Monday, August 13, 2012

বর্ণপরিচয় -- কৌস্তুভ

<< বিজ্ঞান কলমে আগের লেখা "শিশুমানব"

(যদি Blogger এর নিজস্ব গোলমালে লেখা হঠাৎ করে উবে যায়, তবে অন্য Tab এ একবার ক্লিক করে এই ট্যাবে ক্লিক করুন)
আহা! "অ-আ-ক-খ" না, আজকের পর্ব হচ্ছে বর্ণ মানে রঙ নিয়ে। সাজগোজ করে রঙচঙ কেন বাড়ানো হয়, তা একটু যেমন বুঝব, তেমনই, ভেরি ইম্পর্টেন্ট, আমরা দেখব কেন বাঙালি পাত্রপক্ষ কেবলি ফর্সা মেয়ে খোঁজে... 

রঙের কথায়, একটা সহজ পরীক্ষা দিয়েই ব্যাপারটা শুরু করা যাক। উপরের ছবিটা দেখছেন? একেকটা শব্দ একেকটা রঙের। রঙগুলোর নাম ঝটপট বলে ফেলুন তো দেখি!



কিন্তু শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে রঙগুলোর নাম বলতে গেলেই দেখবেন, সমস্যা – রঙের নামের বদলে কেবলই শব্দগুলোই বলে ফেলতে মন চাইছে, ওগুলোও রঙের নাম কিনা। ছোটবেলায় শেখা অআকখ অ-য়ে অজগর মানে বর্ণপরিচয় আমাদের যে ভাষা শিখিয়েছিল, সেই শব্দ চেনার ক্ষমতা আমাদের রঙ চেনার ক্ষমতাকে ওভারট্রাম্প করে দিচ্ছে। এটাই অনেক সহজ হয়ে যাবে যদি বাংলার বদলে কোনো অপরিচিত ভাষা, যেমন চীনে, দিয়ে শব্দগুলোকে বদলে দেওয়া হয়। তখন দেখবেন গড়গড় করে রঙগুলো চিনে নিতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না (আপনি চীনে ভাষা চিনলে অবশ্য অন্য ব্যাপার)।

নেট কানেকশনে যদি ভয়াবহ সমস্যা না থাকে, তবে মাত্র ১৪ সেকেন্ডের এই ছোট্ট ভিডিওটায় এইরকম আরেকটা পরীক্ষা চালিয়ে দেখে নিন, কেমন করে মোশন মানে রঙিন বিন্দুগুলির চলাফেরা তাদের বদলানো রঙের কথা আমাদের এক্কেবারে ভুলিয়ে দেয়! ওনারা এটার নাম দিয়েছেন সাইলেন্সিং


তবে সবসময়ই যে রঙ বেচারা ডাউন খায় এমন নয়। এই মজার ফ্ল্যাশ গেমটার চ্যালেঞ্জ একটু নিয়েই দেখুন না, কেমন করে অবজেক্ট রেকগনিশন মানে বস্তুর হালহকিকত চেনার ক্ষমতা রঙের জঙ্গলে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। মোদ্দা কথা, আমাদের রঙ চেনা, বস্তুর নড়াচড়া চেনা, বস্তুর অবস্থা চেনা, অক্ষর চেনা এই সব কাজ মস্তিষ্কের আলাদা আলাদা অংশে হয়, আর সচরাচর তারা মিলেমিশে কাজ করলেও বিশেষ বিশেষ অবস্থা সহজেই তৈরি করা যেতে পারে যেখানে পরস্পর বিবাদ লেগে যায় তাদের। তখন মস্তিষ্ক একজনকে আরেকজনের উপর প্রাধান্য দেয়, এই যেমন রঙের উপরে নড়াচড়াকে – আর সত্যিই, ভেবে দেখেন, একটা বাঘ যখন আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের দিকে ঝাঁপ দিচ্ছিল, তখন বাঘটার রঙ পাল্টাচ্ছে কি না সেটা খেয়াল করতে গিয়ে সময় নষ্ট করা নেহাতই বাতুলতা!

তবে সার কথা এই যে, চোখ যেমন আমাদের সহ অধিকাংশ প্রাণীরই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং সর্বাধিক ব্যবহৃত ইন্দ্রিয়, সেই চোখের কাজকর্মের মধ্যে আবার রঙ চেনার ক্ষমতা একটা অতি প্রাচীন গুণ – পতঙ্গ থেকে পাখি সবাই এটা পারে। রঙ এতই গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস যে, আমাদের আলোকসংবেদী রড কোষের পাশাপাশি রঙ চেনার জন্যই বিশেষ করে তিনরকম কোন কোষ যে আছে তা তো সবাই জানে।


তা রঙের কথা কেন?

আগের পর্বে আমরা দেখেছিলাম মানুষের উদ্ভবের আদিযুগে তাদের বর্ধিত মস্তিষ্ক ইত্যাদি নানা গুণের উপর নিওটেনির প্রভাব, বিশেষ করে এই নিওটেনি কেমন করে নারীদের নানা বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করছে। আরো দেখেছিলাম, আমাদের স্ত্রী-পুরুষ তারতম্য বা ডাইমর্ফিজমের একটা বড় কারণ হচ্ছে সেক্সুয়াল সিলেকশন, যেখানে যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর রুচি ভিন্ন। অবশ্য আমরা শুধুমাত্র নারীর উপর পুরুষের সিলেকশন, তাও কেবল নিওটেনির প্রসঙ্গেই দেখেছিলাম। আজকে আরেকটু বিশদে দেখব, বিশেষ করে রঙের প্রসঙ্গে।


পার্ট – ১
তবে শুরুতে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেইটাই আগে মেটানো যাক – গায়ের রঙ নিয়ে দুটো কথা বলি। কৃষ্ণকলি নিয়ে রবিবুড়ো দুয়েকটা গান লিখে ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করলেও, দুধে-আলতা বরণ মেয়েরাই কেবল সুয়োরানি হয় আমাদের রূপকথায়। বাঙালি পুরুষ নিজে যেমনই হোক না কেন, বিয়ের সময় যে সুন্দরী (অর্থাৎ কিনা ফর্সা, আমাদের সমাজে) মেয়েই বাঞ্ছা করে সে তো সবাই জানে। এই সামাজিক প্রবৃত্তি, যা আমাদের সমাজে একরকম অভিশাপ বিশেষ, তা সম্পর্কে বিশদে পরে কখনও বলব, তবে যেহেতু আমি তথ্যজীবী তাই আসুন ছোট্ট একটু পরিসংখ্যান দিয়ে আমাদের ধারণাটা মিলিয়ে নিই। 

আনন্দবাজারের পুরনো একদিনের কাগজখানা নিয়ে (যেহেতু স্যায়না ব্যাটারা আজকাল আর অনলাইনে ওই বিজ্ঞাপন দেখায় না) পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপনগুলো উল্টে দেখা যাক না হয়। জানুয়ারির শুরুতে নিলাম, কারণ জানুয়ারির ১৫ মানে মাঘ মাসের শুরু থেকে ‘বিয়ের দিন’ শুরু হয়, অতএব ওই সময়ে অনেক বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। শ’দুই করে পাত্র-পাত্রী দুটোতেই পেলাম, মন্দ স্যাম্পল না। তা মনে মনে সবারই সুন্দরীর দিকে ঝোঁক থাকে সে তো ঠিকই, তবে কতজন সরাসরি সুশ্রী/সুন্দরী পাত্রী চেয়েছেন? গুণে দেখি প্রায় ৭২%! তার মধ্যে আবার এক অভিজাত পরিবার “ফর্সা ও সুন্দরী ব্যতীত যোগাযোগ নিষ্প্রয়োজন” বলে সটান ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন; এনাদের সংখ্যাও কম না – ৩১% পাত্রপক্ষের কাছে ফর্সা ছাড়া আর কিছুই রুচবে না বলে প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন। সেই তুলনায় শিক্ষিতা (এমনকি উচ্চশিক্ষিতাও না) প্রসঙ্গ তুলেছেন মাত্র ২৯%। এনাদের মন-মানসিকতা কী রকম, তা আর বিশদে বলার প্রয়োজন নেই বোধহয়। 

অন্যদিকে, পাত্র চাই-এর মধ্যে সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন মাত্র দেড় শতাংশ পাত্রীপক্ষ, ফর্সার চাহিদা তো আরোই কম। বরং ওখানেও ৫০% ক্ষেত্রেই পাত্রী যে ফর্সা এটা তাঁরা জানিয়ে দিতে ভোলেননি। সেই অনুপাতটা, যা দেখছি, যাঁরা ফর্সা পাত্রী চান তাঁদের চেয়েও অনেকটা বেশি।

বাঙালিদের মধ্যে শ্যামলা রঙের হার বেশ বেশি, যেহেতু বঙ্গের প্রাচীন অধিবাসী দ্রাবিড় বা সাঁওতাল-ইত্যাদি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীরাই – সম্ভবত সংস্কৃত-জাত ভাষাভাষীদের মধ্যে সর্বাধিক কালো আমরাই। দিল্লিতে তো আমাকে তামিলই ধরে নিত লোকজন।
নেহাত ‘আর্য’রক্ত আর কিঞ্চিত চৈনিক মিশ্রণের সুবাদে আমাদের মধ্যে ফর্সাদের উদ্ভব, তাই এখন আমাদের বেশ ফর্সা থেকে বেশ কালো এই বিশালরকম বিস্তৃতি দেখা যায় গায়ের রঙের। তা এই বিশাল অংশ শ্যামলা হওয়া সত্ত্বেও কেন আমাদের এই ফর্সা-লোলুপতা? এবং শুধু পাত্রী চাওয়ার ক্ষেত্রেই নয়, আমেরিকাতে কালোদের প্রতিও আমাদের অনেকেরই রেসিজম বর্তমান, মূলোদার চমৎকার ‘উদারমানসচরিত’ স্মর্তব্য। 
এর উত্তরে দুরকম ব্যাখ্যা বা হাইপোথিসিস দেওয়া হয় সাধারণত। একটা সাম্প্রতিক, আরেকটা প্রাচীন।
 (১) সাম্প্রতিক: এটা আমাদের ইংরেজশাসিত হওয়ার ফল। তাদের কলোনিয়াল মানসিকতা আমাদের মধ্যেও ঢুকে গেছে, তারা যেমন বলত যে কালোরা ‘ডার্টি নিগার’, আমরাও সাদাদের সুপিরিয়র মনে করতাম, স্বাধীন হওয়ার পরেও সেই হীনমন্যতা আর অভ্যাস ছাড়তে পারি নি।
(২) প্রাচীন: ইংরেজ-থিওরির প্রাচীন ভার্শন এটা। ভারতে সেই আর্য দখলদারি ও দ্রাবিড়দের দক্ষিণে হটে যাওয়া থেকে আর্যরা তাদের নিচু জাত বা শুদ্র বলে গণ্য করত, আর তাই তাদের সংস্কৃতি যেখানে গেছে সেখানেই কালোদের প্রতি এই মানসিকতা। বাংলাতে বল্লাল সেন আবার এইটা রিইনফোর্স করেন উত্তর ভারত থেকে কিছু সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ আমদানি করে বাংলায় তাদের বসতি করিয়ে ও তাদের কুলীন ইত্যাদি সম্মান দিয়ে।

কিন্তু এই তত্ত্বগুলোর সমস্যা এই যে, এই নিন্দনীয় অভ্যাসটি বাঙালির একারই সম্পত্তি নয়। বলিউডি গীতে ‘গোরি’র রূপেরই প্রশংসার ছড়াছড়ি কেবল। আমরা যদিও মনে করি যে বাঙালিরাই সবচেয়ে রেসিস্ট, তবে যদি আমাদের নজরটা আরেকটু বিস্তৃত করি, তবে দেখতে পাব ভারতজুড়ে অনেক উদারমনাই তাদের নিজেদের জাতকে সবচেয়ে রেসিস্ট বলে আফসোস করেন। এখানে ব্রিটেনপ্রবাসী এক উত্তর ভারতীয় লিখছেন সেখানের সবচেয়ে বড় দুটি প্রবাসী ভারতীয় গোষ্ঠীকে নিয়ে – পাঞ্জাবী আর গুজরাতি। তাঁকে এক গুজরাতি মহিলা বলছেন, তাঁদের মেয়েদের পক্ষে কোনো আফ্রিকান পুরুষকে ডেট করা খুবই লজ্জার বিষয় হবে তাঁদের সমাজে। কিন্তু অন্যদিকে, 
“For the Indian male, to sleep with a white woman—do it to a white woman rather, speaking of the feel of it—is a mandatory conquest without which the migration experience is never complete.”
সমাপ্তিতে তিনি বলেছেন, 
“আমি নেহাতই ভাগ্যবান যে আমি স্বামী খোঁজার অবস্থায় থাকা কোনো শ্যামবর্ণ ভারতীয় মহিলা নই!” 

তা নাহয় ওই সায়েব/আর্য ভিত্তিক ব্যাখ্যাগুলো আরেকটু বিস্তৃত করলে উত্তর ভারতীয়দেরও অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া যাবে। কিন্তু তার বাইরে?

আমরা যাদের ফুটফুটে গৌরবর্ণ বলেই ধরব, সেই জাপানিদের মধ্যেও দেখা যায় ফর্সা সম্পর্কে একই রকম আচরণ, এবং বহু প্রাচীন কাল থেকেই – ইউরোপীয়দের সঙ্গে মিলমিশ হওয়ার আগেই! সেই অষ্টম শতাব্দীর জাপানি সাহিত্যেও রূপবান কন্যার বৈশিষ্ট্য হল দীঘল লম্বা চুল আর ধবধবে ফর্সা রঙ। তাই জন্যই আমেরিকানদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া মাত্রই মার্কিন তরুণীদের প্রতি তাদের তীব্র ফ্যাসিনেশন দেখা যায়।

এমনকি, খ্রিষ্টপূর্ব সেই রোমান যুগেও সৌন্দর্যের সংজ্ঞা হল মোটামুটি নর্ডিক – শ্বেতপাথরের মত ফর্সা রঙ, ব্লন্ড চুল, গোলাপি টইটম্বুর গাল – যাদের তারা ধরে ধরে দাসী বানাতে খুবই পছন্দ করত। চাচাকাহিনীর লেডি-কিলার পুলিন সরকারও বলেছিল, 
"আহা সুন্দরী ব্লন্ডিনী
      নর্দিশি নন্দিনী..."

তাহলে যা দাঁড়াল, বাঙালি বা ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ওই ব্যাখ্যাগুলো যদি আংশিক সত্যি হয়ও, সামগ্রিকভাবেই সারা দুনিয়াতে এই যে প্রবণতা, তার জন্য নতুন থিয়োরি দরকার।


পার্ট – ২
আগের পর্বেই বলেছি, প্রাণীজগতে সচরাচর পুরুষরাই সেক্সুয়াল সিলেকশনের লক্ষ্য হলেও, মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টে গেছে – এখানে পুরুষরাই নারীদের উপর সঙ্গমসঙ্গী নির্বাচন চালায়, আর তার ফলে রানঅ্যাওয়ে সেক্সুয়াল সিলেকশনের ঠেলা গিয়ে পড়ে নারীদেরই উপর। আর পুরুষেরা স্বভাবতই চায় রূপযৌবন। তার মধ্যে একটাই মাত্র ফ্যাক্টর – ‘কচি নধর মেয়ে’ –আমরা দেখেছিলাম গতবার। এইবার দেখব রূপ মানে সৌন্দর্য নিয়ে আরেকটু বিশদে। তারপরে নতুন থিয়োরির আলোচনায় যাব।

তা রূপ বিষয়ে পুরুষেরা কতটা লোলুপ, তাই নিয়ে একটা চমৎকার পরীক্ষা নিয়ে একটু বলি। একদল মহিলা আর একদল পুরুষকে নেওয়া হয়েছিল, যারা পরস্পরের অপরিচিত, এবং অদেখা থেকেই জুড়ি হিসাবে টেলিফোনে কথাবার্তা চালাবে। তবে, তাদের পার্টনার মহিলাদের ছবি এবং বিশদ বায়োডেটা পুরুষদের দেওয়া হয়েছিল আগেই, যদিও অন্য পক্ষকে কিছু দেওয়া হয় নি।
গবেষকরা একটা দারুণ চাল চাললেন – ওই মহিলাদের আসল ছবির বদলে, র‍্যান্ডম ভাবে অন্য কিছু মহিলাদের ছবি দিলেন ওই পুরুষদের। এবং সেসব ছবির অর্ধেক হল কিছু পরমাসুন্দরী নারীদের ছবি, আর অর্ধেক মামুলি ছবি। এবার পুরুষদের বললেন, কথা শুরু হবার আগেই, যে ছবি ও বায়োডেটা দেখে ওই মহিলাদের আনুমানিক গুণাবলী সম্পর্কে রেটিং দাও।

দেখা গেল, বায়ো যাই বলুক, ছবির সুন্দরী মহিলারাই বেশ সামাজিক, আকর্ষণীয়, বাক্যালাপের উপযোগী বলে রেটিং পেলেন। 

এইবার আরো ইন্টারেস্টিং দ্বিতীয় ধাপ। সব জুড়িকে এবার ফোনে খানিকক্ষণ গল্পগুজব চালাতে বলা হল। তা হয়ে গেলে’পর, সেই রেকর্ড করা কথাগুলো থেকে স্রেফ মহিলাদের কথাগুলো নিয়ে, আরেকদল পুরুষকে স্রেফ ওই কথার ভিত্তিতে মহিলাদের গুণাবলী রেটিং করতে দেওয়া হল। চমকপ্রদ ফলাফল – সেই রেটিংগুলো মিলে যাচ্ছে কথাবার্তা শুরুর আগেই ওই অন্য পুরুষদের দেওয়া ছবি-ভিত্তিক রেটিংয়ের সঙ্গে!

যার অর্থ দাঁড়ায়, পুরুষরা যাদের বেশি সুন্দরী মনে করেছে, ফোনে স্বাভাবিক গল্পগুজবের মধ্যে দিয়েই তাদের প্রতি বেশি লুলবৃত্তি করেছে। আর মহিলারাও সেই ইঙ্গিতগুলো ধরে নিয়ে সেইরকমই আচরণ করেছেন, যা প্রকাশিত হয়েছে তাদের কথাবার্তায়। তাই বলা হয়, expectations can create reality.

বাস্তবিকই, মানবসমাজে রূপ গুণের চেয়েও অনেক বড় প্রাথমিক প্রভাবক। সৌন্দর্যকে তাই প্লেটো বলেছিলেন, ‘the privilege of nature’। আমরাও বলি, ‘পহলে দর্শনধারি, পিছে গুণবিচারি।’ আর beauty lies in the eyes of the beholder অর্থাৎ রূপের ধারণা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত, এই প্রবচনকে দুর্বল করে দিয়ে দেখা যায়, দুনিয়াতে মোটামুটি সব জাতিতেই সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারণাগুলির মধ্যে বেশ মিল আছে। এবং সুন্দর বলে যাদের মনে করা হয় তাদের প্রতি অন্যরা বেশি ইতিবাচক ব্যবহার করে, এবং তারা নিজেরাও নিজেদের সম্বন্ধে বেশি ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ করে, যেন তারা এ বিষয়ে সচেতন (তারা বেশি সেলফ-অ্যাসিওরড, বা অবচেতনে বেশি কনফিডেন্ট)। আর শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই নয়, কথা না ফোটা শিশুরাও অবচেতনে এই একই কাজ করে। 

স্পষ্টতই, প্রাজ্ঞজনের উপদেশ beauty is only skin-deep-ও লোকে কানে নেয় না বলেই দেখা যাচ্ছে। 

তা রূপযৌবন বলতে আমরা কী বুঝি, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, নানারকম লক্ষণ তাঁরা বার করেছেন যা আমরা সচেতনে-অবচেতনে মেপে চলি কাউকে দেখার মুহূর্তেই। তার মধ্যে, মহিলাদের ক্ষেত্রে নিওটেনির ঠিক বিপরীতে উঠে আসা পুষ্ট স্তন ও নিতম্ব এই অতিরিক্ত যৌনলক্ষণগুলো আমরা গতবারই দেখেছি।
এইবারের বিষয় হল, রঙ কী ভাবে রূপের বড় একটা লক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গায়ের রঙ, চুলের রঙ, চোখের রঙ।

 ************************* 
একটা ব্যাপার নিশ্চিত, আফ্রিকার তৃণভূমিতে আমাদের যে আদিম পূর্বপুরুষেরা ঘুরে বেড়াত, তাদের গায়ের রঙও (লোমের নয়, চামড়ার) ছিল শিম্পাঞ্জি বা গরিলার মতই ঘন কালো। তাহলে তাদের থেকে কী ভাবে এত এত সাদা চামড়ার মানুষের উদ্ভব হল, আর কেমন করেই বা সেই সাদা চামড়া সৌন্দর্যের সংজ্ঞার মধ্যে ঢুকে পড়ল?

এর উত্তরে যে ব্যাখ্যা এতদিন ধরে দেওয়া হয়ে এসেছে, তা হল ন্যাচারাল সিলেকশন।



উপরের ছবিটাতে সারা পৃথিবীর নানা স্থানের আদিবাসী গোষ্ঠীদের গায়ের গড় রঙ দেখানো হয়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বিষুবরেখা থেকে যত দূরে যাওয়া হয়, গায়ের রঙ ততই হালকা হয়।

এটার কারণ হিসাবে এই বলা হয় যে, বিষুব অঞ্চলেই যেহেতু ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ঘন মেলানিন স্তর আমাদের চামড়াকে বাঁচায়, নানা ক্ষতিকর মিউটেশন ও ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে, চামড়ার ভিটামিন বি ভেঙে যেতে দেয় না। কিন্তু যত বাইরের দিকে যাওয়া যাবে, সূর্যালোকের প্রখরতা ততই কমে যায়, রক্ষাকারী মেলানিনের প্রয়োজনও কমে যায়। বরং, যেহেতু আমাদের চামড়ায় সূর্যালোক থেকে অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি সংশ্লেষ হয়, ওই অঞ্চলে আলোর তেজ কম বলে কম ভিটামিন পাই আমরা। তাই চামড়ার মেলানিন স্তর কমে যায়, যাতে বেশি আলো আসে আর অল্প রোদেও বেশি ভিটামিন তৈরি করা যায়। তাই ন্যাচারাল সিলেকশনের ধাক্কায় বিষুব অঞ্চল মানে সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে দূরে চলে আসা জনগোষ্ঠীগুলোর গায়ের চামড়ায় মেলানিন অনেক কমে গেল। এটাই কালো রঙ থেকে ওই অঞ্চলে হালকা রঙের চামড়া উদ্ভব হওয়ার কারণ। (নিচের ছবিটা দেখুন। এক প্রৌঢ় শ্বেতাঙ্গ, আমেরিকান ট্রাক ড্রাইভার, সারা জীবন ধরে বাঁদিকের জানলা দিয়ে মুখে রোদ পেয়েছেন, বাঁদিকটায় তাই বার্ধক্যসুলভ ড্যামেজ কত বেশি দেখুন।) 

কিন্তু এই তত্ত্ব, যা আমরা সচরাচর জেনে এসেছি, সাম্প্রতিক সময়ে ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা দেখান, ভিটামিন ডি’র অভাবে রিকেট ইত্যাদি যে রোগের কথা বলা হয়েছিল, তার প্রাদুর্ভাব এতই কম যে ন্যাচারাল সিলেকশনের পেছনে সেটা একটা জোরালো ফ্যাক্টর হিসাবে থাকতে পারে না। 
অথচ ইউরোপ চীন ইত্যাদি স্থানে একেবারে রানঅ্যাওয়ে সিলেকশনের ঠেলায় প্রত্যেকেরই চামড়া ফর্সা হয়ে গিয়েছিল একেবারে (আফ্রিকার তুলনায়)। তাহলে এত জোরালো ফ্যাক্টর কী হতে পারে?

‘রানঅ্যাওয়ে’ শব্দটা শুনলেই আগের পর্বের অভিজ্ঞ পাঠকের যা ইঙ্গিত পাওয়া উচিত, সেইটাই – সেক্সুয়াল সিলেকশন। এবং আবারও, ডারউইন দাদুই সবার আগে তাঁর বইতে এই ইঙ্গিত করে গেছিলেন।

এ কথা ঠিক যে, আফ্রিকা ইত্যাদি প্রখর সূর্যালোক অঞ্চলে মানুষ আদি সমস্ত গ্রেট এপ-দের চামড়ার রঙ ঘন কালো থাকা সম্ভবত ন্যাচারাল সিলেকশন। তার পেছনে ইউভি বা অতিবেগুনি রশ্মির কুপ্রভাব যেমন আছে, তেমনই আছে প্রখর সূর্যালোকে সাদা চামড়ায় সানবার্ন হওয়া, যা কোনো আদিম মানুষের থাকলে তাকে খাদ্য সংগ্রহে যেতে বাধা দিত, এবং কোনো শিশুর হলে ঘাম তৈরি ব্যাহত হয়ে শরীরের তাপ বেরোনোয় বাধা পড়ে তার মৃত্যু অবধি হতে পারত। বস্তুত, আফ্রিকার দুয়েকটি উপজাতিই পৃথিবীতে অনন্য এ অর্থে যে তারা সাদা চামড়া মোটেই পছন্দ করে না – এমনকি কারো অ্যালবিনো শিশু জন্মালে তাকে দুর্বল বিধায় দূরে ফেলে দিয়ে আসে।

তা চামড়ার রঙ হালকা হয়ে আসার পিছনে কীভাবে সেক্সুয়াল সিলেকশন কাজ করে? 

এর উত্তর, মাত্র বাইশ বছর বয়সে – যে বয়সে ডারউইন সবে ধর্মতত্ত্ব পড়া ছেড়ে বীগলে ঘুরতে যাই-যাই এমন আঁট করছেন বাপের ধমক এড়িয়ে – আমেরিকায় পদার্পণের কয়েক মাসের মধ্যেই সবরকম মানবজাতির একটা নমুনা দেখে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ দ্বারা আমি যা ঘোষণা দিয়েছিলাম তাই’ই – সঙ্গীর মধ্যে নারী খোঁজে নির্ভরযোগ্যতা, আর পুরুষ খোঁজে বৈচিত্র্য।

নারীকে কেন দায়ে পড়ে স্টেবিলিটি খুঁজতে হয় পুরুষের মধ্যে, তা আগের পর্বে দেখেছি। আর পুরুষ কেন বৈচিত্র্য খোঁজে, সেটাও অনুমান করা শক্ত নয় – আপনি যদি দশটি বেশ ভিন্নরকম জিনসম্ভারের সাথে আপনার জিনকে মিলিয়ে অপত্যের মধ্যে পাঠিয়ে দিতে পারেন, তাহলে নানা কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের অন্তত কয়েকজনের, এবং ফলস্বরূপ আপনার জিনের, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এটাই পলিগ্যামি বা বহুগামিতার মূল কারণ। এই একই যুক্তি নারীদের ক্ষেত্রেও সত্যি হত, যদি না তাদের শিশুপালনের দায়ে পড়ে পুরুষ-নির্ভর মোনোগ্যামির দিকে ঝুঁকতে হত।

পুরুষরা যে বৈচিত্র্য-লোলুপ, তা খুব সহজেই দেখানো যায়। বিজ্ঞানীরা একদল পুরুষকে পাঁচটা মেয়ের ছবি দেখিয়েছিলেন, যার মধ্যে চারজনের কালো চুল এবং একজনের ব্লন্ড। দেখা গেল, অধিকাংশই ব্লন্ড মেয়েটিকে বেশি পছন্দ করছে। অথচ, যদি চারজন ব্লন্ড ও একজন রেডহেড নিয়ে দেখেন, তখন বেশি পছন্দ হবে লালচুলের মেয়েটিকেই।

এসবের কারণ অবশ্যই এই যে, রঙ আমাদের একটা খুব প্রাথমিক উদ্দীপক। পাকা ফল বেছে খাওয়া ইত্যাদি নানা দৈনন্দিন আবশ্যিক কাজে সেইটা অপরিহার্য। আর তাই সঙ্গীর থেকে রং-সংক্রান্ত কোনো সিগনালকে আমরা বিশাল প্রাধান্য দিই। মিলনের সময় এলে যে পশুপাখিরা তাদের রঙের ছটা বিস্তার করে এত লাফালাফি করে, সে তো এ জন্যেই।

তাই মনে করুন, ইউরোপের ঠাণ্ডা এবং কম অতিবেগুনি রশ্মির এলাকায়, যেখানে ঘন মেলানিনের আর প্রয়োজন নেই, এমন জায়গায় যদি রান্ডম মিউটেশনের ফলে কোনো নারীর চামড়ার রঙ কিছুটা হালকা হয়ে পড়ে, তাহলে সঙ্গী হিসাবে তার চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে, এবং তার সন্তানরাও হালকা রঙের কারণে তাদের জিন বেশি ছড়াতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ, ন্যাচারাল সিলেকশন যদি হালকা রঙকে বাধা না দেয়, তবে রানঅ্যাওয়ে সেক্সুয়াল সিলেকশনের ঠেলায় সেটাই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। 
এখানে দুটো প্রশ্ন করা প্রয়োজন…
(১) প্রথমত, এমন হলেও, মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র (ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাসর্টমেন্ট) বলে যে গুণগুলো পৃথকভাবে সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, এবং কোনোটা রিসেসিভ হয়ে প্রথম প্রজন্মে পুরো হাপিস হয়ে গেলেও দ্বিতীয় প্রজন্মে আবার অবিকৃত ভাবে ফিরে আসতে পারে। তাহলে গায়ের রঙের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় বা চিনাদের মধ্যে তেমনটা হল না কেন?
এর উত্তর, গায়ের রঙের পেছনে যে মেলানিন আছে তা ঠিক ওভাবে কাজ করে না। মনে করুন মেলানিন উৎপাদন করে একটা জিন। সেটা অন্য সব জিনের মতই, আপনার একজোড়া ক্রোমোজোমে দুখানা আছে। এবং, মূল ব্যাপার এই যে, তারা ডমিনেন্ট বা রিসেসিভ নয় – তারা মিলেমিশে কাজ করে। একটা যদি ৩ ছটাক আরেকটা ৭ ছটাক মেলানিন বানায়, তাহলে মিলেমিশে গড়ে আপনার দেহে ৫ ছটাক মেলানিন দেখা যাবে।
এবার ধরুন ঠিক আপনার মতই অন্য কারো সাথে আপনার মিলনে একজন সন্তান হল যে দুজনের থেকেই ৩ ছটাক মেলানিন বানানোর জিনটা পেল। তাহলে তার দেহে গড়ে ৩ ছটাকই মেলানিন উৎপন্ন হবে, এবং সে বাকিদের চেয়ে ফর্সা হবে। অতএব তার চাহিদা বাড়বে ওই পপুলেশনে, এবং ৩ ছটাক মেলানিনের জিনটাই দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, ৭ ছটাকের জিনটাকে ডাউন দিয়ে। ক্রমে সবার মধ্যেই সেটা পৌঁছে যাবে। অতএব একবার মিউটেশন হয়ে ৭ ছটাকের তুলনায় ৩ ছটাক মেলানিনের জিন উদ্ভব হলে, সেটা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে না।
(২) দ্বিতীয়ত, গায়ের রঙের উপর পুরুষদের সিলেকশনের ধরন তো দেখলাম, কিন্তু মহিলাদের এই বিষয়ে সিলেকশনের প্রবৃত্তি কী রকম? তারা যদি অন্যরকম ধারা ধরে, তবে তো ব্যাপারটা ঘেঁটে যাবে!
উত্তর: আমরা শুরুতে যা দেখেছিলাম বাঙালিদের ক্ষেত্রে, সর্বত্রই মহিলাদের সেটা সাধারণ ধারা – তারা গায়ের রঙ ইত্যাদি কম প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না, পাত্র ‘সুপ্রতিষ্ঠিত’ কিনা সেটাই সবাই চায়। অতএব পুরুষরা রঙের উপর যে সিলেকশনের ঠেলা দিচ্ছে, তাতে তাদের কোনো বাধা নেই। 
************************* 

(যদি Blogger এর নিজস্ব গোলমালে এর পরের অংশ হঠাৎ করে উবে যায়, তবে এই লিঙ্কে ক্লিক করে বাকিটা পড়ে নিন)
চট করে আরেকটা জনপ্রিয় পরীক্ষা দেখে নিন, পাঠক, নিচের ছবিটার দিকে তাকিয়ে। কোনটা ছেলের আর কোনটা মেয়ের মুখের ছবি?



সবাই বলবেন, বাঁ দিকেরটা মেয়ের আর ডান দিকেরটা ছেলের। কিন্তু কেন? যে গবেষকরা এই ছবি দু'টো বানিয়েছেন, তাঁরা একটাই ছবি নিয়ে সামান্য হেরফের করে দুটো ভার্শন বানিয়েছেন, অতএব স্পেশাল কোনো পুরুষসুলভ দৃঢ় চোয়াল ইত্যাদি ক্লু নেই আমাদের জন্য। তাহলে কী দেখে আমরা সবাই একই উত্তর দিচ্ছি? 

আরেকবার ভালো করে দেখলে আপনারা নিজেই ধরতে পারবেন, বাঁ দিকের ছবিটায় কেবল ডানদিকের চেয়ে একটু ব্রাইটনেস বাড়ানো, মানে হালকা রঙের। কিন্তু সেটাই সব নয় – আরেকটা মহাগুরুত্বপূর্ণ ক্লু, যেটা আপনার অবচেতন মন ধরতে পারলেও সচেতন মন হয়ত বলতে পারছে না, সেটা হল – ‘মেয়ে’টির ছবিতে মুখের বাকি অংশের সঙ্গে চোখ ও ঠোঁটের কনট্রাস্ট বাড়ানো। অর্থাৎ, তার মুখের বাকি অংশ ‘ছেলে’টির ছবির তুলনায় হালকা রঙের হলেও, চোখের চারপাশ ও ঠোঁট বেশি গাঢ় রঙের। দুটো ছবির ব্রাইটনেসের বিয়োগফল দেখলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার, কারণ যদি এই ‘ফেশিয়াল কনট্রাস্ট’ ব্যাপারটা যোগ না করা হয়, তাহলে কিন্তু স্রেফ হালকা-গাঢ় রঙের তারতম্য করলে লোকে ছবি দুটোয় ছেলে-মেয়ের তফাত করে না।

এইবার ভেবে দেখুন, মহিলাদের প্রসাধনীদ্রব্য ঠিক এই কাজটাই করে না কি? চোখের চারিপাশে কাজল টেনে চোখটাকে হাইলাইট করা হয়, ঠোঁটে লাল রঙের লিপিস্টিক দিয়ে ঠোঁটের সঙ্গে গালের কনট্রাস্ট বাড়ানো হয়, এবং একই সঙ্গে আরেকটা দিকও ম্যানেজ করা হয় – নিওটেনি – কারণ চকচকে, গোলাপি-লাল ঠোঁট হচ্ছে, ‘কচি ঠোঁট’ যাকে আপনি সারারাত চুম্বন করে করে লালা-চা পান করতে লোলুপ থাকেন, তারই ইঙ্গিত। আর গালে স্নো (ট্যালকম পাউডার) বা ব্লাশ দিয়ে যে হালকা রঙের rosy cheeks আনতে চান, সেটাও কিন্তু এই ব্যাপার – গালের ব্রাইটনেস বাড়ানো আর একই সাথে শিশুসুলভ টোপাটোপা নরম লাল গাল আনার চেষ্টা।

অর্থাৎ মেক-আপ আর কিছুই নয়, এই ‘নারীসুলভ’ ফিচারগুলো হাইলাইট করে যৌবনবতী সাজার চেষ্টা। আর এগুলো বেশি করে চোখে পড়ে মানে দৃষ্টিকটু হয় যখন বৃদ্ধারা তেড়েফুঁড়ে মেকাপ করেন – নিচের সোফিয়া লোরেনের ছবিটা দেখলেই প্রতিটা ফিচার খুব স্পষ্ট নজরে পড়বে। অনেকে তো এত টকটকে লাল ঠোঁট বানান যে পরশুরামের ভাষায় যেন ‘তাড়কা রাক্ষসী সদ্য ঋষি খেয়েছে’।



 তাহলে, গায়ের রঙের ইতিহাস খুব সংক্ষেপে:



মধ্য (সাব-সাহারান) আফ্রিকায় নানা কারণে আদিম মানুষ ও গ্রেট এপ-দের মধ্যে ন্যাচারাল সিলেকশনের জন্য কালো রঙ এক্কেবারে ফিক্সড। কিন্তু তারা যখন উত্তরদিকে মানে এশিয়া মাইনর/আরবে এবং তা থেকে আরো উত্তর-পশ্চিমে ইউরোপ এবং উত্তর-পূর্বে মধ্য/পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল, তখন সেই ফ্যাক্টরগুলোর চাপ কমে যাওয়ায়, পুরুষদের হালকা রঙের প্রতি আকর্ষণ জনিত কারণে পপুলেশনে হালকা চামড়ার অনুপাত বাড়তে লাগল, এবং ক্রমে রানঅ্যাওয়ে সেক্সুয়াল সিলেকশনের ঠেলায় গোটা পপুলেশনেরই চামড়ার রঙ বদলে যেতে লাগল। এরই মাঝপথে, মধ্য/পূর্ব এশিয়া থেকে হালকা বাদামি চামড়ার লোকজন পলিনেশিয়া/অস্ট্রেলিয়া ও বেরিং প্রণালী হয়ে আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এবং সেক্সুয়াল সিলেকশন একটা প্রবল শক্তি বলেই, তারা আবার ক্রান্তীয় অঞ্চলের কাছাকাছি ফিরে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের গায়ের রঙ আবার ঘন কালো হয়ে যায় নি। শুরুর ওই ছবিটায় ব্রাজিল ইত্যাদি অঞ্চলে তাকিয়েই দেখুন না। 

এবং পুরুষেরা একাধিক কারণে হালকা রঙের প্রতি আকৃষ্ট। তার একটা হল বৈচিত্র্য কামনা, তা আগেই বলেছি। তাই আজকালকার সায়েব সমাজে আবার গমরঙা ভারতীয়/ল্যাটিনা নায়িকাদের ভারি কদর। আরেকটা হল, যথারীতি, নিওটেনি – বাচ্চারা যখন জন্মায়, তখন তাদের গায়ের রঙ কেমন ফুটফুটে গোলাপি থাকে, কিন্তু বয়সের সাথে সাথে গায়ের রঙ কালোতর হতে থাকে। তাই হালকা রঙও কচিত্বের লক্ষণ – বস্তুত, সিলেকশনের ঠেলা এমনই, মেয়েরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে নারী-হরমোনগুলোর প্রভাবে তাদের রঙও সামান্য হালকা হয়, চামড়ায় ফ্যাট বাড়ার কারণে। আবার অবস্থাগতিকে মেয়েদের মাঠেঘাটে কাজ করা কমল আর বাসায় থাকার দায় বাড়ল, তাই তাদের রোদেজলে খাটার অর্থাৎ মেলানিনের সুরক্ষার প্রয়োজনও কমল (যারা মাঠেঘাটে খাটে, তাদের চামড়া ট্যান হয়ে যায়, দেখেননি?)। সব মিলিয়ে, প্রতিটি জনগোষ্ঠীতেই মেয়েদের গড় মেলানিনের পরিমাণ পুরুষদের চেয়ে বেশ খানিকটা কম, মানে তারা বেশি ফর্সা। 


পার্ট – ৩
লেখাটা ইতিমধ্যেই অনেক লম্বা হয়ে গেছে, কিন্তু রঙের প্রসঙ্গে এসে চুলের/চোখের রঙের কথাটা না বলা অন্যায়ই হবে। তাই অল্প করে আলোচনা করি।


কটা চোখ বা ‘বেড়ালচোখ’ এর সঙ্গে আমরা সবাইই অল্পবিস্তর পরিচিত আমাদের দেশে, না হলেও বিদিশি নায়ক-নায়িকা যেমন এলিজাবেথ টেলরের ঘন নীল চোখ বা কেট উইন্সলেটের সবুজ চোখ সকলেই চেনেন। 
একাধিক জিন এর পেছনে দায়ী, তবে সংক্ষেপে বলা যায়, আমাদের চোখের মণির যে ঘন খয়েরি, প্রায়-কালো রঙ, তাও আসে সেখানে জমা মেলানিন থেকেই। কারো চোখে মেলানিন কম উৎপাদিত হলে হালকা বাদামী (honey/olive বলে ইঞ্জিরিতে), আর একদমই না হলে ধূসর/নীল/সবুজ, অন্য কিছু পদার্থের হেরফেরে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, কেন আমাদের এদিকে প্রায় সবারই চোখ কেবল কালো, আর রঙিন চোখ কেবল উত্তর ইউরোপের ফর্সা সায়েবদের মধ্যেই দেখা যায়। ইউরোপে ওই জিনগুলোয় মিউটেশন শুরু হবার পর, পুরুষদের বৈচিত্র্যের লোভের টানে পপুলেশনে ছড়িয়ে পড়ে ভালোরকম, সেই পুরনো গল্প।

(আর ইয়ে, চোখের রঙ তাই মোটাদাগে মেন্ডেলের সূত্র মেনে চলে, যেখানে নীল রঙ হল রিসেসিভ। বুঝতেই পারছেন, আপনার দু কপি জিনের প্রতিটাই যদি চোখকে মেলানিন দিতে গররাজি হয় তবেই চোখের নীল রঙ আসবে।)


রঙিন চোখের ক্ষেত্রে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ফিচার খুব সহজে ধরা পড়ে। মণির চারপাশে একটা কালো বর্ডার দেখতে পাচ্ছেন? ওইটাকে বলে লিম্বল রিং। বাচ্চা বয়সে বেশি থাকে, বয়স বাড়লে সেটার ঘনত্ব কমে যেতে থাকে। এইটাও নিওটেনির ইঙ্গিত, এবং তাই আমরা বিবর্তিত হয়েছি লিম্বল রিংকে পছন্দ করতে করতে। এতটাই, যে নকল রিং-ওয়ালা কনট্যাক্টও বিক্রি হয়, চোখের সৌন্দর্য বাড়াতে!
 ************************* 


চুলোচুলি করে শেষ করি। চুলের রঙও আসে মেলানিন থেকেই, তাই চোখেরই মত, মূলত উত্তর ইউরোপিয়ান মেলানিন-অভাবী সায়েবদের মধ্যেই ব্লন্ড-প্ল্যাটিনামব্লন্ড- ব্রুনেট এইসব দেখা যায়। (ব্রুনেট বলতে এরা কখনও খয়েরি, কখনও গাঢ় খয়েরি, প্রায়-কালো বোঝায়, পাঠক একটু সাবধান থাকবেন।)
মোটামুটি, চোখের মতই, স্ক্যান্ডিনেভিয়া/উত্তর ইউরোপের বাইরে চুলের রঙের বৈচিত্র্য দেখা যায় না। কারণ, যদি শুরুতে কোনো ওইরকম মিউটেশনের উদ্ভব না-ই হয়, সিলেকশন কাজ করবে কী করে? তবে, চুলের ক্ষেত্রে ওরকম নতুন মিউটেশনের উদ্ভব অন্তত দুবার দেখা গেছে, যেখানে সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল, অবশ্যই লুল্পুরুষদের ঠেলায়। এক হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে পলিনেশিয়া বিশেষত পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ব্লন্ড চুলের একটি ধারা, যা ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আর দ্বিতীয়, ব্রিটেনের উত্তর অংশে লাল চুলের উদ্ভব (শার্লক হোমসের বিখ্যাত গল্পটা মনে আছে নিশ্চয়ই?)।


 ************************* 
পাদটীকা:
(১) এবারও যা দেখা গেল, রং-সংক্রান্ত সিলেকশনেও মূলত পুরুষদেরই দাপাদাপি। সেক্সুয়াল সিলেকশনের মধ্যে নারীরা কীভাবে প্রভাব ফেলে, তার ঠেলায় ‘নারী চরিত্র বেজায় জটিল’ থেকে ‘স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা না জানন্তি’ এতসব প্রবাদের উদ্ভব কেন, পরের পর্বে দেখব নাহয়।(২) Social stereotypes create their own reality – কথাটা বড় খাঁটি!

এই লেখা আগে সচলায়তনে লেখকের নিজের ব্লগে প্রকাশিত। এখানে আবার লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হলো।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই