Thursday, February 23, 2012

প্রশ্নবাণ -- রোদ্দুর

ভদ্রলোকের পুরো নাম প্রকাশ করতে পারছিনে, দুঃখিত! তিনি হতভাগ্য লেখকের আশেপাশেই থাকেন কিনা, তাই লেখাটি জনগণের ঔদার্যে ভদ্রলোকের গোচরে
এলে লেখকের জীবন সংশয় হলেও হতে পারে। তাই ভদ্রলোকের অপার অনন্ত জ্ঞানপিপাসার কথা মাথায় রেখে তাঁকে শ্রীমান প্রশ্নবাণ নামেই সম্বোধন করব।

প্রশ্নবাণের সাথে আমার পরিচয় মাস ছয়েক আগে, জানুয়ারি মাস নাগাদ। হঠা শুনি কিনা আমাদের সকলকে একটি বাধ্যতামূলক কোর্স করতে হবে, না করলে পি-এইচ-ডি রেজিস্ট্রেশন করা যাবে না। কি আর করা, নাম লেখালুম কোর্সে...
আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে আমি, শুকতারা এবং আরও একজন নবাগত যার সাকিন-ঠিকানা জানিনে, কেবল শুনলুম বিবাহিত, চাকুরে (মেদিনীপুরের একটি কলেজে লেকচারারের পদ পেয়েছেন, কিন্তু কাজে যোগদান করেননি এখনও) এবং পার্টটাইম গবেষণায় আগ্রহী, তাই আমাদের ইন্সটিট্যুটে যোগ দিয়েছেন। ক্লাস শুরু হবার কথা দিন কয়েক পরেই, ভাবলুম তখনই আলাপ হবে। কিন্তু...

একদিন ভোরবেলা, মানে ওই সকাল সাতটা নাগাদ সবে লেপটা টেনে নিয়ে পাশবালিশটা আঁকড়ে ধরেছি, এমন সময়ে টের পেলুম, কি যেন কাঁপছে! বড়রাস্তার উপরে বাড়ি হবার দৌলতে রাত্তির বেলা যখন মালবোঝাই বিশাল লড়িগুলো ভীমবেগে বাড়ির সামনে দিয়ে যায়, তখন খাটটা কেঁপে ওঠে। এই কম্পনের সঙ্গে আমি পরিচিত; বছর তিনেক আগে যখন প্রথম এসেছিলুম এ বাড়িতে, তখন চমকে চমকে উঠতুম। এখন বড়জোর পাশ ফিরে শুই। কিন্তু সে কাঁপুনি আর এ কাঁপুনি কোথায় যেন আলাদা...। যদি ভূমিকম্প হয়, তাতে বাড়িটা যদি ভেঙ্গে পড়ে, আর সেই বাড়ির তলায় যদি আমি চাপা পড়ি তাহলে কপালে দুঃখ আছে। মা আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না। আর বাবা ত্যাজ্য করলেও করতে পারে। তাই ঘোরতর অনিচ্ছে থাকলেও উঠে বসতে বাধ্য হলুম। কিন্তু ভূমিকম্প কই? আমার বিছানার কিয়দংশ বাদে কই, আর কিছু তো কাঁপছে না? এই কাঁপুনির উত্স নিঃসন্দেহে আমার চলভাষ এবং কোন অর্বাচী অকালকুষ্মাণ্ড এই অসময়ে আমাকে স্মরণ করছেন কে জানে। পরিচিতরা সকলেই জানে সকাল সাতটায় আমি দ্বিতীয় রাউন্ড ঘুমের জন্যে প্রস্তুত হই। একথা জেনেও যে আমাকে ফোন করবার দুঃসাহস রাখে সে যে কে তা জানতে কৌতূহলও হচ্ছিল। লেপ-কম্বলের বিস্তার থেকে আমার চলভাষখানি খুঁজে বের করবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু পেলুম না। একি রে বাবা...গেল কোথায়? এবারে খাট থেকে নামতে বাধ্য হলুম, বাইরে থেকে সিস্টেমটাকে না দেখলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। শেষে বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরে তেনাকে আবিষ্কার করলুম খাটের এককোণে পড়ে থাকা আমার আধময়লা জীনস্‌-এর পকেট থেকে। ক্ষিপ্র হাতে ফোন রিসিভ করলুম, “হ্যালো?”
অ্যাই, কবে থেকে ক্লাস শুরু গো? আমাকে একটু বলোনা, প্লীজ্‌...”
হতভম্ব হয়ে গেলুম। পুরুষকন্ঠ, এবং এ গলা আগে কখনও শুনিনি। অসময়ে ঘুমভাঙ্গা মাথা তখনও ভারী হয়ে ছিল, তাকে ঝাঁকিয়ে হালকা করে চোখ কচলে গলা খাঁকরে আবার বললুম, “হ্যালো?”
হ্যাঁ, ক্লাস কবে থেকে শুরু?”
নাহ্‌, ভুল শুনছি না। কাক ডাকা ভোরে কেউ আমাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে ক্লাস কবে জিজ্ঞেস করছে। এরকম তো হত সেই ইস্কুলে পড়বার সময়ে, বহুদিনের অনভ্যাসে প্রশ্নটাই ভুলতে বসেছিলাম। যাহোক, বললুম, “জানিনা তো...!”
অ্যাই জানলে আমাকে একটু জানিও না, প্লীজ্‌...!”
কাতর আবেদনে মনটা কেমন জানি নরম হয়ে পড়ল...কিন্তু চলভাষের অপর প্রান্তে কে তা তো জানা দরকার...জিজ্ঞেস করেই ফেললুম, “তুমি, মানে আপনি...কে বলছেন?”
আমি প্রশ্নবাণ। রিতমদা তোমার নম্বরটা দিল আমাকে...”
রিতমদার সেদিন নির্ঘাত গলায় মাছের কাঁটা আটকেছিল...এত্ত অভিশাপ অনেকদিন কাউকে দিইনি!

যাই হোক, একদিন দেখাও হয়ে গেল। আমার দ্বিগুণ মোটা, মাঝারি উচ্চতা, একটা বেশ পুরুষ্টু ভদ্রলোকোচিত গোঁফও আছে। চোখেমুখে বিবাহিত সুখী গৃহস্থের তৃপ্তি। প্রথমদিনেই টের পেলুম তার অদম্য জ্ঞানপিপাসার কথা। শুভ্র যদি প্রশ্নবাণকে চিনত তাহলে অসময়ে আজেবাজে প্রশ্ন করবার জন্যে তাকে নোবেল দেবার দাবী করত নির্ঘাত। এক ঘণ্টার ক্লাসের মধ্যে যতবার সে বাঁদিকে ঝুঁকে পড়ে আমাকে প্রবল অস্বস্তির মধ্যে ফেলে “অ্যাই তুমি কি ফোরট্রান জানো?” জাতীয় প্রশ্ন করল, তা দেখলে অনেকেরই আমাদের মধ্যের সম্পর্কটা নিয়ে সন্দেহ হবার কথা। বিশেষ করে আদালতের রায়ে সমস্ত বিধিনিষেধ উঠে যাবার পরে...শুকতারাকে আমি দোষ দিই না, ওতো শুধু প্রশ্নবাণের ঝুঁকে পড়া দেখেছে, প্রশ্নগুলো তো শোনেনি!   

একদিন একটু বেলার দিকে ইন্সটিট্যুট গেছি, ঘরে ঢোকা মাত্র শুকতারা আমাকে তেড়ে মারতে এল। সকাল সকাল এমন হিংসার কারণ জিজ্ঞাসা করলুম। শুকতারার ভয়ঙ্কর ক্রোধ সামান্য প্রশমিত হলে জানতে পারলুম যে শুকতারা অন্যান্য দিনের মত অনেক সকালে এসে যথারীতি নিজের জায়গায় বসে ফোন এবং চ্যাটের মাধ্যমে জনসংযোগে মনোনিবেশ করেছিল। কিছুক্ষণ পরেই  প্রশ্নবাণের আবির্ভাব হয় এবং সে শুকতারাকে প্রশ্ন করে, “অ্যাই, তোমার হাসব্যান্ড কি করে?” অবিবাহিত শুকতারা হ্যাসব্যান্ডের অবর্তমানে যারপরনাই লজ্জিত হয়ে নাকি পাক্কা এগারো সেকেন্ড কথা বলতে পারেনি। ঘটনা শুনে আমিও বাকরুদ্ধ, রোমাঞ্চিত এবং উত্তেজিত। কিন্তু শুকতারার আমার উপরে ক্রোধের কারণটা বোঝা গেল না...তাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, “ও তো এরকম প্রশ্ন করেই থাকে, তার জন্যে আমাকে আক্রমণ করবার কারণ কি একটু বুঝিয়ে বলবি?
শুকতারা রাগে বেগুনী হয়ে গিয়ে বললে, “তোর জন্যেই তো! ও বললো তুইই নাকি ওকে বলেছিলি যে আমার আসলে বিয়ে হয়ে গিয়েছে”।
এবারে মাথার মধ্যে একটা ষাট ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠল। মনে পড়ে গেল মাস খানেক আগের এক রোদঝলমলে দিনের কথা। আমি আর প্রশ্নবাণ হাঁটছিলুম আমাদের ইন্সটিট্যুটের বাগানের রাস্তা ধরে, শুকতারা আসছিল পিছন পিছন। তখন আমি নেহাত মজা করবার জন্যে এবং প্রশ্নবাণের প্রশ্ন বন্ধ করবার জন্যে অন্য কোনও বিষয় খুঁজে না পেয়ে শুকতারার সঙ্গে মজন্তালি নামক বিড়াল বাহাদুরের সদ্যবিবাহের কথা জনান্তিকে ব্যক্ত করেছিলাম (এ বিষয়ে বিশদে জানতে হলে শুকতারার সঙ্গে যোগাযোগ করুন)। এবং দুঃখও করেছিলাম এই বলে যে কঞ্জুসির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে শুকতারা আমাদের সকলকেই বিয়ের ভোজ থেকেও বঞ্চিত করেছে। এই উত্তেজক সংবাদ শুনে প্রশ্নবাণ মিনিট দু-এক চুপ করে ছিল এবং আমি কিঞ্চিত আরামে ও স্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু সেই দু-মিনিটের স্বস্তির এই ফল যে শুকতারাকে ভোগ করতে হবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।  

এই তো সেদিনকে, একটি বেজায় বাজে ক্লাস করতে গেছি। দুঘণ্টা বসে থাকতে হবে, অথচ কিচ্ছু লাভ হবে না। কাগজপত্র নিয়ে গেলুম, বসে বসে পেপারের ক্যালকুলেশন করছি আর ভাবছি কখন শেষ হবে। কখন যেন প্রশ্নবাণ এসে পাশে বসেছে, লক্ষ্য করিনি। হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিসানি শুনে চমকে উঠলাম, “অ্যাই, এটা কি দেখে লিখছ তুমি?” তাকিয়ে দেখি প্রশ্নবাণ উদ্‌গ্রীব হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অস্বস্তি চেপে বললুম, “কি দেখে মানে? আমার নিজের পেপারের কাজ এটা, কি দেখে করব আবার?” বলে ফের ক্যালকুলেশনে মন দিলাম...খানিক বাদে আবার চমকে উঠলাম। না, এবারে আর ফিসফিসানি শুনে নয়, ফিসফিস করে করা প্রশ্নটা শুনে, “অ্যাই, তুমি সামনের সপ্তাহে একবার আমার সাথে ওখানে যাবে?”
ভীষণ আতঙ্ক আর অস্বস্তির সাথে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”
আমার ওখানে।”
মানে?”
আমার কলেজের ওখানে, আমি একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি তো... অ্যাই, যাবে?”
ঘেমে গেলাম। কোনও রকমে প্রশ্ন করলাম, “কেন?”
আমার ডেস্কটপে উবুন্টু ইন্সটল করে দেবে। যাবে?”

প্রায় প্রত্যেকদিন সকাল সাতটায় টেলিফোনের ঘণ্টি বাজা নিয়ম হয়ে গেছে। ফোন বাজলেই বুঝতে পারি প্রশ্ন আসছে এবং কানে বালিশ চেপে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ি। নম্বর সেভ না করে রাখার একটা অত্যন্ত বাজে স্বভাব আমার আছে। কিন্তু তার যে কতরকম বিপদ হতে পারে তা এবারে বুঝতে পারলুম। সকালবেলাটা বাদ দিলেও সারাদিনে যে সমস্ত ফোন আসছে তার সব তো আর না ধরে থাকতে পারি না। বিশেষ করে এই করতে গিয়ে দুদিন স্যারের ফোন ধরিনি বলে স্যার বেজায় চটে আছেন। রোদ্দুর ফোন ধরছে না বলে হাইকম্যান্ডের (পড়ুন মা ও বাবার) কাছে রিপোর্ট যাচ্ছে। তাই নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রশ্নবাণের নম্বরটা সেভ করে নিলাম। এর ফোন আর ধরা যাবে না...কিছুতেই না। একদিন গেল, দুদিন গেল...সকাল সাতটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত প্রথমদিন মিস্‌ড কল হল বারো টি, দ্বিতীয়দিন একুশটি। রাত্তিরের দিকে ফোন আসে না। পরে বুঝেছি এর কারণ। বিবাহিত পুরুষ দিনান্তে বাড়ি ফিরে কাউকে ফোন করবার স্বাধীনতা সব সময় পান না। তৃতীয়দিন দুপুর বারোটার মধ্যেই এগারোটি মিস্‌ড কলের পরে ওয়ার্কস্টেশনের ফোন বেজে উঠল। ডিপার্টমেন্টের একজন ধরলেন, “হ্যালো?”
“......”
হ্যাঁ, আছে। দিচ্ছি...এই রোদ্দুর, তোমার ফোন!”
নির্দ্বিধায় উঠে গেলুম ফোন ধরতে। এখানে অনেকে ফোন করে, স্যার তো করেনই। তাই চটপট ধরে বললুম, “হ্যালো?”
ওপাশ থেকে ভেসে আসা প্রবল কাতরোক্তি গোটা ওয়ার্কস্টেশনে  ধ্বনিত হল, “অ্যাই, তুমি ফোন ধরছ না কেন গো?”
  
একটি কথাও বানিয়ে বললুম না। বিশ্বাস না হয়, শুকতারাকে জিজ্ঞেস করুন!
    

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই