Monday, August 20, 2012

অকারণে গান গাই -- সুশোভন

সৃষ্টির গভীরতার মধ্যে যে একটি বিশ্বব্যাপী প্রাণকম্পন চলেছে, গান শুনে সেইটেরই বেদনাবেগ যেন আমরা চিত্তের মধ্যে অনুভব করি। এতে করে আমাদের চেতনা দেশকালের সীমা পার হয়ে নিজের চঞ্চল প্রাণধারাকে বিরাটের মধ্যে উপলব্ধি করে।
 ছন্দের অর্থ: রবীন্দ্রনাথ

সে সব আমার শৈশবে স্বপ্নের দিন। গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। এত টি ভি-র প্রচলন হয়নি।  রোজদিন রেডিও-র চিঠি পড়ার আসর শুনে বা সংবাদের চেনা আওয়াজে ঘুম ভাঙত। তার পরে বাজত রবীন্দ্রসঙ্গীত (তখনও রবীন্দ্রনাথের গান কি বুঝিনি)। কোনোদিন রেডিওর বদলে গ্রামোফোন রেকর্ডে নাটক বা গান দিয়ে শুরু হত দিন। সদ্য ঘুম ভাঙা বালকের কানে রান্নাঘরের শব্দ, 
মায়ের বকুনি, নামতা, পাখির ডাক, বাইরের রাস্তায় সাইকেলের ঘণ্টির শব্দ সবই ছাপিয়ে গিয়ে প্রবেশ করল গ্রামোফোনের মধ্যে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা এক গায়কের গাওয়া একের পর এক বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত আর সেই বালকের চোখের সামনে খুলে যেতে শুরু করল সামনের জীবনের পড়ে থাকা কত শত রহস্যের মানে, তার ইঙ্গিত, অস্ফুট সব হাতেগরম আশ্চর্য, অদ্ভুত সব চলচ্ছবি। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ বহু শীর্ণ ডিগডিগে বাঙালি বালকের এই ভাবেই ছেলেবেলা কেটেছে। তারা ওই গায়কের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে এক এক রকম করে জীবনের মানে বুঝেছে। পরে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছে কতকের মানে আছে, কতকের হয়ত নেইও। এবং একটা সময়ে মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ সব গান যেন আমাদের প্রেম-বিরহ-শূন্যতা বুঝেই এই মুহূর্তের জন্যেই লিখেছিলেন। আর এই গায়ক আমার হয়ে সেই গান গেয়ে দিচ্ছেন। তাতে অবশ্য তাদের কিছু যায় আসেনি তেমন।

আমি দেবব্রত বিশ্বাস বা বাঙালির প্রিয় জর্জদার কথা বলছি। এ কথা ঠিক, আমরা যারা এই পৃথিবীতে বেঁচেবর্তে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমাদের ছেড়ে যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের সংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু এই পূর্ব ভারতের নরখণ্ডে যাঁরা আছেন এবং যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্যের মধ্যে হয়ত এইটে অন্যতম গায়ে-গতরে বড় হয়ে ওঠার জন্য এবং শিল্প কী তার মানে অল্প করে বুঝতে হলে তাঁর গান শোনা অবশ্যকর্তব্য।
কিন্তু কেন এত লোক থাকতে তাঁকে আমরা ভালবেসেছি? তা কি শুধুই নিজের জীবনের রহস্য, প্রেমে পড়া, বন্ধুত্ব, প্রতিবাদ, আচ্ছন্নতা এ সবই তিনি হাতে করে বুঝিয়েছিলেন বলে? শুধু এই মানেটুকুই যদি বেরোয়, তা হলে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে খানিকটা। সে মানে তো আরও বহু বরেণ্য গায়কের গায়নরীতিতে লেগে থাকে। প্রত্যেকেই তার থেকে নির্যাস নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সমর্থন খোঁজেন নিজের মতো করে। কিন্তু এই গায়কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বোধহয় এটাই, ধ্রুপদী প্রাতিষ্ঠানিকতার হাত থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে তিনি শুধুমাত্র জনপ্রিয় মৃত্তিকাচারী না করে তাকে গেঁথে দিয়েছিলেন মাটির একেবারে ভেতরে। অর্থাৎ যা কিনা ছিল যুধিষ্ঠিরের রথ, তাকে কর্ণের রথ করে দিয়েছিলেন এই ব্রাহ্ম বাঙাল। যে গান ছিল একান্ত তাকে অনেকান্ত করলেন তিনি, তাই প্রত্যেকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারলেন সেই অনুপম উচ্চারণকে।

তানসেন গান গাইলে নাকি বৃষ্টি নামত! কিন্তু প্রখর মধ্যদিনে আমি  দেখেছি দেবব্রত বিশ্বাস রেডিওতে বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় গাইছেন আর আকাশ জুড়ে নীলাঞ্জনছায়া। এমনকি তিনি আষাঢ় শব্দটি উচ্চারণ করলে, কোনও প্রাচীন বিদর্ভ নগরে নয় আমাদের ইট কাঠের কলকাতায়  বৃষ্টি নামছে। তারপর থেকেই আমার মনে হয় আর কোন বাঙালি গায়ক কি আষাঢ় শব্দের উচ্চারণ জানেন?
অনেকে বলেন তিনি বিতর্কিত’, তাঁর ব্যক্তিত্ব বিতর্কিত তা বোধহয় ঠিক নয় তত। আসলে তাঁর ওই গায়নরীতিই বিতর্কিত যা স্বীয় ব্যক্তিত্বেরই নির্যাস। কারণ সেই গায়নরীতি মৌলিক, স্বতন্ত্র ও যুগের দাবি মেনে অভিনব। আর কে না জানে আমরা মৌলিকতা ও স্বতন্ত্রতাকে যত আক্রমণ করেছি পৃথিবীর অন্যান্য জাতি তার তুলনায় নেহাতই নস্যি।
অনেকে তাঁর গানের ধরন পুরুষবাদী বলেন। এ নিয়েও বিতর্ক থাকতে পারে। এ কথা ঠিক, তাঁর কণ্ঠের পুরুষ-ভক্তের সংখ্যা যত বেশি, মহিলার সংখ্যা তার থেকে কম। কিন্তু যে কিশোর মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকে ছিল তারা’-- শুনে হৃদয়হীনা মেয়েটির জন্য চোখের জল ফেলেছে বা যে তরুণ দুকলম কবিতা লিখেছে শুধু যাওয়া আসা শুনে বা যে দূরের জানলার এক চিলতে শাড়ি এক পলকের জন্য দেখে জানলার শিকে বৃষ্টির দাগ নিয়ে শুনেছে বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ়’, তার প্রতিক্রিয়ায় তো তারা শুধুই পেয়েছে ধুলো কেবলই নিষ্ঠুর ধুলো। কিন্তু সেই সব অভাগা বেগানার রাতের পর রাত সম্বল হয়ে থেকেছেন জর্জদা। যার কেউ নেই তার দেবব্রত বিশ্বাস আছে। এই তো জীবন কালীদা তাই না?
যেমন সাহিত্যে, যেমন নাট্যে, যেমন চলচ্চিত্রে বা শিল্পকলায় গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর স্বর্ণযুগ। বাংলা গান এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। পরের চল্লিশ বছর বাঙালি যা নিয়ে বাঁচবে, তার ভাত ডাল, তরকারি, কাটাপোনা, চাটনি এবং আমাশা পরিকীর্ণ চেনা ছকের জীবনের বাইরের রসদ যা থেকে আসবে, তার গড়ন এ সব মাধ্যমই অল্প বিস্তর তৈরি করে দিতে পেরেছিল। আজকের যে বাঙালি চেহারা বিশ্বমানসের তীব্র গতির সঙ্গে জায়গা করে নিতে পারছে, তার পিছনে আছে মহান সেই সব অতীতের জীবনকুণ্ড ঘিরে প্রদক্ষিণ। যে মানুষ মলিন, যে মানুষ বিবর্ণ আর যে মানুষ উজ্জ্বল তাদের প্রত্যেকের অবস্থান তারা নিজেরা যেমন, এই সব মহান অতীতও তার কিছু কিছু নির্দিষ্ট করেছে। দেবব্রত বিশ্বাসকে সেই কীর্তির অন্যতম পথিকৃৎ বলতে চাই।

রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষের উদযাপনে বাঙালি কেমন করেই জানি ভুলে রইল যে, এই বছরটায় ১৫০তম জন্মদিন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়েরও। এই বাইশে শ্রাবণে কবির মৃত্যুদিবসও স্মরণ করবে বাঙালি; কিন্তু এখনও কী রকম সে ভুলে থাকছে বা থাকবে ৬ ভাদ্র তারিখটা (ব্রাহ্ম সমাজের পত্তনের তারিখও এটা), যে দিন এ বছর শতবর্ষে পা দিয়েছেন কবির গানের সেই যুগন্ধর শিল্পীটি দেবব্রত বিশ্বাস। জীবনে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে ১৯৮০-র এক শ্রাবণ দিনে (১৮ আগস্ট) যে দিন তিনি তাঁর ১৭৪ ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাসা চিরদিনের মত খালি করে চলে গেলেন, সে দিন থেকেই তিনি এ পার বাংলা-ও পার বাংলার কোটি মানুষের বক্ষস্থলে আস্তানা গাড়লেন। মানুষের বুকের যে অঞ্চলে অমর মানুষের বসবাস। মনে আছে সে দিন রাতে আমাদের বাড়িতে বেজেছিল ওঁর কণ্ঠে চিরস্থায়ী করা কবির সেই গান তাঁকে নাকি এই গান শোনানোর অনুরোধ করায় হেসে বলতেন, ‘বেশ তো হাসতাছি, আমারে কান্না করাইয়া কী মজা পান, কন তো?’-‘মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন তব চরণতলে/ শুভলগন গেল চলে
তাঁর শতবার্ষিকীতে বাঙালির হেলদোল নেই দেখে সব চেয়ে বেশি খুশি হয়ত হতেন জর্জদাই, কোনও রকম আনুষ্ঠানিকতার প্রতীকী বিরোধ ছিল মানুষটার! জীবনের শেষবেলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধ ফেলতে না পেরে মঞ্চে সংবর্ধনা নিতে বসেছিলেন। একমুখ দাড়ি নিয়ে সেই ছবি যারা দেখেছেন তারা বুঝেছেন ততদিনে তিনি ক্লান্ত প্রাণ এক’, বা উত্তমপুরুষ এক বচন
১৯৭১-এ গান রেকর্ড করা বন্ধ করার পর থেকে গোটা দশক জুড়ে নিজের ছোট্ট বসার ঘর কাম গানের ঘর কাম আপিস ঘরটাকেই এক মঞ্চ করে সাজিয়ে বসেছিলেন জর্জদা। সেখানে বসেই আড্ডা, চিঠি লেখালেখি-পড়াপড়ি, তাস, চা, পান, গান, অভিমান, স্মৃতি রোমন্থন সব চালাতেন। যাকে ভাল বুঝছেন বাজিয়ে দেখছেন মানুষ ওঁকে ভালবাসে কী বাসে না।
যার গান শোনার জন্যে টিকিটের জন্য লাইন পড়ে, তিনি গানকে কী ভাবে মঞ্চ থেকে বার করে নিজের খোলামেলা দৈনন্দিন জীবনের ভাষা ও ভাষ্য করেছেন, বলতে গেলে এক নিত্যব্যবহার্য শিল্প করে ফেলেছিলেন। ফতুয়া আর লুঙ্গি পরে পান চিবোতে চিবোতে হারমোনিয়ামের রিড-এ খেলা করেছেন, আড় চোখে দেখছেন বাইরে মেঘ হচ্ছে, বললেন, ‘ভাবতাছেন আমি বর্ষার গান গামু? না গামু না। বলেই ধরেছেন নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, এলে সকল-মাঝে--/তোমায় আমি হারাই যদি/ তুমি হারাও না যে... এ গল্প শুনে ভেবেছি, এ কী মানুষ রে ভাই! কী প্রেম! কী ঔদ্ধত্য!

বাংলা ১৪১৯-এ এসে এই মানুষটাকেই আজ সব চেয়ে বেশি রাবীন্দ্রিক বলে ঠাওর হচ্ছে। বব ডিলানের মতো উনি গানকে লাইফস্টাইলে বেঁধেছিলেন, অ্যাকসেসরি বা অনুষঙ্গ করে নয়, হাতের হাঁপানির স্প্রের মতো জীবনদায়ী শ্বাস হিসেবে। কোনও আদিখ্যেতা ছাড়াই, অনুরোধ-উপরোধ ছাড়াই, একটু গলা সাধার প্রয়োজন ছাড়াই, অদ্ভুত অদ্ভুত সব গান গেয়ে ফেলছেন শুধু, ওঁর ভাষায়, ‘একটু খুলে দেখার জন্য। অর্থাৎ গানটাকে একটু কাছ থেকে দেখা!
ইনি বাঙালির পল রবসন! দুর্ভাগ্য দেবব্রতর যে এদেশে যথার্থ সমালোচক নেই। পল রবসনের কথাই মনে হল, কেননা দেবব্রত ও শেষপর্যন্ত একজন আশ্রমিক গীতিকার ও সুরকারকে জনপরিসরে নিয়ে আসার প্রয়াস করেছিলেন। যাকে বলে হার্লেম রনেসঁস। তার সঙ্গে আইপিটিএ-র দেবব্রত যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে পুনরাবিষ্কার করেছিলেন তার মিল রয়েছে।
রবসন নিগ্রো আধ্যাত্মিকতাকে ক্রমশ মুক্তি দিতে চাইছিলেন মার্কিনি শ্রমজীবীর মূল সংস্কৃতিতে, আর দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর পূজা পর্যায়ের গানে ব্রাহ্ম রক্ষণশীলতাকে মুক্তস্রোতা করে দিলেন। রবীন্দ্রসংগীতের মৌলবাদ তাকে ব্রতভ্রষ্ট মনে করে অথচ জর্জ বিশ্বাস রবীন্দ্রচর্চার সীমানার বাইরেও জনসমর্থন পেয়ে যান; অনেকটাই রবসন যেমন কালো সমাজের।
দেবব্রত বিশ্বাসকে কি তবে একধরনের ক্রসওভার শিল্পী বলব? আসলে দেবব্রত যখন সক্রিয়, যেমন রবসন অন্তত ১৯২৪-৪৫ কালপর্বে, তখনো আমরা বুঝিনি সংস্কৃতির নির্দিষ্ট ফ্রেমের বাইরে কীভাবে চলে যাওয়া যায়। আজ হয়ত দেবব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রগানের একটি উপসংস্কৃতিও হয়ে উঠতে পারেন, যেমন হয়ত বিটল ঘরানায় পল ম্যাকার্টনি। নিগ্রো স্পিরিচুয়াল ও ব্রাহ্ম উপাসনারীতি আসলে উপলক্ষ্য ছিল। বিপ্লবী হয়ে ওঠা ছিল দু'জনেরই নিয়ত।

একটা প্রশ্ন অনেকের মনেই উঠেছিল যখন রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট এবং ওঁর গানের বোর্ড উঠে গেল। প্রশ্নটা হল: এই মুহূর্তে দেবব্রত বিশ্বাস বেঁচে থাকলে নতুন কিছু কী করতেন যা আগে করা সম্ভব ছিল না। তাতে ঘুরেফিরে একটিই উত্তর আসবে: যা তিনি করেছেন ষাট এবং সত্তর দশকে অবিকল তাই। প্রাণ দিয়ে স্বরলিপির মধ্যে গান প্রতিষ্ঠা করতেন। স্বরলিপি ভাঙার কথা তিনি কদাচ ভেবেছেন, স্বরলিপির মধ্যে গান খুঁজেছেন, গান গেয়ে গেয়ে তাদের একটু খুলে দেখেছেন’।
একটা ঘটনার কথা বলি, বন্ধুদের মুখে শোনা, লেনিন শতবর্ষ উদযাপন উৎসব (১৯৭০) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা মাঠে রাত সাড়ে এগারোটার সময়ে ছাত্রদের আবদারে তিনি গেয়েছিলেন গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর’ – মঞ্চে লেনিনের বিরাট কাট আউট। একটা প্রেমের গানে যে অত রাজনৈতিক দ্যোতনা আনা যেতে পারে সেই প্রথম জানলাম। অত রাতে বুঝি বাঙালির যৌবন প্রেম শব্দটির অর্থ জেনে শিহরিত হয়েছিল। জীবনে প্রথম সবিস্ময়ে অনেকেই শুনেছিলেন তিনি গাইছেন মম জীবন যৌবন, মম’...



About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই