অরণ্য রিসর্ট |
-ও সেদিন আমার ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি। অবশেষে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটার ওপারে যাওয়ায় ড্রাইভার নিজেই আমাকে ফোন করতে বাধ্য হলেন। আমি কোথায় ছিলাম? বলছি। আমি তখন জনা পনেরো বন্ধুর সাথে লতাগুড়ির ‘অরণ্য’ রিসর্টে। দিন চারেকের একটা কম্প্যাক্ট টুরে বেরিয়েছি- লতাগুড়ি-রিসপ-লাভা-লোলেগাঁও। লতাগুড়ি সফর সেদিন শেষ। আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় জঙ্গল সাফারি করে, বাইসন-হাতির পাল দেখে জঙ্গলের গভীরতার স্বাদ মোটামুটি সকলেই উপভোগ করে ফেলেছি। তারপর আবার রাতে ক্যাম্পফায়ার!
যার শুরুটা নাচ-গান হাসি ঠাট্টা দিয়ে হলেও শেষটা হয় সেন্টিমেন্টে জবজবে আলোচনা দিয়ে। সে রাতেই ‘আসছে বছর আবার হবে’ সুলভ প্রতিশ্রুতি-ও নিয়ে নেওয়া হয়। কাজেই সকালেও hangটা কাটেনি। যা হোক, ড্রাইভারের ফোন পেয়েই কোনরকমে ধড়মড়িয়ে উঠে ল্যাপটপ-ক্যামেরা চটজলদি ব্যাগে ভরে নিয়ে ছুট্টে গেলাম গাড়ি ধরতে। দু’খানা টাটা সুমো আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। কিন্তু গিয়ে দেখি আমাকে নিয়ে পৌঁছে উঠতে পেরেছে মাত্র চারজন। ড্রাইভার খুব মুখ বিকৃত করে আমদের বললো –‘রিসপের রাস্তা খারাপ আছে, তাড়াতাড়ি না বেরোলে পৌঁছনো চাপ!’ আমরা চারজন তড়িঘড়ি সব্বাইকে জাগিয়ে সাড়ে নটা-র মধ্যে রওনা হলাম রিসপের উদ্দেশ্যে। টুবাই (ও-ই গোটা টুরের plan টা করেছে) বললো রিসপে নাকি বাংলো বুক করা আছে আমাদের জন্য। রিসপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-ও দারুণ। এসব গপ্পো শুনতে শুনতে আমাদের সবার-ই মুখ চোখ বেশ জ্বলজ্বলে হয়ে উঠছিলো। কিন্তু ড্রাইভার দাদার মুখে কোনো কথা নেই, হাসি নেই– ক্রমশ-ই মুখ আরো বিকৃত করে চলেছে। মালবাজারে এসে কিছু খাবার দাবার কেনার জন্যে আমরা গাড়ি দাঁড় করালাম। আর সেই break-এ ড্রাইভার এদিক-ওদিকে ফোন করে শুনে ফেলেছে রিসপের রাস্তা পরপর দু’টো ধসের কবলে পড়ে সম্পূর্ণ বন্ধ। ব্যস! এবার আমাদের সবার মুখ বিকৃত...দুটো গাড়িতে মুহূর্তে হই হই পড়ে গেল। কেউ বলছে –‘ড্রাইভার ব্যাটা ভীতু!’, কেউ বলছে –‘আরে হোটেলের বুকিং টা? পুরো মার?’, কেউ বা ‘এবার তাহলে কোথায় যাই?’ হুম! আমি ততক্ষণে স্থানীয় লোকেদের কথা শুনে মনে মনে ড্রাইভার কে সমর্থন করতে শুরু করে দিয়েছি। কারণ কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প আর মুষলধারে বৃষ্টির ফলে রিসপের রাস্তা সত্যিই অচল। আধ ঘণ্টা তর্জা লড়াইয়ের পর সবাই সিদ্ধান্ত নিল ‘চলো-জলদাপাড়া’। গাড়িতে উঠেই GPRS আর modem-এর দৌলতে Google-এ হঠাৎ ‘জলদাপাড়া’ search এর ঢল নামল। গল্পের Topic বদলে রিসপ থেকে জলদাপাড়া হতে বেশি সময় লাগলো না। টানা চার-পাঁচ ঘণ্টার journey বন্ধুদের বাওয়াল আর বিয়ারের সুবাদে নিমেষে কেটে গেল। বুকিং আগে থেকে না থাকায় আমরা হোটেলের নামে একখানা মাঝারি ভাঙ্গা দোতলা বাড়ি পেলাম। সেখানে চা খেতে খেতে হাতির পিঠে করে জঙ্গল সাফারির খোঁজ নিলাম। কিন্তু জলদাপাড়ার এই অন্যতম আকর্ষণ প্রথমেই হোটেল-মালিক নাকচ করে দিলেন- এত জনের হাতি-সাফারি নাকি এত অল্প সময়ে arrange করা সম্ভব নয়। ওঁর suggestion- অনুযায়ী আমরা চা খেয়ে তোর্সা নদী দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাস্তার খানা খন্দের চড়াই উতরাইএ বোঝা সত্যিই ভার আপনি পাহাড়ে রয়েছেন না ডুয়ার্সে।
আমাদের গাড়ি চালক তোর্সা ব্রিজের ওপর আমাদের নামিয়ে কড়া নির্দেশ দিয়ে দিলেন- ‘জলের কাছে যাওয়া চলবে না।’ ‘অ্যাঁ!’, সবার মুখের এক-ই ভঙ্গি- ‘এমন জানলে তো আমরা আসতামই না।’ কাজেই ব্রিজে দাঁড়িয়ে আরেকটা গাড়ির অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকলো না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ফোন করে জানতে পারলাম ওরা নাকি একটু এগিয়ে গিয়ে একটা দারুণ ঝিল দেখতে পেয়েছে ... বললো ছবি টবি তুলে ওদের আসতে কম করে আরো আধঘণ্টা লাগবে। ওমনি আমাদের মনটা কেমন যেন উসখুস করতে লাগলো। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে যদি জলই দেখতে হয় তো হাওড়া ব্রিজে দাঁড়াবো! যে দু’এক জন কম উৎসাহী মানুষ- ‘আবার ঝিল দেখতে যাবো?’- বলেছিল তাদেরকেও বার খাওয়ানোর দায়িত্বটা আমি নিজের কাঁধেই নিয়েছিলাম। অবশেষে তারাও লোভ সামলাতে না পেরে আমদের সাথে গাড়ি নিয়ে চললো ঝিল দেখতে। দশ মিনিট আবার চড়াই উতরাই পেরিয়ে কি দেখলাম? রাস্তায় প্রকাণ্ড size এর একখানা গর্ত আর তাতে বৃষ্টির জল জমে রাস্তা বন্ধ! গাড়ি চালক ভুল করে ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় ওদের এই দেরি। আর একই যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন? সেই ভেবে নাকি আমাদের কেউ ডেকে নিয়েছে ‘বজ্জাত’ গুলো। একে মাথায় আগুন ছুটছে তার ওপর কোমরও জবাব দিয়ে দিয়েছে! এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল বাক্স-পেটরা গুছিয়ে নিজের বাসস্থানে ফিরে যাই, আজই এই ‘ভ্রমণ কাহিনী’-র ইতি ঘটাই। যা হোক, কিছুক্ষণ পর সাময়িক রাগারাগির পাট মিটিয়ে আমরা আবার কোন্দল করতে করতে ফিরছি। প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে... হঠাৎই দেখি রাস্তার দু’দিকের জঙ্গল থেকে বিশাল একটা কিছু উঁকি মারছে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে বুঝলাম তিনখানা হাতি!
এতটুকু সময় নষ্ট না করে পনেরো জনে ষোলো খানা
ক্যামেরা বের করে ঝপাঝপ ফ্লাশ দিয়ে ছবি তুলতে শুরু করেছি। আর ততক্ষণে ‘তেনাদের’ বাড়ি বয়ে গিয়ে বিরক্ত করায় চটে গিয়ে তারাও শুঁড় তুলে চিৎকার করতে
করতে আমাদের দিকে ধেয়ে এসেছে। পড়ি কি মরি করে বেগে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে কোনো মতে
এ যাত্রা রক্ষা পেলাম। সবার তখন দারুণ উত্তেজনা... সারাদিনের বিফল tour তিনটে হাতির তাড়ায় রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল। একি কম পাওনা!
অ্যাড্রেনালিনের সেদিন যে কি অপচয় হয়েছিল তা
বুঝেছি পরে হাতির ছবিগুলো দেখার সময়- প্রায় সবকটা ছবিই smeared! মহা
উৎসাহে হোটেলে ফিরে শ্রেয়া বললো “কাল সকালে জিপে করে জঙ্গল
সাফারি করলে হয় না? হাতির পিঠে না হয় নাই বা হল...”
সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ম বললো “আমার মনে হচ্ছে
আমাদের বাকি জলদাপাড়া-র সময়টা খুব ভালোই কাটবে।” ওদের আশা
দেখে আমরাও কেমন যেন স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই ভাগ্যকে হাতিয়ার করার লোভটা সামলাতে
পারলাম না। কিছুটা হুজুগেই পরের দিন ভোর পাঁচটার সাফারি বুক করে ফেললাম। রাতে
তাড়াতাড়ি খেয়ে, খুব কষ্ট করে আড্ডায় লাগাম দিয়ে শুয়ে
পড়লাম। পরদিন সকালে যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে গেছি। সারি সারি জিপ দাঁড়িয়ে
রয়েছে, চারদিকে বড় বড় এক শৃঙ্গ গন্ডারের পোস্টার। একটা
একটা করে জিপ এগিয়ে আসছে ... আমরা ভাবছি বোধহয় আমাদের জন্য, কিন্তু প্রতিবার-ই আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও ধৈর্যের সাথে
অপেক্ষা করে চলেছি। শুভ্র আবার টিকিট কাউন্টারে গিয়ে তাগাদা-ও দিয়ে এলো- ‘দাদা বেলা বাড়লে যে আর কিছুই দেখতে পাবনা...’ ।
তাতে বিশেষ কিছু লাভ যদিও হল না। ‘দাদা’-রা আমাদের পাঁচটার tour শুরু করালেন ঠিক ছ’টা পাঁচে। চারটে জিপে করে আমরা জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। আমাদের জিপটা সবার আগে
আগে চলেছে। জঙ্গলের প্রকৃতি অবশ্যই লতাগুড়ির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে জঙ্গল
মূলতঃ ঘাসভূমি। আমরা সবাই খুব সজাগ... গন্ডার যাতে কোনভাবে miss না হয়ে যায়।
সাফারি ছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিটের। প্রথম পনেরো-কুড়ি মিনিট প্রচুর বনময়ূর আর দু’একটা হরিণ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি যথারীতি বিরক্ত আর ক্লান্ত। ধৈর্যটা আমার বরাবরই কম! হুট করেই কিছু একটা লক্ষ্য করে গাইড গাড়িটা দাঁড় করাতে বললেন। উনি আমাদের চারজনকে ডানদিকে কোনাকুনি লক্ষ্য করতে বললেন। আর আমার জিপের বাকি তিন বন্ধু উল্লাসে লাফিয়ে উঠল- ‘ওই তো গন্ডারের মাথা’... ‘শিং শিং শিং’... ‘আরে আরে আমি তো শুধু পেছনের view টাই পাচ্ছি... ধুর ধুর!!’ আর আমি? একবার ডাঁয়ে মাথা ঘোরাই, একবার বাঁয়ে ... লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে শেষ মেশ একটা ধূসর ডটকে জঙ্গলে মিলিয়ে যেতে দেখলাম। তখন যদিও স্বীকার করিনি... পেছনের তিনটে জিপের বেচারাদের রসিয়ে রসিয়ে গন্ডারের বিবরণ দিয়েছিলাম। আর মনে মনে মুচকি হেসেছিলাম... খুব বুঝতে পারছিলাম কয়েকজনের মুখটা বেশ ভার হয়ে গেছে। আরো কিছুদূর এগোতেই খেয়াল করলাম শেষের আগের গাড়িটা পিছোচ্ছে, ফলতঃ শেষের গাড়িটাকেও ব্যাক করতে হচ্ছে... সঙ্গে সঙ্গে ফোন-
সাফারি ছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিটের। প্রথম পনেরো-কুড়ি মিনিট প্রচুর বনময়ূর আর দু’একটা হরিণ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি যথারীতি বিরক্ত আর ক্লান্ত। ধৈর্যটা আমার বরাবরই কম! হুট করেই কিছু একটা লক্ষ্য করে গাইড গাড়িটা দাঁড় করাতে বললেন। উনি আমাদের চারজনকে ডানদিকে কোনাকুনি লক্ষ্য করতে বললেন। আর আমার জিপের বাকি তিন বন্ধু উল্লাসে লাফিয়ে উঠল- ‘ওই তো গন্ডারের মাথা’... ‘শিং শিং শিং’... ‘আরে আরে আমি তো শুধু পেছনের view টাই পাচ্ছি... ধুর ধুর!!’ আর আমি? একবার ডাঁয়ে মাথা ঘোরাই, একবার বাঁয়ে ... লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে শেষ মেশ একটা ধূসর ডটকে জঙ্গলে মিলিয়ে যেতে দেখলাম। তখন যদিও স্বীকার করিনি... পেছনের তিনটে জিপের বেচারাদের রসিয়ে রসিয়ে গন্ডারের বিবরণ দিয়েছিলাম। আর মনে মনে মুচকি হেসেছিলাম... খুব বুঝতে পারছিলাম কয়েকজনের মুখটা বেশ ভার হয়ে গেছে। আরো কিছুদূর এগোতেই খেয়াল করলাম শেষের আগের গাড়িটা পিছোচ্ছে, ফলতঃ শেষের গাড়িটাকেও ব্যাক করতে হচ্ছে... সঙ্গে সঙ্গে ফোন-
-“হ্যাঁরে, তোরা ব্যাক
করছিস নাকি?”
-“না, না, রিমা কী জানো একটা দেখতে পেয়েছে রে— কালচে রঙ-এর!”
ব্যস, আমরাও ড্রাইভারকে বললাম –“দাদা গাড়িটা একটু পিছিয়ে ওদের দিকে নিয়ে যান না!” সে কিছুতেই যাবে না- এতদূর এগিয়ে এসে নাকি আর ব্যাক করা সম্ভব নয়। আর
আমরাও নাছোড়বান্দা। ভদ্রলোককে প্রায় রাজি করিয়েই এনেছি- তক্ষুনি পেছন দিক থেকে ‘প্যাঁক প্যাঁক’ হর্নের আওয়াজ।
-“কী রে, চলে এলি যে?”
-“আরে কাটা, কাটা –পাতি গাছের গুঁড়ি।”
বোঝো!!!
এরপর?
আর কী! সাফারির বাকি সময়টা আমাদের একটা ওয়াচ
টাওয়ারে তুলে দেওয়া হল। চারিদিকে শুধু ধু ধু জঙ্গল... দূরবীন নেই তো কি হয়েছে? ক্যামেরা হ্যায়
না! 36x optical zoom-এর সদ্ব্যবহার সেদিন করেছিলাম।
বিশ্বাস করুন, কাক ছাড়া একটি প্রাণীও দৃষ্টিগোচর হয়নি। দশ
পনেরো মিনিট জঙ্গল-আকাশ-বাতাসের ছবি তুলে অগত্যা ব্যাক টু হোটেল। ফেরার পথে সবার
খালি একটাই প্রশ্ন- এতবড় জঙ্গলে এতক্ষণ ঘুরে একটা গন্ডারের আংশিক দর্শন! অদিতি আর
থাকতে না পেরে গাইড কে জিজ্ঞাসা করে ফেললো- “দাদা এখানে আদৌ
কি গন্ডার দেখা যায়?” উনি বললেন-“যাবে
না কেন? তবে হ্যাঁ, না খুব বৃষ্টি না
খুব রোদ, আধো আধো রোদ উঠলে তবেই দেখতে পাবেন”। পাল্টা প্রশ্ন “আর কনকনে শীতে?” ভদ্রলোক কটমট করে তাকিয়ে টাকাটা নিয়ে চলে গেলেন... যাহ্ ব-আ-ব-আ! আমরাও
আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে প্রবল বৃষ্টি-ধস উপেক্ষা করে জঙ্গলকে বিদায়
জানিয়ে লাভা লোলেগাঁও-র উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
ক্রমশ...