সিনেমা দেখতে
ভালোবাসেন না এমন মানুষ বোধহয় খুব কমসংখ্যক-ই আছেন। আমরাও (‘কথা’-গ্রুপ) তার ব্যতিক্রম নই। আমাদের বেশ কয়েকদিনের
ইচ্ছে ছিল এই বিষয়ে অভিজ্ঞ কারুর সাথে একটু আড্ডা দেওয়ার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে
গবেষণারত আমাদের এক বন্ধু পরামর্শ দিল এ বিষয়ে সাহস করে যোগাযোগ করা যেতে পারে
একমাত্র সঞ্জয়দার সঙ্গে। সঞ্জয়
মুখোপাধ্যায়। বর্তমানে
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক। সাধারণ বাঙালি তাঁর মুখ চেনে শুধু ফিল্ম নয়, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লেখালেখি ও সম্প্রতি আনন্দবাজারে তাঁর একটি ব্লগ থেকে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক। সাধারণ বাঙালি তাঁর মুখ চেনে শুধু ফিল্ম নয়, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লেখালেখি ও সম্প্রতি আনন্দবাজারে তাঁর একটি ব্লগ থেকে।
ওঁর সাথে যোগাযোগ করায় উনিও আমাদের সাথে কথা বলতে রাজি হয়ে
যান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঁর ঘরেই একদিন বিকেলে সাক্ষাৎকারের সময় নির্ধারিত
হয়। আড্ডার শুরুতেই
আমরা অনেকটা চাপমুক্ত হয়ে যাই ওঁকে সঞ্জয়দা সম্বোধন করার অনুমতি পেয়ে। আমাদের মতো অর্বাচীনের দলকে দেখে প্রথমেই বোধহয় বুঝেছিলেন- এদের অস্বস্তিটা কাটিয়ে দিতে হবে। হয়তো বহুদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার জন্যেই, মাত্র মিনিট-খানেকের মধ্যে প্রশ্ন এলো- আমরা ঠিক কেন তাঁর প্রতি উৎসাহ দেখাচ্ছি। ঢোক গিলে তার উত্তর দেওয়ার আগেই আবার প্রশ্ন। তারপর আবার। কিছু বোঝার আগেই কখন জানিনা আমরা গল্প করতে শুরু করেছি- প্রশ্ন করছি, শুনছি- সাক্ষাৎকার কোথায়, জমাটি আড্ডা বসে গেলো। তার মধ্যে থেকে অতি সামান্য কিছু অংশ এখানে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম। বাকিটা? জানতে গেলে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসুন একদিন...**
আমরা অনেকটা চাপমুক্ত হয়ে যাই ওঁকে সঞ্জয়দা সম্বোধন করার অনুমতি পেয়ে। আমাদের মতো অর্বাচীনের দলকে দেখে প্রথমেই বোধহয় বুঝেছিলেন- এদের অস্বস্তিটা কাটিয়ে দিতে হবে। হয়তো বহুদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার জন্যেই, মাত্র মিনিট-খানেকের মধ্যে প্রশ্ন এলো- আমরা ঠিক কেন তাঁর প্রতি উৎসাহ দেখাচ্ছি। ঢোক গিলে তার উত্তর দেওয়ার আগেই আবার প্রশ্ন। তারপর আবার। কিছু বোঝার আগেই কখন জানিনা আমরা গল্প করতে শুরু করেছি- প্রশ্ন করছি, শুনছি- সাক্ষাৎকার কোথায়, জমাটি আড্ডা বসে গেলো। তার মধ্যে থেকে অতি সামান্য কিছু অংশ এখানে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম। বাকিটা? জানতে গেলে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসুন একদিন...**
আমরা অনেকেই পদার্থবিদ্যায় গবেষণারত জেনে উৎসাহী হয়ে
জানালেন একসময় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে
পড়াশুনো করে প্রথাগত ডিগ্রী নিয়েও ফিল্ম স্টাডিজের মত একেবারে ভিন্ন স্ট্রিমে চলে আসেন সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে। ‘কথা’র প্রশ্ন- যে বিষয় নিয়ে উনি পড়াশুনো করেছেন আর যে বিষয় নিয়ে কাজ করছেন বা পড়াচ্ছেন এ দু’য়ের মধ্যে ওভারল্যাপ কতটা? সঞ্জয় দার মতে এ দু’য়ের
সম্পর্ক বেশ কার্যকারী, এক জৈব সম্পর্ক।
কথা প্রসঙ্গে বললেন - রেনেসাঁ আমাদের বলেছে মানুষ সভ্যতার
শ্রেষ্ঠ জীব, কাজেই মানুষের দেখা বা দেখানোটাই শ্রেষ্ঠ
হবে। আর এই দেখানো প্রসঙ্গে রেনেসাঁর প্রবক্তা লিওনার্দো দা ভিনচি যেভাবে আমাদের
দেখালেন সেটাই আমাদের মূল দেখা। একটা বস্তুকে দেখতে গেলে প্রথমেই মনে একটা গভীরতার
বোধ তৈরি করতে হয়। দ্বিমাত্রিক ক্যানভাসে যেখানে শুধু দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ আছে
সেখানে গভীরতার জায়গা আমরা তৈরি করি একটা পরিপ্রেক্ষিত অনুসরণ করে। আমাদের বোঝাটা
নির্ভর করে আপাতভাবে যে বাস্তবটা কে আমরা দেখতে পাচ্ছি তার
ওপর ভিত্তি করে। সঞ্জয় দা মনে করেন, গতশতাব্দীর প্রথম তিনটে
দশকে “বাস্তব কি?” – এই প্রশ্নটার
বিজ্ঞান যেভাবে উত্তর দিতে চেয়েছিল বা পেরেছিল সেটা সাহিত্যে প্রায় অনুপস্থিত।
জীবনানন্দ দাশ ছাড়া আর কোনো বাঙালি কবি বা লেখক এই প্রসঙ্গগুলো নিয়ে খুব বেশি
আলোচনায় লিপ্ত হননি। ওনার ভাষায়-“ জীবনানন্দ দাশ মূল যে
বিপ্লব ঘটালেন তা হল আমাদের দেখার চোখ পাল্টে দিলেন বা দেখার চোখের দিকে আবেদন
জানালেন”, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিল্পীরা করেছেন। “
এই দেখার রকমফেরটা তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় যতটা অনুভূত হয়েছে তা অন্য কোনো শাখায় হয়নি”... বিজ্ঞানশিক্ষা যেভাবে ওনার দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার ধরণ কে প্রভাবিত করেছে তাতে ফিল্ম সাহিত্য বা অন্যান্য শিল্প মাধ্যম কে উনি অন্য ভাবে দেখতে পেরেছেন। ওঁর ব্যক্তিগত মত, একজন আধুনিক মানুষের বেঁচে থাকায় সাহিত্য আর বিজ্ঞান কে আলাদা করা অর্থহীন।
আমরা
জানতে চাইলাম-
এর
উল্টোটা
কতখানি
সত্য? মানে একজন আর্টস ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ যদি পরবর্তীতে কখনো বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন তাহলে তার শিক্ষা কি করে তাকে সাহায্য করতে পারে। দুটো একেবারে ভিন্ন মাধ্যম থেকে আসা মানুষের
world view কি এর মাধ্যমে
converge করা সম্ভব?
উনি মনে করেন বিজ্ঞান আর সাহিত্যের এই বিভেদ
আসলে আমাদের তৈরি করা।
একটা উদাহরণ টেনে বললেন - রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ পড়লেই বোঝা যায় সেটা আসলে
গতির কবিতা।
বলাকায় নানা ভাবে গতিকে
গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। "হে বিরাট নদী অদৃশ্য
নিঃশব্দ তব জল...” –কবিতাটা রবীন্দ্রনাথের tribute
to
emerging
time
consciousness। ইউরোপেও অঁরি বের্গসঁ
ও গতি নিয়ে কাজ করেছেন। আরও নির্দিষ্ট করে ফিল্মের
ক্ষেত্রে আমরা উদাহরণ দিলাম- “ধরুন স্ট্যানলি কুব্রিক যিনি 2001 A Space Odyssey...
তৈরি করেছেন তিনি যেভাবে বিজ্ঞানকে বোঝেন ঠিক সেভাবেই ফিল্মকেও বোঝেন। এটা আমাদের দেশে সম্ভব নয় কেন?” একটুও
দ্বিধা না করে বললেন, আমাদের
দেশে হচ্ছে না তার একমাত্র কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
যে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা বড় হয়েছি তা শুরু থেকেই আমাদের কে শিখিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞান আর সাহিত্য
দুটোর বিচরণক্ষেত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এটা যেন পূর্ব নির্ধারিত এক সত্য। আমরা যখনই
গান শুনি তখনই ধরে নিই এটা আর্টসের বিষয় বা
একটা হেক্সাগন অক্টাগন ধরণের কোনো বস্তু দেখলেই ভাবি এটা অঙ্কের এলাকা।
এভাবে একটা পাঁচিল তুলে দেওয়াটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটা ত্রুটি। বোঝা গেলো, নিজে শিক্ষা
ব্যবস্থার সাথে জড়িত থাকলেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি একটা ক্ষোভ ওঁর আছে। বললেন
জীবনানন্দ দাশ নিজে
ইংরেজির ছাত্র হয়েও প্রাণপণে বিজ্ঞানের নানান খুঁটিনাটি কে জানার চেষ্টা করছেন। আবার
বিজ্ঞানের ছাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
লেখাতেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। মানিক আমাদের
আধুনিকতার গুরু। ইন্ডিয়ান ফিল্ম এখনো
পর্যন্ত বিদেশী যেকোনো সিনেমার ধারে কাছে যেতে না
পারার কারণ হিসেবে
বললেন- ফিল্ম অতিমাত্রায়
একটা প্রযুক্তি সমর্থিত মাধ্যম।
সেখানে আমাদের
নির্মাতারা বিজ্ঞানকে
কিভাবে নিচ্ছেন বা নিচ্ছেন না তা খুব জরুরি।
ওঁর মতে এদেশের মেকাররা বিজ্ঞানকে নিয়েছেন
আঠারো শতকের যুক্তিবাদের
মত। বিজ্ঞানের প্রভাবে যেহেতু আমাদের জীবন
যাপনের গতি পাল্টে যেতে পারে তাই আমরা বিজ্ঞানকে সন্দেহ করি। শিল্প আমাদের কাছে এসেছে বিদেশিদের হাত ধরে। শিল্প
আমাদের কাছে একটা “ grafting – organically linked নয়”। তাই আমরা
শিল্পকেও সন্দেহ করি।
আমাদের পাল্টা প্রশ্ন ছিল- স্বাধীনতার
৬০ বছর পরে যখন গোটা বিশ্ব অন্তর্জালে
আবদ্ধ,
তখনো কি এই যুক্তি খাটে? বললেন, বর্তমানে উচ্চবিত্ত পরিবারে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
কিন্তু সেই উচ্চবিত্ত পরিবারের
সংখ্যা কত? মনমোহন সিং-এর উদারীকরণের অর্থনীতি আসার পরে একটা অংশের, বিশেষ করে ভারতের প্রথম দশটা শহরে, ভারতীয় মধ্যবিত্ত নারী পুরুষ অনেকটাই পালটে গেছে গত কুড়ি বছরে। তাদের চিন্তা ভাবনারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে বিশেষত ইন্টারনেটের সুবাদে। কম্পিউটার এখনও আমাদের অনেকের কাছেই একটা নিছক tool, গুগল-ফেসবুক এখন আমাদের অন্যতম identity। কিন্তু
তা আমাদের যান্ত্রিক বিবর্তনকে বেশি করে
জানার সুযোগ করে দিলেও বৈজ্ঞানিক চিন্তা বা চেতনার বিকাশ ঘটায়নি বলে তিনি মনে
করেন।
বর্তমান সময়ের বাংলা সিনেমা নিয়ে সঞ্জয়
দার মতামত জানতে চেয়ে বেশ নেতিবাচক উত্তর পেলাম। ওনার মতে, সিনেমাগুলো কিছু সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে শুরু
হয়, তারপর তাতে আর কিছু বলার থাকে না। এই যেমন কিছু ছবিতে
দেখা যায়, শুধুমাত্র ‘সমকামিতা’-ই ছবির পুঁজি,
একমাত্র উপজীব্য। শিল্পের নামে এসব তাঁর কাছে আত্মকরুণার মতো মনে
হয়। একইসঙ্গে, শুধুমাত্র
পুরুষের যৌনকামনার তাগিদে নারীচরিত্রের উপস্থিতি বা তাদের itemization-এ তিনি যথেষ্ট
বিরক্ত।
প্রশ্ন করলাম, টালিগঞ্জের সিনেমা তো এখন অনেক ধনী, এটাকে আপনি কি বলবেন? বাংলা সিনেমা আলোর দিকে যাচ্ছে না অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে? বললেন- এই টাকা কামানোর কথাটা অনেকটাই গল্প। বাংলা ছবির ভালো ব্যবসা করার কথা বলা হলেও ছবিগুলো সেভাবে
মোটেই জনপ্রিয় হচ্ছে না। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘সপ্তপদী’ যে অর্থে জনপ্রিয়,
২২শে শ্রাবণ কখনোই সে অর্থে জনপ্রিয় নয়। এটা একটা কিংবদন্তী বলে উনি মনে করেন।
এখনকার ফিল্মমেকাররা
সিংহভাগ টাকা তুলে আনেন Television rights বেচে যা পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ছিল না। সঞ্জয়
দার কথায়- “বরং বলা যেতে পারে টালিগঞ্জ হরাইজেন্টালি এক্সপ্যান্ড করেছে”।
অনেক ছবি হচ্ছে। অজস্র ছোট ছোট চ্যানেল মারফত এর প্রচার হচ্ছে। টেকনিশিয়ানদের অনেকটা
উন্নতি হয়েছে। আর পাশাপাশি টেলিভিশন
থাকার কারণে বাংলা ছবি টিকে যাচ্ছে। টেলিভিশন না থাকলে বাংলা ছবির survive-করাই
অসম্ভব বলে ওনার ধারণা।
বললেন, দীর্ঘমেয়াদে বাংলা ছবি কে টিকিয়ে রাখতে গেলে এই মুহূর্তের বাংলা ছবির পরিচালক-নির্দেশকদের
জানা দরকার- “ how
to
tell
a
story. The
whole
problem
is
that
they
have
no
story
to
tell”। কোনো নতুন কথা বলার নেই, তার চেষ্টাও নেই।
ওই একই সম্পর্কের
কচকচানি, যা শুনতে শুনতে দর্শক ক্লান্ত হয়ে গেছে। ফলে নতুন
গল্প দরকার,
নতুন ভাবে গল্প
বলা দরকার। এই প্রসঙ্গে উনি
ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির একটি দৃশ্যের উদাহরণ
টানেন। ছবির দৃশ্যটি এইরকম-
ছাতিমপুরের রেলস্টেশনে অভিরাম নামের এক ব্যক্তি তার মা কৌশল্যাকে খুঁজে পায়। যে
মুহূর্তে অভিরাম ‘মা’ বলে ডেকে
ওঠে সেই মুহূর্তেই আর একজন তাঁকে ডেকে ওঠে ‘বাগদী-বৌ’
বলে। সাথে সাথে এক ‘violent sound montage’ হয়। তাঁর ভাষায়- ‘it
directly invades our perception of Indian history’। অর্থাৎ ভারতবর্ষের যদি কোন মাতৃ আবিষ্কার থাকে, তবে তা ঐ ‘বাগদী-বৌ’...... কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের রাজনন্দিনী
নন। এটা একটা নতুন চিন্তা। ইতিহাসকে নতুন করে দেখার একটা প্রচেষ্টা। আমাদের
শিল্প সাহিত্যে এটা সতীনাথ ভাদুড়ী ঋত্বিকের আগেই করেছিলেন ঢোঁড়াই চরিত মানসে। আমরা এই চিন্তাটাকে গ্রহণ করতেও পারি, না-ও পারি। এখন
