আগে যা ঘটেছে:
তিতিরের ‘জেম্মা’ আদতে টোটার মা হলেও তিতিরকেই নিজের মেয়ের মতো দেখেন আর তার
মা প্রতিমা বুটিক চেনের কাজে ব্যস্ত থাকায় নিজেই মানুষ করার ভার নিয়েছেন। তিতিরের সঙ্গে নিজের
গত জীবনের প্রেমাস্পদ অবিনাশের ছেলে প্রবীরের প্রেমের কথা টোটার কাছে জানতে পেরে
নিজের উদ্যোগে সেই সম্পর্ক ভেঙে দেন। উলটে জানতে পারেন বাড়ির আশ্রিত বিশাখাকে নিয়ে
কে বা কারা গুজব রটাচ্ছে। বিশাখা প্রতিমার কাছে দোকানে কাজের ইচ্ছে প্রকাশ করে। প্রবীরের সাথে সম্পর্কের ইতি হওয়ার পর তিতির কাঁদতে
কাঁদতে জেম্মাকে জিজ্ঞেস করে তার জেঠু বেঁচে থাকলে ভাল হতো কি না।টোটার কথা ২
আজ দোল। রাস্তায় সক্কলে রঙের উৎসবের নামে নিজেদের চাপা ইচ্ছে পূরণ করছে। আমি
বসে আছি গোপালদার বন্ধ চায়ের দোকানে, মোড়ের বাচ্চাগুলোর ছোঁড়া রঙের কুমকুম গায়ে
নিয়ে। ওরা ইতিমধ্যে আমায় পাগল ভেবে নিয়ে মনের সুখে রঙ দিয়ে ক্লান্ত হয়ে এখন পাড়ার
কুকুরগুলোর দিকে নজর দিয়েছে। একটা ভীষণ একা গাছ ভরে পলাশ ফুটেছে। হাল্কা হাওয়া
দিয়েছে। আমি একা। অল্প দুঃখ হচ্ছে। অনুতাপ? নাহ্। পলাশ
গাছটা একা নয়। ওর মতো আরও অনেকে আছে জগতে, যারা
শান্তিনিকেতনে যেতে না পারলেও ফুল ফোটাতে কসুর করেনা। সামনের বাড়ির দোতলার
বারান্দায় একটি ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে। আমি একটু
হাসলাম। কুচকুচে কালো মুখে সাদা দাঁত দেখে বোধহয় একটু ভয় পেয়েই ভিতরে চলে গেলো
মেয়েটা। আমি উঠে পড়লাম টালমাটাল হয়ে।
রঙ নিতে পারি,
খেলতে শিখিনি আজও। তাই
সঙ্গী জোটেনি বোধহয় এখনও। সোনার চাঁদ ছেলে এখনও আকাশে একা। ধুর! কি যে তখন থেকে একা একা করে চাপ খাচ্ছি... আপনাদের তো বটেই, আমার নিজেরও বিরক্তি ধরে গেলো। আসলে নেশা করলে অমন হয়। একই কথা মাথায় মাইক টেস্টিং এর মতো বাজতে থাকে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, দোলের দিন কেউ রঙে, কেউ নেশায় মাতাল হয়। ভাং টাং আমার ভালো লাগেনা। সকাল সকাল মদ খেয়েছি। খালি পেটে অনেকটা বাদামভাজা দিয়ে খেয়ে ফেলেছি বলে বেশ খানিকটা অম্বল হয়ে আছে। তাতে আমার আপত্তি নেই, ওতে খিদে পায় না। বাড়ি ফেরার তাড়াও থাকেনা। রোদটা বোধহয় লাগানো ঠিক হচ্ছেনা। পরে শরীর খারাপ হলে অনর্থক ঝামেলা। আচ্ছা, কি ভাবছেন বলুন তো? পড়তে বসেছিলেন একটা লেখা, গল্পের আশায়, তার বদলে কে যেন ফুল্লরার বারমাস্যা শুনিয়ে যাচ্ছে, তাই না? দুঃখটা বুঝতে পারছি, কিন্তু একটা কথা বলুন, যে কোন গল্প যদি আসলে আমাদের সম্মিলিত জীবন-সমুদ্র থেকে তুলে এক আঁজলা হয়, তবে এমনটা হতে ক্ষতি কি? আপনার আমার জীবনে এর থেকে বেশি কি ঘটে বলতে পারেন? হয় সহকর্মীকে বেশ দু’কথা শুনিয়ে বাড়িতে সেটা দশগুণ করে বলা, নয়তো একখান ডিভোর্স, বা আধখানা চোর ধরা। বাকি গোটা জীবনটাই তো আমার মতো উদ্দেশ্যহীন কাটে, তাই না? এখন আপনি বলবেন, তবে আর কষ্ট করে এই লেখা পড়া কেন? ঠিক কথা। আমার ব্যক্তিগত কেচ্ছা শুনতে এসেছেন তো? নিরাশ করবো না। আমার ব্যক্তিগত বলে তেমন কিছু নেই, তবে যে পরিবারের অংশ, তার কেচ্ছা তো চাইলেই শোনাতে পারি।
সঙ্গী জোটেনি বোধহয় এখনও। সোনার চাঁদ ছেলে এখনও আকাশে একা। ধুর! কি যে তখন থেকে একা একা করে চাপ খাচ্ছি... আপনাদের তো বটেই, আমার নিজেরও বিরক্তি ধরে গেলো। আসলে নেশা করলে অমন হয়। একই কথা মাথায় মাইক টেস্টিং এর মতো বাজতে থাকে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, দোলের দিন কেউ রঙে, কেউ নেশায় মাতাল হয়। ভাং টাং আমার ভালো লাগেনা। সকাল সকাল মদ খেয়েছি। খালি পেটে অনেকটা বাদামভাজা দিয়ে খেয়ে ফেলেছি বলে বেশ খানিকটা অম্বল হয়ে আছে। তাতে আমার আপত্তি নেই, ওতে খিদে পায় না। বাড়ি ফেরার তাড়াও থাকেনা। রোদটা বোধহয় লাগানো ঠিক হচ্ছেনা। পরে শরীর খারাপ হলে অনর্থক ঝামেলা। আচ্ছা, কি ভাবছেন বলুন তো? পড়তে বসেছিলেন একটা লেখা, গল্পের আশায়, তার বদলে কে যেন ফুল্লরার বারমাস্যা শুনিয়ে যাচ্ছে, তাই না? দুঃখটা বুঝতে পারছি, কিন্তু একটা কথা বলুন, যে কোন গল্প যদি আসলে আমাদের সম্মিলিত জীবন-সমুদ্র থেকে তুলে এক আঁজলা হয়, তবে এমনটা হতে ক্ষতি কি? আপনার আমার জীবনে এর থেকে বেশি কি ঘটে বলতে পারেন? হয় সহকর্মীকে বেশ দু’কথা শুনিয়ে বাড়িতে সেটা দশগুণ করে বলা, নয়তো একখান ডিভোর্স, বা আধখানা চোর ধরা। বাকি গোটা জীবনটাই তো আমার মতো উদ্দেশ্যহীন কাটে, তাই না? এখন আপনি বলবেন, তবে আর কষ্ট করে এই লেখা পড়া কেন? ঠিক কথা। আমার ব্যক্তিগত কেচ্ছা শুনতে এসেছেন তো? নিরাশ করবো না। আমার ব্যক্তিগত বলে তেমন কিছু নেই, তবে যে পরিবারের অংশ, তার কেচ্ছা তো চাইলেই শোনাতে পারি।
গত প্রায় ছ’মাস আমার মাথা প্রবলভাবে গুলিয়ে আছে। নিজেদের যে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে সারা জীবন লড়াই করবো ঠিক করেছিলাম, মাত্র
বছর দু’য়েকের মধ্যেই তা গুলিয়ে গেছে। একটামাত্র উদাহরণ দিই,
তাহলেই সমস্ত বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ছোটবেলায় স্বামী বিবেকানন্দের
গল্প পড়েছিলাম, কিভাবে স্বামীজি নিচুজাতের কল্কে করে গাঁজায়
টান দিয়েছিলেন- নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে- আদর্শের হয়ে। মনে হয়েছিল,
এই তো আমার ঈশ্বর, কত যুগ আগে অস্পৃশ্যতার
বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ভেবেছিলাম, শুধু সন্ন্যাসী কেন,
সাধারণ মানুষের পক্ষে কি মানা সম্ভব নয় এই নীতি? বড় হলাম, আম্বেদকরের জীবন পড়লাম।
জানলাম আমার দেশে এখন ছুঁৎমার্গ একটা অপরাধ। তারপর? একদিন
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে উপলব্ধি হলো নিজের বাড়িতেই সবার সামনে এই নোংরামি চলছে।
বিশাখাদি যে ঠিক কতদিন ধরে আছে আমাদের বাড়িতে, সেটা বোধহয় ওর
নিজেরই মনে নেই ভালো করে। ছোটবেলা থেকে দেখছি বলে কখনো আলাদা করে ভাবিনি, এবার চোখে পড়লো, ও আমাদের সঙ্গে একসাথে বসে খায় না।
স্যাঁতস্যাঁতে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে খায়। বাকি সকলের খাওয়ার বাসন এক জায়গায় থাকে,
থালা-গ্লাসের ঠিক নেই যে কে কোনটায় খাবে। শুধু ওর থালা-বাটি-গ্লাস
আলাদা। ধক্ করে বুকে লাগলো যখন মনে পড়লো ওকে কখনো স্কুলে যেতে দেখিনি। শুধু তা-ই
নয়, যে শিশু-শ্রমের বিরুদ্ধে ভাল ভাল কথা লিখে প্ল্যাকার্ড
বয়েছি স্কুলের মিছিলে, সেই শিশুকাল থেকেই ও উদয়াস্ত খেটে
চলেছে আমাদের রান্নাঘরে, কলতলায়, ঘরের
ভেতর। বয়সটা কম ছিলো, তাই বুকে বড্ড বাজলো। রাতে খেতে গেলাম
না যখন, নিয়মভঙ্গ করে বাবা এসে বসলেন মাথার কাছে। মা বোধহয়
নাচতে গেছিলো, তাই বাড়ি ছিলো না। মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস
করলেন, ‘এই বয়স থেকে গোসা করার অভ্যেস করলে পরে কি বাজে হবে
বলতো? তোর বউ তো গোসা করার সুযোগই পাবে না।’ বেজায় অস্বস্তিতে উঠে বসতে বাধ্য হলাম। আমার বাপের এই এক সমস্যা। কেউ
কোনদিন ওঁর ওপর রেগে থাকতে পারেনি। তাও গলায় অনেকটা ঝাঁঝ এনে বললাম, ‘তুমি না সিপিএম করো? সারাদিন কি সব সাম্য-টাম্য বলো,
এদিকে আমাদের বাড়িতে যে শোষণ হয়ে চলেছে, তার
বেলা?’ আশা করি বলে দিতে হবে না যে ওই বয়স থেকেই আমি বেজায়
এঁড়ে পাকা। অবাক হয়ে যখন প্রশ্ন করলেন, গুছিয়ে- না গুছিয়ে
বলে ফেললাম গড়গড় করে মনের সব কথা। পুরোটা শোনার পর বাবার মুখের যা অবস্থা হয়েছিলো,
সেটা আজও আমার পরিষ্কার মনে আছে। বাড়ির কোন ব্যাপারে না থাকলেও ওঁর
আদেশ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা বাড়িতে আর কারুর ছিলো না। পরদিন সকাল থেকে দেখলাম
বিশাখাদির থাকার জন্য আলাদা ঘর নির্দিষ্ট হয়েছে, সামান্য
ফাই-ফরমাশ ছাড়া কোন বড় কাজ ওকে করতে দেওয়া হচ্ছে না, আমাদের
খাওয়ার ঘরেই ওর জন্য টেবিলের পাশে উঁচু টুলের ব্যবস্থা হয়েছে- একসঙ্গে না খেলেও ওই
টেবিলে বসেই ও খাবে- আর মা দু’বেলা বর্ণপরিচয় নিয়ে ওকে পড়াতে
বসছে। ও বোধহয় কোনভাবে বুঝতে পেরেছিলো, কোনভাবে বলছি কেন,
হয়তো আমিই গর্ব করে বলেছিলাম যে ওর এই পরিবর্তিত অবস্থার জন্যে আমিই
দায়ী। মনে আছে, মাস খানেক আমার সঙ্গে সোজা করে কথা বলেনি।
এরপর পৃথিবী অনেকবার সূর্যের চারদিকে ঘুরেছে, আমার দাড়ি শক্ত হয়েছে,
বাবা স্বর্গে যেতে পারেননি, বিশাখাদি মাধ্যমিক
পাশ করে নিজের উদ্যোগে বাড়ির সব কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে। এখন আর ওকে
বারণ করার কেউ নেই। শুধু এটুকু জানি, বাবা মারা যাওয়ার পরের
সময়টুকু বাদ দিলে রাতে যে বাড়ি ফিরে প্রতিদিন খেতে পেয়েছি- সেটা ও ছিলো বলেই। দূর! কি যে বলছি! বেঁচে যে আছি এখনো, সেটা কি ওর কৃতিত্ব নয়?
গোটা বাড়ির লোক একবাক্যে স্বীকার করে- টোটা মারণ জন্ডিস থেকে সেরে
উঠেছে শুধুমাত্র বিশাখার জন্য।
পর পর তিনটে বাইকে করে ন’টা ছেলে প্রবল বেগে হুশ করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো- সঙ্গে
গগনবিদারী চিৎকার। বলেছিলাম না, রঙ খেলা আমার জন্যে নয়- বাকিরা হুল্লোড় দেখতে পেল, আমি দেখলাম কাল সকালের খবরের
কাগজের কোনায় দুর্ঘটনায় মৃত্যুসংবাদ। রোদটা আরও চড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির
রাস্তায় চলে এসেছি। উলটো দিক থেকে কে একটা আসছে জোর পায়ে হেঁটে। এতক্ষণ সামান্য টলছিলাম, এবার বাধ্য হয়ে একটু সতর্ক হলাম, নইলে কে আবার ধরে
জ্ঞান দিতে শুরু করবে তার ঠিক নেই। একটু কাছে গিয়ে দেখলাম বিজন আসছে। আমার
ছোটবেলার বন্ধু। চাপ নিয়ে লাভ নেই। আবার দুলকি চালে চলতে শুরু করলাম। বিজনের
মুখোমুখি হয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘কি রে ব্যাটা, অত তাড়া কিসের? শিবানী ডেকেছে? দুপুরবেলা কি ঘোষবাড়ির সবক’টা নাকে তেল দিয়ে
ঘুমোচ্ছে? আর তুমি চাঁদ ছাদের ঘরে...’ আরও
কিছু বলে ফেলার আগেই বিজন চারটি খিস্তি সহকারে আমায় থামতে বললো। জানা গেলো,
পাশের পাড়ায় গত দশ বছর ধরে তুমুল ব্যবসা করে চলা শ্রীভৃগু (আসল নাম
কি যেন- মাধব না যাদব- কমবয়সে বিজনের এক দূরসম্পর্কের দিদির সঙ্গে পালিয়েছিলো,
পরে বিয়ে করতে অস্বীকার করে- সেই থেকে বিজনরা ওর ওপর খাপ্পা)-র
আস্তানায় চড়াও হয়েছে ওই যুক্তিমনস্ক না কি যেন একটা দল। টিভি চ্যানেল-ট্যানেল চলে
এসেছে- অবস্থা বেজায় গরম। বিজন বললো, ‘রগড় দেখতে চাস তো
এখুনি চল।’ আমি বললাম, ‘কিন্তু বস্,
আমার তো তুমুল নেশা হয়ে আছে!’
-‘তাতে কি?
টিভিতে ইন্টারভিউ দিবি না কি? চুপ করে দাঁড়িয়ে
মজা দেখবি, তারপর ভাল ছেলের মতো বাড়ি ফিরে আসবি।’
প্রস্তাবটা আমার ধোঁয়াটে মাথায় ভালই লাগলো। অতএব আমিও জুটে গেলাম ওর সাথে।
কি যেন বলছিলাম?
ও, হ্যাঁ, বিশাখাদি। যা
বলছিলাম, এই যে ছোটবেলা থেকে নানা রকম কীর্তি করবো ভেবে
বসেছিলাম, সেটা প্রথম গুলিয়ে গেল মনুসংহিতা পড়ে। এ যে উলটো
কথা! কি কথা? জানতে গেলে সত্যি বলছি ও জিনিস নিজে পড়া ছাড়া
গতি নেই। যে যে শব্দগুলো ঘৃণিত মনে করেন যে কোন আধুনিক বিশ্ববাসী- তার প্রতিটা
একনিঃশ্বাসে বলে দেওয়া যায় ওই বইয়ের সম্পর্কে। Sexist, racist, chauvinist- কি নয়! এ তো বস্তাপচা
জিনিস! একে মানবো কি করে?
অতএব বিবেকানন্দের শরণ নেওয়া। কিন্তু এই বুড়ো চোখে লেখাগুলো নতুন করে পড়ে, ভাষার ঔজ্জ্বল্য ছাড়িয়ে বিষয়ে প্রবেশ করে মনের ধাঁধাঁটা আরও জোরদার হলো বই
কমলো না। যে মানুষটা সারা জীবন মানুষকেই পুজো করার কথা বলে গেছেন, তিনি কি করে ওই ছাইপাঁশ মানতে বলেন? সাধারণ গৃহস্থ
না হয় গীতা না পড়ে শুধু ফুটবল খেলেই কাটিয়ে দিলো- আমার কি হবে? গণ্ডগোল। বিস্তর গণ্ডগোল। এ-ই যদি একমাত্র চিন্তার বিষয় হতো, তবে ঠিক ছিলো। কিন্তু উপসর্গের মতো এ সময়েই আমার মায়ের মাথায় ঢুকে বসলো- বিশাখার বিয়ে দিতে হবে। দিতে হবে মানে দিতেই হবে। না হলে যেন সব মহাকাব্য একসাথে
অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আমার কানে খবরটা এলো অনেক পরে। গোটা বাড়ির সবাই জেনে যাওয়ার অনেক পরে একদিন
বিশাখাদি আমায় সঙ্কুচিত হয়ে জানালো খবরটা। বেশ বাজে লাগলো। আমি ভালো করেই জানি, ওর যেখানেই বিয়ে হোক বা না
হোক, নিজের কিছু একটা আয়ের ব্যবস্থা সবার আগে দরকার। তবু ওকে
ওর নিজের ইচ্ছে জানতে চেয়ে শুনলাম ও-ও চায় কাকিমার কাছে কাজ করে কাজ শিখতে। ভালো
প্রস্তাব। আমিও সেদিন রাতে খাবার টেবিলে সময়মতো হাজির হয়ে সকলকে যথোচিত অবাক করে
শিষ্ট সেজে খাওয়াদাওয়া করলাম। সব শেষে থালায় আঙুল বোলাতে বোলাতে মাকে জিগ্যেস
করলাম, ‘শুনলাম বিশাখাদির বিয়ের ব্যবস্থা চলছে, খবরটা সত্যি?’ এতক্ষণের হাসিমুখ মুহূর্তে থমথমে হলো।
আমি উত্তর গোছানোর সুযোগ না দিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘ওকে
জিগ্যেস করেছো, ও কি চায়?’ এতক্ষণে
পুরনো লতা বিশ্বাসের ছোঁয়া নিয়ে উত্তর এলো, ‘এ সব নিয়ে তোমার
ভেবে কোন লাভ নেই, বড়দের ভাবতে দাও।’ আমার
চরিত্রে প্রবল গোলমালের দরুন পাঞ্চ-লাইন অন্যকে ব্যবহার করতে দিতে আমি পারি না।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর- ‘ঠিক কথা, আমিও তাই
বলছি, তোমারও ভেবে কাজ নেই, যার বিয়ে
তাকে ভাবতে দাও।’ এবার ফ্লাডগেট খুলে গেছে, লোমে ঢাকা দাঁত-নখ বেরিয়ে পড়েছে, ‘শোনো টোটা,
কিছু বলিনা বলে ভেবোনা বিশাল কিছু লায়েক হয়ে গেছো। এখনো নিজের পায়ে
দাঁড়াতে অবধি পারোনি, অযাচিত উপদেশ দেওয়া তোমায় মানায় না,
সেটা তোমার বোঝা উচিত। অনেক ঘটনাই তোমার জানা নেই। তোমার জন্য
ঘরে-বাইরে এতো কথা শুনতে হচ্ছে আমায়, কি করে সহ্য করে চলেছি
সেটা আমিই জানি। বিশাখার বিয়ে হওয়াটা এই মুহূর্তে আমাদের পরিবারের সম্মান কিছুটা
হলেও রক্ষা করার জন্য দরকার। এর বেশি আমি তোমায় কোন জবাবদিহি করতে বাধ্য নই,
করবোও না।’ দ্রুত বেসিনের দিকে চলতে থাকা
অবয়বের দিকে লক্ষ্য করে বলেই ফেললাম, ‘সেই লোকলজ্জার
ট্র্যাডিশন তো আজকের নয় মা, তোমার নাচের কেরিয়ারের সঙ্গেই
শুরু হয়েছিলো।’ নিজে কখনো না দেখলেও শুনেছি জোঁকের মুখে নুন
পড়লে কেমন দেখায়। এরকমই হয়তো...
গলির মুখ থেকে থেকে থিকথিক করছে লোক। বাইরে টিভি চ্যানেলের গাড়ি দাঁড়িয়ে। চড়া
রোদেও কেউ পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হলো না। আমার নেশা হয়ে থাকলে প্রচুর লোক দেখলেই
গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করে। জমিয়ে জড়ানো গলায় ‘আমার সাধ না মিটিলো...’ গাইতে শুরু করেছি, বিজন পিছন থেকে মুখ চেপে ধরলো। ‘শালা, মারবি না কি?’ ওর পিছন
পিছন ভিড় ঠেলে এগোতে শুরু করলাম। বিজনের পরিচিত কেউ কেউ ওকে দেখে রাস্তা ছাড়তে
শুরু করলো। ওদের শত্রুতার গল্প সকলেই জানে, অতিরিক্ত খোরাকের
আশাও কেউ ছেড়ে দেয় না। কিছুদূর গিয়েই শুনতে পেলাম ঘরের ভিতর থেকে গম্ভীর গলা,
‘...আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন না? এই যে
চারজন সেলিব্রিটির জন্মতারিখ আর জন্মস্থানের লিস্ট- আপনি জাস্ট বলবেন এঁরা কবে
মারা যাবেন। একজনের ক্ষেত্রেও অ্যাট লিস্ট বছরও যদি মিলে যায়, আপনি একধাক্কায় দু’লক্ষ টাকার মালিক। এতো সহজ কথা
বুঝতে আপনার কিসের কষ্ট হচ্ছে বলুন তো?’
আমার নেশাটা হঠাৎ করে একধাক্কায় বেশ খানিকটা নেমে গেলো...