Monday, March 5, 2012

হাতি, গন্ডার, পাহাড় আর আমরা কয়েকজন- ২ -- অরুণাভ

<< আগের ঘটনা
-‘ভাইয়া, রাস্তে মে বিয়ার কি দুকান মিলেগি ?’
-‘হাঁ মিলেগি সাহাব’।
- ‘ঠিক হ্যায়, ফির থোড়া
রুকনা, হাম বিয়ার খরিদেঙ্গে’।
-‘ঠিক হ্যায় সাহাব’।
কথোপকথনটা হচ্ছিল আমার আর আমাদের গাড়ির ড্রাইভার সুরেশের। আমাদের গাড়ি তখন মালবাজার ছাড়িয়ে পাহাড়ি পথে ওপরে উঠছে। দুইপাশে শুধু চা বাগান আর তার মাঝ দিয়ে মসৃণ কালো রাস্তাটা কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে সামনের দিকে উঠে গেছে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার-এর পাশের সিটে আমি বসেছি, আমার সবচেয়ে পছন্দের সিট। আমি মোটা এবং সেহেতু পেছনের সিটে বসলে স্থান এবং পাত্র উভয়েরই প্রভূত সমস্যা হবে বলে আমাকে সামনেই বসানো হয়েছে। সত্যি বলতে কি মোটা হওয়ার যে কিছু সুবিধেও আছে সেটা সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম আর মনে মনে বড্ড আনন্দ পেয়েছিলাম। মুখে অবিশ্যি এমন একটা ভাব করেছিলাম যেন বাকিদের খুব কষ্ট হবে ভেবেই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছি। সে যাইহোক, সব মিলিয়ে ভেতরে ভেতরে একটা দারুণ উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম আর সেই উত্তেজনাকে আর একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে এমন কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছিল যা আগে কখনো বাইরে ঘুরতে গিয়ে করিনি,
আর সেইজন্যই বিয়ার খাওয়ার পরিকল্পনা। দুবছর আগে বাবা-মা ও বাড়ির বাকিদের সাথে মানালি বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম এক গাড়ি ভর্তি পাঞ্জাবী ছেলেরা বিয়ার নিয়ে হুল্লোড় করতে করতে রোটাং পাস যাচ্ছে। সেদিন ওদের দেখে আমারও খুব ইচ্ছে হয়েছিল, স্বাভাবিক ভাবেই সম্ভব হয়নি। লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেতে খেতে নিজের মনকে প্রবোধ দিয়েছিলাম, দুঃখ করোনা... তুমিও একদিন বেহেড হয়ে পাহাড় চড়বে। সেই সুযোগ যখন আজ এলো তাকে লুফে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ফলে ঝটপট তিনটে বিয়ারের বোতল কিনে গাড়িতে উঠে পড়লাম। এই গাড়ি, গাড়ি ভর্তি বন্ধুরা, দুপাশে চা বাগান আর পাহাড়ি পথে আমি বিয়ার হাতে উঠছি, এই তো চেয়েছিলাম...আমার স্বপ্নের যাত্রা...এটাই তো হওয়া উচিত।
আমাদের গাড়ি সর্পিল পথে পাহাড়কে জড়িয়ে ওপরে উঠে চলেছে। আমি দেখেছি সব পাহাড়ি জায়গাতেই একটা সরু নদী থাকে যেটা গাইডের মতো রাস্তার পাশে অনেকটা নিচ দিয়ে বয়ে যায়। এই নদীগুলো জায়গাটার সৌন্দর্য অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। এখানেও এমনই একটা নদী বয়ে চলেছে দু-তিনশ ফুট নিচ দিয়ে। কঠিন পাথরকে নিজের ঠাণ্ডা নরম স্পর্শে ভিজিয়ে এগিয়ে চলেছে। কি নাম নদীটার? কে জানে। খুব নামকরা নয় বোধহয়। কত সুন্দর জিনিসই তো পৃথিবীতে নামকরা হয়না। এও সেরকমই কেউ হবে হয়তো। আমরা এখন অনেকটা ওপরে উঠে গেছি। মেঘলা আকাশ। কাল নাকি তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল, রাস্তাও বন্ধ ছিল কিছুক্ষণ। সে জন্যই তো আমাদের গতদিনটা জলদাপাড়াতে নষ্ট হল, না হলে প্ল্যান মোতাবেক কালই আমাদের এখানে চলে আসার কথা। যাগ্‌গে, শেষ অবধি যে আসা গেছে এটাই অনেক, আমি ভেবেছিলাম পাহাড়ে ঘোরাটাই বুঝি ক্যানসেল হল। তাই হয়তো আজকে যাওয়াটার মধ্যে একটা অন্য আনন্দ যোগ হয়েছে। ভাবতে ভাবতেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমে এলো। গাড়ির জানালার কাচগুলো তুলে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টির তোড়ে আশপাশ ঝাপসা হয়ে গেল। কিছুই ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না। 
শুধু ঝাউগাছগুলো প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে কেমন ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাছের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে অতিকায় দৈত্যাকার পাহাড়ের ধোঁয়াটে অবয়ব দেখা যাচ্ছে। কি যেন বলেছিলেন সুনীল গাঙ্গুলী? হ্যাঁ, ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’...একেবারে যথার্থ বিশেষণ। আমি জানিনা বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা ক’জনের হয়েছে, যাদের হয়নি তাদের বলবো এ এক অনন্য অনুভূতি, যা বোঝানো যায়না, যা অনুভব করতে হয়। কখনও মনে হয় যেন সবকিছু মিলেমিশে এক হয়ে গেছে, একই বস্তু, একটাই রং। নিজের স্বাভাবিক চিন্তা, যুক্তি সব গুলিয়ে গিয়ে নিজেকেও এর সঙ্গে এক করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। নাহ্‌ ... আমার নেশা হয়ে গেছে।
লাভাতে যখন নামলাম তখনও বৃষ্টি থামেনি। এবারে একটু ঠাণ্ডাও লাগতে শুরু করেছে। ‘ওয়াই ওয়াই খাবে?’ প্রস্তাবটা এলো প্রিয়মের কাছ থেকে। সত্যি বলতে কি সকলেরই খিদে পেয়েছিল। কিন্তু ওয়াই ওয়াই কি ধরনের খাদ্য? প্রিয়মকে জিজ্ঞেস করতে বলল এটা নাকি এখানকার বিশেষ খাবার। ও আগে এখানে এসে খেয়ে গেছে, বেশ ভাল জিনিস এবং সেইজন্য আমাদের খাওয়াটা একেবারে must। আমাদের তখন যা অবস্থা তাতে ওয়াই ওয়াই, জেড জেড যা দেবে তাই খেয়ে ফেলব, তাই দ্বিরুক্তি না করে সকলের জন্য order দেওয়া হল। আমরা যেখানে বসেছি সেটা একটা বড় দোকান। খাবার ছাড়াও সেখানে একদিকে বিভিন্ন মনোহর জিনিস বিক্রি হচ্ছে। আমাদের মেয়ে বন্ধুরা তাই সময় নষ্ট না করে সেদিকে মন দিয়েছে। নানারকম কারুকার্য করা কাপ, চাদর, টুপি আরো কত কি। দেখলেই কিনতে ইচ্ছে করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাটিতে করে ওয়াই ওয়াই এলো। স্যুপি ন্যুডলস টাইপের একটা জিনিস। তার মধ্যে আদা, রসুন আরো কিছু মশলা দেওয়া। ঝাল ঝাল, গরম গরম। পেটে ক্ষুধা আর বাইরের ঠাণ্ডার দাপটের মধ্যে এই জিনিসই আমার অমৃতের মতো লাগছিল। আজ আর বলতে আপত্তি নেই, সেদিন আমি দু-বাটি ওয়াই ওয়াই খেয়েছিলাম। পেটকে শান্তি আর প্রিয়মকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম। এবার গন্তব্য লোলেগাঁও।
       লোলেগাঁও লাভা ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা ওপরে। পাহাড়ি রাস্তা এখানে কোন এককালে পিচ দিয়ে বানানো হয়েছিল, এখন তার অবস্থা বেশ খারাপ। তাই গাড়ি অসম্ভব ঝাঁকুনি সহ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। পেছনের সিটে অনিমার প্রচণ্ড শরীর খারাপ করছে, বোধহয় গা গুলোচ্ছে। আমার এদের জন্য খারাপ লাগে, কষ্টের দরুন যাত্রার আনন্দটাই উপভোগ করতে পারে না। আমার অবিশ্যি সেসব সমস্যা নেই, তাই আশেপাশে যা দেখছি, তা সে পাহাড়ে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট পাহাড়ি ফুল হোক বা হঠাৎ নেমে আসা কোন ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্ণা, সবই দুচোখ ভরে আস্বাদ করে চলেছি।
       আমাদের সামনের গাড়িটা কোন অজ্ঞাত কারণে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছে আর সেই গাড়ির সকলে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশের একটা অনুচ্চ টিলার মাথায় কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। কি ব্যাপার দেখতে আমরাও নেমে এগিয়ে গেলাম। একটু এগিয়ে যা দেখলাম তা বেশ রোমাঞ্চকর, মসৃণ গোলাকার টিলার ওপরে আমাদের বন্ধু রাজা অদ্ভুতভাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর তার স্ত্রী তথা আমাদের বান্ধবী শ্রেয়া সেই দৃশ্য অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে। রাজার এই অকস্মাৎ উল্লাসের কারণ জিজ্ঞেস করায় টুবাই বলল সে নাকি টিলার ওপরে কিছু ছবি তোলার চেষ্টা করছে। এবার ভাল করে চাওয়াতে রাজার হাতের ক্যামেরাটি নজরে পড়ল। সেই সময় ওই দৃশ্য আমাদের অসম্ভব আমোদ দিলেও পরবর্তীতে ওর তোলা ছবিগুলো দেখে ওকে বাহবা দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
       লোলেগাঁও পৌঁছে আমাদের হোটেল দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল। ওরকম পাহাড়ি গ্রাম্য এলাকায় এত সুন্দর হোটেল থাকতে পারে এটা আশাই করিনি। সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু ঝাউবনে ঢাকা পর্বতরাশি। শান্ত, নিরিবিলি একটা জায়গা। যানবাহনের গর্জন, বহুতলের আস্ফালন, মানুষের কোলাহল থেকে যেন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, প্রকৃতির নিজের মতো করে সাজানো আবাসন। সহজ, সুন্দর।
       আমাদের পৌঁছনো মাত্র বৃষ্টিটা আশ্চর্যভাবে থেমে গেছে। পেছন থেকে শুভ্রর ডাক শোনা গেল, ও হোটেলের পেছন দিকটায় চলে গেছে আর ওখান থেকে খুব উত্তেজিত ভাবে আমাদের ডাকছে কিছু একটা দেখানোর জন্য। আমরা দৌড়ে পেছনে গিয়ে একটা অসাধারণ দৃশ্য দেখলাম। হোটেলের পেছনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সাদা তুলোর মতো মেঘে ঢাকা, আর তার ভেতর থেকে মাঝে মাঝে সবুজ ঝাউগাছ মেঘ ফুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে। অবর্ণনীয় সেই সৌন্দর্য। আমরা অবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখছি সেইসময় হঠাৎ সিনেমার পর্দার মতো সামনে থেকে মেঘের আস্তরণ সরে গেল আর পেছন থেকে আবির্ভাব হল তুষারশুভ্র সৌম্যকান্তি বিশালকায় এক গিরিমালা। এতটাই আকস্মিক সেই আবির্ভাব যে কিছুসময়ের জন্য আমাদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। আচ্ছন্ন অবস্থা কাটিয়ে যখন জ্ঞানে ফিরলাম সকলের মুখ দিয়ে অস্ফুটে একটাই শব্দ বেরিয়ে এলো...‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’!!!

ক্রমশ...

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই