বন্ধুদের
আড্ডায় আমি প্রায়ই এই প্রশ্ন শুনতে পাই, যে জীবনে কটা প্রেম করেছিস? একটু হেসে
উত্তর দিই, অসংখ্য। হাসির মানেটা সবার কাছে নানাভাবে পৌঁছায়। কেউ ভাবে সলজ্জ, কেউ
ভাবে নির্লজ্জ। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কেউ বোঝে না। আমার হাসি পায় এটা ভেবে যে, ‘প্রেম’ কিভাবে করে? এটা কি সকালের
প্রাতঃকৃত্যের মত কিছু? নাকি বাজারের দরদাম করার মত? প্রশ্নটার উত্তরটা জানার জন্য
মনটা কয়েকদিন ধরেই ঘুরঘুর করছে এর ওর দরজায়। ‘কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের
মাস...’। কেউ বা বলে অভ্যাস। প্রেম নিয়ে সবার কি মত, তাই ভেবে ঠিক করলাম কিছু একটা
লিখি। সার্থক গদ্য না হোক, একটা স্ট্যাটিস্টিকাল রিপোর্ট তো হবে!
নবনীতা
দেবসেনের একটা লেখা পড়েছিলাম প্রেম নিয়ে। উনি দশ কথার পর এক কথায় বলে দিলেন, এ
শুধু মেঘের খেলা। কি গোলমেলে কথা বলুন দেখি। মেঘের খেলা কি একরকম হয়? কতরকম মেঘ,
তার কতরকম খেলা। এর মানে কি বুঝবেন? তাই নবনীতাকে হাতে রেখে আর একটু আটঘাট বেঁধে
বেরলাম প্রেম খুঁজতে। বন্ধু বান্ধবী, দাদা, কাকা, পিসে, মেসো – যাকে পাই জিগ্যেস
করি (মানে যাদের জিগ্যেস করতে লজ্জা লাগেনা আর কি!), ওগো বলতে পার, প্রেম করা মানে
কি? উত্তরের তালিকা দেখলে চিত্রগুপ্ত তার ফর্দ বের করতে লজ্জা পাবেন। মেসোর দল বললেন,
প্রেম করা আবার কি? দেখিস না, তোদের বয়সী ছেলে মেয়ে গুলো পার্কে বসে ছাতার তলায় যা
করে, তাই হল প্রেম করা। না দেখে থাকলে ইলিয়ট পার্ক ঘুরে আয়। কোনো বন্ধু বলল, ওয়ান
নাইট স্ট্যান্ড ইয়ার। কে জানে! আবার কোনো বন্ধুনী তো এমনতর প্রশ্ন শুনে ভাবল আমি
বুঝি তার প্রেমেই পড়ে গেলাম! কি কাণ্ড! মেসেজের উত্তর দেয়না আর! এক বান্ধবী বলল,
তার ছয় বছরের প্রেম জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে, প্রেম করা একটা অভ্যাস। রোজকার
কাজকর্মের সাথে যার মিলে যাওয়া। যার ওঠা পড়া গুলো সময়ের সাথে থাকে, কিন্তু
অ্যাটিনুয়েটেড হয়ে যায়, তবে মিলায় না কখনও। আর একজন বলল, অতশত বুঝি না, ভালবাসি, ব্যস। বিয়ে করব। ছানা পোনা মানুষ করব। সুখে থাকব। প্রেম কাকে বলে বুঝলেও যা, না
বুঝলেও তাই। বরং বুঝলেই সমস্যা। খালি দ্বন্দ্ব আসবে। বান্ধবীর প্রেমিক জবাব দিল,
জাস্ট ওয়েস্টেজ অফ টাইম। করেছ কি মরেছ। বন্ধুর প্রেমিকাটির মতে, এ হল, খুব ভাল
একটা অভ্যাস। সকালের দাঁত মাজার মত আর কি! ভাইয়ের কথায়, কাঁঠালের আঠা, লাগাস না,
ছাড়াতে পারবি না।
তাহলে
প্রেম করা কি? এত উত্তরের ঝাঁকে মাথা পুরো ডেডলক হতে চলল। তবু প্রেম মেলে না।
উত্তরের জন্যে গুরুদেবের রচনাবলী নামালাম তাক থেকে। সেখানে দেখি তিনি আর এক অভিযোগ
করে বসে আছেন, এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলেনা। আবার পাওয়ার আকুলতা নিয়ে
বসে আছে, কি জানি সে আসবে কবে তার জন্য জাগতে হবে, এমনি তার আকুলতা। তাহলে? এই
মিলনের আকাঙ্ক্ষা, এটাই প্রেম? নাকি ওই সুখ, যার জন্য সবাই প্রেমের যাচনা করে,
সেটাই প্রেম? সব গুলিয়ে দিলেন তো গুরুদেব!
এপাশ
ওপাশ তাকাতে মনে পড়ে গেল স্কুলের দিনগুলোর কথা। ক্লাস নাইন। নতুন নতুন কোচিং –এ
পড়তে যাওয়ার কথা। এক ঝাঁক নতুন মেয়ে। প্রাইমারি স্কুলে মেয়েরা পড়ত একসাথে। কিন্তু
তখনও মেয়েদের নারীত্ব নামক অমোঘ জিনিসটি সম্পর্কে সচেতন হইনি। ক্লাসের বন্ধুদের
সাথে নানারকম তাত্ত্বিক আলোচনা চলত। কিন্তু তাদেরকে একসাথে পেয়ে সবকিছু গুলিয়ে
গেল। বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে শচিনের বাউন্ডারি মারার মত ধপাধপ প্রেমে পড়ার গল্প
শুনতে লাগলাম অফ্-পিরিয়ডে। উফ্, সে কি লোমহর্ষক কাহিনী সব! সে কি রহস্যময়তা! বিশেষ
কোন মেয়ে আজ তাকিয়ে হেসেছে! ব্যস, স্বপ্ন দেখা শুরু। কেউ একজন আমার কাছে নোটস্
চেয়েছে! পরের দিন স্কুলের হেডলাইন!
স্কুলে
থাকার সময় প্রেমের এই সরল রূপটা দিব্যি ছিল। বড় হয়েই বিপত্তি! ওই যে সুকুমার রায়
বলেছেন না, বড় হলেই মানুষ গুলো সব হোঁতকা হয়ে যায়, সহজ জিনিসেরও মানে খুঁজতে চায়
সবসময়। আমার হয়েছে সেই দশা। প্রেম করার আবার মানে কি হে! আর থাকলেও বা, জানার
দরকার কি? জানলে কি চতুর্বর্গ লাভ হবে? মসফেটে কি দু অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট বেশি
যাবে, নাকি ভারতের জিডিপি বাড়বে? কিছুই না, তাহলে!
সেইটাই
তো মুশকিল, কি করে বোঝাই? মনের মধ্যে প্রেম জেগেছে, তাও আবার মানে নিয়ে। কয়েকদিন
আগে, একটা বই পড়ছিলাম। পাওলো কোয়েলহোর লেখা। সেখানেও এক অপূর্ব প্রেমের কথা
শোনালেন তিনি। এক জাপানি মহিলার বেঁচে থাকা কিছু প্রেম বুকে নিয়ে। যার প্রেম, তিনি
এক মহান লেখক, তিনি তাকে ছেড়ে গেছেন বহু বছর। তার কাছে সেই স্মৃতি আর ওই টুকরো
প্রেম ছাড়া আর কিছু নেই। কি অদ্ভুত ভালোবাসা।
কিম-কি-দুকের
কিছু ছবির কথা মনে আসে। দ্য টাইম। এক প্রেমিকার হঠাৎ মনে হয় যে তার প্রেমিক তার
সাথে থেকে বোর হয়ে গেছে। সেই একই দেহ, সেই একই মুখ। রোজ রোজ দেখে দেখে প্রেমিকের
একঘেয়েমি এসে গেছে, তাই হয়ত তাকে তার আর ভালো লাগছে না। এ হেন মানসিকতায় সে
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে সব পালটে ফেলবে। প্লাস্টিক সার্জারি করে ফেললও পালটে।
অপারেশনের ক্ষত শুকানোর জন্য গা ঢাকা দেয়। প্রেমিকটি কিছুই জানতে পারেনা। মেয়েটিকে
পাগলের মত খুঁজে চলে। অতঃপর ঘটনা পরম্পরায় ছেলেটি জানতে পারে মেয়েটির এই কাজের
কথা। খুব রাগ হয় তার। সেও ঠিক করে পালটে যাবে। প্লাস্টিক সার্জারি করে নিজেকে
পালটেও ফেলে। এবার শুরু হয় দুজনের দুজনকে খুঁজে চলা। মন আছে সেই পুরানো, খুঁজে
চলেছে তার সেই খুব চেনা, সবচেয়ে প্রিয় কাছের মানুষটিকে। কিন্তু তাদের চেহারা পালটে
গেছে। হয়ত হয়ে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর সুন্দরী। কিন্তু তারা কেউ কাউকে
চিনতে পারছে না। পৃথিবীর পথে অসংখ্য মানুষের ভিড়ে খুঁজে চলে তারা একে অন্যকে। খুঁজতে
থাকে তাদের প্রেমকে।
এমনই এক
গায়ে কাঁটা লাগানো প্রেম কাহিনী। কি এক মধুর খেলা এই প্রেম। এমনই যে সেই মাধুর্য
অতিক্রম করে বেড়িয়ে পড়ে এই বেদনার্ত গল্প-কথা। তাহলে প্রেম আর দেহ মিলে গেলেই কি
এই যত বিপত্তি? কিন্তু দেহ ছাড়া প্রেম, সে কি করে হয়? সেতো ওই কিছু দার্শনিক বইয়ের
বিষয় ছাড়া কিছু নয়, প্লেটোনিক লাভ- কামগন্ধ নাহি তায়।
আরও
অনেকগুলি ছবির কথা মনে আসছে। মৃণাল সেনের
‘অন্তরীন’-এর সেই ‘বন্দিনী’র সাথে লেখকের এক অদ্ভুত একে
অপরকে না দেখা প্রেম, পেড্রো আলমাদোভারের
‘টক টু হার’-এ ওই জড়বৎ নারীর সাথে পরিচারকের প্রেম। সমস্ত ক্ষতিকে হার মানিয়ে
ভালোবাসার জয়গান। ‘অনুরণন’ ছবিতেও সেই এক সম্পর্কের কথা, যার কোন নাম হয় না। এমন
হাজার এক প্রেমের নমুনা ঝেঁপে আসছে চারিদিক দিয়ে। তাহলে ‘প্রেম করা’টা আসলে কি?
নাহ্। এ বড় কঠিন বিষয়।
মনে গেল
পড়ে কোন এক আলো-আঁধারির সন্ধ্যাবেলা। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা।
বুকের ভিতর দুরুদুরু। সময় কখন আসবে? পাশ দিয়ে চলে যায় দু একটা রিক্সা, হর্ন বাজিয়ে।
দুই-একটা সাইকেলের আওয়াজ। ওই যে কাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না? তবে কি ওর টিউশন
শেষ হল? নাহ, ওটা তো টিভির শব্দ। মাকে বলে এসেছি রি-ফিল কিনতে যাব। রি-ফিল কিনতে
এতক্ষণ! নাহ্, এটা বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আজকেই কেন এত দেরী করছে? মাথার ওপর মশার
ঝাঁক, বন্বন্ করছে। হাতের তালুতে ঘামে ভিজে যাওয়া একটুকরো কাগজ। আমার সব
বজ্র-বিদ্যুৎ গুলো জমিয়ে রেখেছি ওর মধ্যে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, চুপি চুপি
লিখে ফেলা এই চিঠি আমার দৈনন্দিন চালচিত্রের থেকে বাঁচানো সময়টুকু দিয়ে। টিউশন শেষ
হয়। ও আসে, ও চলে যায়। থেকে যায়, আমি, আমার হলুদ ল্যাম্পপোস্ট আর ঘামে ভেজা তালু।
এটাও তো
প্রেম ছিল। কখন সে আসবে, তার একবার দেখা পাওয়ার অন্তহীন প্রতীক্ষা। সে প্রতীক্ষা
কি কারো শেষ হয়? খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরতে থাকে প্রেমের পরশ পাথর। এক ঘাট থেকে
অন্য ঘাটে ভেসে চলে নৌকা। কোন একজন মহান মানুষ বলেছিলেন, বিবাহেই নাকি প্রেমের
সমাপ্তি। সত্যি কি তাই? তাহলে আমাদের বাবা-মা’রা দিব্যি হেসে খেলে রয়েছেন। তাতে কি
প্রেম নেই? নাকি নিছকই অভ্যাস! স্বয়ং কন্দর্পই জানেন, বা হয়ত তিনিও জানেন না। মানুষের
মনের তল পাওয়া কঠিন, যদিও তলিয়ে দেখলে এই জটিল সমাজের তুলনায় মানুষের মন অনেক সরল।
সেখানে কোন নিয়ম থাকেনা, থাকেনা সমাজের বিধি নিষেধ চক্ষুলজ্জা। শুধু কিছু মোটা
দাগের লোভ, কামনা, ভয়। তাই সমস্ত বাধা নিষেধ টপকে তার অগম্য কিছু নেই। তল পাওয়া
কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই অগত্যা হাল ছাড়তেই হয়। শরণ নিই রবীন্দ্রনাথের, ‘নয় নয় এ মধুর
খেলা’। প্রেম করাই ভালো। মানে খুঁজে কাজ কি?
ছবি: সুনন্দ
ছবি: সুনন্দ