Thursday, July 5, 2012

আমার পরাণ যাহা চায়... -- সুনন্দ


“I can’t take my eyes off you…”—Damien Rice
ভেবে বসবেন না যেন, আবার একটা কবর-পচা প্রেমের গল্প বলতে বসেছি। নাঃ, প্রেম নয়, উপরের লাইনটা মনে পড়লো এক ইংরেজি সিরিয়ালের
কথা ভেবে। আমার আর আমার কাছে-দূরের বন্ধু-বান্ধবের অনেকেরই এটা দেখা, হয়তো আপনারও। না দেখা থাকলে দেখে নিতেই অনুরোধ করবো। নাম? বলবো, বলবো… দাঁড়ান, অতো তাড়া কিসের? আগে স্বজাতির অভ্যাস মেনে একটু discourse (সহজ করে বললে, ভাট) সেরে নেওয়া যাক।
আমরা সকলেই কম বেশি বুদ্ধিজীবী তো, মানে বুদ্ধি খাটিয়ে খাই (রান্না করতেও যে ঠিক কতটা বুদ্ধি লাগে, সেটা যে করেনি, জানেনা), তাই আমাদের নিজেদের প্রতি একটা স্বাভাবিক দায়িত্ব থাকে, একটু আলাদা হওয়ার, হট্‌কে হওয়ার। আমরা বিয়ে বাড়িতে একটু ‘অন্যরকম’ সাজতে পছন্দ করি; যারা একটু আলাদা, তাদের ভালো-মন্দ যাই হোক, গুরুত্ব দিই; আমাদের পড়াশুনো, গান-বাজনা, মতাদর্শ, কিছু একটা বাকিদের থেকে আলাদা রকম হলে সেটা নিজের কাছে গর্বের ব্যাপার হয়। “সে কি রে? এই গানটা শুনিসনি?” বলতে অপছন্দ করে, এমন খুব কম লোক আছেন মনে হয়। তা, সেটা খুব ভালো একটা ব্যাপার। ভাগ্যিস! নইলে শিখতামই বা কোথা থেকে, আর প্রাণভরে তর্কই বা করতাম কার সাথে- সবই এই আলাদা হওয়ার গুণেই তো!
কিন্তু, মজাটা হয়, যখন, এই পার্থক্যের চর্চা জন্ম থেকে গুরুত্ব দিয়ে করার ফলে অনেকে আর ‘চলতি’ কোন কিছুই পছন্দ করে উঠতে পারেন না। সারা জীবন বিস্মৃত, এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার খোঁজে থেকে একদিন বড়, পিচের রাস্তাটাকে রাস্তা বলে মানতে অস্বীকার করেন। তখনই হয় গোলমাল। আমরা অধিকাংশই তো ‘গাছেরও খাবো, তলারও কুড়বো’ টাইপ, মানে সোজা কথায় বলতে সুরের গিটকিরি যখন লতার গলায় বা হরিপ্রসাদের বাঁশিতে হয়, বেমালুম ক্লাসিকাল-ভীতি কাটিয়ে সুরের স্রোতে গা ভাসিয়ে আমেজ নেওয়া পাবলিক, তাই আমাদের বেজায় মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় সোজা গলায় মনের কথা বলা। পাঁচ বছর ধরে ভরতনাট্যমের তালিম নেওয়া প্রেমিকাকে কি করে বলি, যে মাইকেল জ্যাক্সনের মুনওয়াক নকল করতে গিয়ে একবার পা মচকেছি? স্টুডেন্ট ইউনিয়ন রুমের দাড়িয়াল দাদাকে কোন সাহসে মুখ ফুটে বলি, যে ‘ব্যাটলশিপ পোটেম্পকিন’ না দেখে গতরাতে ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ চালিয়েছিলাম, আর মোটেই খারাপ লাগেনি?
উলটোদিকেও সমস্যা! শখের ব্যান্ড করা হয়েছে, ড্রামার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এমতাবস্থায় যাকে জোগাড় করা গেলো, সে বললো, ‘ইয়ানি(Yanni)! হাউ সিলি! ওরকম ট্র্যাশ মিউজিক আমি আর শুনিনি…’ এবার কি বলবেন?
না, ঘটনাটা ওই ‘শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেনি এমন কেউ তোমায় যদি প্রোপোজ করে…’র মতো নয়। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো, আপনি নিজের পছন্দটা নিয়ে ঠিক শিওর নন। সারা জীবন বড়দের কথা শোনা অভ্যেস, তাই তারা যখন পরিষ্কার আপনার পছন্দগুলো গুঁড়ো করে দিচ্ছেন, কি করে আর সে কথা বাইরে প্রকাশ করেন? অন্যদিকে ইন্টারনেটে, ছোটদের কলকাকলিতে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, যে আপনার মতের লোক অসংখ্য আছেন, এমনকি তারাই সংখ্যা-গরিষ্ঠ!! কিন্তু এদিকে মনে মনে জানেন, ‘পাব্লিক মাইনরিটি’- কল্কে পেতে গেলে ট্যাঁশ সমাজে পেতে হবে- রাম-শ্যাম-যদুর কথার এখানে কোন দাম নেই।
এমন অনেক ডিলেমা কাটিয়ে আজকের সিরিয়ালটার কথা লিখতে বসা। বিশ্ব-বিখ্যাত সিট-কম (Situational Comedy)—— ‘F.R.I.E.N.D.S’!
যাঁরা দেখেছেন, ভালোবেসেছেন, প্রভাবিত হয়েছেন, সময় সময় quote করেছেন, তাঁদের কিছু বলার নেই। আসুন, কোলাকুলি করি। ঠিক কেমন ভালো লেগেছে- জানান আমায়। আর যাঁরা দেখেননি, তাঁদের জন্যেই বলা- কি হারাইতেছেন আপনি জানেন না।
বহুদিন ধরে চলা এই শো (দশ-দশটা বছর!) সমালোচক আর বিশেষজ্ঞের রেটিং-এ কোথায় আছে জানিনে, কিন্তু একটু আশেপাশে চোখ বোলালেই দেখতে পাবেন অনেক লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের সামনে ফ্রেন্ড্‌স্‌ এর নাম উচ্চারণ করা মাত্র ফিচিক্‌ করে একটুখানি হেসে ফেলে। তারপর যদি কোন এক এপিসোডের কোন এক দৃশ্য বর্ণনা করতে শুরু করেছেন তো হলো- ঝাড়া ঘণ্টাখানেক বকবকানি না শুনে আপনার নিস্তার নেই। কেন এমন হলো? এই লোকগুলো এমন আউলে গেলো কেন? আমার এক বন্ধু, দিব্যি সুস্থ-স্বাভাবিক ছেলে, প্রেম করে, পড়াশুনো করে, বম্বে আই আই টি তে ভালো নাম করেছে বক্তৃতা করে- কিন্তু জিজ্ঞেস করে দেখুন, ফ্রেন্ড্‌স্‌ কতবার দেখেছে, একগাল হাসি নিয়ে উত্তর আসবে- ‘হেঁ, হেঁ, এই গতরাত্রে এগারো নম্বর বার শুরু করলাম।’ সে কি কথা! Get a life, Man! কিন্তু না, ব্যাপার অতো সোজা নয়।
এমন অনেক মানুষ আছেন, (এদের মধ্যে আমিও কিছুটা পড়ি), যারা এই সিরিয়ালটাকে নিছক কমেডি বলে সীমাবদ্ধ করতে নারাজ। এটা অনেকক্ষেত্রেই আমাদের ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ভাবতে বাধ্য করেছে, সহনশীল হতে উৎসাহ দিয়েছে- আর সর্বোপরি- চারপাশে যে খুব দরকারি মানুষগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে- যাদের তেমন করে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, (চারপাশে আছে বলেই) সেই ‘বন্ধুগুলো’র কথা বারবার করে মনে করিয়ে দিয়েছে। অঞ্জন দত্ত খান কুড়ি গান লিখেও ওদের দাম তেমন করে বোঝাতে পারেন নি, যতটা ফ্রেন্ড্‌স্‌ পেরেছে। শুধু কি তাই? চাপ খাওয়া যখন হাওয়া খাওয়ার থেকেও সহজ কাজ, সেই যুগে মুন্না ভাইয়ের অনেক আগে, অনেক দৃপ্ত স্বরে বলে দিয়েছে- ‘টেনশন লেনে কা নেহি’।
আমরা, গ্রীষ্ম-প্রধান দেশের লোক, বাসে-ট্রামে-ট্রেনে-অফিসে দুম করে মাথা গরম করে তারপর বাড়িতে ফিরে আয়নায় তাকিয়ে গালাগাল করি তো? এই ছয়টি ছেলেমেয়ে আপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, এদ্দিন নিজেকে কতটা সিরিয়াসলি নিচ্ছিলেন, আর সেটা কতটা বোকার মত কাজ।
লক্ষ্য করে দেখলেন তো, মোটেই কিচ্ছুটি বললাম না গল্পটা নিয়ে? আমি জানি, আপনারা সব ধুরন্ধর ব্যক্তি, ঠিক সব খবর খুঁজে বের করে নেবেন। বরং আমার চিন্তা হচ্ছে, এই যে বিনে পয়সায় বিজ্ঞাপন করে দিলাম, এ জন্য আমায় আজ রাতে আবার কোন একটা এপিসোড চালিয়ে বসতে হবে- আমায় হাসানো তো এখন ওদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তাই না?
বাকি থাকলো কেবল একটা কৈফিয়ৎ- যে প্রশ্নটা এতক্ষণ ভ্রূ-কুঞ্চিত করে মাথায় ঘোরাচ্ছেন, তার উত্তরে। এই সামান্য কথাটা বলার জন্য মাইলখানেক লম্বা ভূমিকা দিলাম কেন? কারণ খু-উ-ব সোজা। এই দেখুন- এদের মতে Coupling নামের ব্রিটিশ সিরিয়ালটা নাকি অনেক অনেক বেশি ভালো। সে হতেই পারে, তার জন্যে ফ্রেন্ড্‌স্‌ কে funny না বলার কারণ কি? এরকম অনেকরকম আছে। কেউ কেউ এর নাম শুনলেই মুখ বাঁকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যসূচক ‘হুঁহ্‌’ বলে দেয়। তারপর শুরু হয় সমালোচনা- ওখানে কত সমস্যা কে ছোট করে দেখানো হয়েছে, কোন কোন জনগোষ্ঠীকে অসম্মান করা হয়েছে ইত্যাদি। আর সবথেকে বড় সমস্যা? ওটা mainstream, মানে সাধারণ লোকের বেজায় ভালো লাগে। তাই প্রতিবাদ করে ঠিক করেছি, আমাদের মতো সর্বভুকদের জন্য এরপর থেকে এই রকম সব বই, সিনেমা, গান- এ সব নিয়ে এইখানে লিখবো, যেগুলো অধিকাংশের, মানে ছাপোষা লোকেদের ভালো লাগে। তাতে জ্ঞানীরা যতই হতচ্ছেদ্দা করুন না কেন… ঠিক কিনা?




পুনশ্চ: Coupling আমি দেখেছি। অসাধারণ witty serial কোন সন্দেহ নেই। আর যাই হোক, Sherlock এর লেখকের লেখা তো! কিন্তু আমার মনে এদের জায়গা সম্পূর্ণ আলাদা। ফ্রেন্ডস্ ... তো... ঠিক... শুধু... সিরিয়াল নয়... J

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই