একটা রহস্যজনক লোক। লম্বা-চওড়া চেহারা, বড় বড় চুল, অভিব্যক্তিহীন
মুখ। পরনে সবুজ গেঞ্জি, ডেনিম ব্লু জিনস্ আর বেশ কেতার সানগ্লাস। অনেকক্ষণ
ধরে দাঁড়িয়েই আছে ল্যাম্পপোস্টের সামনে। সকাল আটটার
আশে পাশে এখন ঘড়ির কাঁটা। লোকটার যেন কোন কাজ নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মত।
আশে পাশে এখন ঘড়ির কাঁটা। লোকটার যেন কোন কাজ নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মত।
তিথি ঘুম থেকে উঠেছে সাতটা বারোয়। আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে
বারান্দায় গিয়েই চোখে পড়েছিল লোকটা। তারপর ছাদে গিয়ে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সেরসাইজ
করতে করতেও তিথি লোকটাকে দেখেছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আর মাঝে মাঝেই তাদের বাড়ির
দিকে তাকাচ্ছে।
কি ব্যাপার! স্পাই-টাই হবে বলে তো মনে হয় না, তাহলে কি
কোন ‘রোডসাইড রোমিও’? তিথির ঠোঁটের কোনায়
একটু হাসি ফুটে উঠল।
একটু হাসি ফুটে উঠল।
সকাল নটা বাজে। বিদেশি কোম্পানির জুনিয়ার এক্সিকিউটিভ তিথি
সেন একটা নীল সালোয়ারে সজ্জিতা হয়ে অফিস যাওয়ার জন্য বেরোল। নীচে নামতেই একবার ওর
দিকে তাকাল লোকটা।
‘ফলো করবে নাকি?’ নিজের মনেই
ভাবল তিথি। ছেলেটা কিন্তু তার জায়গা থেকে নড়ল না।
তিথি একটা অটোয় উঠে ভাবল, ‘যাক, বাঁচা গেল।’
গড়িয়ায় নেমে তিথি হাঁটা লাগাল টালিগঞ্জ যাওয়ার অটোর লাইনের
দিকে। দু-একবার পিছনে ফিরে দেখলও, কিন্তু লোকটাকে আর দেখতে পেল না।
মেট্রোয় কি একটা কাজের জন্য পুরো সপ্তাহটাই মেট্রো দমদম
থেকে শুধু টালিগঞ্জ অবধি চলছে। জঘন্য ব্যাপার। এই গড়িয়া, নাকতলা, বাঁশদ্রোণি
তো বটেই ওদিকের সোনারপুর, বারুইপুর থেকেও লোকজন টালিগঞ্জ গিয়ে মেট্রো ধরছে, সেই কয়েক
বছর আগের মত। কিন্তু তার জন্য অটোয় লম্বা লাইন, টালিগঞ্জ স্টেশনেও বেশ ভিড় হচ্ছে।
কিন্তু কি আর করা যাবে, এসবই নাকি জনগণের কথা ভেবে, তাদেরই
সুবিধার্থে।
যেমনটা ভেবেছিল, অটো স্ট্যান্ডে সেরকমই লম্বা লাইন।
মোটামুটি মিনিট কুড়ির ধাক্কা। কি আর করা, লাইনে দাঁড়িয়ে গেল তিথি। একের পর
এক অটো আসছিল, তো মিনিট পনেরোর মাথাতেই জায়গা পেয়ে গেল সে। অটোর সামনের
সিট তখন ফাঁকা। অটোওয়ালা ডাক পাড়ল, “একজন কে আছেন? একজন?”
লাইনের পেছন দিক থেকে একজন এগিয়ে এল। তিথি অবাক হয়ে দেখল, এই তো সেই
সবুজ গেঞ্জি, সকালবেলার সেই লোকটা। কি ব্যাপার? বান্দা
পিছুই ছাড়ছে না!
টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের টিকিটের লাইনে হঠাৎ তিথির সঙ্গে
পারমিতার দেখা হয়ে গেল। পারমিতা দত্ত ওর সঙ্গে কলেজে পড়ত। এখন প্রেসিডেন্সিতে
অংকের প্রোফেসর। পারমিতার সঙ্গে ট্রেনে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ নেতাজীভবনের কাছে
গিয়ে তিথি খেয়াল করল, তাদের কামরাতেই একটু দূরে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে
আছে সেই লোকটা। মেট্রোর ভেতরেও সানগ্লাসটা খোলেনি।
তিথি লোকটাকে দেখেও পারমিতাকে কিছু বলল না। কি দরকার!
পারমিতার কি একটা কাজ ছিল তাই ও রবীন্দ্রসদনে নেমে গেল।
পরের দুটো স্টেশন তিথি একা। লোকটা কি এবার কথা বলবে? কে হতে পারে এই লোকটা? টেরোরিষ্ট, স্পাই, কিডন্যাপার-
দূর কোনটাই মিলছে না।
তাহলে কি লোকটা ওর প্রেমে পড়েছে? একটু পরেই
প্রপোজ করবে ওকে। ওর হাত ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে, “আমি- আমি
তোমায় খুব ভালবাসি। তুমি কি-” তিথি একটু রোমাঞ্চিত হল। এতক্ষণে লোকটাকে একটু ভাল
করে খেয়াল করল। দেখতে কিন্তু বেশ স্মার্ট আর হ্যান্ডসম। লম্বা, গায়ের রঙটা
অবশ্য একটু চাপা, কিন্তু তাতে কি আসে যায়।
এইসব ভাবতে ভাবতে তিথি দেখল যে পার্কস্ট্রিট এসে গেছে।
এখানেই নামবে ও। তিথির সঙ্গে সঙ্গে ঐ ছেলেটিও যে সেখানে ট্রেন থেকে নামল সেটা
নিশ্চয় বুদ্ধিমান পাঠক-পাঠিকাদের বলে দিতে হবে না।
এশিয়াটিক সোসাইটির সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল তিথি। ও জানে
যে, লোকটা ওর পেছনেই আসছে। ফ্লুরিজ ক্রস করে ডানদিকে ঘুরতে যাবে হঠাৎ ছেলেটা পেছন
থেকে ডেকে উঠল, “ম্যাদাম, মিস সেন!”
এই ডাকের জন্যই তিথি অপেক্ষা করছিল।
ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, “নমস্কার।
আমার নাম কৌশিক পাল। মিঃ ব্যানার্জী আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন।”
“ও আচ্ছা। কিন্তু আপনি অতো সকাল
থেকে আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?”
“আসলে মিঃ ব্যানার্জী কাল আমায়
বলেছিলেন আপনার সঙ্গে দেখা করার কথা। ঠিকানাও দিয়ে দিয়েছিলেন। এটাও বলেছিলেন যে,
সারাদিন আপনি ব্যস্ত থাকেন, তাই সকালের দিকে দেখা করাটাই সুবিধা। আমার আবার
সারাদিন অন্য কিছু অ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তাই আমি বোধহয় একটু আগেই পৌঁছে
গেছিলাম।” ছেলেটা থামল, তারপর আবার বলল, “তারপর মিঃ ব্যানার্জী আমার মোবাইলে
ফোন করে বললেন যে, আপনি চান যেন আপনার বাড়িতে কেউ জানতে না পারে।
সেইজন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম।”
“ওহ্-”
“ভেবেছিলাম, মেট্রো
স্টেশনে আপনার সঙ্গে কথা বলে নেব, কিন্তু সেখানেও আপনার বান্ধবী এসে গেলেন। তাই অবশেষে
এখানে সুযোগ পেলাম।”
তিথি কবজি ঘুরিয়ে হাতঘড়িটা দেখে একটু ভেবে বলল, “মিঃ
ব্যানার্জী যখন আপনাকে পাঠিয়েছেন তখন তো ঠিকই আছে। কিন্তু আসলে বুঝতেই পারছেন-
রানিং লেট ফর অফিস”
কথা শেষ করার আগেই কৌশিক বলল, “নো প্রবলেম ম্যাদাম। আপনার কখন সময়
হবে বলুন, আমি আমার এদিকের কিছু কাজ শেষ করে সেই মত চলে আসব।”
তিথি মনে মনে ওর সারাদিনের কাজের হিসেব করে বলল, “আপনি এই
তিনটে নাগাদ, এখানে ফ্লুরিজের সামনে চলে আসুন। তারপর কোথাও একটা বসে কথা
বলা যাবে।”
“নিশ্চয়। ধন্যবাদ ম্যাদাম।” কৌশিক
উল্টোদিকে হাঁটা লাগাল।
তিথিও অফিসের দিকে হাঁটা লাগাল। মনটা বেশ খুশী। দত্ত ঠিক
লোককেই পাঠিয়েছে মনে হয়। ওর এই ৯৩ কেজি ওজনটা এবার কমাতেই হবে। বন্ধুরা, বাড়ির লোক, সবাই আওয়াজ
দিচ্ছে আজকাল।
লোকটা কিন্তু বেশ বুদ্ধি করেই ওর ‘Lose weight now, ask me how’ ব্যাজটা খুলে রেখেছিল।