Thursday, December 22, 2011

জেম্মার ডায়রি ৪ -- স্নেহলতা



তিতিরের কথা
দুটো ছটাকা দামের কফির কাপ, এক প্লেট বাটার ফ্রাই (জানি ওটাকে ব্যাটার ফ্রাই বলে, তমিস্রা
কুড়ি-পঁচিশ বার বলেছে, তবু আমার কাছে দোকানের মেনু ভগবান), এক প্যাকেট সিগারেট, অনেকটা প্রেমের সঙ্গে একটু-আধটু রাগারাগি, আমি আর প্রবীর- এই ছিল আমার প্রথম প্রেমের প্রথম এক মাসের দৈনিক ছবি। নন্দন-এর টিকিট কাউন্টারটা ছাড়িয়ে আকাদেমির টিকিট কাউন্টারের দিকে যেতে যে ফাঁকা জায়গাটা, ওইখানে ছিল আমাদের রাদেভুঁ পয়েন্ট। মে মাসের গরম, ক্লাসমেটদের বাঁকা চাউনি, জেম্মার খবরদারি, ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন মায়ের কাছে করা অঙ্গীকার, সন্ধে হলে পুলিশের মদন-ভ্যানেওঠার ভয়- কিছুই আমাদের দমাতে পারেনি। পার্সে কখনোই টাকা বেশি থাকে না, তায় কোথাও বসতে হলেই কিছু না কিছু কিনতে হয়- সব মিলিয়ে সিনেমা হলের অন্ধকারের আবডালটা খুব বড় বিলাসিতা ছিল আমাদের কাছে। তবু জানতাম আমারই মতো প্রবীরও টাকা জমাচ্ছে মাসে অন্তত
একবার কোন কমদামী সিনেমা হলে ঢোকার জন্যে। কলকাতায় যখন প্রথম মাল্টিপ্লেক্স এলো, সব জায়গায় কি লাফালাফি- স্বাধীন হল-মালিকদের ভাত মারা যাচ্ছে। একটা কথা কেউ খেয়াল করেনি, সেটা হলো, ভাগ্যহীন মধ্যবিত্তের প্রেম করার শেষ দূর্গটিও ধূলিসাৎ হলো। মধুশ্রীদিদের দেখেছি, প্রতি হপ্তায় একবার করে মালঞ্চেযেত- একই সিনেমা থাকলেও। ওদের নাকি একটা স্পেশাল জায়গাই ছিল- কাউন্টারে ওদের দেখলেই মুচকি হেসে ওই টিকিট দুটো দিয়ে দিত। আর আমরা? চোখের সামনে মাড়োয়াড়ির ছেলে-মেয়ে গুলো- যারা জামাকাপড় থেকে মাথার চুল অবধি হাফসেদ্ধ আমেরিকানদের মতো দেখতে, যাদের স্লিভলেস পরার কারণই হলো বয়ফ্রেন্ডের হাত রাখার জায়গা করে দেওয়া- দিব্যি ড্যাং ড্যাং করে ১৮০, ১৯০ টাকা খরচ করে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, প্রতি হপ্তায় (নতুন সিনেমা কিন্তু)। সেখানেই শেষ নয়, কষ্ট করে টিকিট কেটে যদি পৌঁছেও যাই, গিয়ে মনে হবে কিছু না খেলে যেন ওই লাল জামা পরা লোকগুলোর চাকরি চলে যাওয়ার কারণ হব। এদিকে পকেটে যে বাড়ি ফেরার টাকাটাও নেই টিকিট কাটার পর, সেটা কে কাকে বোঝায়?
কি বলতে কি বলে চলেছি। আপনাকে আর দমবন্ধ করিয়ে রাখবো না। না, প্রবীরের সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। সাময়িক ঝগড়া নয়, প্রায় দুমাস হলো আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ছাড়াছাড়ি কথাটা কেমন যেন কর্কশ। যেন মনে করিয়ে দেয়, দুজনেই ভেবেছিলাম-ইয়ে ফেভিকল কা মজবুত জোড় হ্যায়, ছুটেগা নেহি। দীর্ঘ ছমাসের সম্পর্কের শেষটা, সত্যি বলতে আমি এখনো মেনে নিতে পারিনি। জানি, প্রথম প্রেম অভিশপ্ত। কিন্তু ব্যতিক্রম তো কতই আছে, আমারটাই বা হলো না কেন?
পাতি গল্প, কিচ্ছু নতুন নেই- তবু আমার তো শুধু এই গল্পটাই জানা- তাই এটাই বলবো। যা বলছিলাম, আমি আর প্রবীর। আগুন আর ঘি। দেখতে আমি নেহাত ফেলনা নই। আর বাইরে যতই অস্বীকার করি না কেন, সেটা আমি ভালই জানি। প্রবীরও তাই ওই কার্টুনের ঘোর লাগা চোখের ছেলে হয়ে ঘুরে বেড়াত আমার পিছনে। কলকাতা শহরের মেয়ে আমি। নিজের নামে লিখতেও হচ্ছেনা। তাই বলতে বাধা নেই, অন্য যেকোনো ওই বয়সী মেয়ের মতো আমিও চাইতাম প্রবীর কবে আরও একটু এগোবে। কিন্তু এই তথাকথিত তথ্য বিস্ফোরণেরযুগেও আদিম কিছু ভাবপ্রকাশ এখনো গোলমেলে আর দ্বিধায় ভরা। সেন্ট্রাল পার্কের ঝোপের আড়ালে বসে চোখ বন্ধ করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যখন একে অন্যের ঠোঁটের মধ্যে খুঁজে নিচ্ছি মোক্ষ, তখন আমার মাথার মধ্যে চলছে- কি করে ওকে বোঝাব আরও একটু এগোনোর কথা? ও কি আমায় সস্তা ভাববে? ঠিক কতটা এগোলে তবে ঠেলে দেব দূরে? যাতে আমার ইজ্জতএর ধোঁয়াশাটা টিকে থাকে?’ একই সময় প্রবীর হয়তো ওর পুরুষমস্তিষ্কে ভাবছে- আমি কি বেশি এগিয়ে যাচ্ছি? ও কি আমায় লুচ্চা ভাবছে? এখানেই থেমে যাবো? তবে কি আমায় ভীতু ভাববে?’ বা হয়তো এসব কিছুই ভাবছে না। মধুশ্রীদি বলতো, ছেলেরা নাকি কুকুরের মতো। একটা ‘Hot’ মেয়ে একটু ঘনিয়ে বসলেই ওদের গোটা বাক্যে চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পায়। বুক’, ‘সুন্দর গন্ধ’, ‘বিছানা’, ‘জামার কলার’, ‘বাদাম ভাজা’- এভাবে চিন্তা করে। সে যাই হোক, আসল কথা হলো, আমি তখন নিচে তাকালে সপ্তম স্বর্গ দেখতে পাচ্ছি। জগতের অন্য কিছু ভাল লাগছেনা অথচ সব কিছুই এত ভাল লাগছে, যে মাঝে মাঝে কান্না পাচ্ছে। হয়তো আমি ফুটপাথ ধরে হেঁটে আসছি আর ও রাস্তার উলটো দিকের পানের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে, কানের ওপর দিয়ে কগাছি চুল হাল্কা উড়ছে হাওয়ায়, পকেটে হাত, এক পা আলতো ভাঁজ করা- দূর থেকে ওকে দেখতে এতো ভাল লাগতো যে আমি আরও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করে তবে এগোতাম।
যখন সবরকমের খেলা পুরনো হয়ে এসেছে- কানা গলির শেষে অন্ধের মতো হাতড়ে চলেছি আর প্রাপ্তির ভাল লাগা ছাপিয়ে উঠছে অপ্রাপ্তির বিরক্তি, সেই রকম সময়ে, জুলাই মাসের কোন এক অসহ্য গরমের দুপুরে সোমনাথ, প্রবীরের সবচেয়ে ভাল বন্ধু, সেই সুবাদে আমারও- এসে খবর দিল ক্লাসের শেষে- ওর বাবা মা ভেলোর গেছে, বাড়ি ফাঁকা। কাঁদতে থাকা বাচ্চাকে নতুন খেলনা কিনে দিলে পরিবেশ ঠিক যেমন করে পালটায়, তেমনি করেই আমাদের মুখভঙ্গি পাল্টেছিল হয়তো। অচেনা বনেদী পাড়ায়, জিজ্ঞাসু অসংখ্য লোকের চোখের সামনে দিয়ে কিভাবে যে ঢুকেছিলাম ওই বাড়িতে, এখন আর চেষ্টা করলেও মনে করতে পারবোনা। হাতে রাস্তার ধার থেকে কিনে আনা চিকেন চাউমিনের প্যাকেট, একটা দুলিটার জলের বোতল আর ডেসিবেল সীমাঙ্ক ছাড়িয়ে ফেলা আমার হৃৎপিণ্ড- সঙ্গে শুধু একটা বোরখা থাকলে বাঁচতাম। ভাগ্য দেবতা কি আর ততটা সুপ্রসন্ন? বদলে দরজা খুলে ঢোকার ঠিক আগে দড়াম করে হাত থেকে মেঝেয় পড়লো বিশমনি তালা- আমি নিশ্চিত চায়ের দোকানের সবকটা ছেলে ঘুরে তাকিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- দিনের আলোয় এই বাড়িতে আর নয়। কথা রেখেছি। আর কখনো কোন বাড়িতেই সেদিনের পুনরাভিনয় হবেনা।
তবে সে কথা পরে- আগে বলি সেই গল্প, যা শোনার জন্যে জুলজুল করে তাকিয়ে আছেন এখন এই লেখাটার দিকে। লজ্জা পাবেন না, এ গল্প শুনতে ভাল, পড়তে ভাল, ভাবতেও ভাল। আচ্ছা একবার ভেবে দেখুন তো, প্রতিদিন সকালে গম্ভীর মুখে খবরের কাগজে মৃতদেহের গুণতি না করে যদি এমন সব গল্প পড়তে হতো, ভাল লাগতো না? অশ্লীল বলে কিছু হয় না। যা স্বাভাবিক, তা অশ্লীল কি করে হয়, আমি জানিনা। হয়তো আমার বয়স কম বলে। হয়তো আপনাদের বয়সে গেলে তবেই এর মানে বোঝা যায়। কে জানে?
প্রবীর আমার মতো ভার্জিননয়। তার জন্যে আমার একটুও মন খারাপ ছিল না। বিশ্বাস করুন, ভাগ্যিস! ওর অভিজ্ঞতা না থাকলে আমি যে কি করতাম কে জানে। ওই ভুতুড়ে বাড়িতে- ভুতুড়ে বলছি কারণ আলো ঢোকে না- কোথায় কি আছে সব চটজলদি দেখে ফেলে ব্যবস্থা করতে শুরু করলো; আমায় বলে দিল যেন মনে রাখি কি কি সরিয়ে কোথায় রাখছি, কারণ যাওয়ার আগে সব আবার একই রকম করে রেখে যেতে হবে। অচেনা বাড়িতে, অচেনা থালায় প্রথম একলা বসে খেলাম দুপুরের খাবার। ঠিক মনে হলো দুটিতে মিলে সংসার শুরু করেছি। খাওয়া দাওয়ার পর ও-ই গেল থালা ধুতে। সোমনাথদের বাড়িতে প্রচুর বই। সাজানো বুককেসে উঁকি দিয়ে দেখছি- হঠাৎ পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রবীর। চমকে উঠে খামচে দিয়েছিলাম বোধহয় ওকে সামান্য। তারপর? নিউটনের চাকতি জোরে ঘুরিয়ে দিলে যেমন রংগুলো আর আলাদা করে দেখা যায় না, তেমনই গুলিয়ে গিয়েছে আমার সব খুঁটি-নাটি। শুধু মনে আছে, কি অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার সমস্ত আগল খুলেছিল প্রবীর। এমনই কি হয়? সবার? এত সুখ? এত যন্ত্রণা? পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে এমন করে শুষে নেওয়ার আকুল চেষ্টা- যার শেষ ঠিক কিভাবে হলে ঠিক হয় কেউ জানেনা? প্রথম বার ওকে অন্তত বারদশেক বাধা দিয়েছি আমি- কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা যন্ত্রণার ভয়ে। একটুও বিরক্ত না হয়ে ও এগিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ঘণ্টা চারেক ছিলাম আমরা ওখানে। অনেকটা পথ চলা যায় চার ঘণ্টায়। অনেকটা। ছোট থেকে বড় হতে যতদূর যেতে হয়, তার থেকেও বেশি।
এর পরে আমি তিনদিন প্রবীরের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। দেখা যেদিন হলো, অবাক হলাম না দেখে, যে ও এখনো আড়ষ্ট। হবে না কেন? ছেলে বলে কি ওর লজ্জা নেই? ওকে সময় দিতে সেদিন আর হাত ধরিনি। সারাদিন পর যখন ফিরবো কলেজ থেকে, ও নিজেই আমায় এগিয়ে দিতে এলো। মনে হলো, এই প্রথম যেন পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। আর শারীরিক সৌন্দর্য নয়, চোখের দিকে সোজা সেই তাকানো। আর মেয়ে নয়, আমি নারী হয়ে উঠলাম।
তারপর? বলছি...


About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই