হে পাঠক, নিচের
শিম্পাঞ্জিশিশুর ছবিটা একবার ভালো করে দেখুন তো দেখি, অনেকটাই একটা
ছোট্টোখাট্টো শান্তশিষ্ট নম্র-ভদ্র কালোকোলো বাচ্চা ছেলের মত (মানে
ছুডুকালে আমি যেমন কিউট ছিলুম আরকি) মনে হয় কি না!
হুঁ হুঁ। তা এইবার
বলেন দেখি, কেন এমন মিল?
এইটার তুলনায়, বাচ্চাটাকে কেন মানুষ-মানুষ মনে হচ্ছে, সেই লক্ষণগুলো আমার যা মনে আসছে সেগুলো বলতে পারি; আপনারা হয়ত আরো কিছু পেতে পারেন:
- দেহের তুলনায় বড় মাথা
- মাথার তুলনায় বড় চোখ
- চ্যাপ্টা কান (বেড়াল-কুকুর-গরু-শিম্পাঞ্জি সবারই খাড়া কান থাকে)
- সমতল ভুরু (শিম্পাঞ্জি-গরিলার দেখবেন কপালের তুলনায় উঁচু ভুরু)
- সমতল মুখ (ধাড়িটার দেখেন চোয়াল-ঠোঁট কতটা এগিয়ে আছে)
- ছোট নাক
- মুখে লোম কম
তবে এইবার আসছে
সবচেয়ে দামি পয়েন্টটা – ভেবে দেখুন, এই প্রতিটা
লক্ষণই কিন্তু শুধু মানবশিশুতে নয় বরং প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেও উপস্থিত!
মানে, যে মিলগুলোর
জন্য মানবশিশু আর শিম্পু-শিশু একরকম লাগে, সেগুলো কিন্তু
অনেকাংশেই ধাড়ি মানুষেও উপস্থিত, কোনো ধাড়ি Ape-এর
বিপরীতে। আর মানুষ এক্ষেত্রে অনন্য কারণ অন্য কোনো পূর্ণবয়স্ক গ্রেট এপ (বিবর্তনবৃক্ষে
যারা আমাদের সবচেয়ে কাছের ভাই, সেই শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাংওটান)
শিশুকালের এই লক্ষণগুলো বহন করে না।
একটা শিম্পাঞ্জির সদ্যোজাত, বাচ্চাবয়সের আর পূর্ণাঙ্গ খুলির হাড়ের গঠন কীভাবে পরিবর্তিত হয় তা দেখানো হয়েছে। আর তা তুলনা করা হয়েছে সদ্যোজাত আর পূর্ণাঙ্গ মানুষের খুলির সাথে। দেখলেই বুঝতে পারবেন, একটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের খুলি অনেকাংশেই একটা বাচ্চা শিম্পাঞ্জির খুলির সমতুল্য – যেন মানুষের খুলিটা মাঝপথে গিয়েই থমকে গেছে, পরিবর্তনের ধারায় পুরোটা অগ্রসর হতে পারেনি।)
আগে এই লক্ষণগুলো
আলাদা আলাদা করে ব্যাখ্যা করা হত, এই যেমন, আমাদের
পরিবেশ-জীবনযাত্রা বদলানোর সাথে সাথে অধিকাংশ জীবের মত মুখ দিয়ে খাবার তোলার
প্রয়োজন ফুরোয় – আদিম মানুষ দু’পায়ে
দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে নিয়ে খাদ্য মুখে দিত – তাই আমাদের
মুখ ছুঁচলো হয়ে এগিয়ে থাকার দরকার কমে যায়।
সে কথা অবশ্যই সত্যি, কিন্তু স্টিফেন জে গুল্ড বা জে. বি. এস. হল্ডেনের মত জীববিজ্ঞানীরা এত নানারকম মিল দেখে যে সামগ্রিক তত্ত্বটা প্রতিষ্ঠা করেন তা হল এই যে,
সে কথা অবশ্যই সত্যি, কিন্তু স্টিফেন জে গুল্ড বা জে. বি. এস. হল্ডেনের মত জীববিজ্ঞানীরা এত নানারকম মিল দেখে যে সামগ্রিক তত্ত্বটা প্রতিষ্ঠা করেন তা হল এই যে,
মানুষ আসলে একরকম
আধা-শিশু বা অপূর্ণবয়স্ক এপ।
এই যে বড়বয়সেও
বাচ্চাদের মত দেখতে লাগা, এটাকে বলে পেডোমর্ফিজম। (পেডো = শিশু, যেমন
পেডোফিলিয়া। এবং এই প্রসঙ্গটা এখানে উল্লেখ করা অহেতুক নয়, আমরা পরে
দেখব।)
আর তার এই যে
ব্যাখ্যাটা, যে আমরা বড়বয়সেও শিশুকালের শারীরিক গঠনকেই বয়ে
নিয়ে চলেছি, এটাকে বলে নিওটেনি। (নিও = নতুন, টেনি =
টেন্ডেন্সি = প্রবৃত্তি, ধারা।)
এই লেখাটা তাহলে মূলত
মানবদেহের নিওটেনি নিয়ে আলোচনাই বলা যায়।
************************
তা বলে আপনি নিশ্চয়ই
এমন ভাববেন না যে, বড় মানুষ = ছোট শিম্পাঞ্জি। বা মানুষের
প্রত্যেকটা লক্ষণই একটা বানর-শিশুর মত। তবে বিবর্তনের ধারায় বেশ কিছু দিক এই
নিওটেনি’র ইঙ্গিত করে, আর সেগুলো আমরা এখন
একটু বিস্তারিত দেখব।
বিবর্তনের ধারায়
মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন কি? তার বুদ্ধি, তার
মস্তিষ্কের ক্ষমতা। একটা ডলফিন বা শিম্পাঞ্জির মত শিকারপটু সামাজিক বুদ্ধিমান
প্রাণী হয়ে থাকলেই যার চলত, আগুন আর কাঠপাথর দিয়ে তৈরি উন্নত অস্ত্রেই সে
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বাসিন্দা হয়ে উঠেছিল। তাহলে তার এত ক্ষমতাবান একটা
মস্তিষ্ক গজাল কেন যেটা তাকে চাঁদে পাঠিয়ে ছাড়ল?
যদি বাকি স্তন্যপায়ীদের তুলনায় মানবমস্তিষ্কের আয়তন মাপা হয়, শরীরের অনুপাতে, সেটা তার সবচেয়ে কাছের ভাই শিম্পাঞ্জির তিনগুণ, আর ডলফিনের দ্বিগুণ। এই ধরেন, গ্রেট এপ সবারই ঘিলুর ওজন ৩০০-৫০০ গ্রামের আশপাশে, এমনকি আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ ভারি গরিলারও ঠেলেঠুলে ৭০০। কিন্তু আমাদের ঘিলুর পরিমাণ ১০০০-১৮০০ গ্রাম!
যদি বাকি স্তন্যপায়ীদের তুলনায় মানবমস্তিষ্কের আয়তন মাপা হয়, শরীরের অনুপাতে, সেটা তার সবচেয়ে কাছের ভাই শিম্পাঞ্জির তিনগুণ, আর ডলফিনের দ্বিগুণ। এই ধরেন, গ্রেট এপ সবারই ঘিলুর ওজন ৩০০-৫০০ গ্রামের আশপাশে, এমনকি আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ ভারি গরিলারও ঠেলেঠুলে ৭০০। কিন্তু আমাদের ঘিলুর পরিমাণ ১০০০-১৮০০ গ্রাম!
এটা মোটামুটি
নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে বুদ্ধি বৃদ্ধিই মানবজাতির ধারাকে অন্যান্য এপ’দের
থেকে আলাদা করতে শুরু করে। কিন্তু এটা মায়েদের জন্য একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি
করে। দ্বিগুণ পরিমাণ মস্তিষ্ক ধারণকারী একটা শিশুকে প্রসব করার জন্য নারীদেহের
শ্রোণীচক্র (পেলভিস) তো অত সহজে দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে না। বার্থ ক্যানাল, অর্থাৎ যেখান
দিয়ে শিশুর মাথাটা বেরিয়ে আসে, সেটা একটা বড়
প্রতিবন্ধক – সেটা যথেষ্ট চওড়া না
হলে শিশু জন্মের সমস্যা হবে এবং প্রসূতি ও শিশু দু’জনেই মারাও যেতে পারে।
অনেকে যায়ও।
তার ফলে যেটা দাঁড়ায়, মানবশিশুকে
তুলনায় অনেকগুণ অপূর্ণ অবস্থায় বেরিয়ে আসতে হয়। একটা সদ্যজাত শিম্পু-শিশু যতটা
চটপটে, ছটফটে, সজাগ, নিজে নড়তে
চড়তে পারে, সেই অবস্থায়
পোঁছতে মানবশিশুর আরো এক বছর লাগে প্রায়। তাই অনেকে প্রস্তাব করেছেন, মানুষের
গর্ভধারণ-সময় আসলে হওয়া উচিত ছিল ৯ মাসের বদলে ২১ মাস!
এবং ওই একই হারে, শিশু থেকে
কিশোর হয়ে পূর্ণবয়স্ক হতে মানুষের যতটা সময় লাগে, সেটাও তাদের
ভাইবেরাদরদের তুলনায় বেশ কয়েকগুণ। মানে তাদের নাবালকত্ব অনেকটা দীর্ঘস্থায়ী। এবং
আমরা যা দেখেছি, যেটাকে আমরা সাবালক বলে মনে করি সেটাও আসলে
ওদের তুলনায় আধা-বালক – একজন বড়
মানুষের শরীরের সাথে ঘিলুর যা অনুপাত, সেটা একটা অল্পবয়সী
শিম্পাঞ্জির মত।
তো এইটুক বোঝা গেল, যে এপ-শিশুর
মত শরীরের তুলনায় বড় মাথা থাকায় আমাদের সুবিধা হয়েছে, আমরা আজ ‘মানুষের
মত মানুষ’ হতে পেরেছি।
তা প্রশ্ন আসে, এমনটা হল কেন?
************************
শুরুতে যেমন বলছিলাম, যে আদিম
মানুষদের জীবনযাত্রা-পরিবেশে নানারকম বদল হতে শুরু করে। আমরা নিয়মিত দু’পায়ে
ভর দিয়ে দাঁড়াতে শুরু করি। শিম্পাঞ্জি-গরিলারা সেটা টুকটাক মাঝেসাঝে করে- ঘাসবনের
মধ্যে দিয়ে অনেক দূর অবধি দেখার সুবিধা পাওয়া যায়, আবার
হাতদুটোকে অন্য কাজে ব্যবহার করতেও সুবিধা হয়। ওহ, বলিনি বুঝি? ওদের মত
জঙ্গলে বাস করার বদলে, মনে করা হয় যে মানুষের পূর্বপুরুষ একসময়
মধ্য-আফ্রিকার ঘাসবনে নেমে এসেছিল, যখন আফ্রিকা রুক্ষতর
হতে শুরু করে, জঙ্গল কমতে থাকে।
তার সঙ্গেই
খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন হতে থাকে – ঘাসের দানা, ফলপাকুড়, ছোটোখাটো
জন্তু। ছুলে নেওয়া লাঠি অস্ত্র হিসাবে শিম্পাঞ্জিও ব্যবহার করতে পারে, বানরে পাথর
ব্যবহার করে বাদাম ভাঙতে; আমরা লাঠিসোঁটা-পাথর ইত্যাদির ব্যবহারে
খানিকদূর এগিয়ে যাই, আকস্মিক পেয়ে যাওয়া আগুনের ব্যবহার আরো
খানিকটা সুবিধা দেয়। যেমন ধরেন, ঝলসানো মাংস হজম করা কাঁচা মাংসের চেয়ে
অনেকগুণ সুবিধাজনক। একই পরিমাণ খাবার থেকে বেশি পুষ্টিগুণ পাওয়ার অর্থ, খাবার
জোগাড়ের কষ্ট কম করতে হবে।
এর সঙ্গে যোগ করুন
আমাদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন, যেখানে দল বেঁধে
শিকারের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, সংগ্রহ করা খাবার ভাগ
হচ্ছে, শিশু, নতুন মা বা
অসুস্থদের সাহায্য করার লোক থাকছে।
একটা ধারা দেখা যাচ্ছে, কীভাবে আমাদের জীবনযাপন সহজতর হয়ে উঠছিল। হিংস্র বন্য প্রবৃত্তিগুলোর দরকার কমে যাচ্ছিল। এবং তার উল্টোটা কী? ‘সরল শিশুর মত’ ব্যবহার!
একটা ধারা দেখা যাচ্ছে, কীভাবে আমাদের জীবনযাপন সহজতর হয়ে উঠছিল। হিংস্র বন্য প্রবৃত্তিগুলোর দরকার কমে যাচ্ছিল। এবং তার উল্টোটা কী? ‘সরল শিশুর মত’ ব্যবহার!
বস্তুত, যদি খাদ্য
সমস্যা এবং তার জন্য জীবনসংগ্রাম কমে যায়, তাহলে হামেশাই দেখা
যায় যে নিরীহ গুণগুলো ফুটে উঠেছে, শরীরে এবং স্বভাবে – ঠিক যেমনভাবে উচ্ছিষ্ট মাংসের লোভে আস্তানার আশপাশে ঘুরঘুর করতে আসা বুনো নেকড়েকে পোষ
মানিয়ে আজকের বাধ্য কুকুর প্রজাতি তৈরি করেছে মানুষ।
কাঁচা মাংস কামড়াতে, বা পরস্পরকে
আঘাত করতে কি ভয় দেখাতে শ্বদন্তের প্রয়োজন আর রইল না, তাই মানুষের
ক্যানাইন টিথ ছোট হতে লাগল। তেমনই, বেশি ছিবড়েযুক্ত
খাবার – কাঁচা মাংস কিংবা
অল্প পুষ্টির ঘাসপাতা অনেকক্ষণ ধরে চিবনোর দরকার কমল, তাই অমন
শক্তপোক্ত বড় চোয়ালও ছোট হয়ে এল। ওই এপ-বাচ্চাদের যেমন থাকে তেমনটা; প্রাপ্তবয়স্ক
এপ’দের যেমন হয় তেমনটার প্রয়োজন ফুরোলো।
এই দেখুন না, মানুষের সাথে
শিম্পাঞ্জির ডিএনএ’র তো প্রায় ৯৫%ই মিল, অধিকাংশ জিনই
এক। কিন্তু যে জিনগুলোর কাজ ওদের অল্পবয়সেই বন্ধ হয়ে যায়, আমাদের সেই
জিনগুলোই অনেক বেশি বয়স অবধি চালু থাকে। ঠিক আমাদের দুধের দাঁত যেমন অনেক দেরিতে
পড়ে, ওইরকম
ব্যাপার। এইটা, যাকে বলে হেটেরোক্রোনি (পরিবর্ধনের সময়
বিভিন্ন শারীরিক ঘটনার সময়ে পরিবর্তন আসা), নিওটেনির একটা বড়
চালক।
********************
শারীরিক নিওটেনি নিয়ে
তো অনেকক্ষণ কথা হল, এবার মানসিক নিওটেনি নিয়েও একটু দেখা যাক।
শিশুমনের সবচেয়ে বড়
দুটো বৈশিষ্ট্য কী? শিক্ষাগ্রহণের ক্ষমতা, আর
কল্পনাশক্তি।
অল্পবয়সে, যখন আমাদের মস্তিষ্ক পরিণত হচ্ছে, তার ভেতরে স্নায়ুসংযোগগুলো তৈরি হচ্ছে, তখনই আমাদের শেখার বা মনে রাখার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে। বিজ্ঞানীরা বলেন, সেটা বেশি নমনীয় (প্লাস্টিক) থাকে। এই সময় আমরা নিজেদের ইন্দ্রিয় দিয়ে শিখি, বাবা-মা-পরিবার-শিক্ষক-পরিবেশ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিক্ষা পাই, তাও না হলে নিজেদের কল্পনামত ব্যাখ্যা দিয়েও জ্ঞানের অভাব ভরাট করার চেষ্টা করি। সব প্রজাতির শিশুরাই তাই করে। মোটামুটি বড় হয়ে গেলে তাদের এই শেখার ক্ষমতা বা আগ্রহটা চলে যায়, এবং এটা অন্য সব প্রজাতিতে হয় মোটামুটি দ্রুতই। মানুষ এখানেও অনন্য – শিশুর মতই তাদের শেখার ইচ্ছা বা ক্ষমতা থাকে বহু বছর। এবং যত গুড় তত মিষ্টি – ঠাকুমার গল্প শুনেই হোক বা ইন্টারনেট পড়ে, একটা মানবগোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞান আদানপ্রদান যত বেশি হবে, সামগ্রিক জ্ঞানের পরিমাণ ততই বাড়বে, সেই গোষ্ঠী ততটাই অগ্রসর হবে।
অল্পবয়সে, যখন আমাদের মস্তিষ্ক পরিণত হচ্ছে, তার ভেতরে স্নায়ুসংযোগগুলো তৈরি হচ্ছে, তখনই আমাদের শেখার বা মনে রাখার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে। বিজ্ঞানীরা বলেন, সেটা বেশি নমনীয় (প্লাস্টিক) থাকে। এই সময় আমরা নিজেদের ইন্দ্রিয় দিয়ে শিখি, বাবা-মা-পরিবার-শিক্ষক-পরিবেশ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিক্ষা পাই, তাও না হলে নিজেদের কল্পনামত ব্যাখ্যা দিয়েও জ্ঞানের অভাব ভরাট করার চেষ্টা করি। সব প্রজাতির শিশুরাই তাই করে। মোটামুটি বড় হয়ে গেলে তাদের এই শেখার ক্ষমতা বা আগ্রহটা চলে যায়, এবং এটা অন্য সব প্রজাতিতে হয় মোটামুটি দ্রুতই। মানুষ এখানেও অনন্য – শিশুর মতই তাদের শেখার ইচ্ছা বা ক্ষমতা থাকে বহু বছর। এবং যত গুড় তত মিষ্টি – ঠাকুমার গল্প শুনেই হোক বা ইন্টারনেট পড়ে, একটা মানবগোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞান আদানপ্রদান যত বেশি হবে, সামগ্রিক জ্ঞানের পরিমাণ ততই বাড়বে, সেই গোষ্ঠী ততটাই অগ্রসর হবে।
শিশুদের কল্পনাশক্তি
বেশি, এইটাও সবাই
জানেন। একটা তেকোনা গাছের ডাল পেলেই সেটাকে বন্দুক বানিয়ে সোফা-পাহাড়ের পেছন থেকে
ছোটবেলায় কত গোলাগুলি করেছি, বিছানার চাদরটাকে
সুপারম্যানের কেপ হিসাবে জড়িয়ে নিয়ে কোলবালিশটাকে সুপারভিলেন মনে করে সারা দুপুর
অগুনতি ঢিশুম-ঢিশুম করতে কোনো সমস্যাই হয় নি। এবং প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের
কল্পনাশক্তিও যে শিশুর মতনই বহুল প্রসারিত হতে পারে, তা
দৈনিকবি-দের দেখলেই মালুম হয়। যাহোক, বিজ্ঞানীরা বলেন, এই বর্ধিত
কল্পনাশক্তি + জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছা, এই থেকেই প্রাচীনতম আর্ট-এর উদ্ভব।
একটু ভেবে দেখুন।
গোষ্ঠীর বড়রা, অভিজ্ঞ শিকারিরা, নতুনদের
শেখাতে চায়, বাইসনের গায়ে কোনখানে বর্শা ছুঁড়ে মারতে হবে।
ঘর মানে গুহার মধ্যেই, গুহার দেওয়ালকেই স্লেট বানিয়ে প্রাথমিক
শিক্ষাটুকু দিতে পারলে কত সুবিধা! আর কাঠিকে বন্দুক মনে করতেও যেমন আমাদের সমস্যা
হয় না, দেওয়ালের
আঁকিবুঁকিকে বাইসন বলে ধরে নিতেও তেমনি তাদের অসুবিধা হত না। এবং এই ধরনের
অ্যাবস্ট্র্যাক্ট চিন্তা করার ক্ষমতা – যে কতগুলো
রেখাকে দেখে একটা বাইসন বলে ধরে নেওয়ার ক্ষমতা – এইটাও বর্ধিত
ব্রেনের সঙ্গে বাড়তে শুরু করেছে।
আর ইসে, শেখার ক্ষমতা বাড়ার সাথেই বেড়েছে নানারকম শব্দ আলাদা করে চেনার এবং বোঝার ক্ষমতা, এবং তা থেকে এসেছে ভাষা। কথার মাধ্যমে ভাব আদানপ্রদান ডলফিন ইত্যাদি অনেক বুদ্ধিমান প্রাণীই পারে, তবে ভাষার মাধ্যমে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট চিন্তা প্রকাশে অবশ্যই মানুষের তুলনা নেই। হাসিঠাট্টা-হিউমারও ওসব প্রাণীতে দেখা যায়, তবে উন্নততর হিউমারের উৎপত্তিও বোধহয় আদিম মানুষের গোষ্ঠীজীবনের সময় থেকেই।
আর ইসে, শেখার ক্ষমতা বাড়ার সাথেই বেড়েছে নানারকম শব্দ আলাদা করে চেনার এবং বোঝার ক্ষমতা, এবং তা থেকে এসেছে ভাষা। কথার মাধ্যমে ভাব আদানপ্রদান ডলফিন ইত্যাদি অনেক বুদ্ধিমান প্রাণীই পারে, তবে ভাষার মাধ্যমে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট চিন্তা প্রকাশে অবশ্যই মানুষের তুলনা নেই। হাসিঠাট্টা-হিউমারও ওসব প্রাণীতে দেখা যায়, তবে উন্নততর হিউমারের উৎপত্তিও বোধহয় আদিম মানুষের গোষ্ঠীজীবনের সময় থেকেই।
এইখানে ‘ডিম
আগে না মুরগি আগে’ একটা সমস্যা দেখা যেত – বুদ্ধি এবং
ফলত মস্তিষ্ক বাড়ার ঠেলায় মাথার আকার বেড়েছে, নাকি মাথার আকার
বৃদ্ধির ফলে মস্তিষ্ক বাড়ার সুযোগ পেয়েছে, এই দ্বিধা নিয়ে
বিজ্ঞানীরা দ্বন্দ্ব করতেন বহুদিন। এখন বলা যাচ্ছে, সবটাই
নিওটেনি’র ফল, এবং সামগ্রিকভাবে এই
সবকিছুতে এই ট্রেন্ড দেখা গেছে।
এখানেও অবশ্য সে
প্রশ্ন একরকম করা যায় – বুদ্ধি
বাড়ছিল বলেই কি আমাদের নিওটেনি বাড়ছিল, নাকি নিওটেনি বাড়াতেই
বুদ্ধি বাড়ছিল? মানে কোনটা কারণ আর কোনটা ফল?
এটার সংক্ষিপ্ত উত্তর – অবাধ
প্রাকৃতিক নির্বাচন, বা রানঅ্যাওয়ে সিলেকশন। (যখন সিলেকশনের ফলে
কোনো গুণ পরিবর্তিত হতে থাকে কোনো বাধা বা রেস্ট্রিকশন ছাড়াই, তখন সেটা
অবাধভাবে ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং গাঢ়তর হতে থাকে। এটাই রানঅ্যাওয়ে সিলেকশন।)
অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি হওয়ায় নিওটেনির দিকে যেই একবার ঝোঁক শুরু হল, দেখা গেল সেটার ততই সুবিধা আছে (বর্ধিত বুদ্ধি ইত্যাদি), এবং ততই সেটা বাড়তে থাকল। এইভাবে মানুষের মধ্যে রানঅ্যাওয়ে সিলেকশনের দ্বারা নিওটেনি জায়গা করে নিল।
অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি হওয়ায় নিওটেনির দিকে যেই একবার ঝোঁক শুরু হল, দেখা গেল সেটার ততই সুবিধা আছে (বর্ধিত বুদ্ধি ইত্যাদি), এবং ততই সেটা বাড়তে থাকল। এইভাবে মানুষের মধ্যে রানঅ্যাওয়ে সিলেকশনের দ্বারা নিওটেনি জায়গা করে নিল।
আর মানুষের বিবর্তনের
পিছনে তার ভূমিকা দেখে ওই প্রবচনটার কথাই মনে পড়ে – “বড়
যদি হতে চাও, ছোট হও আগে”!
পার্ট – ২:
******************************************************************
এইবার আমরা বেশ কিছু
পলিটিকালি ইনকারেক্ট কথাবার্তায় ঢুকে পড়ব, সাধু সাবধান! এই যে
লোকেরা বলে, মেয়েরা ন্যাকা, খামখেয়ালি, হ্যান
ত্যান... সেগুলো নিয়ে কিছু নাড়াঘাঁটা করব। কাটাছেঁড়া করব লুল্পুরুষ আর
শিশুকামীদেরও।
ডিসক্লেমার:
যদি বলি যে কবিরা ন্যাকা পাঠিকা পছন্দ করে, তার মানে
যেমন এই নয় যে প্রত্যেক কবিই তাই চায়, তেমনই এখানে বলা
কথাগুলো যে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সত্যি তা নয়, তবে সাধারণভাবে
অনেকের মধ্যে দেখা যায়, বা বিবর্তনকে ঠেলা দেওয়ার মত যথেষ্ট প্রকট।
এবং এই আলোচনায় আমরা
নানা দুষ্প্রবৃত্তির ব্যাখ্যা পাওয়ার চেষ্টা করব – সেটা হবে
এক্সপ্ল্যানেশন, জাস্টিফিকেশন নয় – অতএব সেই
আনন্দে লুল্পুরুষদের বগল বাজানোর কিছু নেই।
ন্যাচারাল সিলেকশন কী, তা প্রায়
সবাই জানেন। কিন্তু তার একটা মস্তবড় শাখা, সেক্সুয়াল সিলেকশন
সম্বন্ধে পরিচিতি তুলনায় কম। অনেকে আবার কনফিউজড হয়ে গিয়ে সেক্সুয়াল সিলেকশনকে
ন্যাচারাল সিলেকশনের বিপরীত ধারা বলেও মনে করে বসেন। তাই ওটা আগে বুঝে নিই।
রংচঙে ময়ূর দেখতে সবারই
ভালো লাগে। অথচ এই রংঢং, পেখমের সাজ কেবল ছেলে-ময়ূরগুলোর, ময়ূরী নেহাতই
ম্যাড়ম্যাড়ে। কেন? এই প্রশ্নটারই উত্তর হচ্ছে সেক্সুয়াল সিলেকশন, এবং আবারো
সেই বদ ছোঁড়া ডারউইনের ভাবনাতেই এসেছিল এটা।
ডিম পাড়া, ছানাপোনা বড় করা এসব খাটনি তো করতে হয় ময়ূরীকেই। বলা চলে, সে সঙ্গম করতে দিয়ে মস্ত বড় একটা সুযোগ দিচ্ছে ময়ূরকে, বংশবিস্তার করার। তা, সেটা দেওয়ার আগে একটু বাজিয়ে দেখে নিতে হবে না? সবচেয়ে সুস্থসবল, হ্যাঞ্ছাম ময়ূরকেই কিনা সে তার কাছে ঘেঁষতে দেবে, আর তাতে তার ছানাদের সুস্থসবল হওয়ার সম্ভাবনা (ফলস্বরূপ তার জিনগুলো বেঁচে থাকার সম্ভাবনা) বাড়বে।
ডিম পাড়া, ছানাপোনা বড় করা এসব খাটনি তো করতে হয় ময়ূরীকেই। বলা চলে, সে সঙ্গম করতে দিয়ে মস্ত বড় একটা সুযোগ দিচ্ছে ময়ূরকে, বংশবিস্তার করার। তা, সেটা দেওয়ার আগে একটু বাজিয়ে দেখে নিতে হবে না? সবচেয়ে সুস্থসবল, হ্যাঞ্ছাম ময়ূরকেই কিনা সে তার কাছে ঘেঁষতে দেবে, আর তাতে তার ছানাদের সুস্থসবল হওয়ার সম্ভাবনা (ফলস্বরূপ তার জিনগুলো বেঁচে থাকার সম্ভাবনা) বাড়বে।
আর তাই বসন্তকাল এলে
সেই সুযোগটুকু পাওয়ার জন্য ময়ূরের এত লম্ফঝম্প, দারুণ রংবাহারি
(ইরিডিসেন্ট) পালক সাজিয়ে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে তরুণী ময়ূরীদের মন জয়
করার এত চেষ্টাচরিত্র। রঙের জেল্লা তার সুস্বাস্থ্য, শারীরিক তাকত, যৌবনের
পরিচায়ক কিনা।
এখন কথা এই, এই হ্যাপা না
থাকলে ময়ূরের বয়ে গেছিল এত সাজগোজ করতে! এতো পালকের সাজসজ্জা তৈরিতে শরীরের অনেকটা
পরিশ্রম হয় (রিসোর্স খরচ হয়), ফলে আয়ু কমে, এবং নজর কাড়া
যত বেশি হবে তত ঈগল থেকে চিতা সব হানাদারদের চোখে পড়ে প্রাণপাখি ফুড়ুৎ হওয়ার
সম্ভাবনাও বাড়ে। অতএব, ময়ূরী যে লক্ষণগুলো সেক্সুয়াল সিলেকশনের
মাধ্যমে পছন্দ করে, সেগুলো আসলে ময়ূরের সারভাইভাল প্রবাবিলিটি
কমিয়ে দেয়। এইখানেই ওই আপাত-দ্বন্দ্ব।
তবে একজন ময়ূরের বাঁচা/মরা দিয়ে কিই বা যায়-আসে – তার জিনগুলো ওই প্রকট রঙচঙে জিনের ঘাড়ে চড়ে পরের প্রজন্মে পৌঁছে যেতে পারছে, এটাই হল সার কথা। বিবর্তন তো দিনশেষে ‘সিলেক্ট’ করে জিনকেই, একখানা প্রাণীকে নয়।
তবে একজন ময়ূরের বাঁচা/মরা দিয়ে কিই বা যায়-আসে – তার জিনগুলো ওই প্রকট রঙচঙে জিনের ঘাড়ে চড়ে পরের প্রজন্মে পৌঁছে যেতে পারছে, এটাই হল সার কথা। বিবর্তন তো দিনশেষে ‘সিলেক্ট’ করে জিনকেই, একখানা প্রাণীকে নয়।
তা সেক্সুয়াল
সিলেকশনের ফলেও ওই ‘রানঅ্যাওয়ে সিলেকশন’ দেখা যায় – বড় পেখম আর
রঙিন পালকের প্রকোপ বাড়তে বাড়তে ক্রমশ সারা পপুলেশনেই তা ছড়িয়ে পড়ে, এবং রঙের
মাত্রাও ক্রমেই কেবল বাড়তে থাকে। হয়তবা শারীরিক সক্ষমতার একটা সীমায় গিয়ে থামে
সেটা।
************************
চারিদিকে খেয়াল করে
দেখুন, এইরকম
সেক্সুয়াল সিলেকশনের প্রভাব অনেক প্রাণীতেই দেখতে পাবেন, এবং উল্লেখ্য, তা দেখবেন
পুরুষদের মাঝেই। যেমন সিংহ আর সিংহী, মোরগ আর মুরগি। বা
ধরেন গরিলা থেকে জিরাফ, সর্বত্রই পুরুষরা হয় আকারে অনেক বড়সড়, শক্তিশালী, আর স্ত্রীরা
ছোটোখাটো, নিরীহ, সন্তান
উৎপাদন আর প্রতিপালনই কাজ তাদের।
আর এইটা বিশেষভাবে
প্রকট বহুগামিতা বা পলিগ্যামির ক্ষেত্রে। যেখানে পালের গোদা সুযোগ পাচ্ছে বহু
নারীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার, বা গরিলার মত অনেক ক্ষেত্রে হারেম রাখার, সেখানেই ‘আলফা মেল’ বা প্রধান পুরুষ হওয়ার দরকার বেশি, এবং পৌরুষ
ফুটিয়ে তোলার জন্য পুং-হরমোনগুলো বেশি সক্রিয়, আর সব মিলিয়ে
সেক্সুয়াল সিলেকশনের চাপে পুরুষেরা স্ত্রীদের থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে পড়ে। একে বলা
চলে দ্বিরূপতা বা ডাইমর্ফিজম।
যেসব প্রাণীতে
একগামিতা বা মোনোগ্যামি দেখা যায়, তাদের ক্ষেত্রে দেখা
যায় স্বামী-স্ত্রী ভাবসাব করে দু'জনেই সন্তান পালনে হাত লাগাচ্ছে, এবং সেসব
ক্ষেত্রে টাটানো পৌরুষও দেখা যায় কম – তাদের
ক্ষেত্রে স্ত্রী-পুরুষের চেহারা বা স্বভাবের দ্বিরূপতা অনেকটাই কম।
বস্তুত, পলিগ্যামিকে
দুই ভাগে ভাগ করা যায়, গরিলার মত হারেম প্রথা, যেখানে একজন
আলফা মেল’এর দখলে থাকে অনেকগুলি নারী, এবং তাদের
উপর পুরুষটির একচ্ছত্র অধিকার। অন্যদিকে, আমাদের অন্য ভাই
শিম্পাঞ্জির মধ্যে দেখা যায় যথেচ্ছগামিতা বা প্রমিসকুইটি, মানে তাদের
গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে যে যার সঙ্গে পারে মিলিত হয়, হয়ত বেশি শক্তিশালী
পুরুষ একটু সুবিধা পায় কিন্তু একচ্ছত্র অধিকার কারো নেই, আর
নারী-পুরুষের একনিষ্ঠ জুটিও সেভাবে নেই। এখানেও, বোঝাই যাচ্ছে, দ্বিরূপতা
খানিকটা কম থাকবে।
তা মানুষের আদি
পূর্বপুরুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেমন ছিল?
প্রথমত, তাদের
গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজব্যবস্থা ছিল শিম্পাঞ্জিদের মতনই, আর তাই
দ্বিরূপতাও মোটামুটি কমই ছিল। কিন্তু বড় সমস্যা হল ওইটা, যা আগে
দেখলাম – মানুষের শিশু জন্মায়
বাকিদের তুলনায় অনেক অপরিণত অবস্থায়, তার লালনপালন
ইত্যাদিতে শ্রম এবং যত্ন অনেক বেশি লাগে, এবং তার রোগবালাই
ইত্যাদিতে মরার সম্ভাবনাও অনেক বেশি থাকে।
এর ফলে, বানর-মা যেমন শিশুকে কোলেকাঁখে নিয়েই গাছে গাছে ঘুরে ফলপাকুড় খেতে পারে, মানবশিশুর দায় ঘাড়ে পড়লে তেমনটি আর করা চলে না। ফলে খাদ্য থেকে সুরক্ষা, অনেককিছুর জন্যই শিশুর মা তার বাপের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে অনেকখানি।
এর ফলে, বানর-মা যেমন শিশুকে কোলেকাঁখে নিয়েই গাছে গাছে ঘুরে ফলপাকুড় খেতে পারে, মানবশিশুর দায় ঘাড়ে পড়লে তেমনটি আর করা চলে না। ফলে খাদ্য থেকে সুরক্ষা, অনেককিছুর জন্যই শিশুর মা তার বাপের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে অনেকখানি।
তার ফলটা কী দাঁড়ালো? যথেচ্ছাচার
করে আর নারীদের তেমন লাভ নেই, বরং তাদের খোঁজা
দরকার একটা শান্তশিষ্ট, বিশ্বাসী, দায়িত্বশীল পুরুষ (আমার মত, হেঁ হেঁ, ঘটকগণ টেক
হীড!) যে শুধু সঙ্গম করেই কেটে পড়বে না, অন্তত বছরকয়েক তার
সঙ্গে থাকবে, তার এবং শিশুর যত্ন নেবে। ফলে পলিগ্যামির বদলে
তাদের মোনোগ্যামির দিকে ঝুঁকে পড়তে হল।
************************
এইটার প্রভাব হল বেশ
বড়সড়। পুরুষদের সাজগোজ পরে নাচাকোঁদা করে মহিলাদের মন জয়ের চাপটা যেমন কমছিল, তেমনই
মহিলাদের পক্ষে পুরুষদের ধরার এবং ধরে রাখার দায়টা বাড়ছিল। অতএব তাদের মধ্যে
পরোক্ষ প্রতিযোগিতাও বাড়ছিল। এরকম ঘটতেই পারত যে, সমাজে
দায়িত্বশীল বলে সুপরিচিত একজন পুরুষকে দেখে এক উর্বর মহিলা ডাক দিল, কিন্তু তাকে
দেখতে শুনতে ভালো নয় দেখে সেই পুরুষ “সময়
যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে” বলে এড়িয়ে
গেল; ঠিক যেমন
পাত্রী দেখতে গিয়ে পছন্দ না হলে ‘পরে
জানাবো’ বলে চলে আসে পাত্রপক্ষ।
একটা নতুন রকম জিনিস
দাঁড়াল – যারা সন্তান ধারণ ও
পালনের সবরকম হ্যাপা পোয়াচ্ছে, সেই মহিলাদের উপরেই
সেক্সুয়াল সিলেকশন! এবং সেটাও আবার রানঅ্যাওয়ে সেক্সুয়াল সিলেকশন।
(বলছি না যে পুরুষদের উপর থেকে সেক্সুয়াল সিলেকশন ভ্যানিশ করে গেল, তবে তার চাপ এবং রকম অনেকটাই বদলে গেল, পরের পর্বে দেখব।)
(বলছি না যে পুরুষদের উপর থেকে সেক্সুয়াল সিলেকশন ভ্যানিশ করে গেল, তবে তার চাপ এবং রকম অনেকটাই বদলে গেল, পরের পর্বে দেখব।)
তা পুরুষেরা হবু
সঙ্গীর মধ্যে চাইত কী? বুনোদির থেকে ধার করা এই বিজ্ঞাপনের
লুল্পুরুষটি আজ যা চায়, রাজাবাদশারা যা চাইতেন, লক্ষ-লক্ষ
বছর আগের পুরুষেরাও তাই চাইত – কচি নধর মেয়ে!
কচি মেয়ের অনেক সুবিধা – তাদের শারীরিক সক্ষমতা বেশি, মানে তারা বুড়ি বা অসুস্থদের চেয়ে গর্ভধারণে বেশি সক্ষম, বেঁচেও থাকবে বেশিদিন, মানে সন্তান পালনেও বেশি সক্ষম, এবং অন্য কোনো পুরুষ ইতিমধ্যে তাদের গর্ভিণী করে গেছে এই সম্ভাবনাও কম হবে।
আশা করি এবারে আর ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না, কীভাবে নারীদের মধ্যে নিওটেনি অবাধ নির্বাচনের দ্বারা গেড়ে বসে গেল?
কচি মেয়ের অনেক সুবিধা – তাদের শারীরিক সক্ষমতা বেশি, মানে তারা বুড়ি বা অসুস্থদের চেয়ে গর্ভধারণে বেশি সক্ষম, বেঁচেও থাকবে বেশিদিন, মানে সন্তান পালনেও বেশি সক্ষম, এবং অন্য কোনো পুরুষ ইতিমধ্যে তাদের গর্ভিণী করে গেছে এই সম্ভাবনাও কম হবে।
আশা করি এবারে আর ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না, কীভাবে নারীদের মধ্যে নিওটেনি অবাধ নির্বাচনের দ্বারা গেড়ে বসে গেল?
**********************
এখন, নিওটেনির একটা
মুশকিল আছে। একজন ঈমানদাঁড় পুরুষ কী করে বুঝবে, তার সামনে একটি কচি
কিন্তু যৌনসক্ষম মেয়ে, নাকি একটি বাচ্চা মেয়ে? বাচ্চা মেয়ে
ধরে ইয়ে করতে গেলে তো যাচ্ছেতাই কাণ্ড হয়ে মেয়েটির মারা যাওয়ারও সম্ভাবনা, আর যে
বিবর্তনের মূল লক্ষ্য সন্তান উৎপাদন ও তার সারভাইভাল, সেই
সন্তানরাই এমনভাবে সমস্যায় পড়বে, এই কষ্ট কি বিবর্তন
সইতে পারে?
তাই উদ্ভব হল একসেট
অতিরিক্ত যৌনলক্ষণ (সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল ক্যারেক্টারিস্টিক্স)-এর, যেগুলো
কিশোরী থেকে তরুণীর পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। (উল্লেখ্য, এগুলো প্রকট
হয় বয়ঃপ্রাপ্তি বা পিউবার্টির ১-২ বছর পরে, কারণ বয়ঃপ্রাপ্তির
সঙ্গে সঙ্গেই গর্ভধারণ করা অপরিণতবয়স্কা মা এবং শিশুর স্বাস্থ্যের পক্ষে সমস্যাজনক
হয়ে দাঁড়ায়।) এবং তার মধ্যে প্রধান একখানা – সেয়ানা পাঠক
নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন – স্তন।
নারীদেহের স্তন
প্রয়োজনীয় দুগ্ধগ্রন্থি ছাড়াও মেদকলায় ঠাসা, যেগুলোর সরাসরি কোনো
প্রয়োজন নেই। অন্য কোনো প্রজাতিতে স্তনকে যৌনতার অংশ ধরে এমন মাতামাতি করাও হয় না।
এই তো শুনলুম, আমেরিকায় ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট ইত্যাদি মিলিয়ে
ফি-বছর যত খরচা হয়, তাই দিয়ে একটা ছোটোখাটো দেশের রাষ্ট্রীয় বাজেট
হয়ে যায়! স্তনকে বলা চলে একরকম সিগনাল, যেটা কিশোরীবেলা
পেরোনো সক্ষম তরুণী তার আশপাশের সক্ষম পুরুষদের প্রতি ভাসিয়ে দিচ্ছে।
আরেকটা লক্ষণ হচ্ছে, আলিসাহেব
যেটার ইংরিজি অনুবাদ হয় না বলেছিলেন – নিতম্বিনী।
শিশুর বড়ো মাথা বেরোনোর জন্য নারীদের পেলভিস বড় হয় তা আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, কিন্তু
পশ্চাতাঞ্চলে মেদের সমাহার হয়ে নিতম্ব আরো অনেকটা বৃদ্ধি পায়। বুক-কোমর-পেছন
মিলিয়ে তাই ওই জলঘড়ি বা আওয়ারগ্লাস ফিগারের ইঙ্গিত আসে।
এই আফ্রিকান
উপজাতিটিকেই দেখুন না (আন্দামান-নিকোবরেও এদের শাখা পাওয়া যায়) – খোইখোই নামের
এই উপজাতিটির মহিলাদের চেনার বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হল তাদের পিঠের তুলনায় প্রায় সমকোণে
বেরিয়ে আসা পুরু নিতম্ব। কে বলতে পারে, হয়ত আমাদের
পূর্বপুরুষও ট্যাঙ্গান্যিকা হ্রদের ধারে কোনো বসতিতে বসে এমনই কোনো তরুণীর
উদ্দেশ্যে তৎকালীন হুপহাপ ভাষায় কাব্যরচনা করত, “গুরুয়ানিতম্বিনী
গমনবিলম্বা...”
সংক্ষেপে বলা যায়, এই নানা
যৌনলক্ষণগুলো সক্ষম পুরুষদের লুলবৃত্তিকে উত্তেজিত করার জন্য একরকম ইঙ্গিত; তা নইলে যে
বংশবৃদ্ধির সমস্যা!
(আবার তাই রজোনিবৃত্তি হয়ে গেলে, প্রজননের বেলা বয়ে গেলে, নারীদেহে নানারকম পরিবর্তন হয়ে তারুণ্যের অপ্রয়োজনীয় লক্ষণগুলো ক্রমে ঝেড়ে ফেলা হয়।)
(আবার তাই রজোনিবৃত্তি হয়ে গেলে, প্রজননের বেলা বয়ে গেলে, নারীদেহে নানারকম পরিবর্তন হয়ে তারুণ্যের অপ্রয়োজনীয় লক্ষণগুলো ক্রমে ঝেড়ে ফেলা হয়।)
তাহলে যা দাঁড়াল – মোনোগ্যামি
বৃদ্ধি এবং পুরুষদের উপর সেক্সুয়াল সিলেকশনের প্রভাবহ্রাস, এই দুটো
মিলিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিরূপতা অনেকটাই কমে আসে। তবুও, নারীদের উপর
সেক্সুয়াল সিলেকশনের ঠেলায় (যার মধ্যে শিশুরূপতা ও যৌনলক্ষণ দু’টোই
আছে) স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে খানিকটা ডাইমর্ফিজম দেখা যায়, শারীরিক এবং
মানসিক। নারীদেহে পুরুষের তুলনায় মোলায়েম ত্বক, লোমের কমতি, উচ্চতা কিছু
কম, কণ্ঠস্বর নরম, বড়
অশ্রুগ্রন্থি, কম আগ্রাসী মনোভাব, অপরকে
বিশ্বাস/নির্ভর করার প্রবণতা, এইগুলো আসে নিওটেনির
প্রভাবে, আর নির্দিষ্ট
কিছু স্থানে মেদের বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা প্রভাব আসে সময়কালে স্ত্রী-হরমোন থেকে, তবে দু'টোর
প্রভাব বর্তমানে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে বলা যায়। তা অনেকে প্রস্তাব করেছেন, মানবজাতির
বিবর্তনের মূল চালক যদি নিওটেনি-ই হয়, তাহলে তুলনায় আরো
বেশি নিওটেনি-সমৃদ্ধ নারীদের বলা উচিত ‘মোর
ইভল্ভড’!
[পরের ভাগ- 'বর্ণপরিচয়'।]