কি? মনেরটা মেটা নিয়ে একটা আষাঢ়ে গপ্পো মনে পড়ে গেল। গল্পটা একটি ব্রতকথার, নিশ্চয় শুনে থাকবেন।  ইতুপুজো নামে একটা লৌকিক পুজো। পৌষমাসেই। সেই ব্রতর ব্রতকথায় উম্‌নো আর ঝুম্‌নো নামে দুই গ্রাম্যবালিকার পিতা শীতের সকালে গিন্নিকে হুকুম করেছেন পিঠে বানানোর। ভদ্রলোক গুণে রাখছেন অপক্ক পিঠে, কড়ায়-গণ্ডায় সবটুকু ভোগ করার জন্য। মাঝখান থেকে স্নেহময়ী মা দুই মেয়েকে দুখান পিঠে দেওয়ায় পিতা কর্তৃক অকালে মেয়েদের নির্বাসনদণ্ড। অধুনা একটা বাংলা বিজ্ঞাপন মনে পড়ছে? “...এ স্বাদের ভাগ হবে না। যাহোক, অমন কঠোর পিতার ভূমিকায় না নামলেও পিঠে খাওয়ার ব্যাপারে বাঙালির হ্যাংলাপনাকে লাল-সবুজ সবরকম সেলামই জানানো উচিত। তাইতো বলি, আসুন এই সংক্রান্তিতে অপারেশন পিঠে পুলি।  পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলেই ডুব দিই পায়েসের বাটিতে- পিঠের সাথে।


About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই