অমলকান্তি জয়েন করেছিল “মিঠে রোদ” হিসেবে।
জুনিয়র-মোস্ট পজিশন। কিন্তু তখন কাজে আনন্দ পেত। লোকজন তার দেখা পাওয়ার জন্যে
সারাদিন অপেক্ষা করতো। তাকে দেখতে পেলেই তাদের মুখে হাসি ফুটতো। তাকে আদর করে ডাকত
“রোদ্দুর” বলে।
কিন্তু এখন অমলকান্তি প্রমোশন পেয়ে “চড়া রোদ”-এ
উন্নীত হয়েছে। আর তাকে সারা বছর বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয়না। গ্রীষ্মকালেই
যা একটু ইন্সপেকশন ডিউটি পড়ে। বাকি সময়টা মেন-অফিসে নিজের জন্যে তেজ, উত্তাপ, আলো
সংগ্রহ করেই কাটাতে হয়। এসব করতেই হবে, নাহলে যে অফিসের কলিগদের কাছে পিছিয়ে পড়তে
হবে। অমলকান্তি বুঝতে পারে তার দায়িত্ব যেমন বেড়েছে, দূরত্ব বেড়েছে ততোধিক।
লোকজনের ভালবাসায় ভাটা পড়েছে। আর তাকে দেখে কেউ হাসে না, বরং তাড়াতাড়ি মুখ লুকোয়।
তার সংস্পর্শ সবাই এড়িয়ে চলতে চায়।
এরকমটা অমলকান্তি চায়নি। তা সত্ত্বেও তার এই প্রতিষ্ঠা, এই প্রতিপত্তির সাথে সে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে আজ যে এখন আর ফিরে তাকাবার সুযোগ তার কাছে নেই। সুযোগ থাকলেও ইচ্ছে আর নেই। সামনে আবার আরেকটা বড় প্রমোশনের হাতছানি, এটা ক্লিয়ার করতে পারলে সে হয়ে যাবে “কাঠফাটা রোদ”, অর্থাৎ ম্যানেজার সূর্য-বাবুর খুব কাছের জন। তখন তার প্রতাপ দেখে কে! কত কি করার পরিকল্পনা আছে তখন অমলকান্তির!
********
সকাল থেকে খুব মিঠে গলায় গান ধরেছে রামেশ্বর ওরফে
রামু। গানের কথা গ্রাম্য। আমাদের অপরিচিত। কিন্তু একটা করুণ সুর আছে যা সহজেই
মানুষের মনকে নাড়া দেয়। নাকি নাড়া দেয় না? রামুর সামনে রাখা শূন্য বাটিটা তো তাই
বলছে। রামু কিন্তু জানে তার গান হাটে উপস্থিত সকলেরই ভালো লাগে। অন্তত এক সময় তো
লাগতো। এরা প্রত্যেকেই তখন তার সাথে গলা মেলাতো, তাকে ঘিরে নাচতো, কেউ কেউ ঢোল
কাঁসর নিয়ে সঙ্গত দিত। মাত্র কয়েক বছর আগেকার কথা। তখন এদের সকলের জমি ছিল, পেশায়
চাষি ছিল সবাই।
হঠাৎ কিছু জোতদার এসে দখল করলো তাদের জমি। সরকার
আবার তাদেরই সাথে। তাই সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে বেহাত হয়ে গেল জমি। অন্ধকার
নেমে এলো সকলের চোখে। তাদের একমাত্র আশার আলো দেখায় গাঁয়ের ছেলে অমল। সে শিক্ষিত,
চটপটে, কথাবার্তাতেও পটু। কাদের সঙ্গে জানি চেনাশোনাও আছে। তারা নাকি প্রচুর
প্রভাবশালী, টাকার জোর আছে। তাহলেও লোক ভালো। অমল বলতো, “কিছু ভেবো না খুড়ো, একবার
আমাদের হাতে ক্ষমতা আসতে দাও, তারপর দেখো।” তখন অমলকে কত বাবা-বাছা
বলে ডাকতো রামু। কতো ভালোবাসতো। আগের ইলেকশনে বিপুল ভোটে জয়ী করলো তাকে। তার কিছু
দিন পর সপরিবারে শহরে চলে গেল অমল। ওখানে থাকলেই নাকি সে গ্রামের জন্যে বেশি
সাহায্য করতে পারবে। তারপর থেকে বলতে গেলে আর তার দেখাই পাওয়া যায় না। সে নাকি
ভীষণ ব্যস্ত। এত ব্যস্ত যে নিজের বাস্তু ভিটেটাকেই দেখবার সময় পায়না?
সূর্যের সাথে রামুর গলাও চড়তে শুরু করেছে। লোকগুলো
কি সব বোবা-কালা হয়ে গেছে? অন্যদিন কিছু টাকা তার এরমধ্যেই রোজগার হয়ে যায়। “দিন
আনি দিন খাই” - এ ভাবেই কোনোরকমে সংসার চলে যায়। আজ যে ভাঁড়ে মা ভবানী। রামুর মনে
কতই আশা ছিল যে আবার জমি ফিরে পাবে, চাষ করবে। কিন্তু হারামজাদা অমলের যে পাত্তাই
নেই! এদিকে শোনা যায় তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে দল নাকি তাকে আগামী-বার আরও বড় পদের
জন্য ভোটে দাঁড় করাচ্ছে। জিততে পারলে অমল নাকি হয়ে যাবে তাদের দলপতির ডান হাত। তখন
তার প্রতাপ দেখে কে! আচ্ছা, তখন অমল তার গাঁয়ের দিকে ফিরে তাকাবে তো?
কিন্তু সে তো কালকের কথা, তাই শুকিয়ে কাঠ হওয়া
সত্ত্বেও গলা ফাটিয়ে গান গাইতে থাকে রামু - তার গান আজকে
লোকের কানে পৌঁছে দিতেই হবে।