Sunday, July 31, 2011

সাজ - সতেরো -- নির্মাল্য


ছবি: সুনন্দ

সাজসজ্জা। বাংলা অভিধানের অনেক আপাত- নির্বিষ সন্তানদের মধ্যে একটি। বিখ্যাত, সুপ্রাচীন (কারণ ভাষার জন্মের অনেক আগে এটি পৃথিবীর আলো দেখেছে) এবং victory stand এ ক্ষুন্নিবৃত্তির ঠিক নীচেই দেখা যায় একে। আক্ষরিক অর্থেই আমার-আপনার আপাদনখশির এরই তত্ত্বাবধানে। ব্যাপারটার জন্মকাল সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা একমত নন। সম্ভবত ঠান্ডা-গরম-লজ্জার হাত থেকে বাঁচানোর অছিলায় বস্ত্রছদ্মনামে সভ্যতার ইতিহাসে এর অনুপ্রবেশ। তারপর জীবনের প্রয়োজন দেখা দিল Addiction রূপে......কাটিলে সময়। খুব শীঘ্রই দেহাবরণ ছাড়াও একে একে এসে গেলো দেহাভরণেরা- মাকড়ি, হার, বাজুবন্ধ,

মল......শ্রীদুষ্টের অষ্টোত্তর শতনামের মতো। নারী-পুরুষের প্রয়োজন ও গঠন অনুযায়ী ওগুলির শ্রেণীবিভাগ হতেও দেরী হলো না বিশেষ (গুস্তাখি মাফ, কিন্তু শ্রেণীবিভাগ আজকাল মুছেও গেছে বেশ, জয়, সমানাধিকারের জয়!)। ধর্ম, জাতি অনুসারে উপবিভাগও হলো শক্তপোক্ত রকমের। চেতনার বিভিন্ন রকম রঙে সবুজ, নীল, লাল- রকমারি পান্না ও চুনি উঠলো অঙ্গে- ঐক্যের মাঝে বৈচিত্র্যের মতো।
প্রথমেই কেশকীর্তন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সীমানা ছাড়িয়ে ইতিহাস বলছে লম্বা চুলের কথা, নর-নারী উভয়েরই। একসময় যা ছিলো বাধ্যবাধকতা (কাঁচা মাংস খেতে হতো কিনা, কাজেই সেলুন তখনো স্বপ্নেই)কালে তা হয়ে দাঁড়ালো style statement পরের চুল (পরচুলার কথা বলছিলাম আর কি) ব্যবহার করার বাসনাও আজকের নয়। কিন্তু হায়, দিন বদলে গেলো দ্রুত, আজ নিজের চুলই ব্যবহার করার ইচ্ছে নেই কারুর। রিনাদি, অনামিকা-রা চটজলদি বদলে নিয়েছে রুচি। পার্লারে এক ঘণ্টার অর্থনাশ- তারপরেই বাঃ বেশ স্মার্ট লাগছে তো আমায় দেখতে!হ্যাঁ, জানি যুক্তি আছে, ঘোমটা মাথায় হাড়ী ঠেলার দিন আর নেই- বাসে ট্রামে লম্বা বেনী দুলিয়ে গিয়ে দেখো চাঁদু, কেমন লাগে আমাদের......বুঝলেন পুরুষেরা, এগিয়ে এলেন অনেকেই, “কে লইবে মোর কার্যডাকে সাড়া দিয়ে অনেকেই রাখছেন পিঠ অবধি লম্বা (এর চেয়ে বেশী প্রকৃতি মেনে নেয় নি......কাজেই) কেশদাম, দামী সাবান তেলে যত্নও করছেন দস্তুরমতো, কেউ বা গীটার হাতে পেলেই লম্বা চুল ঝাঁকানোর প্রয়োজন বোধ করতেন, সুবিধে হলো তাদেরও।
চুলোচুলির পালা শেষ করে আসুন চাঁদবদনে। বিধাতার দেওয়া এই ক্যানভাসে চিত্রায়নের অধিকার প্রত্যেকে উপভোগ করছি আজন্ম। শুরু হয়েছিলো সাদা গুঁড়ো মেখে একটু আলোকিত হওয়ার বাসনা থেকে, তারপর আজ আর চাঁদবদন চাইছে না কেউ। মানে কালো কালো ছোপ ছোপ এর হাত থেকে রক্ষা করতে হাজির হাজারো মলম, কেউ বা সূর্যতাপের রক্ষাকবচ, কেউ আবার গ্যারান্টি দিচ্ছে রুক্ষ-শীতের পরশ থেকে বাঁচাবে বলে। কাজেই নো চিন্তা...... এর ওপর আছে থুতনির নীচে, গর্দানের পিছে, কানের গোড়ায়, চোখের কোণায় লাখো লাখো ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট / রংচঙে ছোটবড় উল্কি। সতেরোর পর থেকেই বড়, মেজো, ছোটো করে বা এক্কেবারে সাফ করে ক্ষৌরকর্ম সম্পাদন পুরুষের প্রয়োজনমাত্র নয়, সজ্জাবিলাসও বটে। এছাড়া নবতম সংযোজন (বা প্রত্যাবর্তনও বলা চলে), বিভিন্ন আকার ও প্রকারের ঝিলিক মারা কানের দুল- সব মিলিয়ে বদলে গেছে মুখের ভাষা
এর মাঝে এসেই পড়লো গয়নার কথা, অলঙ্কার আর অহঙ্কার এর দুর্বোধ্য সীমারেখায় সজ্জার বিচরণ চিরকালীন। পোড়ামাটি থেকে তামা হয়ে রূপোর ছোঁওয়া নিয়ে তারপর আক্ষরিক অর্থেই এলো স্বর্ণযুগ, আবার মূল্যবৃদ্ধির ছোট্ট ধমক খেয়ে ব্যাক টু পাস্ট। রূপোর ওপর জলকরিয়ে, তামা, টিন এমনকি লোহার কাঠামো দিয়ে আবার পোড়ামাটিতে পুনর্মূষিক। পকেটের সাথে তাল মিলিয়ে glamour এর সংজ্ঞা বদলে নিয়েছেন আধুনিক(কা)রা। স্বর্ণবিপণী গুলি যদিও ঘটা করে বিজ্ঞাপনের ঘাটতি রাখছে না, তবু দিব্বি চলছে পাইরেসির রমরমা। রকে বসে ঝাড়ি মারতে পাঁচ টাকা পিস হীরে কানে নিচ্ছে আজকালকার হীরো। আর ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে যাওয়ার অভিনয় করার জন্য ধান-চালের গয়নাই কিশোরীর প্রথম পছন্দ।

লিঙ্ক

এইবার পরিচ্ছদের পরিচ্ছেদ, সজ্জাপুরাণে এইটি সবচেয়ে বিতর্কিত এবং নিঃসন্দেহে মুখরোচক অধ্যায়। কেষ্ট নিজের ফেরেন্ডোকে জীবনের নশ্বরতা বোঝাতে গিয়ে ছেঁড়া কাপড়ের উপমা দিলেন মিষ্টি করে, কিন্তু ঐ যে বলেছে চোরা না শুনে ধরমের গপ্পো”, কাজেই সাজগোজের main dish হিসেবে জামাকাপড় নিয়ে আদিখ্যেতা বাড়লো বই কমলো না। গাছের ছাল টু হাউস কোট- বিবর্তনের সবকটি ধাপ ডিঙ্গিয়ে যাওয়া গেছে অনায়াসে। হঠাৎ করেই একদিন মানবকুল উপলব্ধি করলো বিশ্ব-উষ্ণায়নের বিপদ, মানে, এই নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ঢের আগেই সক্কলের মনে হলো আঃ, গরমে গেলুম বাপু! অতএব একটি একটি করে অন্তর্ধান করলো বাড়তিরা। লজ্জা বলে বস্তুটি যখন নিভু নিভু হয়ে এল একসময়, তখন সেটি নিবারনের জন্য প্রয়োজনীয় আবরণও শীর্ণতর হয়ে এসে এখন বিলুপ্তির পথে। মানবসমাজ গোড়ালি-ছোঁওয়া কাপড়চোপড় ত্যাগ করেছে বহুদিন হলো। ঐতিহ্য কে কাঁচকলা দেখিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে এখন জনপ্রিয় হয়েছে হাওয়া খেলানো- লোক দেখানো এবং অবশ্যই মন ভোলানো বস্ত্র-খণ্ড
তাহলে যে প্রশ্নটা করি করি করেও দুর্মুখ কলমের উপদ্রব সহ্য করছিলেন চুপ করে, এবার সেটির পালা। তা, হ্যাঁ রে, এই যে অনর্গল বাজে বকলি এতক্ষণ ধরে, তোর গায়ে কি ধুতি চাদর? মাথায় কি টেরি বাগাস নি? নাকি সুযোগ পেলে ঘড়িটা চেনটা পরবি না?” আজ্ঞে, ঠিকই পরবো, আপনি জানেন না, এরই মাঝে দুবার আয়নাকে বাধ্য করেছি আমার মুখশ্রী দেখতে (সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানিয়েছে আমরা নারীপুরুষ মিলে গড়ে জীবনের প্রায় চারটি বছর নাকি এই কর্মটি করে কাটাই !!)। আসলে ওই যে মন্দ লোকে বলেছে না কি যেন.....ও হ্যাঁ, পররুচি পহেননা..., এই আমার মোক্ষম সুযোগ, সবই তো আপনারই জন্য। অতএব, সাজছি মোরা সাজছি দেখো......

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই