ছবি: সুনন্দ |
গত বৃহস্পতিবার আমাদের
গাঁয়ে একটা সার্কাস এসেছিল। দূর দূরান্তের গাঁ থেকে অনেক লোক এসেছিল মজা দেখতে।
সকাল থেকে বৃষ্টি তে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল আমাদের গাঁ। পথ-ঘাঠ কাদায় মাখামাখা। এমনিতে
এ সময়টা বৃষ্টির কারণে প্রকৃতি সবুজ থাকে। মাটির ঘাস নিঃশ্বাস নেয়। নরম মাটি। তার
মধ্যে লোকে হেঁটে-দাপিয়ে আমাদের মাঠের বারোটা বাজিয়ে দিল। এখন আর ও-দিকে তাকানো
যায় না। গাঁয়ের লোক এত তো বোঝে না। বুঝবেই বা কী করে? তারা
তো এমনটাই দেখে আসছে গত ৩৪-৩৫ বছর ধরে। তখন গাঁয়ের দাদারা যা বলতেন,
কী হল সে দিন?
যা হল তা তো টিভি বাবুরা
দেখাল। কিন্তু যা দেখাল না বা যাদের দেখা গেল না, তা
নিয়ে দুটো কথা বলি। মানে স্টেজের এ পারের কথা। টুকরো টুকরো দুটো গল্প। বেশ মজার।
যাঁরা সে দিন স্টেজের ওপর ছিলেন, বা যাঁরা
স্টেজের ওপর থাকা পছন্দ করেন, তাঁরা তো
এ সব জানতে পারেন না। যাঁরা টিভি সেটের ওপারে ছিলেন, তাঁরাও
এ কথা জানতে পারেননি। তাই বলি।
সকালের বনগাঁ লোকালে
এসেছিলেন অসিত মাল। সঙ্গে ছিল বাদাম, চানাচুর, চিড়ে-র ছোট বড় প্যাকেট। মোটামুটি বিকেল তিনটের মধ্যে সব
খতম। তা হলে বিক্রি ভালই হাল? “তা হল
বাবু। এ বার ফিরব”, বললেন অসিত। কিন্তু এখনও
তো শেষ হয়নি। “ধুর নিকুচি করেছে। বউ ছেলে নিয়ে
ঘর করি। ওরা বলল। তাই আপনাদের গাঁয়ে আজ এসেছি। আগেও এসেছি। যখন দাদারা ছিল। একই
কারণে। এই দিনে সেল বেড়ে যায়।” নির্লিপ্ত
অসিত জানালেন।
রানাঘাট থেকে এসেছেন, চন্দন। ৬ বছরের মেয়ে আছে সঙ্গে। কেমন লাগছে?
“আর
দাদা, বলেন কেন। ভাবলাম মেয়েটাকে নিয়ে
একটু আপনাদের গাঁয়ে ঘুরব। ওর তো বেড়াতে যাওয়া হয় না। আমি মাছ বিক্রি করি। বটতলার
বাজারে। সময় কোথায়? তাই ভাবলাম...। কিন্তু আজ
যে বৃষ্টি লাগাল, কোত্থাও যাওয়া তো হলই না, মেয়েটাও ভিজল।” চন্দন
বলে চলেছেন। কিন্তু এখানে কেমন লাগছে? “ভাল কি
আর লাগে দাদা, কাদার মধ্যে, এক হাতে ছাতা, অন্য
হাতে মেয়ের হাত ধরা। মাথা অবধি কাদা...। সকালে বেরোনোর সময় বুঝিনি এই ভোগান্তি
হবে। বাজারে কাল ওরা বলল, ‘সকালে
যেন স্টেশনে দেখতে পাই’। না এসে
আর যাই কোথায়। তখনই ভাবলাম মেয়েটাকে নিয়ে যাই। গাঁ-টা দেখিয়ে আনি।”
ছবি: সুনন্দ |
চন্দন বা অসিত এসেছিলেন
প্রাণের রসদ জোগানোর লক্ষ্যে। বেঁচে থাকার তাড়না থেকে। এই রকম আরও অনেক চন্দন বা
অসিত সে দিনের ভিড়ে ছিলেন, যাঁদের
নিয়ে পরের দিন খবরের কাগজে সার্কাস কর্তৃপক্ষকে গর্ব ভরা মন্তব্য করতে দেখা
গিয়েছে। তাঁরা স্টেজের ওপর থেকে মাথা গুনেছেন। আনন্দ করেছেন এই ভেবে, ‘কত লোক আমাদের শো দেখতে এসেছেন।’ কিন্তু
তাঁরা কি জানতে পেরেছেন; ঘটে যা, তা সত্যি হয় না সব সময়? না
হলে, এর আগের যে দল আমাদের গাঁ-য়ে
সার্কাস করতে এসেছিল, তাঁদের আর কিছু দিনের
মধ্যে গাঁ ছেড়ে যেতে হত না। সে দিনও আশপাশের গাঁ থেকে অনেক লোক এসেছিল। এসেছিলেন
অসিত। চন্দনও। সে দিনও আমাদের মাঠের ঘাসগুলোর প্রাণ কেঁদে উঠেছিল। কেউ শোনেনি সে
কান্না।
তবে, যতদূর মনে পড়ে, সে দিন
বৃষ্টি হয়নি।