Thursday, April 5, 2012

সত্যি ভূত মিথ্যে ভূত -- রোদ্দুর

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে শকুন্তলা দেখল দাদা দরজার সামনে অপেক্ষা করছে।

বেশ অবাকই হল শকুন্তলা, দাদার তো আসবার কথা ছিল নাবিশেষ করে
এখন তো পাপানের স্কুলে হাফ্‌-ইয়ার্লি পরীক্ষা চলছেবৌদি কালকেই ফোনে বলছিল এখনও ম্যাথ্‌স আর ওয়ার্ক এডুকেশন নাকি বাকি আছে... এই সময়টায় তো ডঃ সত্যবান চ্যাটার্জী পাপানের ঘরের বাইরেই বেরোতে চান না... তাহলে? অঙ্কটা তো মিলছে না...বাড়িতে কোনও বিপদ টিপদ হল নাকি? মায়ের শরীরটা খারাপ হয়েছিল কদিন আগেই – হঠা কিছু হল নাকি আবার? একরাশ আশঙ্কা নিয়ে শকুন্তলা জিজ্ঞাসা করল, “কিরে, তুই এখন? কিছু হয়েছে নাকি?”

সত্যবান বেশ অবাকই হল, “কেন, কি আবার হবে?”

"না, তুই হঠা এখন এলি, পাপানের পরীক্ষা তো এখনও শেষ হয়নি... বৌদি বলছিল।"

"ওহ্‌ তাই বল!”, সত্যবান একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল, “ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি তুই কুন্তলা! আজ দুপুরে চেম্বারে বসেছিলাম, সেখান থেকেই আসছি। অনেক দিন দেখা হয়নি, তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই... তা বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকব? দরজাটা খুলবি তো, নাকি? আশ্চর্য!

সত্যিই তো! সারাটা দুপুরের পরে তেতেপুড়ে আসছে মানুষটা... তাড়াতাড়ি কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলাটা থেকে চাবির গোছা বের করে কোল্যাপসিব্‌ল গেটের তালা খুলল শকুন্তলা। সদর দরজার তালাটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, “অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস নাকি? পাপানের পরীক্ষা কেমন হল?”
"নানা, তুই কখন ফিরিস তাতো জানিই... এই পাঁচ মিনিট হল", সত্যবান হাসল, “ছেলে আমার পরীক্ষা তো কখনও খারাপ দেয় না... শুধু ম্যাথ্‌সটাতেই যা একটু... তা আজকেই ছিল, বুঝলি! চেম্বার থেকে বাড়িতে ফোন করেছিলাম, সুলেখা বলল ছেলে নাকি বলেছে এবারে নাইন্‌টি পাবেই পাবে... হান্ড্রেডও হয়ে যেতে পারে।"
তোর কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি, সবে তো ক্লাস সেভ্‌ন!”, শকুন্তলা ড্রয়িংরুমের ফ্যানটা অন্‌ করে দিল... আজ গরমটা যেন একটু বেশি... সত্যবান পায়ের উপরে পা তুলে বসে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, অরিন্দম কখন ফিরবে? দেরি হবে নাকি?” 
মাথা নাড়ল শকুন্তলা, একটু আগে ফোন করেছিল, বলল রাস্তায় আটকে আছে। এসে যাবে এক্ষুনি... তুই বোস, আমি চেঞ্জ করে আসি... পাঁচটা পিরিয়ডতারপর আবার সেই নাকতলা থেকে ভবানীপুর বাসে করে... আর পারছি না! বোস একটু”, বলে কাঁধের ব্যাগটা সেন্টার টেব্‌লের উপরে নামিয়ে রেখে দাদাকে কি খাওয়ানো যায় ভাবতে ভাবতে বেডরুমের দিকে পা বাড়াল শকুন্তলা।

আধঘণ্টা পরে ট্রে-তে চা, চানাচুর, ওমলেট আর স্যান্ডুইচ সাজিয়ে ঘরে ঢুকল শকুন্তলা..."নে, চা খা। পাপানটার পরীক্ষা শেষ হলে একদিন যাব... অনেকদিন দেখিনি ওকে।”
এক্ষুনি করতে গেলি কেন, অরিন এলে না হয় করতিস... একসাথেই খেতাম", ট্রে থেকে একমুঠো চানাচুর তুলে নিয়ে বলল সত্যবান... "তাতান কখন ফিরবে স্কুল থেকে?”
সে অনেক দেরী। বাবুর আজ ক্যারাটে ক্লাস, ইস্কুল থেকে সেখান হয়ে ফিরবে", ডোরবেল শুনে উঠে গেল শকুন্তলা...অরিন্দম ফিরল নিশ্চই। অনেকদিন পরে আজ দাদা এসেছে, বেশ খুশিই হবে অরিন্দম। অরিন্দম তো আসলে সত্যবানেরই বন্ধু... প্রায়ই ওদের বাড়িতে আসত। সত্যবান পড়ছিল মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি, আর অরিন্দম অনার্স করছিল কেমিস্ট্রিতে... টকটকে ফরসা রঙ, কোঁকড়ানো একমাথা চুল, বিশাল বড় বড় আর ভীষণ সুন্দর দুটো চোখ... শকুন্তলা সেই কবে থেকে দরজার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত ওকে... কিন্তু কিছু বলে ওঠবার সাহস ছিল না দাদার প্রাণের বন্ধুটিকে। শেষকালে সকলের পরীক্ষা শেষ হবার পরে এদিক ওদিক চলে যাবার আগে শেষ যেদিন একসাথে আড্ডা মারার প্ল্যান করল ওরা, সেদিন অনেক সাহস করে... ওরা সকলে তখন বসার ঘরে বসে হইহুল্লোড় করছে... কিন্তু বলা তো দূরের কথা, মাথাই তুলতে পারছিল না শকুন্তলা! মিনিট দু-এক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবার পরে অরিন্দমই বলেছিল, “কাল ঠিক বারোটায় এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে... আমি অপেক্ষা করব।

ঘরে ঢুকে সত্যবানকে দেখে ক্লান্ত হাসল অরিন্দম, “কিরে, কতক্ষণ?”
এই তো...এত দেরী কেন রে তোর? আমার বোনটা বাড়িতে এসে একা বসে থাকবে সে খেয়াল নেই?”
আরে আর বলিস না... কলেজের এক কলিগের হঠা মাথাটাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে সে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা, তো তাকে নিয়েই গিয়েছিলাম বাড়িতে পৌঁছে দিতে... ওই শকুন্তলাদের স্কুলের কাছেই বাড়ি... সেখান থেকে ফেরার পথে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হিট অ্যান্ড রান। বিশাল ঝামেলা, রাস্তাটাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে পাবলিক... তাই ভেহিক্‌লস ঘুরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ... সেইখানেই আটকে থেকে দেরী হয়ে গেল! চা খেয়েছিস...?”
হুম্‌! আচ্ছা তোকে মাফ্‌ করা গেল... আর কি খবর বল? তোকে এত সিক্‌ দেখাচ্ছে কেন রে? মুখ শুকনো, চোখ লাল, খুব ঘামছিসও... ফিলিং অলরাইট?”
আই অ্যাম ওকে...আজ যা গরম, তারপরে যা হ্যাজার্ডস গেল... তাই একটু... ও কিছু না। তোর ছেলের পরীক্ষা চলছে না?”
পরশু শেষ... তাতানকে ক্যারাটে ক্লাসে ভর্তি করেছিস শুনলাম! দ্যাট্‌স গুড! একটু এক্সারসাইজ দরকার... পাপানকেও ভর্তি করে দেব একটা কিছুতে, আরেকটু বড় হোক...”
টেবিল থেকে একটা জলের বোতল তুলে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে প্রায় এক বোতল জল শেষ করল অরিন্দম, “এক্সারসাইজ তো বটেই, তাছাড়া পড়াশুনা ছাড়া একটা কিছু নিয়ে তো থাকতেও হবে, নাকি? ছেলে সারাদিন তো শুধু বই নিয়েই আছে, এখন আবার একটা নতুন নেশা হয়েছে, ভূতের গল্প। রাজ্যের বই এনে পড়ছে, ভয় পাচ্ছে, আর রাত্তিরে মাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছে...”।

এবারে বেশ বিরক্তই হল সত্যবান, “তুই ওগুলো পড়তে দিস কেন বল তো? আমি তো এক্কেবারে অ্যালাউ করি না... যতসব আজগুবি গল্পগুলো পড়বে, আর ভয় পাবে। এইরকম ভয় পাওয়াটা মোটেই স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয় কিন্তু... বিশেষ করে বাচ্চাদের পক্ষে তো একেবারেই নয়...”।
বন্ধুর উত্তেজনা দেখে হাসল অরিন্দম, “ইউ আর ওভার রিঅ্যাক্টিং, সত্য। ছেলেবেলায় ভূতের গল্প আমরা কি পড়িনি নাকি? আমাদের বাড়ির পিছনদিকে বান্টিদের পোড়ো জমির সেই বটগাছটার কথা মনে নেই? যেখানে ভূত দেখে তুই ভির্মি খেয়েছিলি? তখন আমাদের কত বয়স ছিল বল তো, ক্লাস এইট বোধহয়!”
হ্যাঁ, ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা ছিল ওই গাছের ডালে আটকে থাকা একটা সাদা কাপড়! ফাঁকা জমি, বটগাছ, চাঁদের আলো, সাদা কাপড়... সব মিলিয়ে একটা মিস্টিক্যাল অ্যাট্‌মসফিয়ার তৈরি হয়েছিল... ক্লাস এইটের একটা ছেলে সেটা দেখে ভয় পেতেই পারে... না পাওয়াটাই অ্যাবনর্মাল। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছে করে কিছু আজগুবি গল্প পড়ে ভয় পাওয়ার কোনওমানে হয় নাকি? এতো শুধু শুধু নিজেকে দুর্বল করে তোলা...”, বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠল সত্যবান। বরাবরই সত্যবানটা এইরকমই... ওর ধ্যানধারণার বাইরের কিছু হলেই সেটাকে নস্যা করে দেবার জন্যে উঠে পড়ে লাগে ও। অরিন্দম ওর এই স্বভাবটাকে খুব চেনে, আর তাই প্রায়ই মজা করবার জন্যে সত্যবানের সাথে তুমুল তর্ক জোড়ে ও। তারপরে অবশ্য সন্ধি হতেও দেরী হয় না...

অরিন্দমের জন্যে চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকল শকুন্তলা, “আজ কি নিয়ে লাগল দুজনের?” অরিন্দম আর সত্যবানের এই তর্কাতর্কি শকুন্তলা বেশ উপভোগই করে... দুজনের একজন ডাক্তার, একজন অধ্যাপক। নিজের নিজের স্বপক্ষে যুক্তি সাজাতে দুজনেরই জুড়ি নেই... সময়ে সময়ে এদের তর্ক শোনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। চায়ের কাপটা অরিন্দমের হাতে দিয়ে দাদার পাশে সোফায় বসে পড়ল শকুন্তলা... এখন হাতে বিশেষ কাজ নেই। রাত্তিরের জন্যে তরকারি সকালেই করে রেখে গেছিল ও, শুধু কটা রুটি করে নিলেই হবে। এমন একটি জমাটি তর্ক দেখবার সুযোগ শকুন্তলা কিছুতেই ছাড়তে চায় না।

চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে অরিন্দম জিজ্ঞাসা করল, “কুন্তলা, তোমার দাদা বলছে ভুতের গল্প পড়বার কোনও মানেই হয় না... ওগুলো সব বোগাস। শুধু শুধু নিজেদের ভয় পাওয়ানো হয়...”
শকুন্তলা দাদার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল "তা তো বটেই, দাদা তো আবার ভূতের গল্প পড়ে একদম ভয় পায় না...”
বোনের উপরে ভীষণ রেগে গেল সত্যবান, “বাজে বকিস না তো কুন্তলা... ভূতের গল্প মাত্রেই এক একটি গুলের ডিপো! কটা নিষ্কর্মা লেখক কিছু আজগুবি ব্যাপার বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে লিখে বিক্রি করবে, আর তোরা সেগুলো পয়সা খরচ করে কিনে পড়বি... হোপলেস্‌!”
এবারে আরাম করে একটা সিগারেট ধরালো অরিন্দম, “সেদিন একটা সিনেমা দেখলাম, বুঝলি? তাতানই দেখাল... স্লিপি হলো’। ইংলন্ডের একটা গ্রামে এক স্কন্ধকাটা ঘোড়সওয়ার তার মুণ্ডুটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে... গ্রামের অন্য লোকজন যে তার সামনে পড়ছে, তার মুণ্ডু কেটে নিয়ে যাচ্ছে... আর লন্ডন থেকে এক পুলিশ অফিসারকে সেখানে পাঠানো হয়েছে এইসব খুনের কেস সল্‌ভ করবার জন্যে। বেশ ভাল সিনেমা, দেখে কিন্তু বেশ ভয় ভয় করছিল...”
মনে মনে হাসল শকুন্তলা, এই সবই অরিন্দমের চাল, সত্যবানকে আরো রাগিয়ে দেবার জন্যে... আর হলও তাই। সত্যবান চেঁচিয়ে বলল, “ ননসেন্স! কখনও সম্ভব নয়। এইসব সিনেমা বানাবার সময় মূর্খ ডিরেক্টরগুলো খেয়াল রাখে না যে ওরা যেটা দেখাচ্ছে সেটা মেডিক্যালি ইম্পসিব্‌ল। আরে যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে ওইসব ভূতটুত ছেড়ে শুধুমাত্র পরিবেশ দিয়ে ভয় সৃষ্টি করে দেখা...তাহলে বুঝব। ভয়টা খাঁটি... সাইকোলজিক্যালি পসিব্‌ল, কিন্তু ভূত? আর যত রাজ্যের বাজে কথা... ভূতের গা নাকি বরফের মত ঠাণ্ডা, ভূতের ছায়া পড়ে না... আরে তোরা যদি ভূত দেখতে পাস, তার মানে হল আলো ভূতের গায়ে রিফ্লেক্ট করে তোর চোখে এসে পড়ছে, তাই তো? তাহলে তো ভূত হাওয়া নয়... সলিড, বা অন্ততঃ লিক্যুইড কিছু! তাহলে তার ছায়া যে কি করে পড়ে না সেটা তো আমার মাথায় ঢোকে না...”
অরিন্দম চুপ করে শুনছিল, এবারে শান্তভাবে বলল, সে তুই যাই বলিস না কেন সত্য... এত লোকে বলে তারা ভূত দেখেছে, তারা সকলে কি মিথ্যা বলে? যা রটে তার কোনও কিছুই ঘটে না এমনটা তো হতে পারে না!”
তারা বাজে কথা বলে”, হাঁটুতে একটা চাপড় মেরে বলল সত্যবান, “সত্যি, তোর বিজ্ঞান পড়া বৃথা হয়েছে অরিন। ভীতু লোকগুলো ভয় পেয়ে ভুলভাল বকে, অথবা কিছু অ্যাটেনশন সিকিং ইডিয়ট মনগড়া গল্প বলে, আর তোরা সেটা বিশ্বাস করিস। শেম অন ইউ অরিন, শেম অন ইউ!”
কিন্তু দাদা,”, সোফাতে পা তুলে বসে বলল শকুন্তলা, “এই সেদিন আমাদের স্কুলের নন-টিচিং স্টাফ অসিতবাবু বলছিলেন যে উনি ওনার দেশের বাড়িতে একবার রাত্রিবেলা এক মাঝিকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছিলেন, পরে জানা যায় মাঝিটা নাকি আগের দিনই মারা গেছিল। উনি কি মিথ্যাবাদী? ভেবে দেখ, বৃদ্ধ মানুষ – প্রায় পঞ্চান্ন বছর বয়স... মিথ্যা বলে মিছে বদনাম কুড়োতে উনি যাবেন কেন? কিছু তো নিশ্চয় দেখেছিলেন... তাই না

হা হা করে হেসে উঠলো সত্যবান, “উত্তরটা তো তুই নিজেই দিয়ে দিলি কুন্তলা...পঞ্চান্ন বছর বয়স হয়েছে, দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়েছে, কি দেখতে কি দেখেছেন...আচ্ছা, তুই বল! এই যে ইট, কাঠ, পাথর... এগুলোকে তো আমরা দেখতে পাই? এগুলো কি কখনও অদৃশ্য হয়ে যায়, না যেতে পারে? তেমনি ভূতও যদি তুই দেখতেই পাস, সে কি করে অদৃশ্য হয়?”
শকুন্তলা দাদার হাত চেপে ধরে বলল, “না দাদা, তুই জানিস না। সব ভূতই অদৃশ্য হতে পারে। আজ বিকেলে বাসটা ধাক্কা মারবার পর থেকে আমিও পারি... দেখবি?”

এই বলে সত্যবান আর অরিন্দমের চোখের সামনে শকুন্তলা অদৃশ্য হয়ে গেল।


About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই