ছবি: সুনন্দ |
আমার নামটা দেখে হয়তো আমার পরিচিতেরা আন্দাজ করতেই
পেরেছে আমি কে। আমি সেই ভাগ্যবান কিছু মানুষের মধ্যে একজন যারা নিজেদের পছন্দের
কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ পায়। পড়াতে আমি ভালবাসি। আমার জীবনের
অবিচ্ছেদ্য অংশ আমার ছাত্রীরা। যতক্ষণ স্কুলে থাকি ওদের ভালমন্দ, পড়াশুনো, চাওয়া-পাওয়া,
হাসিকান্না সবকিছুর সাথে জড়িয়ে পড়তেই হয়। স্বাভাবিকভাবেই আমার লেখায়
ওদের কথা চলে আসবেই। বয়সে অনেক ছোট হলেও ওদের প্রত্যেকেই এক-একজন পূর্ণাঙ্গ
অস্তিত্ব। প্রায় পনেরশোটা মানুষ একসাথে এক
ক্লাস সিক্সের সাবিনা* সেদিন কল্পনা* দিদিমণির হাতে
এনে ধরালো একটা বড়সড় টিফিনবাক্স। কল্পনাদি স্কুলের অন্যতমা বয়োজ্যেষ্ঠা শিক্ষিকা।
জিজ্ঞেস করলেন, “কি আছে রে এটাতে?” মেয়েটি বলল, “দিদি, কাল সবেবরাত ছিল তো, মা
হালুয়া বানিয়েছিল। এটা আপনারা সবাই একটু একটু খাবেন।” বলেই
দিল ছুট। স্টাফরুমের বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বড়দির নিষেধ। কল্পনাদি প্রথমে
খুব আনন্দ পেলেন। মেয়েরা মাঝেসাঝে জন্মদিনে চকোলেট খাওয়ায় দিদিদের। হালুয়ার
ব্যাপারটা বেশ অভিনব। স্টাফরুমে ঢুকে কল্পনাদি খুব উৎসাহ নিয়ে সবাইকে বললেন
ঘটনাটা। সকলে খুব উৎসাহ নিয়ে শুনলো, মেয়েটির নাম জানতে চাইলো;
সবেবরাত এবার রবিবার থাকায় আমরা ছুটি পাইনি এ কথাও হল। আরেকটু এগিয়ে
কেউ কেউ বললেন মুসলিম পরব বলে কম গুরূত্ব না দিয়ে সোমবারও ছুটিটা দেওয়া যেত।
টিফিনের সময় কল্পনাদিই নিজে দায়িত্ব নিয়ে সকলকে
হালুয়া বিতরণ করলেন। মুখে দিয়ে দেখলাম ঘি চপচপে, কাজু কিসমিস দেওয়া - অতি উন্নত মানের
রান্না নয়, তবে মন্দ নয় খেতে। বোঝা যায়, সীমিত আয়োজনে যথাসাধ্য লৌকিকতা করার চেষ্টা। ঈদে খাওয়া সেমুইএর কথা মনে
পড়ল। বাল্য-বান্ধবীর বাড়িতে খেয়েছিলাম একবার। বড়ো যত্ন করে খাইয়েছিলেন ওর মা।
হালুয়া খাওয়ার পর পাশে চোখ যেতে দেখলাম শর্বরীদির ভাগটা পড়ে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম “কি ব্যাপার, খাবেনা?” বললেন “আমার পেট ভরে গেছে, তুই খেয়ে নে।” মহানন্দে ওঁর ভাগটাও খেয়ে ফেললাম। তারপর বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে ডাস্টবিনে
নজর যেতে দেখলাম প্রচুর হালুয়া পড়ে রয়েছে। কিছু বুঝতে আর বাকি রইলনা।
বাড়ি ফেরার সময় অটোতে বীণাদি* শর্বরীদিকে হঠাৎ
জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, তুই হালুয়া খেয়েছিলি?” শর্বরীদি মাথা নাড়লেন। বীণাদি বললেন, “আমিও খাইনি।
কার না কার বাড়ির রান্না; আমার খুব পিটপিটানি- রান্না করা
খাবার আমি যার তার বাড়ির খাইনা।” একবার শুধু জিজ্ঞেস করতে
ইচ্ছে হল, বীণাদি, রেস্তোঁরা থেকে আনা
যে খাবারগুলো স্কুলে বসে মাঝে মাঝে আপনি খান, সেগুলো খেতে গা
পিটপিট করেনা?
খারাপ লাগছিল শুধু সাবিনার জন্য- ছোটবেলা থেকে সব
মানুষ সমান বলে যে বুলিটা দিদিরা ক্লাসে পড়ানোর সময় আওড়ান, সেটা না বলে তাঁদের মনের সত্যটা
শেখালে ও কোনদিনও বাড়ি থেকে হালুয়া আনার ধৃষ্টতাটুকু করতো না।