রাজা সেদিন হঠাৎ বলে বসল :
‘আচ্ছা,
শ্রীজাতদার সঙ্গে যে আমরা সেদিন আড্ডা মারলাম, সেটা আমাদের পত্রিকার জন্য লিখে ফেলা যায় না?’ --- দেখলাম আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু কঠিন কাজ, কারণ ‘আড্ডা লেখা’-র
চেয়ে ‘আড্ডা মারা’টা বোধহয় একটু
সহজ। তবে এই কাজটা করতে আমাকে যাঁরা বিশেষ সাহায্য করেছেন... মানে যাঁদের সাহায্য
ছাড়া এটা হয়তো নিছকই একটা ‘চারিয়ারি কথা’ হয়ে যেত, সেই টেপ রেকর্ডার ও রেকর্ড করা
ক্যাসেটটির কাছে আমি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
বাঙালির সময় মতো সকাল ১০টা ৭ মি: আমরা শ্রীজাতদার বাড়িতে পৌঁছই। পৌঁছবার
সময় অবশ্য ছিল সকাল ১০টা। বেল টিপতেই দরজা খুলে দিয়ে শ্রীজাতদা জিজ্ঞেস করল, ‘চা চলে তো? বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টিও পড়ছে, তাই তোমাদের
দেখেই মাকে চায়ের ব্যাপারটা...’
সৌভিক : অবশ্যই। আড্ডা দেবো বলেই তো এসেছি। বাঙালির আড্ডা আর চা নেই, কখনও হয়েছে?
মেঝের
ওপর ফরাস পাতা। কিছু কুশন রাখা আছে,
হয়ত আমাদের জন্য। বাথরুম থেকে পা ধুয়ে গুছিয়ে বসেই রাজা জিজ্ঞেস করল,
হয়ত আমাদের জন্য। বাথরুম থেকে পা ধুয়ে গুছিয়ে বসেই রাজা জিজ্ঞেস করল,
রাজা : তোমার বয়স কত?
শ্রীজাত : ২৮
রাজা : ছেলেবেলা তোমার কোথায় কেটেছে?
শ্রীজাত : একদম কলকাতায়। আমরা থাকতাম বরানগরে আমার 'বাবার বাবার' বাড়িতে। তারপর ১৯৭৯-এ গড়িয়ায় চলে আসি।
রাজা : ছোটবেলা থেকেই সকলের জীবনে কারোর না কারোর
প্রভাব পড়ে। তোমার কবিতা পড়ে মনে হয় শঙ্খ ঘোষ তাদের মধ্যে অন্যতম। বাবা-মায়ের
প্রভাবও যথেষ্ট। এছাড়া আমরা যা জানি না এমন
কেউ?
শ্রীজাত : (একটু হেসে ) এইটা খুব ভালো। শঙ্খ ঘোষের
প্রভাব পড়েছে এইটুকু অন্তত কেউ বললে... খুব। যাই হোক গর্বিত বোধ হয়। এছাড়া আমার ভালো লাগে সুকুমার
রায়, কবীর
সুমন। তবে প্রভাব আছে কিনা বলতে পারব না। আমি আমার ভালো লাগার কথা বলছি।
সৌভিক : ভালো লাগার কথা যখন বললে, লেখক হিসেবে
তোমার কার কার লেখা...
শ্রীজাত : (একটু ভেবে) সেই ভাবে বলা মুশকিল। একেক
লেখক একেক কারণে ভালো লাগে। তাও, প্রিয় লেখক... আমার
জীবনানন্দের গদ্য খুব ভালো লাগে, সেটা এক কারণে। আর যদি
জলের মতো ফ্লো বলতে হয়, তবে সুনীল গাঙ্গুলী। এছাড়াও যাঁরা
স্টলওয়ার্ট গদ্য লিখেছেন আমাদের... বিভূতিভূষণ।
শ্রীজাত : জয়দার প্রথম দিকের গদ্য বেশি ভালো লাগে আমার। মানে, আমি ওই প্রথম তিনটি
উপন্যাসের খুবই আগ্রাসী পাঠক।
প্রশ্ন : আচ্ছা, তুমি বিভূতিভূষণ অবধি গেলে... রবীন্দ্রনাথ?
শ্রীজাত : (হেসে) ও আচ্ছা। মানে... আসলে এই নামটা
একেবারেই মিশে গেছে। হাওয়া থেকে কি লোকে অক্সিজেন আলাদা করতে পারে?
রাজা : কবিখ্যাতি তোমার হয়েছে, কিরকম লাগছে?
শ্রীজাত : এটা একটা ...মানে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারণ
ভালো লাগা একটা আছেই আর ভালো লাগার থেকেও বড় কথা, একটা স্বস্তি। আমি
যেভাবে চলছিলাম তাতে এখন পর্যন্ত আমার কোনো স্থায়ী জীবিকা নেই বা কবে হবে আমি জানি
না। সেক্ষেত্রে এই সম্মানটা একই সঙ্গে সম্মানের দিক থেকেও এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও
অনেকটা...।
প্রশ্ন : এটা আলাদা করে কোন চাপ বাড়ায়নি তোমার ওপর?
শ্রীজাত : হ্যাঁ, ভীষণ। সেটাই একটা খারাপের দিক আর কি।
সৌভিক : ফরমায়েশি লেখা দিতে কেমন লাগে?
শ্রীজাত : সেটা ডিপেন্ড করে। আসলে অনেক সময়... যেমন
...আমি দুটো ইনসিডেন্ট বলতে পারি। আনন্দবাজার থেকে আমাকে বলেছিলেন যে রবিবারের
পাতার জন্যে,
বৃষ্টি আসছে, আপনি বর্ষা নিয়ে যদি কখনও
কবিতা লেখেন। এটা তো চাহিদা তাদের। অদ্ভুত ভাবে যা হয়, আমার
বৃষ্টি নিয়ে কিছু কবিতা ছিল। তার সঙ্গে ২-১ টা কবিতা যোগ করে আমি দিয়েছি, কোন অসুবিধা হয় নি।
প্রশ্ন : এটা তো একটা দিক গেল। জয় গোস্বামী
সাম্প্রতিক তাঁর এক লেখায় লিখেছেন যে কবিখ্যাতি হওয়ার আগে তাঁর হাতে ছিল ২৫ টি
নতুন কবিতা। ছাপা হল হয়ত তার থেকে পাঁচটা কবিতা। আর এখন ২৫/৩০ টা পত্রিকা থেকে
লেখার আমন্ত্রণ আসে। হাতে হয়ত কবিতা
রয়েছে ৫ টি। এই বিষয়ে তোমার অভিজ্ঞতা কেমন? যে আবেগ দিয়ে তুমি লেখ, অর্ডারি লেখায় কি তা থাকে?
শ্রীজাত : না থাকে না, একদমই থাকে না। অর্ডারি লেখা একেবারে কখনও লিখতে হয়
না তা নয়। আমাদের ক্ষেত্রে যে মুশকিলটা ছিল, হয়ত জয়দার সেটা ছিল। আমাদের স্থায়ী চাকরি ছিল না। অনেক অর্ডারি
লেখায় বেশ টাকা পাওয়া যায়। ধরো উপন্যাস লিখলে ওরা ২৫/৩০ হাজার টাকা দেন। এবং একজন,
যাঁর কোন চাকরি নেই, সে কি এটা ঠেলে দিতে পারবে? অত মহান ...
রাজা : সমরেশ বসুর অনেকটা যে ধরণের সমস্যা ছিল।
শ্রীজাত : হ্যাঁ। এবার যেটা হয়, অনেক সময় মুশকিল হয়। সেদিন
আমাকে একজন বললেন, একটা ছোট পত্রিকা, আমাদের
পুজো সংখ্যার জন্য আপনি দীর্ঘ কবিতা লিখুন। আমি বললাম, দীর্ঘ
কবিতা তো আমার হাতে নেই। তিনি বললেন, “আপনি বসলেই চার পাঁচ
পাতা লিখতে পারবেন”। আমি বললাম, আপনি যদি চান আমি বসে চার পাঁচ
পাতা লিখে আপনার কাগজের জন্য দিই, আমি হয়তো পারবো। সেটা কি
ভালো হবে? তখন উনি বললেন যে, ... না,
আপনি অন্যান্য জায়গায় তো পারছেন, তাহলে আমার
কাগজে নয় কেন? এই অভিমানটা মানুষের হয়। উনি তো পরিষ্কার
বললেন, আনন্দবাজারে আপনি একপাতা লিখেছেন (রবিবার), আমরা ছোট কাগজ বলে কি আপনি পারছেন না? আমি বললাম,
ওরকম ভাবার কোন কারণ নেই...
রাজা : তুমি কবিতা ছাড়া, তোমার ভালো লাগে এরকম কিছু
লিখেছ ?
শ্রীজাত : দেখ, গদ্য লেখার জন্য একটা ভালো চেহারার দরকার।
(আমরা সমবেত) : কেন? কেন...?
শ্রীজাত : (একটু হেসে) হ্যাঁ, আমি লিখতে গিয়েই বুঝেছি, এই চেহারায় হয় না। কেন রবিঠাকুর রবিঠাকুর, কেন সুনীল
গাঙ্গুলী- সুনীল গাঙ্গুলী, তা ওঁদের চেহারার দিকে তাকালে বোঝা যায়। প্রচণ্ড খাটুনির কাজ গদ্য লেখা। ওই
টেনাসিটি... ! কবিতা লেখাটা না বেশিরভাগ সময় মাথায় হয়। আমি জানি না কার কিভাবে হয়।
রাজা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তো চেহারা খুব একটা
ভালো ছিল না?
শ্রীজাত : ওঁর মাথার চেহারাটা খুব ভাল ছিল নিশ্চয়ই (হাসি)। কবিতা লেখার পুরো শ্রমটা না মাথার মধ্যে হয়।
গদ্য এভাবে হয় না। গদ্য লিখতে গেলে ওই পেন নিয়ে খাতার সামনে বসে থাকতে হবে। তবে
গদ্য আমি একেবারে যে লিখিনি তা নয়। তবে তা এখনও প্রকাশ করতে দিইনি।
রাজা : প্রথম আমাদের সঙ্গে যেদিন তোমার পরিচয় হয় ৮বি
তে, সেদিন
আমাদের মধ্যে বাবুনদার খুব আগ্রহর বিষয় ছিল তোমার গানবাজনা।
প্রশ্ন : তুমি তো সেদিন বললে তোমার দাদু সঙ্গীতাচার্য্য
শ্রীতারাপদ চক্রবর্তী মহাশয়। তো তুমি গানটাকে কখনও কেরিয়ার হিসেবে ভাবোনি কখনও ?
শ্রীজাত : এটা আসলে... তুমি তো জান
ব্যাপারগুলো- এগুলো না... কিছু পারিবারিক পেশা থাকে তো... যেমন ধরো কুমোরের
ছেলে কুমোর হবে- এই নিয়ে তো কুমোরের ছেলে ভাবে না। ও জানে যে কুমোর হবে। সেইরকম যারা গানবাজনা করে তার ছেলেমেয়েরাও ভাবে
যে আমার আর ভবিতব্য কি, আমি তো গানই গাইবো। ফলে আমার হয়ত গান গাওয়াটাই
খুব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু গান গাইতে গিয়ে আমি দেখলাম... বিশেষত হিন্দুস্থানি
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যে অ্যাবস্ট্রাকশনস্ আছে সেটা আমার কাছে স্যাটিসফ্যাকটরি নয় বা রাদার আমি সেটার যোগ্য নই।
প্রশ্ন : কি রকম?
শ্রীজাত : আমি যেটা মনে করি একটা লোক
শিল্প করে এক্সপ্রেশনের জন্য। আর দায়বদ্ধতা কখনও আমার মনে হয় মাধ্যমের কাছে হওয়া
উচিত নয়। হওয়া উচিত অভিব্যক্তির কাছে। মানে সে যদি মনে করে যে সে কবিতা না লিখে
সিনেমা করলে ভালো কাজ হবে তবে তার সিনেমাই বানানো উচিত। কবিতাই লিখবো --- ওই সততার
কোন মানে হয় না। মিডিয়ার কাছে দায়বদ্ধ থাকার থেকে আমার মনে হয় শিল্পের কাছে
দায়বদ্ধ থাকাটা জরুরী। ঋত্বিক বলেছিলেন, তোমরাও নিশ্চয় শুনেছ, যে ফিল্মের থেকে বেটার মিডিয়াম পেলে ক্যামেরাকে লাথি মেরে
ফেলে দাও। ফিল্ম বানাচ্ছি, কারণ এর থেকে বেটার মিডিয়াম নেই। আমার মনে হয় যে আমার মূলকাজ হল আমার বক্তব্য। সেটা আমি কবিতা লিখে পারি।
ধরো এরিয়ালী পিয়া বিনা... এটা ওই ১৭, ১৮ বছর বয়সের আমি, আমার
বলবার কথা নয়। বা যাঁরা বলেছেন তাঁরা নিশ্চয় এটার মধ্যে এমন কিছু পেয়েছেন যেটা
ওঁদের মনের মধ্যে থেকে গেছে। এটা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তার অন্যতম একটা
কারণ অবশ্যই সুমন। মানে, ‘আমাকে না আমার আপস, কিনছ তুমি...’ এই কথাটা একটা লোক গীটার
বাজিয়ে বলতে পারে। আমার মনে হচ্ছিল গানটাও এভাবে হয়। আমার তখন মনে হচ্ছিল
ডিরেক্টলি বাংলা ভাষায় কিছু বলতে হবে।
রাজা : তোমার ভেতর তো সুর ছিল, কথাও ছিল...
শ্রীজাত : হ্যাঁ, আসলে ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আমি চেষ্টা করিনি
যে তা নয়। কিন্তু কিছু হয়নি। আর সুমন ওয়াজ টু মাচ স্যাটিসফ্যাকটরি ফর আস। যেমন রবিঠাকুরের
গান শুনলে মনে হয় যে সবই আছে।
ফলে, গীতবিতান খুব বেশি পড়া খুব মুশকিল। গীতবিতান
একমাস পড়ে আমি দু-তিন মাস লিখতে পারিনি। তাই শুধুমাত্র ভাবাবেগ বা অন্য কোন কারণের
জন্য গান গেয়ে আমি নিজের সঙ্গে ওই অসততাটা করতে পারতাম না।
প্রশ্ন : আচ্ছা, আজকে তুমি একটা ধাপ পেয়েছ, যে কারণে তুমি এই কথাগুলো বলতে পারছ। যদি এটা
না পেতে তবে কি...
শ্রীজাত : এই কথাগুলো বিগত সাত বছর ধরেই
আমি বলে আসছি। আর গান গাইলে আমার ধাপ পাওয়া সহজ ছিল। আর যেটা বলা উচিত নয়...গান
গাইলে টাকা আছে। সারারাত কবিতা পড়লে ওই পরিমাণ টাকা দেওয়া হয় না। কারণ মানুষ মনে
করে এর পিছনে দৃষ্টিযোগ্য শ্রম নেই...।
রাজা : তাহলে তুমি বলতে চাইছ যেটা তৈরি
হল তাকে মানুষ গুরুত্ব দেয় না, তার পিছনের শ্রমটাকে গুরুত্ব দেয়...।
শ্রীজাত : আমার তো তাই মনে হয়। এটা খুব
ক্ষোভের কথা। আমি আনন্দ পুরস্কার ভাষণেও বলেছিলাম। আমাকে প্রচুর লোক জিজ্ঞেস করেছেন 'কি করো?' আমি বলি কবিতা লিখি... বোকার মত উত্তর। "তা তো লেখো বুঝলাম, কিন্তু কাজ কি কর?" তখন আমি বুঝতে শিখেছি যে কবিতা লেখা তবে কোন
কাজ নয়। বাকি সবই কাজ।
প্রশ্ন : ধরো যখন রবীন্দ্রনাথ কবিতা
লিখেছেন, নজরুল লিখেছেন তখন কবিতা
সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা হয়ত এরকম ছিল না... এটা এই এখন হয়েছে। এই যে এখনকার
কবি কবিতাকে এত দুর্বোধ্য করে তোলেন তো, তাকে মানুষ একসেপ্ট করবে কি
করে?
শ্রীজাত : এটা আমি দু’ভাবে উত্তর দেব। এক হচ্ছে যদি আমি দুর্বোধ্যতাকে মেনে নিয়ে কথাটার উত্তর
দিই তাহলে পৃথিবীর কোন শাস্ত্রীয় শিল্প দর্শক বা শ্রোতা পাবার কথা নয়। কবিতায়
কিন্তু একটা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ আছে...সাইন ও আছে সিগনিফায়ার ও আছে। ভারতীয় গানে
মার্গ সঙ্গীতে তা নেই...। আমি পা থেকে কোমল গা-এ এসে
বলছি এটা বর্ষার রাগ। কেউ প্রশ্ন করে না কেন এটা বর্ষার রাগ। ধরো ক্ল্যাসিক্যাল সিনেমা
...তাও তো খুব একটা সুবোধ্য নয়। তারও দর্শক প্রচুর। সেই হিসেবে আমার মনে হয় কবিতা
একটু সাফারার। কবির কবিতার কাছ থেকে হঠাৎ করে দাবি করা হয় সুবোধ্যতা। দ্বিতীয় কথা
হল ৭০ এর পর যাঁরা লিখতে এসেছেন তাঁরা খুব সচেতন ভাবে এই দুর্বোধ্যতাকে বাদ দেওয়ার
চেষ্টা করেছেন। আর, আমরাই বা কবে চেয়েছি আমাদের কবিতা পাঠকদের না
বোঝাতে?
সৌভিক : আমার আঁকার স্যার বলতেন, 'আমি যখন একটা ছবি আঁকি তখন আমি চেষ্টা করি আমার
সমস্ত জ্ঞান দিয়ে ছবিটা আঁকতে। কয়েকটা ছবি শেষ করার পর মনে হয় যে আমার সঞ্চিত
জ্ঞানের সবটাই তো ধরা রইল তাহলে আমি আরো ছবিতে কীভাবে ক্রিয়েটিভ হব?' আমার আবার একটু অন্যরকম মনে হয় । মনে হয়, এই ছবিতে, যে একটু কমতি রয়ে গেল সেটা
আমায় ছবি করতে সাহায্য করে। তোমার ক্ষেত্রে কোনটা হয়?
শ্রীজাত : আমার ক্ষেত্রে দুটোই হয়।
শঙ্খবাবুর একটা লাইন ছিল 'লিখে বুঝিয়ে তো ভুল এ তো আমি চাইনি বোঝাতে...'
সৌভিক : একটু অন্য কথা বলি...প্রত্যেক
শিল্পীর কাছেই নারীর ডেফিনেশন একটু আলাদা...
প্রশ্ন : এই ধরো কারো কাছে নীরা, কারো কাছে রাণী...
শ্রীজাত : (একটু হেসে ) হ্যাঁ ...আমার
কাছে নারী, নীরা বা রাণী নয়। জীবনে
বহুরকম নারী দেখেছি। যে নারীকে দিয়ে সবার জীবন শুরু হয়, আমারও তাকে দিয়ে শুরু... মা। তিনি একরকম আমার
জীবনে। আমরা বান্ধবীদের হাতে মানুষ হয়েছি বলা যায়। পাঠভবনে ১১/১২ এ ৫টি ছেলে ও ৬২ টি মেয়ে পড়তাম আমরা।
রাজা : হ্যাঁ, তুমি কি নিয়ে পড়েছ এটা জিজ্ঞেস করা হয়নি।
শ্রীজাত : আমি তখন ইকোজিয়ো, ম্যাথ, স্ট্যাট নিয়ে পড়তাম তারপর
জিওগ্রাফি অনার্স।
প্রশ্ন : এম.এস.সি...
শ্রীজাত : না, না, আমি বিএসসি পার্ট টু
থিয়োরিকালটা দিয়ে প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের দিন রাতে কলকাতা শহর থেকে পলায়ন
করি।
আমরা : কেন? কেন?
শ্রীজাত : আমার না, বিরক্তিকর লাগছিলো বিশ্বাস করো। আমার মনে হয় এটা তোমাদের খুব খারাপ লাগবে, কারণ তোমরা সবাই একাডেমিক্সের লোকজন। (একটু হেসে) আমার মনে হয়েছিল আমি যদি প্র্যাকটিকালটা দিই তাহলে ভালো রেজাল্টের সম্ভাবনা আছে; সেক্ষেত্রে আমাকে আবার এম.এস.সি পড়তে যেতে হবে।
ফলে আমার একমাত্র বাঁচার উপায় হল পরীক্ষাটা না দেওয়া কারণ দিলে আমি খারাপ দিতে
পারব না। আর ভালো রেজাল্ট হলে আমাকে এম.এস.সি পড়তে হবে... না হলে বাড়িতে প্রচুর
অশান্তি হবে। অবশ্য এতেও খুব একটা কম অশান্তি হয়নি।
প্রশ্ন : কোথায় পালিয়ে গিয়ে...
শ্রীজাত : জামশেদপুরে আমার এক মাসির
বাড়ি, উনি আমাকে ভীষণ প্রশ্রয় দেন।
আমি ফিরি আড়াই মাস পর। তখন পরিবেশ মোটামুটি ঠাণ্ডা।
রাজা : সত্যি কথা বলতে বাঙ্গালি
সমাজে ডিগ্রির একটা দাম আছে সেটাকে তুমি ইয়ুজ করো বা না করো...
শ্রীজাত : সেটা আমি হাড়ে হাড়ে টের
পাই... চাকরি খুঁজতে গেলেই টের পাই...কিন্তু কি জানো তো, একটা জিনিসের নিজের কাছে দাম না থাকলে সমাজের
কাছে যতই দাম থাকুক না কেন সেটার পেছনে দৌড়ে লাভ হয় না।
প্রশ্ন : হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ...। আচ্ছা আমরা যেটা শুরু
করেছিলাম, মানে যে আলোচনার মাঝখানে তোমার পড়াশুনার কথা
উঠল...
শ্রীজাত : কি যেন?
প্রশ্ন : ওই যে বান্ধবীদের হাতে মানুষ হওয়ার
ব্যাপারটা...
শ্রীজাত : (হেসে) ওঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ নারী, এটা খুব ক্লিয়ার প্রশ্ন। নারীর ধারণা আমার ... যেটা মনে হয়, খু...ব ভা...লো একটা কম্পেনিয়ান। আমার ছেলে বন্ধুরা বেশির ভাগই বাইরে। আর বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে গেছে...
রাজা : “... আবার দাঁড়াব রেলিঙে কোমর দিয়ে
ব্যালকনি থেকে দেখব কী
বিচ্ছিরি
বান্ধবীদের বিয়ে...”
শ্রীজাত : (হেসে) হ্যাঁ, হ্যাঁ সেই, কিন্তু সব
ঠিকঠাক থাকলে একটি মেয়ের থেকে ভালো কম্পেনিয়ন হয় না।
প্রশ্ন : মানে, কম্পেনিয়ান, বন্ধুর বাইরে কিছু...
শ্রীজাত : আসলে একটা বন্ধুর মধ্যে আমি না, অনেক কিছু পাই। এটা
একটা ওই প্রিজমের মত জানো। একটা আলো পড়ে ওই কি একটা হয় না... আমি যখনই একটা মেয়েকে
দেখেছি তখনই ওই প্রিজম এফেক্টটা হয়েছে।
প্রশ্ন : এই বন্ধুত্ব থেকে প্রেম ট্রেম...
শ্রীজাত : (হেসে) ওমা! প্রেম করব না ? প্রেম অতি স্বাস্থ্যকর জিনিস।
রাজা : হ্যাঁ, তোমার কবিতা থেকেই...
শ্রীজাত : এবং প্রেম... থাকুক, ভাঙুক... এর থেকে আখেরে লাভ হয়। কারণ প্রেম ভাঙা থেকেও
মানুষ প্রচুর কিছু......
প্রশ্ন : এই আখেরটা কি? যাতে লাভ হয় ? (হাসি)
শ্রীজাত : (একটু হেসে এবং একদমই অপ্রস্তুত না হয়ে) আখেরটা
হচ্ছে ওই... ‘বুদ্ধি বলে গোছাও কিছু আখের মাখা মরীচিকা’। আখের
হচ্ছে একধরণের মরীচিকা, যাতে লাভ হয়।
প্রচণ্ড হাসলাম কিছুক্ষণ
আমরা।
সৌভিক : সুন্দর উত্তর।
প্রশ্ন : হ্যাঁ, আড্ডা ঠিক আড্ডার মতোই হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে।
শ্রীজাত : এই ধরণের প্রশ্ন বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে তো হয়েই
থাকে। আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বের এই সম্পর্কের একটা আলাদা ব্যাপার আছে, তোমরা লক্ষ্য করেছ কিনা জানি না। আমাদের সমাজে
নারীপুরুষ এদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ইয়ারকি কাজ করে। বিয়ের পর ছেলেটা যেন কর্তা হয়ে ওঠে, মেয়েটি গিন্নি হয়ে যায়।
মেয়েদের ব্যাপারটা আমাদের দেশে ভাবা হয় শরীর হিসেবে--- মেয়েদের মন আছে... এসব অনেক
পরে শোনা গেছে। মানে “ওমা, মেয়েদের মন আছে?” এইরকম আর কি...
সৌভিক : ওই গাছেদের প্রাণ আছের মতো...
শ্রীজাত : না না, গাছেদের প্রাণ আছে ও তো প্রমাণিত। এটা এখনও কিন্তু প্রমাণিত হয় নি। তবে
এই দৃষ্টিটা কিন্তু এখন পাল্টাচ্ছে। এখন একটা কমরেডশিপ্ যাকে বলে... তা আস্তে
আস্তে হচ্ছে।
প্রশ্ন : আচ্ছা, ধর্ম সম্পর্কে তোমার দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক...
শ্রীজাত : ধর্ম মানে?
প্রশ্ন : হ্যাঁ, রিলিজিয়ন।
শ্রীজাত : আমি ধর্মকে বিশ্বাস করি যতক্ষণ আমার ধর্ম
নিজেকে এক্সপ্রেস করে। আমি হিন্দু ধর্ম মুসলিম ধর্ম মানি না এবং তার রিচুয়ালগুলো
এড়িয়ে চলি।
প্রশ্ন : ধর্মের নামে হিপোক্রেসি...
শ্রীজাত : খুব খারাপ লাগে। অনেক কিছু হয় এখন এদেশে। ঠাকুরের ছবি নিয়ে
ভিক্ষা করা থেকে যে ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় করে সে ভোটে জিতে যায় এটা আমাদের দেশেই
হয়। আমার খুব অবাক লাগে ওই ভদ্রমহিলা... যাঁর সারা জীবনের কাজ হল হিন্দি
সিরিয়ালে সীতা সাজা,
তিনি অদ্ভুত ভাবে ভোটে জিতে গেছেন। এখন আবার শুরু হয়েছে বিভিন্ন
ধরণের পুত্রবধূ ও শাশুড়ির যুগ। এঁরাও ভোটে দাঁড়াতে শুরু করে দিয়েছেন।
রাজা : এগুলো দেখো?
শ্রীজাত : (হেসে ফেলে) ওরে বাবা! না না! একদিন না
সত্যি করে খুব চেষ্টা করেছিলাম। দিয়ে দেখলাম এটা ওই আমার বি এস সি পরীক্ষা দেওয়ার
থেকেও কঠিন কাজ। (হাসি)।
সৌভিক : রাজাও মালদা গিয়ে আবার পালিয়ে এসেছে সিরিয়াল
দেখার ভয়ে।
শ্রীজাত : ওটা কি বলতো? বিভিন্ন লোক উৎকট রকমের
টিপ পরে ঝগড়া করছে !!!
রাজা : শুতে যাচ্ছে বিয়ে বাড়ি যাওয়ার পোশাক পরে...
প্রশ্ন : আচ্ছা, তোমার নিজের সম্পর্কে ডিসস্যাটিসফেকশন
বা অপ্রাপ্তি বোধ কিরকম? যেমন ধরো রবীন্দ্রনাথ, নোবেল পাওয়ার পর রক্তকরবী লিখেছেন,
তারও ১০টা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। জয় গোস্বামী যেটা বলেছেন যে এই হল
প্রকৃত আর্টিস্টের এই ‘অনাস্থা’, তোমার...
শ্রীজাত : ব্যক্তি হিসেবে আমি অনেকটাই অপ্রাপ্ত। আমার বয়েসে আমার
বয়েসি ছেলে-মেয়েরা যা পেরেছে আমি তার কিছুই ...
প্রশ্ন : এর থেকে তোমার ফাস্ট্রেশন বা ডিপ্রেশন আসে
না?
রাজা : তোমার কবিতা পড়ে বোঝা যায় কিন্তু...।
শ্রীজাত : হ্যাঁ, এই অপ্রাপ্তি থেকে কিছুটা ডিপ্রেশন
হয়তো আসে।
প্রশ্ন : সেটা কি তোমাকে ভেঙে ভেঙে গড়তে সাহায্য করেছে...?
শ্রীজাত : আমার মনে হয় সেটা। ওই যেটা
বলছিলাম একটু আগে প্রেম নিয়ে আখেরে লাভ হয়...।
রাজা : আচ্ছা “শঙ্খ
ঘোষের নাম শোনেনি এমন কেউ তোমায় যদি প্রোপজ করে, কী করবে...”
তোমারই কবিতার লাইন ... সত্যি তুমি কি করবে?
শ্রীজাত : (হেসে) তোমাদের একটা সত্যি
ঘটনা তাহলে বলি। এটা শঙ্খবাবু ছাড়া আর প্রকাশ্যে আমি বলিনি। টিভিতে ‘এই তো সু্যোগ’ বলে একটা শো হয়। তাতে আমার এক
বান্ধবীর বৌদি অংশ গ্রহণ করবেন। তো, তাতে বৌদি লাস্ট টেন
ইয়ার্স কোয়েশ্চেন যেমন হয় তেমনটা সংগ্রহ করেছেন। মানে লাস্ট ১০ টি এপিসোডের প্রশ্ন
উত্তর আর কি। তার থেকে উনি প্র্যাকটিস করেছেন। তার মধ্যে একটা প্রশ্ন আটকে গেছে।
বান্ধবীটি আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে “তুই তো কবিতা টবিতা
লিখিস ... ‘বাবরের প্রার্থনা’ - কার
লেখা?” আমি বললাম শঙ্খ ঘোষের। তো ফোনের ওপারে বলছে –
“শঙ্খ কি... বল আরেকবার...” আমি বললাম ঘোষ। “শঙ্খ ঘোষ”... তো... “ঘোষ”
তো। আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটি শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেনি। তখন আমি ভাবলাম
এই মেয়েটি তো চমৎকার। একটা মেয়ে ... মেয়েটির মধ্যে কোথাও কোন অসুবিধে নেই... খালি
একটাই অসুবিধে সে শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেনি। এবার কেন জানিনা আমার মাথায় এল যে এই
মেয়েটা যদি কোন সকালে বলে যে “আমি তোর প্রেমে পড়েছি...”
আমি কি করব? তারপর ওই কবিতাটা আসে আর কি। এরপর
আমাকে একজন বলেন “তুমি ক’জন নোবেল জয়ী
ফিজিসিস্টের নাম শুনেছ?” আমি বললাম না সত্যি আমি শুনিনি। তখন
উনি বললেন “তবে ফিজিক্সের কোন মেয়ে কি তোমার প্রেমে পড়তে
পারে না?”...
রাজা : তোমার লেখা তোমার প্রিয়
কবিতা...
শ্রীজাত : এটি বলা খুব কঠিন। সব কবিতা
অপ্রিয় হয় না, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। আসলে প্রতিনিয়তই এগিয়ে
চলেছিতো।
রাজা : না, তুমি
তো এগিয়ে চলেছো... তোমার পাঠক তো সবসময় এগোতে পারে না... তাই না?
শ্রীজাত : সেটা হয়ত হয়। তবে বাবা মার
সিরিজটা আমার মনের খুব কাছাকাছি।
আমরা : হ্যাঁ ওটা আমাদেরও সবচেয়ে
ভালো লেগেছে।
রাজা : এই কবিতার কথা উঠল বলে বলি... তোমার কবিতার লাইন- “এই যেমন বাবা আজকাল সারাদিন সিঁড়ির উপর
গালে হাত দিয়ে ব’সে থাকেন ” আরেকটা
কবিতায়- “কিছু দূরে মেঝেয় কাপ হাতে চুপ করে বসে আছে অপেক্ষায়”
বাবার প্রতি আর মার প্রতি তোমার কিছুটা মনোভাব পার্থক্য পাচ্ছি।
তুমি বলো...
শ্রীজাত : এটা না আমি এখন ঠিকঠাক মনে
করতে পারছি না। রণজিৎদা এটা খুব ভালো বলেছেন। একজায়গায় বলেছিলেন মা একটা, ওই পাখির বুকের মতো আস্থার জায়গা আর বাবা একটু দূরের মানুষ; একটা পাওয়ার সাপ্লায়ার। তাকে শহর থেকে দেখা যায় না। তবে এখানে আমি জেনডার
বায়াস্ড্নেসের কথা বলছি না।
প্রশ্ন : না না এখানে ফ্রয়েড কে আনাটা
উচিত হবে না...
শ্রীজাত : হ্যাঁ, সেই...
রাজা : বাবার মানসিক অবস্থাটা কখন
তোমার কবিতায় বলতে ইচ্ছা করেনি...
শ্রীজাত : আমার তো সবসময় মনে হয়... আমি
যেটা লিখেছিলাম... বাবা রোজ রাতে ৩ টি দেশলাই কাঠি চান।
রাজা : তোমার কবিতার লাইন-“আমি শুধু চেয়েছিলাম এই দুই বোনের মাঝে রোগা সোগা, একরোখা,
বদমেজাজি একটা ছেলে, যে অনেক রাত অব্দি গান
শোনে, ... বন্ধু নেই কোন।”- তুমি ঠিক
কি বোঝাতে চেয়েছ? আমরা কিছু একটা অনুমান করেছি...
শ্রীজাত : (হেসে) তাহলে আমি তাই চেয়েছি।
রাজা : আমরা বুঝেছি তুমি কখন
প্রতিবাদী হতে চেয়েছ, কখনও ভাবতে চেয়েছ... আর একাকীত্ব
এক্সপ্রেস...
শ্রীজাত : হ্যাঁ ঠিকই। আসলে কি জান তো
কবিতার নিজস্ব কিছু ধারণা আছে... “এটা হল প্রেমের কবিতা - এটা হল প্রতিবাদের কবিতা” আমি বোধহয় তার মাঝখানে একটা স্পেস
খুঁজতে চেয়েছি... যেখানে ওই ভাবে কবিতাকে ডিফাইন করা যাবে না।
প্রশ্ন : তোমার কিছু কবিতায় কোন ছেদ,
যতি চিহ্ন ব্যবহার করোনি... এটা কি কোন চমক?
শ্রীজাত : না ঠিক তা নয়- উৎপলদা,
জয়দা এরকম অনেক লিখেছেন। আসলে আমার মনে হয়েছে, যে ছেলেটার মুখ দিয়ে কথাগুলো বলানো হয়েছে... তার মানসিক অবস্থাটা। একেক
সময় হয় না অনেকগুলো কথা মাথায় ঘোরে... তখন আর তার ওই যতি চিহ্নের বিলাসিতাটা
সম্ভব নয়... সে আর এগুলো এফোর্ড করতে পারছে না।
রাজা : যেমন, একটা
কবিতা প্রতিবন্ধী...
শ্রীজাত : হ্যাঁ, ওটা
আমি ফিল করি...
সৌভিক : তসলিমা নাসরিন পড়েছ?
শ্রীজাত : না, খুব
বেশি পড়িনি।
সৌভিক : কেমন?
শ্রীজাত : আসলে, উনি
যে ঠিক সাহিত্য করতে চেয়েছেন তা ঠিক...। ওনার লেখা খুব বোল্ড, বক্তব্যধর্মী। তবে আমার মনে হয়েছে এটা ঠিক যে, উনি
যে পরিবেশ থেকে উঠে এসে কথাগুলো বলেছেন তা আগে হয়তো কেউ বলেনি... হতে পারে এটা
সাহিত্যের একটা নতুন উইং। ভবিষ্যতের কোন এক সময় ফ্লারিশ করবে।
সৌভিক : আচ্ছা তোমার নামের
পিছনে পদবী ব্যবহার করাটা ঠিক পছন্দ করো না- কিন্তু বাড়ির নেম প্লেটে
বন্দোপাধ্যায়ের ব্যাপারটা...
শ্রীজাত : ওটা খুবই জঘন্য
একটা কাজ হয়েছে। আমি বাড়িতে ছিলাম না যখন ওটা লেখা হয়েছে এবং সেই সুযোগে যিনি এটা
লিখেছেন তাঁর প্রতিভার একটা স্বাক্ষর রেখে গেছেন। পদবি নিয়ে, বিশেষত যাঁরা এই রকম
ব্রাহ্মণ্য জাতির অন্তর্গত, তাঁদের কিছু ভাটের গর্ব আছে। আমি
এও দেখেছি “বন্দোপাধ্যায়... কাকে বিয়ে? ঘোষ... এ বাবা...!” আমি দেখেছি চক্রবর্তী দাসকে বিয়ে
করছে- সে বিয়েতে অনেকে যায়নি। আমি কলেজেও দেখেছি “... আমি
বাঁড়ুজ্যে বংশের...” হতে পারে কুড়িয়ে বাড়িয়ে ওই একটাই বিষয়
পেয়েছেন গর্ব করার মতো। ফলে আমার যাতে ওই বিষয়ে কোন দিনও গর্ব না হতে পারে তার
জন্যেই ওটাকে...
প্রশ্ন: তুমি একশোর মধ্যে
প্রথমে মানুষ হিসেবে, পরে কবি হিসেবে ও আরও পরে প্রেমিক হিসেবে নিজেকে কত দেবে?
শ্রীজাত : মানুষ হিসেবে ১।
কবি হিসেবে ২... কারণ আমি যখন কবিতা লিখি তখন আমি বেটার লোক। প্রেমিক হিসেবে... ওটা মনে হয় প্রেমিকা দেবে...
আমি বরাবরই ১০০ র মধ্যে ওই
এক দুইয়ের মধ্যেই খেলেছি। কারণ আমি টেস্টে অংকে ২০০তে ২ পাই। তারপর আমার স্যার
আমাকে খুঁজেছিলেন... তখন একজন ফোন করে বললো “এখন তুই আসিস না, উনি
তোকে পাগলের মতো খুঁজছেন...” এর পর H.S এ আমি ওটাকে আটগুণ বাড়িয়ে ষোল করি... ফলে মানুষ
হিসেবে আর ওই এক-দুইয়ের থেকে বেশি কি করে দিই...
রাজা : তুমি অংকটাকে
মনুষ্যত্বের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে...?
শ্রীজাত : (হেসে) ওরে বাবা!! আমি বাঁচতে গিয়ে বুঝেছি যে জীবনে প্রচুর অংক আছে। একেবারে পিওর ম্যাথেমেটিক্স...
প্রশ্ন: অনেকক্ষণ হয়ে গেল।
এবার উঠতে হবে... শ্রীজাতদা, তোমার গান শোনা হলো না...
শ্রীজাত : দাঁড়াও- হারমোনিয়মটাকে বার করি...
রাজা : তাড়াতাড়ি করো... আমার
আবার ক্লাস আছে...
পাঠকেরা নিশ্চয় বুঝতে
পারছেন- আড্ডার বাকি অংশটা আপনাদের কাছে তুলে ধরার মতো ক্ষমতা বা সুযোগ কোনটাই
আমাদের নেই। হলে হয়তো ভাল লাগতো...
অনেক বছর আগে (২০০৪-০৫ নাগাদ) আমরা কিছু
অত্যুৎসাহী বালক একটি পত্রিকা প্রকাশ করি। সেটি একমেবাদ্বিতীয়ম। তার নাম ‘ঐকিক’। এই সাক্ষাৎকারটি সেখানেই প্রথম প্রকাশিত।