<<আগের সংখ্যা
প্রতিমার কথা
আমার ব্যবসা বাড়ছে- কাজ
বাড়ছে দ্বিগুণ গতিতে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যন্ত্রের কানায় মরচে ধরছে, তেল পড়ছে
না, সব যেন ঠিক মসৃণ নয়। কি করে পারি? নিজের চোখে সব কিছু সব দিন দেখা সম্ভব না।
দশভুজাও একা দশ জায়গায় থাকতে পারতেন না একইসঙ্গে।
কিন্তু বিশ্বাস করে দায়িত্বটা দেবো কাকে? যাদের বিশ্বাস করি, তাদের অভিজ্ঞতা নেই- যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা সবক’টা চোর। এই যে অপরাজিতা মেয়েটা। ভালো ঘরের মেয়ে, মিষ্টি দেখতে, নিজেকে গুছিয়ে রাখতে জানে, চলনে বলনে স্পষ্ট বনেদী ছাপ আছে- এককথায় দোকানের অ্যাসেট। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেও নিজে মোকাবিলা করতে পারেন না। ক্ষমতা নেই তা নয়। আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত অভাব। কি হয়েছিলো সকালে? না, চল্লিশ পিস্ একই প্রিন্টের ব্র্যান্ডেড ছাপা শাড়ি আনা হয়েছিলো- যাদের লেবেল তুলে দিয়ে সুতোর ঢাকা কাজ করতে পাঠানো হয়েছিলো সুরেনের হাতে- মেদিনীপুর। পনেরো দিন পর আজ তার অর্ধেক এসে পৌঁছেছে সকাল ন’টায়। দোকান তখন বন্ধ। গোডাউনে মাল রেখে দিয়ে সুরেন ফিরতি ট্রেন ধরে ভাগল্বা। বেলা দশটায় তুই মেয়ে এসে দেখলি তার মধ্যে পাঁচখানা শাড়ির আঁচলে টারকোইযের বদলে সায়ান সুতো ব্যবহার করেছে, তোর কি কর্তব্য? সুরেন তখনো খাওয়া-দাওয়া সেরে হাওড়াও হয়তো পৌঁছয়নি। একটা ফোন করলে মানুষটা এসে নিয়ে যেত, পরের লটে বদলি পাওয়া যেত। তা না করে বিদ্যেধরী আমার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। বেলা এগারোটায় যখন খবর আমার কানে পৌঁছলো, ততক্ষণে খড়গপুর লোকাল পাঁচ-ছ’খানা স্টেশন পেরিয়ে গেছে। এখন এই পাঁচ খানা গেলো খরচের খাতায়- ওই ক’টা কখনো আলাদা করে পাঠানো সম্ভব? বিষয়টা ক্ষতির নয়। কতই বা খরচ হলো আর এমন। কিন্তু এর পিছনে যে অদক্ষতাটা, সেটার শিকড় অনেকদূর পর্যন্ত ছড়ানো। আজ অপরাজিতার জায়গায় মানসী থাকলেই সব ঠিক থাকতো, কিন্তু সে আবার আরেক জিনিস। মুখের ওপর বলে দেবে- ‘আমার কিন্তু ওটা কাজ নয়।’ আরে! এই বুটিকেই তো চাকরি করিস- তার ভাল-মন্দ দেখা তোর দায়িত্ব নয়! অথচ জানেন, আজ থেকে আট বছর আগে যখন ‘সম্পূর্ণা’ একটা ছোট্ট দোকান ছিলো, কোথাও কোন শাখা তৈরি করার কথা আমাদের মাথাতেও ছিলো না, তখন এই মেয়েই বাকি চারজনের সঙ্গে থেকে কি পরিশ্রম করেছে উদয়াস্ত, সে আমি নিজের চোখে না দেখে থাকলে বিশ্বাস করতাম না। রাত সাড়ে দশটাতেও অনেক দিন দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়নি। তারপর কলকাতায় কত রাস্তা খোঁড়া হলো, পরিবর্তন পুরনো হল, মানসীর মেয়ে হলো, টিনার ডিভোর্স আর চেতনার মা-ও মারা গেলেন। আমি তিতিরের বাবাকে না জানিয়ে তিতিরের এক ভাই বা বোন কে জন্মানোর আগেই স্বর্গের দ্বার দেখালাম। এখন গোটা কলকাতায় তিনটে আউটলেট আমাদের। ‘সম্পূর্ণা’ পুরনো জায়গা ছেড়ে উঠে এসেছে গড়িয়াহাটের কাছে, মানে আমার বাড়ির আরও কাছে। মৌলালির কাছে খুলেছে ‘পরিপূর্ণা’ আর
‘স্বভূমি’ তে ‘আধুনিকা’। বাইশজন নিয়মিত কর্মী আমার ওপর নির্ভরশীল-দোকান, গোডাউন আর পরিবহন মিলিয়ে। নিজেদের দু’টো ম্যাটাডোর আছে আর আমার একটা
স্যান্ট্রো। ছ’খানা হ্যান্ডলুম গোষ্ঠী ঠিকে হিসেবে আমাদের হয়ে কাজ করে। আমাদের
তৈরি জিনিস বিক্রি হয় কলকাতার প্রায় সমস্ত শপিং মলে, বড় দোকানে এমনকি ছোট অসংখ্য
ব্লাউজের দোকানেও। পরপর দু’টো হস্তশিল্প মেলায় আমরা স্টল দিয়েছি- প্রতিবারই দারুণ
সাড়া পেয়েছি। ক্রেতাসংখ্যা বেড়েছে লাফ দিয়ে দিয়ে। নিজেদের উকিল আছে,
অ্যাকাউন্ট্যান্ট-ও। মৌলালি আর গড়িয়াহাট অঞ্চলের মোট ছ’টা ক্লাবকে প্রতি পুজো আর
কালী পুজোয় মোটা চাঁদা দেওয়া হয়। দু’টো বড় আর একটা ছোট পার্টিকে নিয়মিত ডোনেশন
দিই। ফলে মেয়েগুলো রাত হলেও বাড়ি ফিরতে ভয় পায় না। সবাই জানে ওরা ‘সম্পূর্ণা’র
মেয়ে। আগের অ্যাড এজেন্সিকে ছেড়ে নতুন এজেন্সি ধরেছি। ওয়েব-সাইট তৈরি হচ্ছে।
ফিউচার গ্রুপের সঙ্গে কথা চলছে, বিগ বাজারে আমাদের প্রোডাক্ট রাখা নিয়ে।
আগে যা ঘটেছে:
তিতিরের ‘জেম্মা’ আদতে টোটার মা হলেও তিতিরকেই নিজের মেয়ের মতো দেখেন আর তার
মা বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকায় নিজেই মানুষ করার ভার নিয়েছেন। তিতিরের সঙ্গে নিজের
গত জীবনের প্রেমাস্পদ অবিনাশের ছেলে প্রবীরের প্রেমের কথা টোটার কাছে জানতে পেরে
নিজের উদ্যোগে সেই সম্পর্ক ভেঙে দেন। উলটে জানতে পারেন বাড়ির আশ্রিত বিশাখাকে নিয়ে
কে বা কারা গুজব রটাচ্ছে। প্রবীরের সাথে সম্পর্কের ইতি হওয়ার পর তিতির কাঁদতে
কাঁদতে জেম্মাকে জিজ্ঞেস করে তার জেঠু বেঁচে থাকলে ভাল হতো কি না।প্রতিমার কথা
পই পই করে বলে দেওয়া
হয়েছে যে সামান্য সাত-দশটা শাড়ি নিয়ে গোলমাল হলে আমায় যেন না ডাকে, তাও ওই
ভ্যাবলামুখী অপরাজিতা মেয়েটার কি আমায় না জ্বালালেই চলছিলো না? সকাল এগারোটায় কোনো
বুটিক-চেন এর মালকিন দোকানে আসা তো দূরে থাক, দোকান খোলার কথাও ভাবে না, সেখানে
তোমার বস্ এসে পৌঁছনো মাত্র তুমি নিজের অক্ষমতার ফিরিস্তি নিয়ে হাজির হবে? সব
কিছু বলে দেবে- করে দেবে প্রতিমাদি-ই যদি, তবে আর কি- বাকি পাওনা টাকা তুলে নিয়ে
মানে মানে চলে গেলেই তো পারো! সেই কথাই স্পষ্ট করে বলায় শুরু হল নাটক! সক্কাল
সক্কাল ধিঙ্গি মেয়ের নাকের জল দেখলে মাথায় আগুন চড়বে, তাতে আশ্চর্য কি? সেই যে সকালে
শুরু হয়েছিলো দুর্যোগের, সন্ধ্যেবেলা সেটাই চরমে পৌঁছলো।
কিন্তু বিশ্বাস করে দায়িত্বটা দেবো কাকে? যাদের বিশ্বাস করি, তাদের অভিজ্ঞতা নেই- যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা সবক’টা চোর। এই যে অপরাজিতা মেয়েটা। ভালো ঘরের মেয়ে, মিষ্টি দেখতে, নিজেকে গুছিয়ে রাখতে জানে, চলনে বলনে স্পষ্ট বনেদী ছাপ আছে- এককথায় দোকানের অ্যাসেট। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেও নিজে মোকাবিলা করতে পারেন না। ক্ষমতা নেই তা নয়। আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত অভাব। কি হয়েছিলো সকালে? না, চল্লিশ পিস্ একই প্রিন্টের ব্র্যান্ডেড ছাপা শাড়ি আনা হয়েছিলো- যাদের লেবেল তুলে দিয়ে সুতোর ঢাকা কাজ করতে পাঠানো হয়েছিলো সুরেনের হাতে- মেদিনীপুর। পনেরো দিন পর আজ তার অর্ধেক এসে পৌঁছেছে সকাল ন’টায়। দোকান তখন বন্ধ। গোডাউনে মাল রেখে দিয়ে সুরেন ফিরতি ট্রেন ধরে ভাগল্বা। বেলা দশটায় তুই মেয়ে এসে দেখলি তার মধ্যে পাঁচখানা শাড়ির আঁচলে টারকোইযের বদলে সায়ান সুতো ব্যবহার করেছে, তোর কি কর্তব্য? সুরেন তখনো খাওয়া-দাওয়া সেরে হাওড়াও হয়তো পৌঁছয়নি। একটা ফোন করলে মানুষটা এসে নিয়ে যেত, পরের লটে বদলি পাওয়া যেত। তা না করে বিদ্যেধরী আমার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। বেলা এগারোটায় যখন খবর আমার কানে পৌঁছলো, ততক্ষণে খড়গপুর লোকাল পাঁচ-ছ’খানা স্টেশন পেরিয়ে গেছে। এখন এই পাঁচ খানা গেলো খরচের খাতায়- ওই ক’টা কখনো আলাদা করে পাঠানো সম্ভব? বিষয়টা ক্ষতির নয়। কতই বা খরচ হলো আর এমন। কিন্তু এর পিছনে যে অদক্ষতাটা, সেটার শিকড় অনেকদূর পর্যন্ত ছড়ানো। আজ অপরাজিতার জায়গায় মানসী থাকলেই সব ঠিক থাকতো, কিন্তু সে আবার আরেক জিনিস। মুখের ওপর বলে দেবে- ‘আমার কিন্তু ওটা কাজ নয়।’ আরে! এই বুটিকেই তো চাকরি করিস- তার ভাল-মন্দ দেখা তোর দায়িত্ব নয়! অথচ জানেন, আজ থেকে আট বছর আগে যখন ‘সম্পূর্ণা’ একটা ছোট্ট দোকান ছিলো, কোথাও কোন শাখা তৈরি করার কথা আমাদের মাথাতেও ছিলো না, তখন এই মেয়েই বাকি চারজনের সঙ্গে থেকে কি পরিশ্রম করেছে উদয়াস্ত, সে আমি নিজের চোখে না দেখে থাকলে বিশ্বাস করতাম না। রাত সাড়ে দশটাতেও অনেক দিন দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়নি। তারপর কলকাতায় কত রাস্তা খোঁড়া হলো, পরিবর্তন পুরনো হল, মানসীর মেয়ে হলো, টিনার ডিভোর্স আর চেতনার মা-ও মারা গেলেন। আমি তিতিরের বাবাকে না জানিয়ে তিতিরের এক ভাই বা বোন কে জন্মানোর আগেই স্বর্গের দ্বার দেখালাম। এখন গোটা কলকাতায় তিনটে আউটলেট আমাদের। ‘সম্পূর্ণা’ পুরনো জায়গা ছেড়ে উঠে এসেছে গড়িয়াহাটের কাছে, মানে আমার বাড়ির আরও কাছে। মৌলালির কাছে খুলেছে ‘পরিপূর্ণা’ আর
কি বলতে কি বলে চলেছি।
আসলে কি জানেন, দিবা-রাত্রি এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে এখন এমন হয়েছে যে অপছন্দের লোকের
বাজে কথা শুনতেও আর অসুবিধে হয় না। শুধু কানের সুইচ অফ্ করে পড়ে থাকা কাজের কথা
ভাবতে শুরু করি। পোক্ত ব্যবসাদার হয়ে উঠেছি। যারা এককালে হাসতে হাসতে কেটে কেটে
বলেছিলো- ‘জানো তো, বাঙালির দ্বারা ব্যবসা হয় না, তায় তুমি তো আবার ইশকুল
মাস্টারের মেয়ে...’ তারা এখন নতুন আলাপীদের সঙ্গে খাতির জমায় আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত
আলাপের কথা বলে। সাফল্যের নেশা, কাজের নেশা কি জিনিস, সেটা যারা অনুভব করেনি তাদের
পক্ষে আন্দাজ করাও সম্ভব নয়। স্বীকার করতে আমার একটুও লজ্জা নেই, আমি সফল। আমার
শ্বশুর কূলে এক আমার শ্বশুর ছাড়া আর কেউ কখনো এত কম সময়ে এতো বিত্ত-সঞ্চয় করতে
পেরেছে বলে আমার জানা নেই। পিতৃকুলের কথা ছেড়েই দিন। মাস্টারের বংশ। টাকার দাম
কোনদিনই দিতে পারেনি। সেই নির্বোধ, অতি কষ্টে উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ মেয়ের এই রমরমা
দেখে তাঁদেরও চোখ ঝলসায় বৈকি। কিন্তু সে সব বলতে আজ বসিনি। আজ
শুধু দুর্যোগের দিন। সকালের সামান্য হেঁচকিটা তেমন কষ্ট না দিলেও বুঝেছিলাম আরও
একটু শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। সংস্থাকে ছড়ানোর আগে আরও সুস্থিত হতে হবে। সারা দিন
‘সম্পূর্ণা’র তদারকিতে কাটলো। বাথরুমের পাইপ লিক থেকে আসন্ন অডিটের হিসেব- সব
মিটিয়ে উঠতে বিকেল গড়িয়ে গেলো। কাবেরী চা দিয়ে গেছে, একটা ক্রিম ক্র্যাকার দিয়ে
আস্তে চুমুক দিয়েছি, এমন সময় অপরাজিতা দরজা অল্প ফাঁক করে উঁকি দিলো ঘরের ভিতরে-‘দিদি, একটি মেয়ে এসেছে তোমার বাড়ি থেকে, নাম বলছে বিশাখা। বললো তোমায় বললেই হবে।’
অপরাজিতা ছাড়া সকলেই
বিশাখাকে চেনে এখানে। আমি ঘাড় নেড়ে ওকে ভেতরে আনতে বললাম। কে জানে কি দরকার?
তিতিরের কিছু হয়নি তো? নাকি আমার বড়-জা র ফরমায়েশ? এখানে মালিক হলে কি হবে, বাড়ির
লোকের তো আমি বাঁদি- হুকুম করলেই হলো- তামিল করা আমার জন্মগত কর্তব্য! তেতো মুখে
চা-টাও আর ভালো লাগলো না। বিশাখা ঘরে ঢুকলো স্বভাবসুলভ শুকনো মুখে। এই মেয়েটা কি
হাসতে জানে? সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে। চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে
কাজের ভান করে ফাইলগুলো বন্ধ করতে শুরু করলাম। দুজনেরই একটু থিতু হয়ে নেওয়া দরকার। হাত খালি করে ওর দিকে তাকিয়ে চায়ের অফার করলাম আর ও আমায় নিবৃত্ত করে বলতে শুরু করলো- “বৌদি, একটা দরকারে এসেছি তোমার কাছে।” সে আর কে-ই বা দরকার ছাড়া এসে ব্যবসাদারদের কাছে? বললাম, ‘আরে, ভণিতা না করে বলে ফেল্... কি দরকার?’
কাজের ভান করে ফাইলগুলো বন্ধ করতে শুরু করলাম। দুজনেরই একটু থিতু হয়ে নেওয়া দরকার। হাত খালি করে ওর দিকে তাকিয়ে চায়ের অফার করলাম আর ও আমায় নিবৃত্ত করে বলতে শুরু করলো- “বৌদি, একটা দরকারে এসেছি তোমার কাছে।” সে আর কে-ই বা দরকার ছাড়া এসে ব্যবসাদারদের কাছে? বললাম, ‘আরে, ভণিতা না করে বলে ফেল্... কি দরকার?’
- ‘তুমি তো ভালো করেই
জানো আমি সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ জানি অল্প-বিস্তর। গায়ে-গতরে পরিশ্রমও করতে পারি যথেষ্ট-...’
-‘সে তো জানিই, কিন্তু
তাতে আমি কি করবো, সেটা তো বলবি?’
-‘আমি জানি তুমি কাজ
বুঝে লোক নাও। কিন্তু তোমার আরও একটা নতুন দোকান হয়েছে- লোকের দরকার- সেটা আমি
বাড়িতে তোমাদের কথা শুনেই বুঝেছি।’
আমি চেয়ারে পিঠ এলিয়ে
বসলাম- ‘তুই কি কারুর সুপারিশ করতে এসেছিস? জানিস তো, সুপারিশের লোক ভালো না হলে
মালিকের ওপর দিয়ে কি যায়?’
ওর মুখটা আরও কাঁচুমাচু
হয়ে গেলো- ‘না বৌদি, সুপারিশ নয়। আমি নিজেই কাজের দরখাস্ত করতে এসেছি। আমায় কাজে
নেবে? আমি সব কাজ করতে পারবো-...’ ওর কথার মাঝে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- ‘নিজে কাজ
করবি মানে? তোর বাড়িতে কাজ নেই? বাড়িতে কেউ জানে এ কথা? লতাদিকে বলেছিস? রাজি
হয়েছেন?’ ওর উত্তরের আগেই আমি জানতাম হননি। বস্তুত বিশাখার এই ইচ্ছের কথা বোধহয়
আমিই প্রথম জানলাম। মাথা নিচু করে উত্তর দিলো- ‘আমি বলতে পারিনি। কিন্তু তুমি যদি
কাজ দাও তবে আজকেই গিয়ে বলবো।’
সোজা হয়ে বসতেই হলো।
এতোগুলো বছর ঝামেলা এড়িয়ে চলে এখন এই নিয়ে যদি ঝামেলায় জড়াতে হয় তবে সেটা মোটেই
সুখকর হবেনা আমার পক্ষে। ‘কাজের কথা পরে। আগে বল হঠাৎ কেন? বাড়িতে কোন অসুবিধে
হচ্ছে? কিছু হয়েছে? ভয় না পেয়ে বল। জানিস তো, বলা গেলে একমাত্র আমাকেই বলা যায়।’
-‘না দিদি, কিছুই হয়নি।
শুধু আর এই বিয়ে হতে পারার নাটক ভালো লাগছে না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াবো। তারপর
বিয়ে হোক চাই না হোক। গোটা জীবন কোন বাড়িতে গলগ্রহ হয়ে থাকা যায় না দিদি। এটুকু
বুদ্ধি আমারও আছে।’
যা ভেবেছি তাই। বিশাখার
মতো প্রাচীনপন্থী মেয়ে যখন বাড়ির বাইরে বেরিয়েছে, তখন গোলমাল কিছু একটা বেধেছে
অবশ্যই। আর সেটা সহজে ঠিক হওয়ারও নয়। অনেক করে বোঝালাম এরপর ওকে। কেন বাড়িতে থাকার
থেকে দোকানে কাজ করাটা মোটেও সোজা কাজ নয়, কেন বাড়ির লোকের খিটিমিটির থেকে কর্মচারী-রাজনীতি
অনেক খারাপ ব্যাপার, একবার রাস্তায় বেরোলে ভদ্র ছাপটা গা থেকে মুছে যাবে- এ সব।
জানতাম এ গোঁয়ার মেয়ে এ সবে মানবে না। তবু আমার কর্তব্য। ওকে পেলে আমার হাতে চাঁদ
আসবে। সারা দিন ধরে যে ধরনের কর্মচারীর অভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম, সেটা মিটবে।
কে বলেছে মন দিয়ে কিছু চাইলে পাওয়া যায় না? ওকে কন্ট্র্যাক্টের ফর্ম দিলাম। কাজের কথা বুঝিয়ে বললাম। এও
বললাম, আজ রাতে বাড়িতে কথাটা জানিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে। তখনও ইচ্ছে থাকলে এসে
আমার সঙ্গে কথা বললে আমরা টাকা-পয়সা নিয়ে আলোচনা করবো।
বিশাখা বেরিয়ে যাওয়ার পর
ভাবতে বসলাম এর ফলাফল নিয়ে। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। মনটা তাই কু গাইছিলো।
তবু এ সব ভুলে আবার কাজ নিয়ে পড়তে হলো।
সব শেষ করে, দোকানের
লোহার গেট লাগিয়ে সবার পিছনে বেরোলাম আমি আর অপরাজিতা। বিশাখা জয়েন করলে
অপরাজিতাকে বসা কাজ দেবো। শিক্ষিত মেয়ে, ভালো পারবে। এই সব দৌড়োদৌড়ির কাজ ওর নয়।
গাড়ি থেকে নেমে
ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারেজ করতে আর পরের দিন কখন আসতে হবে বলে বাড়ি ঢুকলাম। খাওয়ার
সময় প্রায় হয়ে এসেছে। ডাইনিং রুমে উঁকি দিয়ে বললাম- ‘এক্ষুনি আসছি, মুখে-চোখে জল
দিয়েই।’ টেবিল ঘিরে বসা থমথমে মুখগুলোর কোন পরিবর্তন এলো না। শুধু লতাদি, আমার
মেয়ের পেয়ারের জেম্মা, এই বাড়ির হিটলার, হাতের ইশারায় ভেতরে আস্তে বললেন। আমি,
প্রতিমা চৌধুরী, ডাকসাইটে ব্যবসাদার, যার এক ডাকে জনা চল্লিশ লোক মুহূর্তে হাজির
হতে পারে, অপরাধীর মতো মুখ করে এগিয়ে গেলাম।
-‘আমাদের কাউকে না
জানিয়ে বিশাখাকে দোকানে কাজ দেওয়াটা কি ভালো হলো পুটু?’ রান্নাঘরে কলের আওয়াজ এক
ঝটকায় থেমে গেলো শুনে বুঝলাম, অন্য অপরাধীও আমার মতোই অন্ধকারে।
ক্রমশ...