কিন্তু এই চেষ্টাটাই অনুপস্থিত। ঋত্বিক ঘটক প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, ঋত্বিকের সাথে তাঁর প্রথম দেখা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গান্ধী ভবনে এক
ছবির প্রদর্শন উপলক্ষ্যে। তখন থেকেই সুচিত্রা-উত্তমের ভ্রূবিলাস থেকে ঋত্বিকের
দিকে ঝোঁকা। তাঁর মতে, অজস্র কিংবদন্তি লোককথা লোকগানের
মধ্যে দিয়ে ঋত্বিক ভারতীয় ইতিহাসের নানা স্তরগুলিকে পরীক্ষা করেছেন। যুক্তি তক্কো
গপ্পো-তে ছৌ নাচের মুখোশ বানান যে শিল্পী, তাঁর সঙ্গে যখন সংস্কৃত পণ্ডিতের সংলাপ হয় – সেটা ভারতীয় সংস্কৃতির একটা মূল
তর্কের দিকে আমাদের নিয়ে যায়। ঋত্বিক বক্তব্য পেশ করার সময় প্রায় নাশকতার দূতের
মতই প্রচলিত প্রথা এবং সিনেমার আস্থাশীল ধারাবাহিক যুক্তি পরম্পরাকে প্রশ্ন করেন।
তিনি তাঁকে আত্মার আত্মীয় মনে করেছেন এই কারণে যে তাঁর ছবি দেখলে র্যাঁবোর মতই
মনে হয় এক পবিত্র নৈরাজ্যের উদ্বোধন করেছেন তিনি। সেটা কাহিনীকে চিরদিনের জন্য এক
বিশেষ স্তরে নিয়ে যায়। ইতিহাসের সঙ্গে সমকালের যোগসূত্র তৈরি করে।
ঋত্বিককে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে দেখাটা
কতটা আলাদা? সঞ্জয়দা জানালেন, ঋত্বিকের মত বড় শিল্পীরা যুগের প্রতিস্বর তৈরি করতে চান বলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির সাথে সংঘাত অনিবার্য। একজন
প্রতিষ্ঠানের মূল মানগুলিকে প্রশ্ন করবেন, বিদ্রূপ করবেন, আর প্রতিষ্ঠান তাঁকে
পুরস্কৃত করবে এমনটা হয় না। ঋত্বিক চলচ্চিত্র মাধ্যমে বহুবিধ নতুন বিস্ময়ের সঞ্চার
ঘটিয়েছিলেন। তৎকালীন সিনেমার লোকজন এগুলো মেনে না নিলেও জীবনানন্দ, বোদলেয়ার যেমন আজ সাহিত্যের প্রধান কবি হয়ে উঠেছেন তেমনভাবে ঋত্বিক আজ
গুরুত্ব পাচ্ছেন। আজ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে ঋত্বিককে পরীক্ষা
করেও আগুন থেকে ছুটে আসা ফুলকি ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তাঁকে খুব কষ্টের
মধ্যে দিয়ে সিনেমা করতে হয়েছে এবং সেই অর্থে কোন মূল্যায়নই তাঁর হয়নি। আজকের
প্রজন্মকে এঁদের কথা বললে হয়তো বা আর একটা নতুন ভোরবেলা বা একটা নতুন সকাল খুঁজে
পাওয়া যেতে পারে বলে তিনি আশাবাদী।
তাঁর যৌবনকাল বাংলা থিয়েটার জগতের স্বর্ণযুগ ছিল। এ
প্রসঙ্গে সঞ্জয়দা জানান, থিয়েটারের প্রতি তাঁর আকর্ষণ কম ছিল।
অবশ্য সে সময় গ্রামে-গঞ্জে মফস্বলে থিয়েটার একটা সজীব ঐতিহ্য ছিল। উৎপল দত্তর
নামেই জনসমাগম হত। অজিতেশকে যাদবপুরের অঙ্গনেও অভিনয় করতে দেখেছেন। শম্ভু মিত্র তাঁর আগেই অবসর নিয়েছিলেন। তাঁর মতে
কৃষ্ণকুমারী, রক্তকরবী, মুক্তধারা,
নবান্ন ব্যতীত বাংলা ভালো নাটক খুব কম আছে। উৎপল দত্তর টিনের
তরোয়াল বাদে অন্য কোন নাটক পাঠ্য হিসাবে তাঁর উৎকৃষ্ট মনে হয়নি। কিন্তু
পারফরমেন্সের দিক থেকে দানীবাবু, শিশির ভাদুড়ী থেকে শম্ভু
মিত্র, অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ,
উৎপল দত্ত – এরা এত উচ্চমানের ছিলেন যেটা আজ প্রায় স্বপ্নাতীত।
তৎকালীন বাঙালি কবিদের
মধ্যে তাঁর মনে সবচেয়ে বেশি ছাপ
ফেলেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নিজের ভাষায়, “কবি বলতে কি বোঝায় অনেকদিন অবধি
আমার ধারণা ছিল ওনাকে দেখেই।” তাঁর বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন বিষ্ণু দে। “ওনাকে নানারকম
প্রশ্ন করতাম। উনিও প্রশ্রয় দিতেন। ওনার কাছে আমি
প্রভূত ভাবে ঋণী”......জানালেন সঞ্জয়দা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নামও তখন বেশ
তুঙ্গে।
শেষে আমরা জানতে চেয়েছিলাম ফিল্ম
স্টাডিজ কীভাবে কোথায় পড়ানো হয়? বা ফিল্ম
স্টাডিজ
কেন পড়ব? কেরিয়ারের
সুযোগ কিরকম? ওনার মতে বাংলা বা ইংরাজির মতই ফিল্ম
স্টাডিজ-ও আর একটি ভাষা, যা আমাদের
পারিপার্শ্বিকের সাথে আমাদের একটা যোগসূত্র স্থাপন করে দিতে পারে। আর টেলিভিশন –এর দৌলতে এখন ফিল্ম
স্টাডিজ-এর ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে চাকরীর ক্ষেত্রও প্রচুর।
Editing,
sound engineering - এগুলো আমাদের রাজ্যে কোথায় কোথায় পড়ানো হয়? এছাড়া film
appreciation course কোথাও হয় কি? বললেন, যাদবপুরে এখনও হয় না। সরকারী
ভাবে রূপকলা কেন্দ্রে হয়,
SRFTI তে হয়। এছাড়া ছোটখাটো ভাবে হয় ‘চিত্রবাণী’তে।
Film appreciation course একটা পশ্চিমবঙ্গ সরকার করান,
তবে সেটা অনিয়মিত। আর যারা এগুলো নিয়ে
পড়াশোনা করছেন
তাদের পরবর্তীতে উনি অবশ্যই বোম্বেতে যেতে
suggest করলেন- কারণ ওখানে কাজের স্কোপ অনেক বেশি।
**সেদিনের আড্ডা শেষে আমাদের খেয়াল হলো, গল্পের ঝোঁকে অনেক দরকারি কথা, মানে সাক্ষাৎকার হিসেবে প্রকাশ করতে যা যা লাগে আর কি, জিগ্যেস করাই হয়ে ওঠেনি। সঞ্জয়দা কে বলায় উনিই আমাদের দিলেন ওঁর আগে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার, ‘দেখো জীবন- জীবন দেখো’ পত্রিকায়’, তন্ময় দত্ত গুপ্তের লেখা। এই লেখার অনেক অংশ তৈরি করতেই আমরা ওঁর নেওয়া সাক্ষাৎকারটি ব্যবহার করেছি। ওঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
**সেদিনের আড্ডা শেষে আমাদের খেয়াল হলো, গল্পের ঝোঁকে অনেক দরকারি কথা, মানে সাক্ষাৎকার হিসেবে প্রকাশ করতে যা যা লাগে আর কি, জিগ্যেস করাই হয়ে ওঠেনি। সঞ্জয়দা কে বলায় উনিই আমাদের দিলেন ওঁর আগে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার, ‘দেখো জীবন- জীবন দেখো’ পত্রিকায়’, তন্ময় দত্ত গুপ্তের লেখা। এই লেখার অনেক অংশ তৈরি করতেই আমরা ওঁর নেওয়া সাক্ষাৎকারটি ব্যবহার করেছি। ওঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ।