অনেক দিন হলো, আমাদের বৈঠকখানায় একটা Post পড়েছিলো- “হুসেন হোক বা পাওলি- মুখ খুললি কি গেলি...”।
সেখানে
নিজেদের মনের কথা বলতে বলা হয়েছিলো এই বিষয়ে। এদ্দিনে আমাদের বন্ধু ‘হিজিবিজবিজ’
এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। লেখাটা একই সঙ্গে ঐ Post এর
নিচেও দেওয়া হলো... এই লেখায় মন্তব্য তো বটেই, গুছিয়ে লিখতে চাইলে ওখানেও লিখতে
পারেন- আমরা সেগুলোও share করবো।
অতএব? আর কি? লিখতে থাকুন- আড্ডা/ তর্ক জমে উঠুক...
আবার লজ্জাজনক এক অধ্যায়ের
পুনরাবৃত্তি। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হল
জন্মসূত্রে এক ভারতীয়রই। ধর্মীয় চরমপন্থীদের হুমকির সামনে মাথা নোয়ালেন স্বয়ং
সরকার-বাহাদুর। জয়পুর
সাহিত্য সমাবেশে ব্রাত্যই করে রাখা হল বুকারজয়ী লেখক সলমন রুশদিকে। তাঁর অপরাধ? এক
সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত কিছু ধারার ব্যুৎপত্তি সংক্রান্ত
কয়েকটি বিতর্কিত মন্তব্য। অবশ্য ঘটনাটি একদম অপ্রত্যাশিত ছিল এমনটা নয়। যে বইটিকে
ঘিরে এত বিতর্ক সেই বইটি (The Satanic Verses) প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। প্রকাশ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই বইটিকে ban করা হয় এবং ভারতবর্ষ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশে তাঁর
উদ্দেশ্যে ‘ফতোয়া’ জারি হয় ‘most wanted’ অপরাধীদের মতই।
এমনকি পশ্চিমে থেকেও ধর্মোন্মাদদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বারবার তাঁকে নিজের
বাসস্থান পাল্টাতে হয়েছে। এককথায় পালিয়ে বেরাতে হয়েছে প্রাণের ভয়ে। কেউ জানে না,
আদৌ কোনদিন জন্মভূমিতে মাথা উঁচু করে ফেরা হবে কিনা রুশদির! এম এফ হুসেন কে মনে
পড়ে? তাঁর অপরাধ অবশ্য আরও গুরুতর ছিল! তিনি আবার এদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের
ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে আহত করেছিলেন নগ্ন সরস্বতীকে চিত্রায়িত করে। জীবনের শেষ
কয়েকটা দিন তাই বিদেশ-বিভুঁয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অবাঞ্ছিতের মতই অতিবাহিত করতে হয়েছে ঐ
মহান শিল্পীকে। কিন্তু কেন বলুন তো? এই এঁদের মত মানুষদের দেখিয়েই না একদিন
বিশ্বের দরবারে কলার তুলেছি আমরা! আর আজ ঐ লোকগুলোর কোন একটা লেখা বা কোন একটা ছবি
আপনার ঠুনকো, ভ্রান্ত কিছু বিশ্বাসকে আঘাত করেছে বলেই দূর করে দিতে হবে তাঁদের?
হুসেনের মত শিল্পীদের কি আপনার পছন্দ অপছন্দের কথা ভেবে ক্যানভাসে তুলি টানতে হবে?
তাহলে তো সে ক্যানভাস আর ক্যানভাস থাকতো না!
ঐ ছোটবেলার স্কুলের শিক্ষককে খুশী
করার জন্য স্কেল মেপে নকশা আঁকা work education-এর খাতা হয়ে যেত! ওতে করে তো আর শিল্প হ্য় না! স্রষ্টা সৃষ্টি করেন
সৃষ্টির আনন্দে। সে সৃষ্টিতে তাঁর মৌলিক অধিকার। যদি সেই সৃষ্টি তিনি ভিন্ন বাকী
গোটা দুনিয়ার চক্ষুশূল হয় তবুও শুধুমাত্র শিল্পের স্বার্থেই সেই সৃষ্টিও সার্থক। আপনার
ভালো লাগে না কারণ আপনি বোঝেন না। কেই বা আপনাকে দিব্যি দিয়েছে সবকিছু বোঝার? আপনি
হুসেনের ছবিও বুঝবেন, শচিনের ব্যাটিংও বুঝবেন, জয় গোস্বামীর কবিতাও বুঝবেন, আবার
রবিশঙ্করের সেতারও? অবশ্য সে কি আর আপনি জানেন না? কিন্তু ঐ যে, বাড়িতে, বাজারে,
অফিসে, আড্ডার ঠেকে আপনার সবজান্তা লেকচার ঝাড়ার বাতিক! ঝট্ করে একটু টিভিটা
চালিয়ে বা খবরের কাগজে চোখটা বুলিয়ে নিয়ে কোন্ দিকে পাল্লাটা ভারী বুঝে বুলি কপচে
নিত্য আপনার দেশোদ্ধার করায় সত্যিই কিন্তু একজন হুসেন বা একজন রুশদির কিছুই যায়
আসে না। কিন্তু একটু ভাবুন, যে বুলি আপনি আওড়াচ্ছেন সেটা ঐ বোকা বাক্সের মধ্যে
দিয়ে আপনার মাথায় গেঁথে দেওয়া মুষ্টিমেয় কিছু লোকের মতামত নয় তো? আপনার এই
অবিমৃশ্যকারিতাকে হাতিয়ার করেই কিন্তু ঐ ধূর্ত লোকগুলো প্রতিদিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে!
কতটা তা তো দেখতেই পাচ্ছেন! মহামান্য আদালতও আজ এদের ভয়ে শিল্পীর ন্যূনতম
অধিকারটুকুও ফিরিয়ে দিতে অপারগ। আসলে কি জানেন? অন্যের মুখের ঝাল খেতে খেতে
নিজেদের স্বাদকোরকগুলো কবে যে হারিয়ে ফেলেছি আমরা নিজেরাও জানি না। একটা উদাহরণ দিই।
আমরা সপরিবারে খাজুরাহোর মন্দির দেখতে যাই। সেখানকার ভাস্কর্য দেখে আহা-উহু করি।
সত্যিই প্রাচীন কালের অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের
শিল্পকর্মের নিদর্শন এইসব ভাস্কর্য। কিন্তু তার বিষয়বস্তু? তা একবারও আপনার অশ্লীল
বলে মনে হয় নি? না, কারণ আপনাকে তো আগেই বলে দেওয়া হয়েছে ওটা সুন্দর! তাই আপনি এখন
ওটার সৌন্দর্য খুঁজতেই ব্যস্ত! আর হুসেনের শিল্প? কদর্য। রুশদির লেখা মিথ্যে।
তসলিমার লেখা মিথ্যে। কারণ? ঐ একই। আমাদের যারযার ধর্মগুরুরা আমাদের এই ‘বিধান’ই
তো দিয়েছেন! কিন্তু শিল্প! সে তো ধর্ম মেনে হয় না! পৃথিবীর কোন মন্দির, কোন মসজিদ,
কোন চার্চ আজ অবধি পারে নি কোন শিল্পীর কণ্ঠরোধ করতে। একজন লেখক বা লেখিকার কোন বক্তব্য থাকলে আপনি শুনবেন। কোন চিত্রকর যদি
কোন ছবি আঁকেন আপনি সেটা দেখবেন। সেটা শ্লীল না অশ্লীল, সত্য না মিথ্যে বিচার
করবেন।
বিচার করবেন আপনি নিজে......কোন ‘বাবা’ বা কোন ‘মৌলবি সাহেব’ বা কোন ‘ফাদার’-এর কথা
শুনে নয়। ভালো না লাগলে পড়বেন না। দেখবেন না। শুনবেন না। প্রচণ্ড রাগ হলে প্রতিবাদে আর একটা বই লিখতে পারেন বা একটা গান।
তাও যদি না পারেন, চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে
প্রতিবাদ (এরকম দৃষ্টান্তও রয়েছে......আপনিই প্রথম হবেন না!) করতেও পারেন। কিন্তু
বইয়ের দোকানে আগুন দেওয়ার কোন অধিকার আপনার নেই। অথবা একজনকে-‘ঐ বইটা পড়িস না!’ বলার অধিকারও আপনার নেই।
একজন শিল্পীকে দেশছাড়া করার অধিকার আপনার নেই। পুরনো সব ধ্যানধারণা ভুলে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
তাই আরও রুশদি, আরও হুসেন, আরও তসলিমা-দের দরকার.........কিংবা নিদেনপক্ষে একটা পাওলি
দাম.........যারা ঝেড়ে থাপ্পড়টা কষাতে পারবে। ভালোমন্দের বিচারটা না হয় পরেই হবে। ততদিন
‘ভালো’ আর ‘খারাপ’ দুটোই দেখুন না! না হলে ‘ভালো’-র ভালোত্ব উপভোগ করবেন কেমন করে? কেই বা বলতে পারে, আগামীকাল আপনিই হয় তো চমকে
উঠবেন আপনার চোখে আজকের না বোঝা ‘খারাপ’টাকেও ‘ভালো’ হয়ে উঠতে দেখে!