আমি জানিনা কেন ফোটোশপিং ব্যাপারটাকে এখনও লোকে যথাযথ শিল্পের মর্যাদা দিতে পারছে না। জ্যান্ত মানুষের শরীরের ওপর কসমেটিক সার্জারি, ইমপ্ল্যান্ট, ইলংগেশন, আরও কত রকমের হ্যানা-জব ত্যানা-জব রমরমিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলল অথচ ফোটোর ওপর রঙতুলি ছোঁয়ালেই গেল-গেল রব। অদ্ভুত।
বছর দুয়েক আগে স্কুলের বাচ্চাদের ছবি পছন্দমত অদলবদল করা নিয়ে খুব শোরগোল হয়েছিল। অনেকে অনেক গলা ফাটিয়েছিলেন। বলেছিলেন এটা জেনেশুনে কচি মনে চেহারা নিয়ে অতিসংবেদনশীলতার বীজ বপন করা ছাড়া আর কিছু নয়। আর যে দল ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বদা সবকিছুর ওপর স্থান দেন, তাঁরা বলেছিলেন বাচ্চাদের বাবামায়েদের যদি বিষয়টায় আপত্তি না থাকে তাহলে বাকিদের মতামতে কিছু এসে যায় না।
যথারীতি এব্যাপারেও তৃতীয়বিশ্ব প্রথমবিশ্বের থেকে অনেক এগিয়ে আছে। আজ থেকে কুড়ি কিংবা তারও বেশি বছর আগে যখন আমার পিসির বিয়ের সম্বন্ধের ছবি তোলা হচ্ছিল স্টুডিওতে গিয়ে, তখনও কোনো ছবিতেই পিসিকে অবিকল পিসির মতো দেখতে লাগত না। চুল ঘন হত, কপালের শৈশবের পক্সের দাগ বেমালুম হাওয়া, চোখের কোলে আবছা কাজলের টান। আলোকচিত্রী বুদ্ধি খাটিয়ে এঁকে দিতেন। শেষে ছবি তোলবার সময় এলে বাড়ির সবাই পিসিকে বলতেন, “চল তোর ছবি আঁকিয়ে নিয়ে আসি।” আমিও দু’চারবার পিসির ছবি আঁকানো দেখতে গেছিলাম মনে আছে।
কাজেই জন্মদাগ মুছে দিয়ে, চিবুকে সাঁটা ব্যান্ডেড মিলিয়ে দিয়ে, চুলের ছাঁট বদলে দিয়ে বাচ্চাদের আরও বেশি “ফোটোজেনিক” করে তোলা নিয়ে কারো কেন আপত্তি থাকবে আমি বুঝতে পারছি না।
তবে এটা সত্যি, বাকিগুলো মেনে নিলেও, রিটাচ করে ব্যান্ডেড তুলে দেওয়াটা বিশুদ্ধ নৃশংসতা। আপনার কথা জানিনা, আমি ব্যান্ডেড সাঁটতে পারাটাকে একটা প্রিভিলেজ মনে করতাম ছোটবেলায়। ভিতু আর ক্যাবলা টাইপের বাচ্চা ছিলাম কাজেই বিশেষ চোট পেতাম না। কিন্তু যখন পেতাম তখন সগর্বে ব্যান্ডেড লাগিয়ে সেটার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে একটুও লজ্জা পেতাম না। আমার ধারণা কেউই পেত না। স্কুলে থাকতে জনসন অ্যান্ড জনসন রংচঙে ব্যান্ডেড বাজারে ছেড়েছিল। পরের দু’সপ্তাহ ধরে স্কুলশুদ্ধু মেয়ে হাঁটুতে, চিবুকে, আঙুলের ডগায় ব্যান্ডেড সেঁটে এসেছিল মনে আছে।
যাই হোক, সপক্ষে থাকি বা বিপক্ষে, বিষয়টা জরুরি। যাদের ছবি রিটাচ করা হচ্ছে তাদের পক্ষে, তাঁদের বাবা মায়েরা যারা এই রিটাচের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাঁদের পক্ষে, এবং হ্যাঁ আমার পক্ষেও। কারণ আমি সুবিচার চাই। এযাবৎ যত ছবি তোলা হয়েছে আমার, বিশেষত পাসপোর্ট সাইজ ছবি, যেগুলো সারাজীবনের মতো আমার অ্যাডমিট কার্ড, আই-কার্ড, পাসপোর্টে সাঁটা হয়ে গেছে, আমি সেই সব ছবি রিটাচ করাতে চাই। না, জালিয়াতি করে নিজেকে ফোটোজেনিক করে তুলতে চাই বলে নয়। যাতে ছবিগুলোকে সত্যিই আমার ছবি বলে চেনা যায়, সে জন্য।
আমার ভোটার কার্ডের ছবিটিকে রিটাচ করে কেউ যদি আসল কুন্তলার মতো করে দিতে পারেন আমি চিরজীবন তাঁর কেনা হয়ে থাকব।
তবে সায়েন্স যেরকম এগিয়েছে তাতে তার পক্ষে আরও অনেককিছু করা সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। বাবামায়ের ওপর গভীর অভিমান নিয়ে শিমূলতলায় ঝর্ণার সামনের পাথরে বসে ছবি তুলেছিলাম, রাগ তো আর নেই, কেন হয়েছিল সেটাও মনে নেই। খালি একটা গোমড়ামুখো ছবি অ্যালবামে পড়ে আছে। রিটাচ করে ছবি থেকে রাগটা সরিয়ে দিতে পারেন কেউ? অথবা হোলির দিন ঝিলম লনে তোলা গ্রুপ ফোটো থেকে আমাকে নিঃশব্দে মুছে দিতে?
জানতাম। কাজের কাজ করার মুরোদ নেই, যত কেরামতি শুধু ব্যান্ডেড বেচারার ওপর।
যাক গে। ছবি নিয়ে এত কথা বলতে গিয়ে নস্ট্যালজিক হয়ে পড়ে পুরোনো ছবির ফোল্ডার হাতড়ে নিচের ছবিটা বেরোল। বুচিদিদিদের বাড়ির ছাদে চাঁদিফাটা দুপুরের রোদ সোজা চোখের ওপর, ঘামাচি সারাতে নাইসিল বডি পাউডারের শিশি আমার গলায় উপুড় করে দিয়েছেন মা এবং প্যান্ট ইস্তিরি করতে ভুলে গেছেন।