পুজো মানেই বাড়ির কর্তাদের কপালে
ভাঁজ। কারণ বাড়ির মা দুর্গারা ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, পুজোর চারদিন ‘নো রান্না’, আর
তার মানেই পুজোয় ঠাকুর দেখার ফাঁকে চাইনিজ রেস্তোরাঁর সামনে দৈনিক অন্তত দু’ঘণ্টা করে অপেক্ষা এবং চিলি
চিকেন, মাঞ্চুরিয়ান বা কিং সাইজ প্রন খেয়ে পকেট ফাঁক।
বাড়ির গিন্নিরাও কিন্তু নিশ্চিন্তে নেই। বোরোলিনের মতোই তাঁদের জীবনের আর এক অপরিহার্য অঙ্গ সেইসব ‘ক্যাবলার মা’ বা ‘খেঁদির মা’দের ফরমায়েশি শাড়ি চাই। তাদেরও আবার আজকাল নানা বায়নাক্কা, “বুঝলে বৌদি, ও বাড়ির মাসিমা কি ভালো একটা শাড়ি দিয়েছে, কি ভালো কাজ, কি সোন্দর রঙ! বলে, তুই তো আমার নিজের মেয়ের মতো।” শুনেই গিন্নির চাপ! অনেক কষ্ট করে এই একজনকে পাওয়া গেছে। মাসের মধ্যে পাঁচ দিন কামাই বাঁধা, কিন্তু তাও তো আছে। এ চলে গেলে নতুন লোক খুঁজে পাওয়া আর ভগবানকে পাওয়া একই ব্যাপার, বরং ভগবানকে পাওয়াই অনেক সহজ কাজ! তাই গিন্নিও লেগে পড়লেন তাকে তুষ্ট করতে, তার জন্যেও এলো রংবেরঙের নতুন শাড়ি।
এর সঙ্গে আছে অসংখ্য আত্মীয়ের জন্য পুজোর উপহার কেনার পালা। ছোটমাসির জন্য সাদা গরদ, মাসতুতো ভাইয়ের পাঞ্জাবি, তার অর্ধাঙ্গিনীর বালুচরি, দু’টো কাচ্চাবাচ্চার জন্য জিন্স আর টিশার্ট। লিস্টি এখানে শেষ নয়, বরং বলা যায় সবে শুরু!
অতঃপর শুরু হলো বকশিসের পালা, সেই অফিসের দারোয়ান থেকে শুরু করে পোস্টম্যান, লিফটম্যান, খবরের কাগজওয়ালা থেকে পাড়ার পানের দোকান, কেউই বাদ নেই। মাঝে মধ্যেই পাঁচ-ছ’জন লোকের হামলা এবং দশ মাইল দূরের পুজোকেও “আপনাদেরই তো পুজো, আপনারাই আনন্দ করবেন ইত্যাদি” বলে বিভিন্ন পরিমাণের চাঁদা আদায়। আজকাল আবার লোকজন চাঁদায় কত টাকা জিজ্ঞেস করার ধার ধারে না, “টাকার আমাউন্ট বসিয়ে দিলাম দাদা, পরে ক্লাবে গিয়ে দিয়ে আসবেন। দেখবেন, দরি করবেন না যেন।”
দেখতে দেখতে পুজো এসে পড়ল প্রায়। ক’দিন আগে থেকেই সাজো সাজো রব, কোনো পাড়ার পুজোর উদ্বোধন চতুর্থী তো কারও তৃতীয়া থেকেই লেগে গেলো, সঙ্গে কম্পিটিশন, কে কত বড় স্টারকে আনতে পারে! আর এই রেষারেষির পাল্লায় পড়ে কোনো মন্ত্রীর একদিনে চোদ্দ টা তো কোন ফিল্মস্টারের সতেরো জায়গায় উদ্বোধনের নেমন্তন্ন আর পরের দিনের খবরের কাগজের সামনের পাতায় বিশাল বড় ছবি! ওদিকে মা দুর্গা তখন-ও এক-সপ্তমাংশ বাকি, কিন্তু উপায় কি? পাশের পাড়ার উত্তাল সঙ্ঘের পুজোর আগে উদ্বোধন না হলে যে মানসম্মান কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না!
বাড়ির গিন্নিরাও কিন্তু নিশ্চিন্তে নেই। বোরোলিনের মতোই তাঁদের জীবনের আর এক অপরিহার্য অঙ্গ সেইসব ‘ক্যাবলার মা’ বা ‘খেঁদির মা’দের ফরমায়েশি শাড়ি চাই। তাদেরও আবার আজকাল নানা বায়নাক্কা, “বুঝলে বৌদি, ও বাড়ির মাসিমা কি ভালো একটা শাড়ি দিয়েছে, কি ভালো কাজ, কি সোন্দর রঙ! বলে, তুই তো আমার নিজের মেয়ের মতো।” শুনেই গিন্নির চাপ! অনেক কষ্ট করে এই একজনকে পাওয়া গেছে। মাসের মধ্যে পাঁচ দিন কামাই বাঁধা, কিন্তু তাও তো আছে। এ চলে গেলে নতুন লোক খুঁজে পাওয়া আর ভগবানকে পাওয়া একই ব্যাপার, বরং ভগবানকে পাওয়াই অনেক সহজ কাজ! তাই গিন্নিও লেগে পড়লেন তাকে তুষ্ট করতে, তার জন্যেও এলো রংবেরঙের নতুন শাড়ি।
এর সঙ্গে আছে অসংখ্য আত্মীয়ের জন্য পুজোর উপহার কেনার পালা। ছোটমাসির জন্য সাদা গরদ, মাসতুতো ভাইয়ের পাঞ্জাবি, তার অর্ধাঙ্গিনীর বালুচরি, দু’টো কাচ্চাবাচ্চার জন্য জিন্স আর টিশার্ট। লিস্টি এখানে শেষ নয়, বরং বলা যায় সবে শুরু!
অতঃপর শুরু হলো বকশিসের পালা, সেই অফিসের দারোয়ান থেকে শুরু করে পোস্টম্যান, লিফটম্যান, খবরের কাগজওয়ালা থেকে পাড়ার পানের দোকান, কেউই বাদ নেই। মাঝে মধ্যেই পাঁচ-ছ’জন লোকের হামলা এবং দশ মাইল দূরের পুজোকেও “আপনাদেরই তো পুজো, আপনারাই আনন্দ করবেন ইত্যাদি” বলে বিভিন্ন পরিমাণের চাঁদা আদায়। আজকাল আবার লোকজন চাঁদায় কত টাকা জিজ্ঞেস করার ধার ধারে না, “টাকার আমাউন্ট বসিয়ে দিলাম দাদা, পরে ক্লাবে গিয়ে দিয়ে আসবেন। দেখবেন, দরি করবেন না যেন।”
দেখতে দেখতে পুজো এসে পড়ল প্রায়। ক’দিন আগে থেকেই সাজো সাজো রব, কোনো পাড়ার পুজোর উদ্বোধন চতুর্থী তো কারও তৃতীয়া থেকেই লেগে গেলো, সঙ্গে কম্পিটিশন, কে কত বড় স্টারকে আনতে পারে! আর এই রেষারেষির পাল্লায় পড়ে কোনো মন্ত্রীর একদিনে চোদ্দ টা তো কোন ফিল্মস্টারের সতেরো জায়গায় উদ্বোধনের নেমন্তন্ন আর পরের দিনের খবরের কাগজের সামনের পাতায় বিশাল বড় ছবি! ওদিকে মা দুর্গা তখন-ও এক-সপ্তমাংশ বাকি, কিন্তু উপায় কি? পাশের পাড়ার উত্তাল সঙ্ঘের পুজোর আগে উদ্বোধন না হলে যে মানসম্মান কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না!
কোথাও আবার প্রতি বছরই চাই নতুন
উদ্বোধক। খেলোয়াড়, অভিনেতা, সমাজসেবী, জ্যোতিষী সব হয়ে গেছে, এবার হয়তো সানি লিওনের
পালা। গত বছর এরকমই এক পুজোয় গিয়ে দেখি উদ্বোধনের দিন মা দুর্গার সামনে লাল রিবনের
বদলে মোটা নারকেল দড়ি বাঁধা। একজন কর্মকর্তাকে পাকড়াও করে জানতে চাইলাম, “ভাই, এই
গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে হবেটা কি?” সে প্রচুর ঘ্যাম নিয়ে বলল, “জানেন না, এবার পুজোর
উদ্বোধন করছেন বিখ্যাত ফাঁসুড়ে শ্রী তরুণকুমার, তাই এখানে ফাঁসির দড়ি লাগিয়েছি।
এটাই হলো এ বছরের থিম, ‘ফাঁসির মঞ্চে মা’!” আমি আর ভয়ে সেই পুজোয় ত্রিসীমানা মারালুম না। কে জানে যদি দর্শকদেরও ঝুলিয়ে
দেয়! যা দিনকাল পড়েছে কিছুই অসম্ভব নয়।
অতঃপর পুজোর দিন এলো, আপামর বাঙালি
বেড়িয়ে পড়লো... টালা থেকে টালিগঞ্জ কিম্বা বালি থেকে বেহালা, থামার কোন প্রশ্ন
নেই, ঠাকুর দেখতে হবে তো! ছেলে-বুড়ো, মাসি-পিসি, মামা-কাকা সবাই বেড়িয়ে পড়েছে।
পিছিয়ে পড়লে চলবে না। চারটে কি পাঁচটা মোটে দিন, তার মধ্যে দেশলাইয়ের প্যান্ডেল,
বিড়ির প্যান্ডেল, বাঁশের প্যান্ডেল, পাবলিককে বাঁশ দিয়ে রাস্তার মধ্যেখানে বানানো
প্যান্ডেল, সব ক’টাই তো দেখতে হবে!
আর মা দুর্গা কোথাও বিপাশা বসু, কোথাও বা সরস্বতী সাইনা নেহওয়াল, এমনকি কয়েক বছর আগে সৌরভ ভক্তদের বানানো গ্রেগ চ্যাপেলরূপী অসুরও অনেক জায়গায় দেখা গেছিলো। শহর জুড়ে শুধু থিম পুজো, কোথাও মনিপুরি বাগান-বাড়ি তো কোথাও বার্মার প্যাগোডা। থিমের আড়ালে মা দুর্গা অদৃশ্যপ্রায়! এহেন এক থিম পুজোয় বছর খানেক আগে নিম্নলিখিত সংলাপ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল:
আর মা দুর্গা কোথাও বিপাশা বসু, কোথাও বা সরস্বতী সাইনা নেহওয়াল, এমনকি কয়েক বছর আগে সৌরভ ভক্তদের বানানো গ্রেগ চ্যাপেলরূপী অসুরও অনেক জায়গায় দেখা গেছিলো। শহর জুড়ে শুধু থিম পুজো, কোথাও মনিপুরি বাগান-বাড়ি তো কোথাও বার্মার প্যাগোডা। থিমের আড়ালে মা দুর্গা অদৃশ্যপ্রায়! এহেন এক থিম পুজোয় বছর খানেক আগে নিম্নলিখিত সংলাপ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল:
১৭১ পল্লির
পুজো দেখে বেরিয়ে এসে দুই ব্যক্তির আলাপচারিতা,
১ম (দু’জনের
মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক): গুরু, শুনেছিলাম যে থিম নাকি ‘বাংলার একটি গ্রাম’,
পুরো গ্রাম দেখে ফেললাম, কিন্তু...
২য়
(মধ্যবয়স্ক, মুখে একটা সুখেন দাস মার্কা ভাবুকতা): ত? কি ভালো বানায়েসে দেখেছস?
পুরা গ্রামখান জ্যান উইঠ্যা এসছে। তুলসি-মণ্ডপ, ধানের গোলা, খড়ের চাল...
১ম: না
মানে, আমি বলছিলাম কি...
২য়: সাথে
একখ্যান ঢ্যাঁকি, গোয়ালে গাই, কাশফুল... আহা রে ভাই, কি দ্যাখলাম! ছেলেবেলার কথা
মনে পইরা গ্যালো।
১ম (মাথা
নেড়ে): সে তো হলো, কিন্তু ইয়ে... ঠাকুরটা কোথায়?
২য় (একটু
হতভম্ব হয়ে): ঠাকুর? ঠিক কইছস... ঠাকুরখান কই?
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর ২য় জন ফিরে এলেন, মুখে একশ ওয়াটের হাসি, “পাইছি খুঁজে। অই যে ঘরের দেওয়ালে একখান পটে মা দুর্গার ছবি ছিল না, ওইটিই হলো গিয়া প্রতিমা। আসলে থিমটাই হইল গিয়া আসল। বুইলি কিনা!” তাও দুর্গাপুজো থাকবে। মানুষ হন্যে হয়ে সারা কলকাতা ঘুরে বেড়াবে হাতে বান্ধবীর (ভাগ্যহীনদের ক্ষেত্রে স্ত্রী) হাত আর ক্যামেরা নিয়ে। শত শত বাঙালি ছেলে-মেয়ে পুজোতে ঘরের দিকে পাড়ি দেবে ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, মুম্বাই কিম্বা নিউইয়র্ক থেকে। মেট্রোয় আরোহী হবে দ্বিগুণ, রাস্তায় বেড়ে যাবে ট্রাফিক পুলিশ, হকার আর ভিখিরির সংখ্যা। উত্তরদিকের পুজো দেখতে হলে প্রথমে জনগণের সঙ্গে লাইন দিয়ে দক্ষিণদিকে যেতে হবে কুড়ি মিনিট, তারপর নিতে হবে ইউ-টার্ন। রাত দু’টোর সময় রাস্তার ধারের দোকানের রোল, আওয়াজ আসে, “দাদা, একটু ঝালটা বেশি দেবেন তো...”
আর স্মৃতির পুজো, সে কি ভোলা যায়?
বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়ে সেই প্রথম রাত ১২টায় বাড়ি ফেরা, সেই প্রথম মদ্যপান, সেই
পাশের পাড়ার মাধুরী দীক্ষিতকে দেখতে সকাল থেকে প্যান্ডেলে গিয়ে বেগার খাটা,
বান্ধবীর প্রথম চুমু... ওইসব মুহূর্ত তো চিরদিনের।
কিন্তু যদি কেউ প্রশ্ন করে যে এই
পুজো আসলে কার? তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেইসব ছোট্ট, উজ্জ্বল মুখগুলো। নতুন জামা
পরে সক্কালবেলা স্নান করে যারা চলে যায় পুজোর প্যান্ডেলে, হাতে খেলনা পিস্তল,
ক্যাপ ফাটছে দুম দুম করে! বিকেল হতে না হতেই মা-বাবা-দাদা-দিদির হাত ধরে বেরিয়ে
পড়ছে ঠাকুর দেখতে। কোথায় অসুরের কত মোটা গোঁফ, কোথায় অসুর ৩ খানা, গণেশ ঠাকুরের
ভুঁড়িটা সবচেয়ে ফোলা কোথায়... সব তাদের মুখস্থ।
ছেলেটির সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা
হয়েছিল। সে এখন বড্ড বড় হয়ে গেছে, পড়াশুনো শেষ, সারা বছর চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, পুজোর
সব দিনগুলোতেও তার ছুটি থাকে না। ১৫০ তো নয়ই ৫০টা ঠাকুর ও দেখা হয়ে ওঠে না ওর।
দুর্গাপুজোতে এই একটা কারণেই মনটা
বড্ড খারাপ হয়ে যায়। সেই চলে যাওয়া শৈশবটাকে শত চেষ্টা করলেও ফিরে পাওয়া যায় না। কোন
চিন্তা নেই, বন্ধুদের সঙ্গে পড়াশুনো নিয়ে ইঁদুর-দৌড় নেই, চাকরি বাঁচাবার টেনশন
নেই! আহা! সেই ম্যাজিক-মুহূর্তগুলো।
এবারের পুজোতেও সেই একটা জিনিসই
চাইবো, ‘মা গো, সেই হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলাটা একবার ফিরিয়ে দাও। ফিরে পেতে চাই সেই
ছোট্টবেলার ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দ, বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে আচার খাওয়া, এয়ারগান দিয়ে
বেলুন ফাটানোর মজাটা। আর যে আমার তোমার কাছে কিচ্ছু চাওয়ার নেই...’