Thursday, July 26, 2012

মিসেস ব্যানার্জি -- কুন্তলা

আজ থেকে ৪০ বছর আগে, চৈত্রমাসের এক সকালে ডালহৌসির মোড়ে বাস থেকে নামলো মণি আর মণির মেজদা। বাসস্টপ থেকে
গঙ্গার দিকে কয়েক পা এগোলেই ডান ফুটপাথের ধারে একটা আকাশছোঁয়া ধপধপে সাদা বাড়ি। ওটাই ওদের গন্তব্য। সাদা বাড়িটার পেটের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে মেজদা মণিকে পিছু ডাকলেন।
পেন নিয়েছিস?”
না তো।
অ্যাঁ! ইন্টারভিউতে যদি কিছু লিখতে বলে কী বলবি? আপনাদেরটা দিন, আমি পেন আনতে ভুলে গেছি?” গাঁট্টা মারার ভঙ্গি করে মেজদা বুকপকেট থেকে নিজের পেনটা মণির হাতে গুঁজে দিলেন।

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মণিকে একটা ঘরে ঢুকতে বলা হল। ঘরের ভেতরটা সিনেমায় যেমন দেখায়, মাঝখানে একটা বড় টেবিল, টেবিলের এধারে একা মণি, ওধারে বাঘের মতো মুখ করে তিনজন গোমড়া ভদ্রলোক পাশাপাশি বসে আছেন। মণি কাঁপা হাতে নিজের মার্কশিটগুলো এগিয়ে দিলো। সেগুলো হাতে হাতে ঘুরলো কিছুক্ষণ। মাথা-টাথা নড়লো। তারপর বাঘেদের মধ্যে যিনি সবথেকে কেঁদো, তিনি একটা নোটপ্যাড মণির দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, “নিজের নাম ঠিকানাটা লেখো এতে।লেখার পর শুরু হলো সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা। গোটা দশেক রাজ্য আর তাদের রাজধানী। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক কে আবিষ্কার করেছিলেন? অবশেষে কেঁদোবাঘ গম্ভীর গলায় বললেন, “ওঘরে গিয়ে দেখবে একটা ফোন রাখা আছে। সেটা তুলে রিসিভারের কাছে মুখ নিয়ে নিজের নাম ঠিকানা বলে, রিসিভার ঠিক জায়গায় নামিয়ে রেখে আবার এ ঘরে ফিরে আসবে।
রাজ্য রাজধানী আর ম্যালেরিয়া জিজ্ঞেস করতে হয় বলে করা। টেলিফোন অপারেটরের চাকরির জন্য মার্কশিট, হাতের লেখা আর গলার আওয়াজই যথেষ্ট।
ওঘরের ভারি আর কালো গামবাট ফোনে উল্টোদিকের শূন্যতাকে উদ্দেশ্য করে নিজের নামঠিকানা বলে মণি এ ঘরে ফিরে এলো। কেঁদোবাঘ টাইপ করা একটা চিঠির ওপর মণির নাম লিখে আর নিচে খসখস করে নিজের সই করে চিঠিটা মণির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “সোমবার সকাল ১০টায় চলে আসবে।
কিন্তু আমার তো এখনো পরীক্ষা শেষ হয়নি। প্র্যাকটিকাল বাকি আছে।
প্র্যাকটিকাল শেষ করেই এস তবে।

***
৪০ বছর আগে প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সেই যে শুরু হয়েছিলো, শেষ হবে এই আর দুদিন পরেই, ৩১শে মার্চ, ২০১২।
আমার মায়ের গল্প আগেও অনেক করেছি, পরেও অনেক করবো। কিন্তু আজকের গল্পটা আমার মায়ের নয়। মিসেস ব্যানার্জির। সাড়ে ৯টার সময় যিনি এক হাতে ঘড়ি, চশমা, গলার হার, হাতের আংটি, গত কয়েকবছর ধরে মোবাইলও যোগ হয়েছে, মুঠো করে ধরে; আরেক হাতে খসে পড়া খোঁপা সামলাতে সামলাতে, মীরা মাসিকেমনে করে ছাদের জামাকাপড় নামিয়ে আনারনির্দেশ দিতে দিতে তীর-বেগে ছুটে বেরিয়ে রবিকাকুর রিকশায় উঠে হুস করে চলে যান, আর বাড়ি ফেরেন সেই সন্ধ্যে পেরিয়ে, সারা পাড়ায় টিউবলাইট জ্বলে যাওয়ার পর। এই মাঝখানের সময়টায় তিনি ঠিক কী করেন, কোথায় যান, কী খান, কেমন করে কথা বলেন, অফিসসুদ্ধু লোককে গলা মোটা করে বকেন নাকি সবার সাথে মিষ্টি হেসে আলাপ করেন, সেটা আমরা কেউ জানিনা।
ঠাকুমা জানেননা, বাবা জানেননা, আমার কথা তো ছেড়েই দিন।
ওই সময়টার জন্য মা আমাদের কেউ নন। তিনি মিসেস ব্যানার্জি। ক্বচিৎ কদাচিৎ ফোনে মিসেস ব্যানার্জির গলা আমি শুনতে পাই। ফোন তুলেহ্যালোবলার আগের এক সেকেন্ডে কাউকে একটা ফাইল নিয়ে আসতে বলছেন। আমি চুপ করে শুনি। অদ্ভুত লাগে। মনে হয় অচেনা কারো জীবনের ভেতর চুরি করে উঁকি মেরেছি। মা বছরকয়েকের জন্য যখন আসামে পোস্টেড ছিলেন, তখন মায়ের ঘর ছিল অফিস-বাড়ির একতলায়। একদিন একটা গরু, গেট খোলা পেয়ে, অম্লানবদনে হেঁটে হেঁটে বাড়ির ভেতর চলে এসে, মায়ের ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে মুণ্ডু গলিয়ে খুব গম্ভীর মুখে মায়ের দিকে তাকিয়েছিলো। নিজেকে সেই গরুটার মতো মনে হয় আমার। পর্দা সরিয়ে মিসেস ব্যানার্জির জীবনে উঁকি মেরে দেখছি। বেশিক্ষণ দেখতে পাইনা অবশ্য। পর-মুহূর্তেই মিসেস ব্যানার্জি মিলিয়ে গিয়ে আমার ৩১ বছরের পুরনো চেনা মায়ের গলা ভেসে আসে, “সরি সরি সোনা মা, তোমাকে ধরিয়ে রেখেছি...খেয়েছো?...পড়াশোনা করেছ?...ঠাণ্ডা লাগেনি তো...”

***
৩১ তারিখ সন্ধ্যেবেলা লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বাড়ি ফিরবেন মিসেস ব্যানার্জি। রোজ যেমন ফেরেন। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে। হয়তো সেদিন আকাশের একটা কোণ এমন অপূর্ব এক বিষণ্ণ আলোয় ভরে উঠবে, ব্যাগ খুলে মোবাইল বার করে সেটার ছবি তুলে রাখবেন। ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে আনমনা হয়ে যাবেন। লঞ্চ জেটিতে এসে ভিড়বে। লোকজন ব্যস্ত হয়ে নামবে। পেছনের লোকটা তাঁকে ওভার-টেক করে যেতে যেতে বিরক্ত হয়ে মনে মনে বিড়বিড় করবে, উফ মহিলা কি ভাববেন না হাঁটবেন?
মিসেস ব্যানার্জিকে আমি ভালো করে চিনি না, কিন্তু আমি জানি ওই মুহূর্তে মিসেস ব্যানার্জি কী ভাবছেন। মণির কথা। ২০ বছরের মণি। বাড়ির সকলের কথা অমান্য করে, ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মুখ চেয়ে, পড়া শেষ হতে না হতেই যেমনতেমন একটা চাকরিতে ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়া মণি। যদি না ঢুকতেন, কী হতো? অন্য কোন পথে বইত জীবন? কেমন হতো সেই পথ? ভালো? নাকি আরও ভালো? হাওড়া স্টেশনের ভিড়ের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে মিসেস ব্যানার্জি ভয়ে ভয়ে মণির দিকে তাকান।
সাদা বাড়িটার সামনে বিনুনি বাঁধা, ছাপা শাড়ি পরা, মুখে হাজার ওয়াটের হাসি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মণি মিসেস ব্যানার্জির দিকে প্রবল হাত নাড়ে। ঠোঁটে দুহাত ছুঁইয়ে উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “গুড জঅঅঅঅঅব।
মিসেস ব্যানার্জি চোখে শাড়ির আঁচল চেপে ধরেন। মার্চ ফুরোয়নি এখনো, তাতেই কী গরম পড়েছে বাপরে।

***
এখন কী করবে মা সারাদিন? যমের অরুচি বাংলা সিরিয়ালগুলো দেখবে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে? নাকি ঠাকুমার আলমারি থেকে কথামৃত নামিয়ে পাতা উল্টোবে? দুপুরবেলা ঘুমনোর অভ্যেস কি হবে তোমার এই বয়সে নতুন করে? নাকি শুয়ে শুয়ে ফেলে আশা দুপুরগুলোর কথা ভাববে? মনে আছে তোমার হেয়ার স্ট্রীটের অফিস-ঘরটার জানালা দিয়ে একটা মসজিদের সোনালি রঙের গম্বুজ দেখা যেত? টেলিফোন ভবনের জানালা দিয়ে তাকালে লালদিঘি আর টোডি ম্যানসনের জানালা দিয়ে তাকালে কী দেখা যেত জানিনা, তোমার ওই অফিসটায় আমাকে নিয়ে যাওনি কখনো। ধুবড়ির অফিসের জানালা দিয়ে তাকালে গৌরীপুরের মাঠ আর মাঠের ধারের বিরাট বটগাছটা দেখতে পেতে। ব্রহ্মপুত্র দেখা যায়না বলে কত দুঃখ ছিল তোমার মনে আছে? সে দুঃখ আবার নতুন করে উথলে ওঠে যদি? যদি চোখে জল এসে যায়?

তখন তুমি তাড়াতাড়ি সেই গরুটার কথা মনে করো মা। ওই যে, যে গরুটা পর্দা সরিয়ে তোমার ঘরে ঢুকে পড়েছিলো? দেখবে দুঃখ-টুঃখ কোথায় চলে গিয়ে হাসি পেয়ে গেছে। অফিসের জানালা দিয়ে ব্রহ্মপুত্র অনেকেই দেখতে পায়, কিন্তু অফিসের ভেতর আস্ত, জলজ্যান্ত একখানা গরু! তুমি ছাড়া কেউ কখনো দেখেনি মা, দেখবেও না।

লেখিকার নিজের একখান ব্লগ আছে, এই লেখা সেখান থেকেই অনুমতিক্রমে নেওয়া... ব্লগটা পাশের Partners লিস্টে আছে। এমনই অনেক ভালো লেখা দিয়ে সাজানো...

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই