পৃথিবীর এই গোলার্ধে এখন গভীর রাত। আর কিছুক্ষণ
পরেই সাত সকালের আমন্ত্রণে এই গোলার্ধে
কিছু সংখ্যক মানুষ জেগে উঠবেন। গত ক'দিন এই পৃথিবীর মানুষ মেতে ছিলেন ভালবাসায়। ব্যতিক্রমও ছিল। কোথাও পুড়েছে ভালবাসার ছবি আবার কোথাও, শুধু ভালোবাসাবাসিরা মাখামাখি করেছে প্রথম বসন্তে।
প্রেম আর মৃত্যুর এক অপূর্ব গন্তব্য। সত্যজিৎ
রায়ের পথের পাঁচালির সেই অপূর্ব দৃশ্য, রেললাইনে কান পেতে ট্রেনের দূরত্ব মাপা।
আহা, সেই মেয়েটির দু'বুকের মধ্যে দূরত্ব কতটা ছিল কে জানে! রেললাইনে ঝাঁপিয়ে পড়তেও
নাকি এর চেয়ে কম সময় লেগেছিল তিস্তার, লাইভ টেলিকাস্টে তার
চেয়েও কম সময় লেগেছিল।
কিছু সংখ্যক মানুষ জেগে উঠবেন। গত ক'দিন এই পৃথিবীর মানুষ মেতে ছিলেন ভালবাসায়। ব্যতিক্রমও ছিল। কোথাও পুড়েছে ভালবাসার ছবি আবার কোথাও, শুধু ভালোবাসাবাসিরা মাখামাখি করেছে প্রথম বসন্তে।
ভালবাসা দিবসের প্রথম প্রহরে সংবাদ শিরোনামে
তিস্তা...। হৃদয় কৃষ্ণ লেইনের মেয়েটি কুরবানি দিয়েছে রেল লাইনে নিজেকে। তিস্তা
হৃদয়, কাজল চোখ, কিছুই বাঁচানো যায়নি।
সময় মতো ভূগোলটা জানলে সংরক্ষণ করা যেতে পারতো
কলকাতা মিউজিয়ামে। 'সুইসাইড ডে', সারাবছর ধরেই উদযাপন হয় এই পৃথিবীতে।
সুইসাইড নোটে সেই পরিচিত লাইন,
'আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমাকে ক্ষমা
করে দিও...। ইতি, তোমাদের তিস্তা।'
করে দিও...। ইতি, তোমাদের তিস্তা।'
বাঙালি সংস্কৃতিতে এই ফেব্রুয়ারি মাসটি যেন
বিশেষ গাম্ভীর্যের মাস। এতো আদিখ্যেতা কোন ভাষা নিয়ে কোন কালে কোন জাতি করেছে কিনা
জানিনা। অনেকটা কার্ল মার্ক্সের কম্যুনিজমের মতো। সহজ সরল তত্ত্ব,
শ্রেণী সংগ্রাম। কোন বৈষম্য চলবে না। সবাই সমান, সবাই রাজা সবার দেশে। প্রদেশ
একটি, দেশ একটি। কিছু কিছু শ্রদ্ধেয় কমরেড আজকাল এই সহজ সরল তত্ত্বটিকে
জটিল করে দিয়েছেন। আজ সারা বিশ্বজুড়ে মার্ক্সের বড্ড অকাল, ঐ সুইসাইড নোটের মতো।
অথচ কার্ল মার্ক্স এতোটাই রোম্যান্টিক ছিলেন যে, জেনি আর নিজের প্রেম সম্পর্কিত
জীবনদর্শন থেকেই সৃষ্টি করেছিলেন মার্ক্সীয় তত্ত্ব।
মানুষের ভাষাতো মাতৃ জঠরেই ভ্রূণ হয়ে জন্ম নেয়। পৃথিবীর
এতো মায়ের 'ভ্রূণদিবস' পালন করার সময় আছে কি বাঙালির! মৈথিলী, অহমীয়া, ককবরক,
উর্দু, পালিতেও আজকাল বাঙালি অভ্যস্ত।
ক্যালেন্ডারের পাতায় কোন দিবসের জন্য আজ আর কোন স্থান নেই কিন্তু।
আরেকটি কাঁচ ভাঙ্গার খবর দিই। শুধু মার্ক্সীয়
কিছু নীতিবাগীশের কারণেই পঁয়ত্রিশটি শিশু চব্বিশ ঘণ্টা ধরে
মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছে ত্রিপুরার পাহাড়ে এই ভালোবাসার মাসে। আজ পাহাড়ের উপর
যাবতীয় ক্ষোভ উগড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। গত দুই দশক ধরে ত্রিপুরার পাহাড়ের শিক্ষা,
স্বাস্থ্য উন্নয়নে তালা দিয়েছিল কিছু ভূমিপুত্র। সবার স্বাধীন রাজ্য চাই, দেশ চাই।
কিছু মানুষ তালিবানের সঙ্গে ভালবাসাবাসি করে আবার নতুন জিগির তুলছে, স্বাধীনতা
চাই। এই গৃহযুদ্ধ পৃথিবীর প্রায় সব প্রদেশেই। সবাই চায় স্বাধীনতা। পৃথিবী কতবার
টুকরো হবে! ভালোবাসার মাসটি আরও কতবার আহত হবে কে জানে!
ভালোবাসেনা কে?? খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলমান
সবার যেন ভালো না বেসেই বাচ্চা হয়ে যায়!
তবে বাঙালি একটু বেশিই ভালোবাসাবাসি করেন। তাই
আজকাল বিচ্ছেদের পাহাড়ে জবুথবু স্বয়ং দার্জিলিং। এতো কান্না বাঙালি মেয়ের, যে
বঙ্গোপসাগর নাকি জলে থইথই। তিস্তার শরীর নিয়ে টানাটানি চলছে। তিস্তার জন্য খারাপ
লাগে। যুবতি তো হোক, তারপর নাহয় ভোগে লাগুক! চিকিৎসা দরকার তিস্তার। পেটে পাথর
হয়েছে। এখন গর্ভবতী হলে মেয়েটির বিপদ আরও বেড়ে যাবে। কে শোনে কার কথা! দুই পুরুষ
ধরে সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিস্তার দখল চাই! একই খাদ্য, একই ভাষা, একই
কথা বলে এই মানুষেরা। কিন্তু শুধু পৌরুষ জাহির করার জন্যেই তিস্তা চাই। পৃথিবীর
বহু ভাষা হারিয়ে গেছে। বহু ধর্ম হারিয়ে গেছে, কিন্তু রসগোল্লা হারায়নি।
বাঙালি গোগ্রাসে রসগোল্লা মুখে দিয়ে চোখের
পিচুটি মোছেন, হাত চালান করেন প্যান্টের পকেটে।
ত্রিপুরার পাহাড়ের ত্রিশ থেকে চল্লিশটি শিশু
জেট্রোফা ফল খেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল গত ক'দিন। এদের পাহাড়ি ভাষা বোঝেনি বাঙালি চিকিৎসক, নেতা, মন্ত্রী কেউই। একজন মাত্র
চিকিৎসক বুঝতে পেরেছিল খিদেয় জর্জরিত এই শিশু গুলি ইস্কুল পালিয়ে খেয়েছে বিষাক্ত
জেট্রোফা ফল। এই দিনটির জন্যও একটি বিশেষ দিন নির্ধারিত হোক। 'শিশু ক্ষুধা দিবস' এই
মধুমাসে! বিষাক্ত মদ খেয়ে যে মানুষগুলি মারা গেছেন, তাঁরা আজ সাদা কালো।
এক্সক্লুসিভ একটা খবর দিয়ে রাখি, এই বঙ্গদেশের
সর্বহারা মানুষ আবারও বিষাক্ত মদ খেয়ে পেট ফুলিয়ে মরতে চাইছেন, বেঁচে থাকলে এই
অর্থ পাওয়া যাবে না, যে দরদ পাওয়া যায় মদ খেয়ে মরলে। মদ, সরকার, অর্থ, বেঁচে থাকা,
ঋণমুক্তি, সবুজ ধান আর ভাতের মদের দারুণ
ভালবাসাবাসি।
ঐ শিশু গুলিতো বউ পেটাতে বা মহাজনকে গালি দিতে
নেশা করেনি, ইস্কুল পালিয়ে জঙ্গল থেকে ফল খেয়েছে, খিদে পেয়েছিল তাই। এত্তো বড় পেটে
কালো নাভিমূল এখনও হোমিওপ্যাথির বোতল বন্দী হয়নি। এরপরও কি ঘৃণা করবেন? আর যদি না
করেন, তাহলে আপনিও ফল খাওয়া ছেড়ে দিন। দেবেন ওদের একটা কমলা বা একটা আম! হোক কামড়
বসানো এঁটো আপেলটিই। ওরা খেয়ে নেবে। আদম ইভের বিষ ফল তো নয়! অন্যথায়
একবার আপনি চেখে দেখতে পারেন জেট্রোফা ফল।
স্যারেরা ছিলেন সব ভ্যালেন্টাইন ডে'র ছুটিতে,
সুযোগ পেয়েই মার্কসবাদের ক্লাসে ছুট। পাঠ
শেষে প্রেমিকাকে বলেছেন প্রমোশনটা এই মাসে হয়েই যাবে, এরপরই বিয়েটা। একটা জায়েন্ট
স্ক্রিন টিভিতে মধ্যরাতে নীল ছবি। আহা মার্ক্সবাদী রক্ষণশীলতা নীল মধ্যরাতে।
আঙুরের কিলো একশ পঞ্চাশ।
আজ তিস্তা পাড়ের মা'য়েরা সব মেতে উঠেছেন বৈষ্ণব সেবায়। ছেলে মেয়ের মাথা গুনে বাড়ি
বাড়ি ভিক্ষে করে যোগার চলছে ভগবানের নৈবদ্যের। এরপরও রক্ষা হলোনা ছেলে মেয়েগুলির।
তিস্তার মা নেই। খিদার ভালবাসা, জলের ভালবাসা, ভাষার ভালোবাসা, গম্ভীর ফেব্রুয়ারি
প্রেমের ভালবাসা, মার্ক্সীয় ভালবাসা, তিস্তার
ভালবাসা সবাই মরে যাক। বেঁচে থাকুক ছেলে মেয়েগুলি। কে বাঁচে, কে মরে কে
জানে! আমিও জানিনা।
এবার ঘুম পেয়েছে শহীদ মিনারের। ঐ শুনুন মিষ্টি
মিষ্টি মুখ করে তিস্তা আপনাকে সাত সকালের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। নুন চিনি জল গুলে
স্যালাইন খেয়ে নিন। আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে শুনেছি।
ফল না খাওয়াই ভালো... আজ অন্তত!