Thursday, July 5, 2012

ফটিক ও বিরিঞ্চি বাবা-১ -- ঘনাদা

বাঙালির একটা বদ-অভ্যাস আছে। ডাক নামকে বিকৃত করার। একটা স্নেহ মাখা অবজ্ঞার সঙ্গে ডাক নামকে ওলট পালট করে দেয় এই জাতটা।
বাঙালি বোধহয়, মনে করে- এই অবজ্ঞা পরে ছেলেটাকে বড় করে তুলবে।
তা, ফটিক, ফইটক্যা হয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে
উনি একজন সত্যিকারের বড় মাপের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন পরবর্তীকালে।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে খাটো না করেই বলা যায়, বেঙ্গল- কেমিক্যাল, যে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল, সেটা এই ফটিকের জন্যই।
প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একবার চিঠি দিয়ে, ফটিক সম্বন্ধে কৃত্রিম অভিযোগ করেন রবীন্দ্রনাথকে।
তিনি, ফটিকের ভালো নাম দিয়ে লিখেছিলেন:-
“আপনি, ফটিকের বইয়ের এত প্রশংসা করছেন, যে বেঙ্গল- কেমিক্যাল অসুবিধায়। প্রশংসার দরুন বেঙ্গল- কেমিক্যাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কারণ, প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার সব কাজ- কর্ম শিকেয় তুলে কেমিস্ট্রি ছেড়ে গল্প লেখায় মত্ত হবে।”
রবীন্দ্রনাথ এই চিঠির উত্তরে যে চিঠি ( ১৮ ই অঘ্রান, ১৩৩২) লেখেন, তার শেষাংশ ছিল এই রকম:-
যে সব জন্ম সাহিত্যিক গোলমালে ল্যাবরেটরির ভেতর ঢুকে জাত খুইয়ে বৈজ্ঞানিকের হাটে হারিয়ে গিয়েছেন তাদের ফের জাতে তুলব। আমার এক একবার সন্দেহ হয়, আপনিও বা সেই দলের একজন হবেন, কিন্তু আর বোধহয়, উদ্ধার নেই।যাই হোক, আমি রস যাচাইয়ের নিকষে আঁচড় দিয়ে দেখলাম আপনার বেঙ্গল- কেমিক্যালের এই মানুষটি একেবারেই কেমিক্যাল গোল্ড নন, ইনি খাঁটি খনিজ সোনা
রবীন্দ্রনাথ, একবার ফটিককে বলেছিলেন- তুমি এত রস কোথা থেকে পাও?
ফটিকের উত্তর ছিল- আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমি রসায়নের (কেমিস্ট্রি) লোক।
রবীন্দ্রনাথ ফটিক সম্বন্ধে এক জায়গায় বলেছিলেন:-
“তিনি মূর্তির পর মূর্তি গড়িয়াছেন। এমন করিয়া গড়িয়াছেন যে মনে হইল ইহাদিগকে চিরকাল চিনি।”
একজন লেখকের এর চেয়ে বড় প্রশস্তি কি আর হতে পারে?
বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, শ্লেষ বা ব্যঙ্গের লক্ষ্য- সন্ধানে দক্ষতা এবং সেই সঙ্গে অনায়াস ভঙ্গিতে কৌতুককর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অতুলনীয় ক্ষমতা ফটিকের ভালো রকমই ছিল।
এই সব দুর্লভ গুণের অধিকারী হয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রশস্ত অঙ্গনে রসের ঝর্ণা ছুটিয়ে পাঠকদের “হাড্ডি পিলপিলিয়ে” দিয়েছিলেন।
তার রচনার মধ্যে দিয়ে কটাক্ষ করেছেন, আঘাত হেনেছেন, কিন্তু এই রসিকতা শুধু বিষের দহন আনে নি, এনেছে বিশুদ্ধ কৌতুক রস।
পাঠকদের দুর্ভাগ্য, তাঁরা Zআন্তি পারেন নি।
যে কোনো তারযন্ত্রে, তারটাকে বেঁধে সুরেলা করতে হয়। এই ফটিক, ২১ টা সুরে বাঁধা তার লাগিয়েছিলেন, যা বাংলা সাহিত্যের সেতারকে আরও সুরেলা করে তুলেছিল। সেই তারের ঝংকারে, সুরের মূর্ছনা তো বটেই, ঝলসে উঠেছিল বিদ্যুৎতের দীপ্তি।
বিয়াল্লিশ বছরে পা দিয়ে, একসময় ফটিক যে কলম তুলে কাগজে আঁচড় কেটেছিল, তার থেকে বেরিয়ে এসেছিল, সোনার ফসল।
ভালো ল্যাংচা খেতে গেলে বর্দ্ধমানের শক্তিগড় যেতেই হবে। ১৮৮০ সালের ১৮ ই মার্চ  (অন্যমতে, ১৬ ই মার্চ), ফটিকের জন্ম এই শক্তিগড়ের কাছে ব্রাহ্মণ পাড়ায়। শক্তিগড়, এই ফটিকের জন্যই আরও বিখ্যাত হয়ে আছে।
ফটিক নামের আড়ালে, এই মানুষটি কে? বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছেন!
হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন, ইনি ৺ রাজশেখর বসু। একটা ছদ্মনামও ছিল- পরশুরাম।
আগে, জেনে নেই রাজশেখর বসু নামটা কেন হয়েছিল ফটিকের।
বড় ভাই, শশীশেখরের স্মৃতিচারণ থেকে জানতে পারি:-
“দ্বার ভাঙ্গা থেকে ঘুরে এসে চন্দ্রশেখর (পিতা) বললেন- ফটিকের নাম ঠিক হয়ে গেছে। মহারাজ লক্ষ্মীশ্বর সিংহ (শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার দ্বিতীয় ছেলের নামও একটা শেখর হবে নাকি? কি শেখর হবে?আমি বললাম- ইওর হাইনেস, যখন তাকে আশীর্বাদ করেছেন, তখন আপনিই তার শিরোমাল্য- আমি আপনার সামনেই তার নামকরণ করলাম, ‘রাজশেখর’।”
ঠিকঠাক ভাবে বলতে গেলে, এই নামকরণটা সার্থক হয়েছিল। জীবনের রঙ্গমঞ্চে তিনি, গ্রীক ট্র্যাজেডির নিঃসঙ্গ নায়ক ছিলেন। ঋষিসুলভ জীবনজিজ্ঞাসার সঙ্গে ক্ষত্রিয়সুলভ তিতিক্ষা তাঁর জীবনকে এক রাজকীয় আভিজাত্যে প্রচ্ছদায়িত করে রেখেছিল। এক্ষেত্রে, তিনি সত্যিই রাজশেখর।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, চন্দ্রশেখর ছিল রাজশেখরের বাবার নাম।
আমরা এটা জানি, বাঙালি কবি বা লেখকের গায়ে একটা অগোছালো ঢিলেঢালা চাদর থাকে। এই চাদরটি তিনি সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কবিস্বভাব থাকলেও তিনি ছিলেন, অসাধারণ বিষয়নিষ্ঠ বা বস্তুনিষ্ঠ। প্রতিটি কাজের নিখুঁত ছক তৈরি করেই তিনি কাজে নামতেন এটাই ছিল তাঁর স্বভাব। আজকালকার এম.বি.এ. ডিগ্রিধারীরা তাঁর ধার কাছ দিয়েও যেতে পারবেন কিনা, সন্দেহ আছে। বেঙ্গল কেমিক্যালকে পূর্ণভাবে গড়ে তোলার কাজই হোক বা “চলন্তিকা” অভিধান, রামায়ণ- মহাভারতের অনুবাদই হোক, সেই সব রচনার কাজ, সব কিছুই তিনি প্ল্যান- মাফিক করতেন।
যে কোনো সফল বৈজ্ঞানিকের একটা গুণ থাকা দরকার, সেটা হল- একান্ত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। রাজশেখর সেটা অনায়াসে করতে পারতেন। তাই তাঁর  এই ক্ষমতাকে নিজের জীবন আর কাজে প্রয়োগ করে, একজন সফল লেখকের পাশাপাশি, প্রযুক্তিবিদ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সংসারধর্মই হোক বা সাহিত্য কর্ম, যখনই সার্থক শিল্প হয়ে ওঠে, তখন সেই সবের সঙ্গে অঙ্কের বা গণিতের কোন পার্থক্য থাকে না। ভালো সাহিত্য কর্ম আর ভালো অঙ্ক প্রায় সমার্থক। Muse of the Universe কে যদি ঠিক ভাবে ভাবা যায় তবে সেটা বিচিত্র অঙ্কের ঐকতান। বিশ্বজাগতিক নিয়মের অঙ্কই তো ছন্দ। মানুষের জীবনকেও তাই অঙ্কের নিয়মে ছকে নিয়ে তার মধ্যে থেকে এসেন্স অফ লাইফ বা জীবন নির্যাস সংগ্রহ করেছেন রাজশেখর।
একটি শিশু যেমন হামাগুড়ি দিয়ে সারা বাড়ীতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে, একটা লাল পিঁপড়েকেও মুখে পোরে তার স্বাদ জানার জন্য তখন পিঁপড়ের হুলের তীক্ষ্ণ কামড় পেয়েও তাকে ছাড়ে না, কৌতূহলের জন্য, রাজশেখরও সেই রকম কৌতূহলের অধিকারী ছিলেন।


(চলবে)

তথ্যঋণ এবং কৃতজ্ঞতা: রাজশেখর বসু স্মরণিকা (আলিপুরদুয়ার, ১৯৮৩), চরিতাভিধান- সাহিত্য সংসদ, ইন্টারনেট।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই