Thursday, February 23, 2012

আ মরি বাংলা ভাষা -- শিবাশিস

ইয়ে  ফেভিকল্‌কা মজ্‌বু জোড়্‌ হ্যায়...

          ছোবেলায় যখন বাংলামাধ্যম স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের কাছের কিছু চেনা-পরিজনেরা আমার বাবা-মাকে বলেছিলেন যে,  "ছেলেটাকে ইংলিশ মিডিয়ামে দিলে পারতে, তাহলেই
ভবিষ্যতে কোনো না কোনো চাকরি পাকা "। কলেজ জীবনে যখন সেন্ট জেভিয়ার্সে ঢুকলাম, তখন সেইসব চেনা-পরিজনেরা আমাকে বলেছিলেন, " সাবধান , ওই কলেজে কিন্তু
সবকিছু ইংরেজিতে হয় , তুই ধরতে পারবি তো?"  তারপর যখন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে চলে গেলাম , তখন তাঁরা কি বলেছিলেন ঠিক মনে নেই। আর সাড়ে চার বছর আগে যখন একেবারে দেশের বাইরে চলে এলাম তখন তারা মনে হয় ঠোঁটে ফেভিকল্‌ আটকে বসে ছিলেন। 
  
ভাষা এমন কথা বলে বোঝেরে সকলে... 

         ভাবা যায় আজ থেকে ঠিক ষাট বছর আগে এই দিনটিতে কি ঘটনাই না ঘটেছিল ! "ভাবা যায়" লিখলাম এই কারণে যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের মাতৃভাষা কতটা মাতৃদুগ্ধের সমান এই নিয়ে কমবেশি আমরা সবাই ধন্ধে পড়েছি। আমার নিজের ক্ষেত্রেই আমি বলতে পারি যে এ ব্যাপারে আমি খুবই কন্‌ফিউজ্‌ড। দেখলেন তো, হঠাৎ করে কিরকমভাবে একটা ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে গেলো আমার লেখায়। এটাই হচ্ছে মুশকিল। বাংলায় কথা বলতে বলতে আমার অজান্তেই আমি ইংরেজি, হিন্দি ইত্যাদি ভাষার শব্দ হর্‌দম্‌ ব্যবহার করে থাকি। আবার যখন বাংলায় লিখতে যাই তখন আমি যেরকমভাবে কথা বলি ঠিক সেরকমভাবেই লিখতে চেষ্টা করি আর তার ফলে অনিবার্যভাবেই অন্য ভাষার শব্দরা আমার মাতৃভাষার কাঁটাতার লঙ্ঘন করে। দীর্ঘ দশবছর পশ্চিমবঙ্গের (পড়ুন কলকাতার) বাইরে থাকার ফলে হয়তো এই অভ্যাসটা বেড়ে গেছে কিন্তু কলকাতায় থাকাকালীনও যে খুব শুদ্ধভাবে বাংলা বলতাম বা লিখতাম তাও তো মনে পড়ে না। এও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে অনেকসময়েই আমি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যভাষার শব্দ ব্যবহার করি , হয়তো একটু সতর্ক হলে সেটা এড়ানোও যায় কিন্তু তা আমি করি না। এর মানে কি আমি আমার মাতৃভাষাকে ভালোবাসিনা? নিজেকে বারবার এই প্রশ্ন করেছি , কিন্তু আমার উত্তর আমাকে হতাশ করেনি। নিজের জন্মস্থান থেকে বহু দূরে বসে আমি বাংলাভাষা চর্চা করি আর তাতে যদি আমার আশেপাশের মানুষজনের ভাষা কিছুটা হলেও আমাকে প্রভাবিত করে তাতে আমার মাতৃভাষার কোনো ক্ষতি হয় বলে আমি মনে করি না। জো করে , অন্য কোনো ভাষার শব্দ ব্যবহার না করে , খুব সতর্ক হয়ে বাংলায় লেখা বা কথা বলা হয়তো এ জন্মে আমার আর হবে না, কিন্তু তা বলে যখন দেখি কেউ আমার ভাষাকে বিকৃত করে লিখছে বা বলছে তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। কলকাতায় গেলে যখন আমার বাঙালি বন্ধুরা তাদের বাঙালি বন্ধুদের সাথে আমার পরিচয় করায় ইংরেজিতে আর সেই নতুন আলাপ হওয়া ছেলেটি বা মেয়েটি যখন আমার সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলতে থাকে (কি কারণে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, আমেরিকাতে থাকি বলে কি এমন হনু আমি যে আমার সাথে উৎকট আমেরিকান অ্যাক্‌সেন্টে কথা বলতে হবে?) তখন খুব অবাক হয়ে আমি বাংলাতেই উত্তর দিতে থাকি, তাই স্বভাবতই আমাদের মধ্যে কথোপকনটা খুব একটা বেশিদূর এগোতে পারে না। আবার দুজন বাঙালি ছেলে নিজেদের মধ্যে যখন ইংরেজি বা  হিন্দিতে গল্প করে তখন যদিও আমার খুবই হাসি পায়, কিন্তু এওতো সত্যি যে বাঙলি বলেই যে তাদের মাতৃভাষাতেই গল্প করতে হবে, এই মাথার দিব্যিও তারা দেয়নি। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাইরে বেরোলে আমাদের অন্য ভাষায় কথা বলতেই হবে কিন্তু তা বলে নিজের বা অন্যের ভাষার অসম্মান ঘটানো কোনোরকম ভাবেই কাম্য নয়, যেমন নয় নিজের ভাষা নিয়ে বড্ড বেশিরকমের কোনো বাড়াবাড়ি করাও।
  
বলা বার...

            আমাদের পাড়ার রতনদার বইয়ের দোকানে আমরা প্রায় প্রতিদিন আড্ডা মারতে যেতাম। বইতো বেশি কিনতে পারতাম না কিন্তু ওই আড্ডার ছুতোয় বেশ কিছু বই ওখানেই পড়ে নিতাম। রতনদা মানুষ খুব ভালো ছিলেন কিন্তু আমাদের এইরকমের বেয়াদবিতে খুব রেগে যেতেন মাঝে মাঝে। আর আমরাও রতনদাকে খচাতে খুব ভালোবাসতাম , বলা যায় ওটাই ছিলো আমাদের ফেভারিট্‌ পাস্‌ টাইম্‌। একদিন রতনদাকে খুব গম্ভীরসে জিগ্যেস করেছিলাম, "রতনদা, বর্ণপরিচয়ের মানে বইটা এসেছে নাকি? একটু দেখাও তো?" এর উত্তরে রতনদা কি বলেছিলো তা এখানে নাই বা বললাম, কিন্তু ভয় হয়, সত্যি সত্যি এরকম দিন আসবে না তো? রতনদার মতো কারুর কাছে আমারই মতন কেউ এইরকম প্রশ্ন করবে আর ভবিষ্যতের রতনদা সেই আগামিদিনের আমিকে ঐ বিশেষ বইটি এগিয়ে দেবে কোনো কিচ্ছু না বলে আর কোথা থেকে একটা পুরোনো (বেশি পুরোনো?) দিনের বাংলা গান ভেসে আসবে - "...বলা বার..."।      

পুনশ্চ: কিছু ইংরেজি, হিন্দি ইত্যাদি শব্দ ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে আমার লেখাটিতে ঢুকে পড়েছে, আজকের এই বিশেষ দিনে যেটা ঠিক সমীচীন নয়। কিন্তু এ দোষ সম্পূর্ণ আমার, তাই এ জন্য আমায় যত পারেন গালি দিতে পারেন, ওদেরকে দয়া করে কিছু বলবেন না।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই