“তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।
হঠাৎ
আলো দেখবে যখন
ভাববে এ কী বিষম কান্ডখানা।“
--[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বলাকা’, ১]
যুগ যুগ ধরে সমাজ, সংসার, অথর্নীতি, রাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান-দর্শনের মত প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই যখন নতুনের জোয়ার এসেছে, রক্ষণশীলদের বাধা সবসময় তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে ; যে কারণে সক্রেটিস কে পান করতে হয়েছে হেমলক, কোপারনিকাস-ডারউইন কে দেখানো হয়েছে গণশত্রু হিসাবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ হাসি হেসেছে ‘সত্য’। আজ আবার বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে সেরকম
এক যুগ সন্ধিক্ষণে। যা স্বতঃসিদ্ধ, তার
বাস্তবতা নিয়েই সন্দিহান বিজ্ঞানীসমাজ। তাদের চুলচেরা গবেষণায় আপাতত দিশাহারা (নাকি দিশাসন্ধানী!) বিজ্ঞান। নতুন কোন সিদ্ধান্তে যতক্ষণ গবেষককুল উপনীত হচ্ছেন, ততক্ষণ আমরা একবার আমাদের মতো করে অনুসন্ধান তথা
পর্যালোচনা করে নিই সামগ্রিক পরিস্থিতি।নিউট্রিনো নামে এক কণা নাকি আলোর চেয়েও জোরে ছোটে--ইদানিংকালে সংবাদপত্রে বা টিভি চ্যানেলে বহু আলোচিত একটি সংবাদ। আমরা যারা পদার্থবিদ্যা নিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করেছি তারা ছাড়া নিউট্রিনোর সাথে তো বাকিদের হয়ত খুব বেশি পরিচয় ছিল না এতদিন! স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে –
এখনো অবধি যা জানা যাচ্ছে তাতে
নিউট্রিনো একটি অতি নিরীহ কণা। কিন্তু এ হেন নিরীহ একটি কণা
হঠাৎ ঘটিয়ে ফেলেছে ভয়ানক এক বিপদ। গত সেপ্টেম্বর-এর শেষ দিকে CERN –এর OPERA Collaboration ঘোষণা করেছে Geneva-র CERN laboratory থেকে ইটালির Gran Sasso –র দিকে তাক করে ছোঁড়া নিউট্রিনোদের নাকি ছুটতে দেখা গেছে আলোর চেয়েও বেশি গতিতে। বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের মাথায় হাত পড়ে যাবার মত ঘটনা। আইনস্টাইনের Theory of relativity বা আপেক্ষিকতাবাদ তো বলছে আলোর চেয়ে বেশি দ্রুতগামী কেউ নেই, হতেও পারে না – আলোর বেগকে cosmic constant আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আইনস্টাইন-উত্তর বিজ্ঞান এই স্বীকার্যের উপর ভিত্তি করে এগিয়ে গেছে অনেকদূর। সেই গোড়াতেই যদি গলদ থাকে তাহলে পরবর্তী বিজ্ঞানের সব কাজও তো ব্যর্থ হয়ে যায়!
হঠাৎ ঘটিয়ে ফেলেছে ভয়ানক এক বিপদ। গত সেপ্টেম্বর-এর শেষ দিকে CERN –এর OPERA Collaboration ঘোষণা করেছে Geneva-র CERN laboratory থেকে ইটালির Gran Sasso –র দিকে তাক করে ছোঁড়া নিউট্রিনোদের নাকি ছুটতে দেখা গেছে আলোর চেয়েও বেশি গতিতে। বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের মাথায় হাত পড়ে যাবার মত ঘটনা। আইনস্টাইনের Theory of relativity বা আপেক্ষিকতাবাদ তো বলছে আলোর চেয়ে বেশি দ্রুতগামী কেউ নেই, হতেও পারে না – আলোর বেগকে cosmic constant আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আইনস্টাইন-উত্তর বিজ্ঞান এই স্বীকার্যের উপর ভিত্তি করে এগিয়ে গেছে অনেকদূর। সেই গোড়াতেই যদি গলদ থাকে তাহলে পরবর্তী বিজ্ঞানের সব কাজও তো ব্যর্থ হয়ে যায়!
কি হলে কি হবে সেই ভাবনাটা বাদ
দিয়ে একটু বিশদে জেনে নেওয়া যাক ঠিক কি ঘটেছে। 23 সেপ্টেম্বর, 2011 OPERA Collaboration জানিয়েছিল 17 GeV শক্তির নিউট্রিনোদের বেগ আলোর চেয়ে বেশি। OPERA Experiment এর মূল লক্ষ্য কিন্তু নিউট্রিনোদের বেগ মাপা ছিল না। এই
এক্সপেরিমেন্টটার নাম কতৃর্পক্ষ উল্লেখ করেছেন CERN Neutrinos to Gran Sasso (CNGS) বলে। তো এই CNGS টিম আসলে কি দেখছিল? এরা
দেখছিলেন ‘নিউট্রিনো অসিলেশন’ ( Neutrino
Oscillation) যাতে মিউওন নিউট্রিনো (νμ) অসিলেট করে
টাও নিউট্রিনোতে (ντ) পরিণত হয়। নিউট্রিনোদের বেগ মাপাটা এক্সপেরিমেন্টের একটি
বাই-প্রোডাক্ট। Super
Proton Synchrotron (SPS) নামক একটি
যন্ত্র দিয়ে প্রোটনদের 400 GeV শক্তিতে ত্বরান্বিত করা হচ্ছিল। এরপর এদের ছুটতে দেওয়া
হচ্ছিল। এই প্রোটনরা 2 মিটার দৈর্ঘ্যের গ্রাফাইট টার্গেটে পড়ে তৈরি করছিল পায়ওন/কেওন (π / K), যারা
প্রত্যেকেই স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মেসন শ্রেণীভুক্ত। দুটি ম্যাগনেটিক হর্ন ব্যবহার
করে এই মেসন –দের ফোকাসিং করা হচ্ছিল। তারপর একটি 1000 মিটার (= 1 কিলোমিটার) লম্বা
ভ্যাকুয়াম টানেলে মেসনরা ক্ষয় পেয়ে তৈরি করছিল মিউওন ও নিউট্রিনোদের। এর মধ্যে
মিউওনদের বিষয়ে আমরা মোটেই আগ্রহী নই, বা বলা ভাল CNGS
টিমের কর্তাব্যক্তিরা ছিলেন না। তাই মিউওনদের আগেই ছেঁকে
নেওয়া হচ্ছিল। লম্বা পথ অতিক্রম করে Gran
Sasso যাচ্ছিল শুধু নিউট্রিনোরা(ছবি: ১)।
ছবি: ১ |
না, তা মোটেই
নয়। শুধু তা হলে বিজ্ঞানীরা মোটেই এটা নিয়ে এত মাথা ঘামাতেন না। ব্যাপারটা
আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি জটিল। টার্গেট ও ডিটেক্টরের
দূরত্ব বা এই দূরত্ব যেতে নিউট্রিনোদের নেওয়া সময় কোনটাই সহজে মাপা যায়নি।
এই সমস্যাটার একটা সমাধান এখানে
করা হয়েছিল। দুটো প্রোটন এক্সট্র্যাকশনের ফলাফল যোগ করে এবং normalize করে পাওয়া
যাচ্ছিল বিভিন্ন সময়ে নিউট্রিনোরা কি ঘনত্বে বেরিয়ে আসছে তার সম্ভাবনার একটা গড়
ছবি। এটাকে বলা হয় নিউট্রিনোদের PDF। নিউট্রিনোদের সনাক্ত করার সময়ে আবার মারা হচ্ছিল time stamp। GPS-এ রেকর্ড
রাখা হচ্ছিল সময়ের।
প্রথমে জানা দরকার CERN থেকে Gran Sasso-র দূরত্ব। এর জন্যে GPS (Global Positioning
System) পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। Gran
Sasso-র ডিটেক্টরটা যার নামটাই আসলে OPERA , তার সঠিক পজিশন মাপার জন্য Gran Sasso-এর 10 কিলোমিটার লম্বা highway tunnel-এর দুইপাশে GPS benchmark বসানো হয়েছিল। প্রোটনদের টার্গেটের
ফোকাল পয়েন্টের পজিশনও GPS –এ পাওয়া
গেছিল। এইদুটো পজিশন থেকে টার্গেট আর ডিটেক্টরের
দূরত্বের মান পাওয়া গেছিল (730534.61 +/- 0.20) মিটার। এর সঙ্গে BCT ( Beam Current Transformer যা কিনা প্রোটন বিমের time structure মাপে) আর টার্গেটের দূরত্ব (743.391 +/- 0.002) মিটার যোগ করলে প্রয়োজনীয় দূরত্বের মান দাঁড়াচ্ছে (731278.0
+/- 0.2) মিটার বা প্রায় 731.278 কিলোমিটার। মহাদেশীয় পাত সঞ্চালন বা ভূমিকম্পের ফলে দুটি জায়গার দূরত্বের যে
সামান্য পার্থক্যও ঘটে তার হিসাবও রাখা হয়েছিল এই পদ্ধতিতে।
নিউট্রিনোদের জন্মবৃত্তান্ত তো আগেই জানা গেছে। এর পরেও তো বাকি থেকে যাচ্ছে অনেককিছু ; পুরো ব্যাপারটার অনেক অনেক খুঁটিনাটি। কিরকম? যেমন, উৎস থেকে প্রোটনরা কিন্তু একটানা বেরচ্ছিল না। তাহলে? ধরা যাক, শাটার দেওয়া একটা জানালা আছে। জানলাটা t সময় খুলে রেখে কিছু প্রোটনকে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হল অর্থাৎ প্রথম এক্সট্র্যাকশন করা হল। এরপর T সময় জানলাটা বন্ধ রেখে আবার t সময়ের জন্য খুলে প্রোটনদের এক্সট্র্যাকশন হল। ঠিক এভাবেই OPERA experiment –এ প্রোটন পাল্স্ যেতে দেওয়া হচ্ছিল t = 10.5 মাইক্রোসেকেন্ড ধরে। এভাবে দুবার প্রোটন পাল্স্ পাঠানো হচ্ছিল যাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল T = 50 মিলিসেকেন্ড। CNGS নিউট্রিনোদের CERN থেকে Gran Sasso যেতে কত সময় লাগে সেটা কিভাবে মাপা হচ্ছিল? এটা মাপতে একটু ঘুরপথ ব্যবহার করছিলেন বিজ্ঞানিরা। উৎস থেকে যে প্রোটনরা বেরচ্ছিল 10.5 ন্যানোসেকেন্ডে তাদের time distribution দেখা হচ্ছিল প্রথমে। সেটা কি? এই t = 10.5 মাইক্রোসেকেন্ড সময়টাকেও যদি আবার অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভেঙ্গে নেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে, যে সবসময় প্রোটন বের হবার সম্ভাবনা একরকম ছিল না। বিভিন্ন সময়ে প্রোটনরা কি ঘনত্বে বেরিয়ে আসছে তার সম্ভাবনার ছবিটাকে বলে প্রোটনদের Probability Density Function (Proton PDF)। (ছবি: ২)প্রোটনরা বেরিয়ে আসার সময় GPS এ একটা সিগ্ন্যাল যাচ্ছিল ও এই বেরিয়ে আসা প্রোটন তরঙ্গতে একটা stamp মারা হচ্ছিল ঠিক যেমন বিভিন্ন অফিসে কোন কাগজপত্র গ্রহণ করার সময় মারা হয়। তবে এক্ষেত্রে stamp টা একটু আলাদা, এটা হচ্ছে time stamp। কোন সময় প্রোটন বেরিয়ে এসেছে তার ওপর কড়া নজরদারি রেখে এই stamp টা মারা হচ্ছিল। যে বিশেষ জায়গা থেকে প্রোটন বেরিয়ে এল সেই coordinate-এর universal time –এর রেকর্ড রাখা হচ্ছিল GPS –এ। এই প্রোটন থেকেই তো আমরা পাবো নিঊট্রিনোদের। এখানে কিন্তু একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে। এটা উল্লেখ করা জরুরি যে, এই নিউট্রিনোদের জন্মকুন্ডলী নিয়েও ছিল ধোঁয়াশা! প্রোটন বেরনোর জানলাটা যতক্ষণ খোলা ছিল তার মধ্যে বেরনো যে কোন প্রোটন থেকেই তো নিউট্রিনো তৈরি হয়ে ডিটেক্টরে ধরা পড়তে পারে। আরেকটু সহজভাবে বলা যাক। যে 10.5 মাইক্রোসেকেন্ড ধরে প্রোটন বেরচ্ছিল তার মধ্যে কোন প্রোটন যে কোন নিউট্রিনোর পূর্বপুরুষ তা নিখুঁতভাবে বোঝার উপায় পাওয়া যাচ্ছিল না।
নিউট্রিনোদের জন্মবৃত্তান্ত তো আগেই জানা গেছে। এর পরেও তো বাকি থেকে যাচ্ছে অনেককিছু ; পুরো ব্যাপারটার অনেক অনেক খুঁটিনাটি। কিরকম? যেমন, উৎস থেকে প্রোটনরা কিন্তু একটানা বেরচ্ছিল না। তাহলে? ধরা যাক, শাটার দেওয়া একটা জানালা আছে। জানলাটা t সময় খুলে রেখে কিছু প্রোটনকে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হল অর্থাৎ প্রথম এক্সট্র্যাকশন করা হল। এরপর T সময় জানলাটা বন্ধ রেখে আবার t সময়ের জন্য খুলে প্রোটনদের এক্সট্র্যাকশন হল। ঠিক এভাবেই OPERA experiment –এ প্রোটন পাল্স্ যেতে দেওয়া হচ্ছিল t = 10.5 মাইক্রোসেকেন্ড ধরে। এভাবে দুবার প্রোটন পাল্স্ পাঠানো হচ্ছিল যাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল T = 50 মিলিসেকেন্ড। CNGS নিউট্রিনোদের CERN থেকে Gran Sasso যেতে কত সময় লাগে সেটা কিভাবে মাপা হচ্ছিল? এটা মাপতে একটু ঘুরপথ ব্যবহার করছিলেন বিজ্ঞানিরা। উৎস থেকে যে প্রোটনরা বেরচ্ছিল 10.5 ন্যানোসেকেন্ডে তাদের time distribution দেখা হচ্ছিল প্রথমে। সেটা কি? এই t = 10.5 মাইক্রোসেকেন্ড সময়টাকেও যদি আবার অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভেঙ্গে নেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে, যে সবসময় প্রোটন বের হবার সম্ভাবনা একরকম ছিল না। বিভিন্ন সময়ে প্রোটনরা কি ঘনত্বে বেরিয়ে আসছে তার সম্ভাবনার ছবিটাকে বলে প্রোটনদের Probability Density Function (Proton PDF)। (ছবি: ২)প্রোটনরা বেরিয়ে আসার সময় GPS এ একটা সিগ্ন্যাল যাচ্ছিল ও এই বেরিয়ে আসা প্রোটন তরঙ্গতে একটা stamp মারা হচ্ছিল ঠিক যেমন বিভিন্ন অফিসে কোন কাগজপত্র গ্রহণ করার সময় মারা হয়। তবে এক্ষেত্রে stamp টা একটু আলাদা, এটা হচ্ছে time stamp। কোন সময় প্রোটন বেরিয়ে এসেছে তার ওপর কড়া নজরদারি রেখে এই stamp টা মারা হচ্ছিল। যে বিশেষ জায়গা থেকে প্রোটন বেরিয়ে এল সেই coordinate-এর universal time –এর রেকর্ড রাখা হচ্ছিল GPS –এ। এই প্রোটন থেকেই তো আমরা পাবো নিঊট্রিনোদের। এখানে কিন্তু একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে। এটা উল্লেখ করা জরুরি যে, এই নিউট্রিনোদের জন্মকুন্ডলী নিয়েও ছিল ধোঁয়াশা! প্রোটন বেরনোর জানলাটা যতক্ষণ খোলা ছিল তার মধ্যে বেরনো যে কোন প্রোটন থেকেই তো নিউট্রিনো তৈরি হয়ে ডিটেক্টরে ধরা পড়তে পারে। আরেকটু সহজভাবে বলা যাক। যে 10.5 মাইক্রোসেকেন্ড ধরে প্রোটন বেরচ্ছিল তার মধ্যে কোন প্রোটন যে কোন নিউট্রিনোর পূর্বপুরুষ তা নিখুঁতভাবে বোঝার উপায় পাওয়া যাচ্ছিল না।
ছবি: ২ |
তাহলে এ অবধি যা বোঝা গেল তাতে GPS-এ ওই যে
দুটো সময়কে রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ব্যবধানই হল নিউট্রিনোদের যেতে যতটা সময়
লেগেছে। এই সময় লাগাটা যদি আলোর এই দূরত্ব যেতে যে সময় লাগবে তার সাথে তুলনা করা
যায় তাহলেই বোঝা যাবে কার বেগ বেশি – আলো না নিউট্রিনো! তার জন্য
প্রথমে দেখতে হবে আলোর কি সময় লাগা উচিত। আলোর বেগ তো জানাই আছে – 2.99792458 x 108 মিটার/সেকেন্ড। তাই CERN
থেকে Gran Sasso যেতে কত সময় লাগবে তা বার করতে পারবে যে কোন স্কুল
পড়ুয়াই। এই সময়টাকে বলা যাক Tc
। এবারে দেখতে হবে নিউট্রিনোদের কি সময় লাগছে। ধরা যাক
এই সময়টা পাওয়া গেল Tν । এই দুটো সময়ের পার্থক্য, δt = Tc - Tν । প্রাথমিক ভাবে যদি ধরে নেওয়া যায় যে নিউট্রিনোদের বেগ
আলোর সঙ্গে সমান তাহলে CERN থেকে Gran Sasso যেতে নিউট্রিনোদের আর আলোর একই সময় লাগার কথা। অর্থাৎ, সেক্ষেত্রে δt –এর মান হবে 0। বলা বাহুল্য, তা কিন্তু হয়নি এবং হয়নি বলেই এত সমস্যা দেখা দিয়েছে।
প্রোটনদের PDF আর নিউট্রিনোদের PDF এর ছবি একটা
অন্যটার উপর ফেলে, মানে superpose করে দেখা গেছিল এদের মধ্যে একটা time shift আছে, একটা অন্যটার
ঠিক ঘাড়ে ঘাড়ে পড়ছে না। ঘাড়ে ঘাড়ে পড়তে গেলে নিউট্রিনো PDF এর সময়টা
একটু সরিয়ে দিতে হবে, তাই δt –এর মান
শূন্য হবেনা। (ছবি: ৩)এভাবে δt-এর মানটা পাওয়া গেছে (1048.5 +/- 6.9 (statistical))। এরপরেও আছে কারেকশন। সেই সব ( 987.8 ন্যানোসেকেন্ড
) বাদ দিয়ে এবং যন্ত্রপাতির প্রমাদ ধরলে (7.4 ন্যানোসেকেন্ড) শেষমেশ ওই
মানটা দাঁড়ায় (60.7 +/- 6.9 (statistical) +/-
7.4 (system)) ন্যানোসেকেন্ড। কিন্তু এক্ষেত্রে
গণনায় তো একটা ভুল থেকে যায়! টানেলের কোথায় নিউট্রিনো তার জন্মদাতা মেসন থেকে তৈরি
হচ্ছে সেটা তো জানা ছিল না! এ প্রসঙ্গে অবশ্য OPERA টিম
জানিয়েছিল তাদের ব্যাখ্যা। আসলে মেসন কণাদের বেগ আলোর বেগের খুব কাছাকাছি। ধরা যাক, প্রোটন-টার্গেট
থেকে ডিটেক্টরে পৌঁছতে আলোর বেগে চলা কোন কণা সময় নেবে t1। আবার যদি
ধরা হয় মেসনরা ডিকে করার আগে পর্যন্ত তাদের নিজেদের বেগে চলেছে এবং বাকি রাস্তা
নিউট্রিনোরা গেছে আলোর বেগে এবং পুরো এই চলাটায় সময় লেগেছে t2, তবে t2 আর t1 –এর তফাৎ হয়
মাত্র .2 ন্যানোসেকেন্ড। অর্থাৎ, যেহেতু এখন
পর্যন্ত পাওয়া সবরকম কারেকশন ধরে নিলেও আলোর পৌঁছনোর সময়টা নিউট্রিনোর চেয়ে বেশি
তাই স্বভাবতই নিউট্রিনো আলোর চেয়ে বেশি গতিতে না গেলে এটা সম্ভব হত না!
কিন্তু এই ফলাফল কি সত্যিই সম্ভব? আইনস্টাইনের
special relativity অনুযায়ী আলোর বেগে চলতে গেলে কণাটির কোন ভর থাকা চলবে
না। আলোর বেগে পৌঁছতে গেলে ওর ভর সব পালটে ফেলতে হবে শক্তিতে। কিন্তু নিউট্রিনোদের
তো ভর আছে, তা সে যত কমই হোক না কেন। পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী নিউট্রিনো
আবার আলোর চেয়েও দ্রুতগামী। সেটাই বা কি করে সম্ভব? Special relativity তো এটাও বলেছে কোন কিছুর বেগ আলোর বেগের কাছাকাছি গেলেই তার
সময় ধীরে চলতে থাকে। তাই কোনভাবেই আলোর বেগের কাছে পৌঁছনোর উপায় থাকছে না। এই ফলাফল
যদি সত্যি হয় তবে আমাদের ভাবতে হবে special
relativity –র বাইরে গিয়ে।
CERN-এর রিসার্চ ডিরেক্টর Sergio Berlolucci এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “ When an experiment finds an apparently unbelievable result and can find no artifact of the measurement to account for it, it’s normal procedure to invite broader scrutiny.”
Fermilab, Chicago তে এ ধরণের এক্সপেরিমেন্ট আগে করা হয়েছিল। MINOS নামের এই
এক্সপেরিমেন্টটি হয় 2007 সালে। কিন্তু সেখানে এক্সপেরিমেন্ট-এর যে error margin ছিল
তাতে পরিষ্কার বোঝা যায়নি নিউট্রিনোরা সত্যিই দৌড়ে আলোকে হারিয়ে দেয় কিনা। CERN –এর OPERA এক্সপেরিমেন্ট-এ error margin ছিল 10 ন্যানোসেকেন্ড
(1 সেকেন্ডের 10 কোটি ভাগের 1 ভাগ)। এদিকে দেখা গেছে যে Geneva থেকে Gran Sasso যেতে আলোর যে সময় লাগার কথা, নিউট্রিনোরা
নিয়েছে তার চেয়ে 60 ন্যানোসেকেন্ড কম সময়। তাই error margin টাকে
গুরুত্ব দিলেও কিন্তু এই সময়ের তারতম্য হওয়াটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা হিসাবেই
পাওয়া যাচ্ছে ; অর্থাৎ কিনা , সংখ্যাটা এত ছোট হচ্ছে না যাতে ধরে নেওয়া যায় যে এই
পরিমাপটা আসলে আমাদের যন্ত্রপাতির ভুলে (ঠিক ভুল নয়, পরিমাপের ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে সহ্যমাত্রা) বা
ক্যালকুলেশনের প্রমাদে। এসব কারণে Fermilab,
Chicago চাইছে ফলাফলটা re-analyse করতে।
নিউট্রিনোদের অদ্ভুত আচরণ ব্যাখ্যা
করতে অনেক রকমের তত্ত্ব পাওয়া যাচ্ছে। এর সবগুলো এই পরিসরে জানানো সম্ভব নয় বা
জানানো খুব জরুরিও নয়। যে কটা বেশ আকর্ষক আমরা কেবল সেগুলোই এখানে আলোচনা করব।
১) একটা বড়সড় আপত্তি তুলেছেন
জ্যোতির্বিজ্ঞানিরা।
২) আর একটা তত্ত্ব দাবি করেছে, এক্ষেত্রে
তো ট্যাকিওন (Tachyon) বেরতে পারে।
৩) Andrew G. Cohen ও Sheldon L.
Glashow নামক দু'জন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী এক
অন্য আঙ্গিকে প্রশ্ন তুলেছেন এই অতিআলোকীয় ঘটনার বাস্তবতা সম্পর্কে।
৪) আরো একটি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে
নিউট্রিনো কনডেন্সেট্ বা ডার্ক এনার্জির সঙ্গে নিউট্রিনোদের interaction হয়।
এর ফলে নিউট্রিনোরা আলোর চেয়ে বেশি বেগে যেতে পারে। অন্য আরেকদল বলছেন OPERA টিম proton PDF এক্সট্র্যাকশনে
কিছু ভুল করে থাকতে পারে। হয়ত এমনটা হতেই পারে যে proton PDF আর neutrino
PDF পুরোপুরি এক নয়!
৫) OPERA-র জন্যে নতুন একটা সমস্যা তৈরি করেছেন ICARUS এক্সপেরিমেন্টের
সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা।
OPERA কর্তৃপক্ষ স্বভাবতই এতে খুশি নন। Cohen-Glashow দের
তত্ত্বকেও তারা পুরো স্বীকার করতে পারছেন না। ICARUS-ও তাদের বেশ
অস্বস্তিতে ফেলেছে। এখন সবটাই নির্ভর করছে নতুন গবেষণা তথা সময়ের উপর। আরো নতুন
তত্ত্ব ও ব্যাখ্যাই বলে দেবে কোনদিকে পাল্লা ভারি হয়! OPERA –র দাবি সত্যি হলে নতুন ঝড় উঠবে বিজ্ঞানের আকাশে।
পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্র হয়ত নতুন করে লিখতে হবে ; পুরনো
তত্ত্ব নতুন করে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে
বিজ্ঞানের গতি হয়ত সাময়িক ভাবে কিছুটা মন্দীভূত হবে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে ইতিহাসের
পুনরাবৃত্তি ইতিহাস নিজেই ঘটাবে, আবার ছুটবে অশ্বমেধের ঘোড়া, পিঠে
নবোদ্ঘাটিত সত্যে বর্মাবৃত বিজ্ঞান।
8. www.Stanford.edu.
10. phantom-of-opera.