Thursday, March 1, 2012

মধ্যবিত্ত ভীরু প্রেম -- কূপমণ্ডূক

জানো, বহুদিন হয়ে গেল, বাড়িতে মিথ্যে কথা বলা হয় নি। নোট নিতে আজকাল আর বন্ধুর বাড়ি যেতে হচ্ছে না... বা এক্সট্রা ক্লাসগুলোও
এখন আর হয় না। আসলে তো কোনকালেই হতো না। কিন্তু মা তো জানতো না। তোমার জন্য পড়ুয়া ছেলের ইমেজটার কোনোদিনই ক্ষতি হয়নি বাড়িতে। তবে এখন সময়মতো স্কুলে যা, ক্লাস নিই, কফিহাউসে আড্ডা মারি, কখনো রাত জেগে পড়াশুনো করি, সিনেমা দেখি। কখন যে দিনটা শেষ হয়ে যায়... তোমার জন্য নষ্ট করার সময় করে উঠতে পারি না। কি? ‘নষ্টকথাটা শুনতে খারাপ লাগলো? এখনও লাগে?


 তুমি আছো আর তুমি নেই- এর মাঝখান থেকে শেষবার তোমাকে লিখেছিলাম... তোমার মনে আছে? আমি অবশ্য ভুলিনি। এমনি, মনে রাখতে চেয়েছিলাম তাই। সেখানে বেশ ভালোই ছিলাম। আমার বলে অনেক কিছু ছিল সেখানে। 
সকাল-বিকেলের সঙ্গী একটা খুব প্রিয় সাইকেল ছিল, আর সঙ্গী বলতে বেপাড়ায় যাওয়ার... তোমার পিছু নেওয়ার সাহস। সেখানেও কেন জানি না দু-এক জোড়া পরিচিত চোখ কোথা থেকে জুটে যেত। ফুচকাওয়ালাটাও থাকতো সেখানে নিয়মকরে, আইসক্রিম পার্লারটাও ছিল একটু দূরে... যদিও স্বপ্ন দেখায় বার বার বাধ সেধেছে পকেট। বাড়ি ফিরেও চার দেওয়ালের মধ্যে কত না ছিলে তুমি। কখনো বইয়ের তাকে, খাতার ভাঁজে, কখনো বা ডায়েরির শেষের পাতায়, খাপছাড়া কবিতায়... তারপর একরাত্রি স্বপ্নে- একস্বপ্ন ঝকঝকে সকালে... এরকম অনেক টুকরো, তোমাকে ছড়িয়ে রেখেছিলাম চারিদিকে। সপ্তাহে তিনবার মাত্র কয়েক ঝলক দেখা- তাই পুঁজি করে গান বেঁধেছিলাম মনে মনে- এই ক্ষণ যেন সব ক্ষণ...”। বাকিটা ভুলে গেছি। একটা ভাঙ্গাচোরা তুমিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো আমার কমবয়স। কেন এরকম করতাম ঠিক জানি না। শুধু জানতাম ডানদিকের শেষ সীটটা খালি থাকলে সেদিন আর টিউশনে থাকার কোনো মানেই হয় না। চোখ বন্ধ করলে টেবিলের উপর রাখা তোমার হাতদুটো ছাড়া কিছুই ভালো করে মনে আসতো না। আসলে ভালো করে কখনো তোমার দিকে তাকিয়ে দেখা হয়নি। একদিন উপলব্ধি করলাম, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখার সাহসটাই আমার কোনোদিন ছিল না। সেদিন বাড়িতে অনেক রাগ দেখিয়েছিলাম। রাতে খেতে যানি, একসপ্তাহ বাড়িতে ভালো করে কথা বলিনি কারো সঙ্গে। এই মধ্যবিত্ত ছাপোষা পরিবারে জন্মানো, বাংলা মাধ্যমের স্কুল, বছরে মাত্র একবার নতুন জামা-  সবকিছুতে ঘেন্না ধরে গেল। একরা অনেকটা বড়...... জীবনটাকে অন্যরকম ভাবে শুরু করতে ইচ্ছে হয়েছিল সেদিন। স্কুল পেরিয়ে একলাফে চাকরি পেয়ে যেতে ইচ্ছে করলো একদিন, অনেক টাকা মাইনের চাকরি। ঠিক কতটা পথ একসাথে চললে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখা যায়, সেদিন জানতাম না। অবশ্য আজও জানি না। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সে অজানা রাস্তায় ছুটতে চেয়েছিল, আমি-তুমি-র বাইরের বিরাট একটা সমাজটাকে চিৎকার করে অস্বীকার করতে চেয়েছিল সেদিন। কে জানো? আমার কোষে কোষে ঘুণ ধরা মধ্যবিত্তয়ানা।
সত্যি বলছি, সেসব বোধ আর বেঁচে নেই। তাদের আমি গলা টিপে মেরে ফেলেছি বহুদিন। মধ্যবিত্তের গণ্ডির অনেক বাইরে বাইপাসের ধারে একটা ফ্ল্যাটে এখন আমার একা জীবন। বৃষ্টির রাতে গলায় দামি  হুইস্কি ঢালতে ঢালতে তাই তোমার অমঙ্গল কামনার দুঃসাহস এখন আমার আছে। ভাবি, রাজারহাটের চারতলার ঘরে খুব জোরে এসি চলে, তবু সারারাত তোমার ঘুম আসে না। এতদিনের সংসারের পরও বিছানায় পাশের লোকটা তোমার অচেনা থেকে যায়। রাতের পর রাত ঐ অচেনা শরীরটার সঙ্গে মিলিত হতে তোমার গা গুলিয়ে আসে। তুমি বারান্দায় বেরিয়ে আসো ভেজা চোখে। আমার জানালা থেকে চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় তোমার চোখ চকচক করে। খুব ভাবতে ইচ্ছে করে, তুমি ভালো নেই...... তুমি ভালো থাকতে পারো না আমায় ছেড়ে......
জানি, এসবের কিছুই হয়তো সত্যি নয়, তবু ভাবনাগুলোকে বাধা দিই না। তারা আসে আর সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যায়। তারপর অনেক রাতে নেশা কেটে গেলে শুতে যাই। খুব ঠাণ্ডা লাগে বিছানাটাকে। এককোণে কুঁকড়ে পড়ে থাকি। তবু শীত কাটে না। বুঝতে পারি, এবার সব মুখোশ খুলে যাবে। আসলে আমার একটা মধ্যবিত্ত প্রেম বহুদিন আগেই তোমার কাছে হেরে গেছে।


About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই