<<আগের সংখ্যা
“পরশুরাম একজন স্যাকরা। পৌরাণিক পরশুরামের সঙ্গে
এর কোনো সম্বন্ধ নেই। স্বনামে গল্প ছাপানোতে আমার একটু সংকোচ ছিল। বন্ধু-বান্ধব সহ একটা ছদ্মনামের চিন্তা করছিলাম। দৈবক্রমে সেই সময় তারাচাঁদ পরশুরাম নামে একজন কর্মকার, আমাদের পার্শি বাগানের বাড়ীর “উৎকেন্দ্র”র মজলিসে উপস্থিত হয়। হাতের কাছে তাকে পেয়ে তার নামটাই নিয়ে নেই। এই নামের পেছনে অন্য কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য নেই। পরে, আরও লিখবো জানলে ও-নাম হয়তো নিতাম না।”
এর কোনো সম্বন্ধ নেই। স্বনামে গল্প ছাপানোতে আমার একটু সংকোচ ছিল। বন্ধু-বান্ধব সহ একটা ছদ্মনামের চিন্তা করছিলাম। দৈবক্রমে সেই সময় তারাচাঁদ পরশুরাম নামে একজন কর্মকার, আমাদের পার্শি বাগানের বাড়ীর “উৎকেন্দ্র”র মজলিসে উপস্থিত হয়। হাতের কাছে তাকে পেয়ে তার নামটাই নিয়ে নেই। এই নামের পেছনে অন্য কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য নেই। পরে, আরও লিখবো জানলে ও-নাম হয়তো নিতাম না।”
এবারে, “উৎকেন্দ্র”র মজলিসের ব্যাপারে কিছু বলি।
পৈতৃক বাড়ী, ১৪ নং পার্শি বাগান লেনে বসতো “উৎকেন্দ্র”র বৈঠক। “উৎকেন্দ্র” র নামটা তৈরি হয়েছিল- উৎকট + কেন্দ্র, এই দুটো শব্দ অনুসারে। “উৎকট” এই নামটার প্রথম অক্ষর উৎ এবং কেন্দ্র নিয়ে। এতে, রাজশেখর ছাড়াও থাকতেন তাঁর চার ভাই, জলধর সেন, ব্রজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলেন সাহা, রঙীন হালদার, প্রেমাংকুর আতর্থী, যতীন সেনের মত সেই কালের জ্ঞানী-গুণীরা। অশ্লীল এবং যৌন – আলোচনাও বাদ যেত না। এখানেই রাজশেখর বসুর গড্ডলিকার গল্পগুলো পাঠ করা হত।
পৈতৃক বাড়ী, ১৪ নং পার্শি বাগান লেনে বসতো “উৎকেন্দ্র”র বৈঠক। “উৎকেন্দ্র” র নামটা তৈরি হয়েছিল- উৎকট + কেন্দ্র, এই দুটো শব্দ অনুসারে। “উৎকট” এই নামটার প্রথম অক্ষর উৎ এবং কেন্দ্র নিয়ে। এতে, রাজশেখর ছাড়াও থাকতেন তাঁর চার ভাই, জলধর সেন, ব্রজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলেন সাহা, রঙীন হালদার, প্রেমাংকুর আতর্থী, যতীন সেনের মত সেই কালের জ্ঞানী-গুণীরা। অশ্লীল এবং যৌন – আলোচনাও বাদ যেত না। এখানেই রাজশেখর বসুর গড্ডলিকার গল্পগুলো পাঠ করা হত।
জলধর সেন, তা “ভারতবর্ষ” পত্রিকায় ছাপান। পরে, এটা বই আকারে প্রকাশিত হলে,
রাজশেখর প্রথম এই “পরশুরাম” নামটা ব্যবহার করেন। তখন তাঁর
বয়স ৪২ বছর। এদিক দিয়ে
পরবর্তী কালের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলির সঙ্গে মিল আছে।
তাঁর প্রথম রচনা “দেশে-বিদেশে” বইটাও মুজতবার ৪২
বছরে প্রকাশিত হয়। আমার ব্যত্তিগত
পর্য্যবেক্ষণ হলো-
বিশাল মাপের সাহিত্যিকদের কোনো না কোনো ভাবে একটা অদ্ভুত মিল থেকেই যায়।
বিশাল মাপের সাহিত্যিকদের কোনো না কোনো ভাবে একটা অদ্ভুত মিল থেকেই যায়।
এখন কথা হচ্ছে, রাজ শেখর বসুর জনপ্রিয়তার উৎস কোথায়?
মৌলিক পরিকল্পনার উদ্ভাবনী শক্তি হাস্যরস
সৃষ্টির প্রথম এবং প্রধান কথা। রাজশেখর
বসুর তা সহজাত কবচ-কুণ্ডলের মতই ছিল। এছাড়া, তাঁর হাস্যরস সৃষ্টির
পেছনে কাজ করত একটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাব। কোনো কৃত্রিমতা তাঁর রচনাকে কোনোভাবেই স্পর্শ করে নি। তাই তিনি
বাংলা সাহিত্যে বিরাজ করেছেন, রাজকীয় মহিমায়।
এটার কারণ “বোধহয়” তিনি নিজেই বলে গিয়েছেন। ডঃ সুশীল রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে, তিনি একবার বলেছিলেন:-
“জীবনে আমি খুব কম লোকের সঙ্গে
মিশেছি। তাই আমার
অভিজ্ঞতাও খুব কম। গ্রাম বেশী
দেখি নি। কর্মসূত্রে
যাদের সঙ্গে মিশেছি, তারা সবই ব্যবসায়ী এবং দোকানদার ক্লাস।”
আমার মনে হয়, ব্যবসায়ী এবং দোকানদার ক্লাসের সঙ্গে তাঁর যে কথোপকথন হত, তাতেই তাঁর গল্পের ঝুলি ফুলে ফেঁপে যেত। শান্ত, গম্ভীর, এবং সংযমী-বিদগ্ধ এই রস সাহিত্যিক, তাই রসিকতার সামান্য সুযোগ পেলেই
তার সদ্ব্যবহার করতেন।
১৯২২ সালে,পরশুরাম ছদ্মনামে, তাঁর
প্রথম রচনা- শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড। প্রকাশিত হয়েছিল, জলধর সেন সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকায়। প্রথম
রচনার কথা বলতে গিয়ে, তাঁর স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন
(ডঃ সুশীল রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে):- “আমার প্রথম রচনা অবশ্য- কবিতা ছিল। শিশুদের
হাম বা ডিপথেরিয়া হওয়ার যে একটা প্রাকৃতিক নিয়ম আছে, ঠিক সেই প্রাকৃতিক
নিয়মেই আমি দু-একটি কবিতা লিখি, কিন্তু
সেটা পনেরো–ষোল বছর বয়সেই চুকে যায়। বাল্যের কবিতা রচনার কথা বাদ দিলে বেঙ্গল কেমিক্যালসেই আমার সাহিত্য–চর্চার আরম্ভ। এখানেই তার হাতে খড়ি, বলতে পারা যায়। অবশ্য মূল্য–তালিকা
তৈরি করা বা বিজ্ঞাপন লেখাকে যদি কেউ সাহিত্য বলে গ্রাহ্য করে! কেন না, শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেডের আগে আমার যা-কিছু বাংলা
রচনা তা এছাড়া আর কিছু না।”
শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড লেখা
প্রকাশিত হবার পর, রাজশেখর বসু বলেছিলেন, লেখাটি পড়ে পাঠকদের ধারণা হয়েছিল, এই রচনা কোনো উকিলের।
এই “শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী
লিমিটেড” এর গল্পে, আমরা ব্যঙ্গের প্রাথমিক
চকিত স্পর্শ পেয়েছিলাম। ভণ্ডামি
আর মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে, বক্তব্য সেখানে তির্যক রেখায় অঙ্কিত হয়ে ছিল।
স্বদেশী কোম্পানী বা বাংলার যৌথ ব্যবসা
গুলো মোটামুটি ভাবে চিরকালই জাল-জুয়াচুরির আখড়া ("এই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে")।
বাঙালীর এই জাতীয় চরিত্রের মজ্জাগত
প্রবৃত্তির বিরুদ্ধেই হাস্য-রসাত্মক দৃষ্টি ভঙ্গিতে আক্রমণ করেছিলেন,
রাজশেখর বসু।
ব্রহ্মচারী অ্যান্ড ব্রাদার–ইন–ল, জেনারেল মার্চ্চেন্টসের শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী,
অটল, গণ্ডেরিরাম- এই সব চরিত্রকে
আজও আমরা বাস্তব জীবনে দেখতে পাই। মানুষ ঠকানোর
ব্যবসা এদের দীর্ঘকালের।
ব্যঙ্গের প্রয়োজনে কিছু অতিরঞ্জনের
ছোঁয়া থাকলেও, কখনই তা বাস্তবকে ছাড়িয়ে যায় নি।
গণ্ডেরিরাম ব্যবসা করে ভেজাল ঘিয়ের। চর্বি, চিনা বাদাম তেল মিশিয়ে
যে বস্তুটি সে উৎপাদন করে, তার নাম দিয়েছে- "ঘই"।
নিরামিষ ভোজী, ফোঁটা-কাটাওয়ালা, ভজন-পূজনে সমর্পিত প্রাণ গণ্ডেরিরাম এই পাপ কাজ করেন কি করে?
অটলের এই প্রশ্নের জবাবে গণ্ডেরিরাম
উত্তর দিচ্ছে:-
“পাপ? হামার কেনো পাপ হোবে? বেওসা তো করে কাসেম আলি। হামি রহি কলকাত্তা ! ঘই বনে হাথরাসমেঁ। হামি না
আঁকসে দেখি, না নাকসে শুঁখি। হনুমানজি কি কিরিয়া। হামি তো
স্রিফ্ মহাজন আছি। রূপয়া দে
কর খালাস।”
এই সংলাপে হাসি চেপে রাখা দায় হয়।
“শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড”
র প্রসপেক্টাসটিও চরম ভাবে শ্লেষাত্মক।
“যাত্রীদের নিকট হইতে যে দর্শনী
ও প্রণামী আদায় হইবে, তাহা ভিন্ন আরও নানা প্রকারে অর্থাগম হইবে। দোকান, বাজার, অতিথি শালা, মহাপ্রসাদ বিক্রয় হইতে প্রচুর আয় হইবে। এতদ্ভিন্ন by product recovery এর ব্যবস্থা থাকিবে। ৺ সেবার
ফুল হইতে সুগন্ধি তৈল প্রস্তুত হইবে, এবং প্রসাদী বিল্বপত্র মাদুলিতে
ভরিয়া বিক্রিত হইবে। চরণামৃতও
বোতলে প্যাক করা হইবে। বলির নিহত
ছাগ সমূহের চর্ম ট্যান করিয়া উৎকৃষ্ট “কিড-স্কিন” প্রস্তুত হইবে এবং বহুমূল্যে বিলাতে চালান যাইবে। হাড় হইতে বোতাম হইবে। কিছুই ফেলা যাইবে না।”
আমরা রাজশেখর পূর্ব ত্রৈলোক্যনাথের
ডমরু-চরিতেও আমরা এই ধরণের বাঙালীর যৌথ ব্যবসার সন্ধান পেয়েছি।
(চলবে)
তথ্য ও ঋণ স্বীকার:-
আলিপুর দুয়ার থেকে প্রকাশিত
“রাজশেখর বসু (পরশুরাম)
স্মরণিকায়”, ১৯৮৩ তে প্রকাশিত প্রবন্ধ সকল।
১। সর্বশ্রী বিমলেন্দু বিষ্ণু, কমলেশ রাহা রায়, ডঃ জোৎস্নেন্দু চক্রবর্তী, মিহির রঞ্জন লাহিড়ী, ডঃ হরিপদ চক্রবর্তী, ডঃ সুরঞ্জন দত্তরায়, অর্ণব সেন, পবিত্রভূষণ সরকার।
২। সংসদ বাংলা চরিতাভিধান।
৩। ইন্টারনেট।
৪। পরশুরাম রচনাবলী।